মাধবী মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথোপকথনে সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়।
সত্যজিৎ রায়ের ছবির একজন সফল ও বিখ্যাত নায়িকা হিসেবে নিজেকে ভাবতে কেমন লাগে?
এই পরিচিতি সত্যিই খুবই সম্মানের। অমন উচ্চমানের, পৃথিবী-বিখ্যাত পরিচালকের সঙ্গে কাজ করতে পারাই তো বিরাট একটা ব্যাপার! তবে কিনা, আমার সত্যি খুবই সৌভাগ্য যে, আমি আরও অনেক বিখ্যাত পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করতে পেরেছি। কেবল সত্যজিৎ রায় নয়, আমি কাজ করেছি মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, পূর্ণেন্দু পত্রীর মতো পরিচালকদের সঙ্গে। এঁরা এক-একজন এক-এক ধরনের পরিচালক। এঁদের কাজ এবং তার রিপ্রেজেন্টেশন ভিন্ন। এবং সেই সবই তাঁদের অনন্য করেছে। তবে হ্যাঁ, আমার ব্যক্তিগত ভাবে সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা খুব সম্পূর্ণ মনে হয়, খুব নিটোল।
আপনি তো এখনও কাজ করছেন, আপনার কি মনে হয় এখনকার পরিচালকরা সত্যজিৎ রায়কে অনুসরণ বা অনুকরণ করতে সমর্থ?
আমার এখনকার সিনেমা খুব যে ভাললাগে তা নয়। পরিবারের সঙ্গে বসে দেখা যায় না। এত অশ্লীল ডায়লগ থাকে যে, অস্বস্তি হয়। অথচ দ্যাখো, সত্যজিৎ রায়ের সিনেমায় এমন অনেক হিন্ট আছে যা প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যই হয়তো প্রযোজ্য, কিন্তু উনি এমনভাবে দৃশ্যায়ন করতেন যে, তা সবার সঙ্গে বসে দেখতে কোনও অসুবিধে হত না। এখানেই পরিচালকের মুন্সিয়ানা।
‘চারুলতা’ ছবিটা খুব চর্চিত সব সময়, সব কালে। ‘চারুলতা’র মধ্যে এমন কী ম্যাজিক আছে, যা এই সিনেমাটাকে এতটা কাঙ্ক্ষিত করে রাখে দর্শকের কাছে?
প্রথমেই বলি, ‘চারুলতা’ কিন্তু ‘চারুলতা’ হওয়ার কথা ছিল না। ছবির নাম হওয়ার কথা ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাসের নামে— ‘নষ্টনীড়’। কিন্তু ওই নামটির স্বত্ব আগে থেকেই অন্য এক পরিচালক নিয়ে রেখেছিলেন। ফলে বাধ্য হয়েই সিনেমার নাম দিতে হয় ‘চারুলতা’। ‘চারুলতা’য় ক্যামেরাম্যান সুব্রত মিত্রর আলো করা নিয়েও খুব হইহই হয়েছিল। তিনি নতুন ধরনের আলো করেছিলেন এই ছবিতে। আর অভিনেতা হিসেবে যদি বলতে হয়, তা হলে খুব আলাদা করে বলার কিছু নেই। উনি কী চাইছেন, সেটা আমাদের বলে দিতেন, আমরা সেই ভাবে অভিনয় করতাম। উনি কিন্তু অভিনয় নিয়ে কোনও সময়ই খবরদারি করতেন না। আসলে সব মিলিয়ে সত্যজিৎ রায় যে-জিনিসটাকে উপস্থাপনা করতেন, সেটাই ম্যাজিক। সিনেমার কোনও একটা দিক দুর্দান্ত হল আর বাকি দিকগুলো ততটা হল না, এমনটা হত না ওঁর ছবিতে। সব বিভাগের সঙ্গে সব কিছুর আশ্চর্য সামঞ্জস্য ছিল। একটা মাত্রায় বাঁধা থাকত।
জানো, সত্যজিৎ রায় চলে যাওয়ার এত বছর পর বা ওঁর সিনেমাগুলো তৈরি হওয়ার এত বছর পর, এখন ধন্য-ধন্য হয় সারা পৃথিবীজুড়ে, এসব দেখে খুব কষ্ট হয়। কারণ এই সিনেমাগুলোই যখন প্রথম রিলিজ করত, তখন যে কী কঠিন আর রূঢ় সমালোচনা হত, তা বলার নয়। ‘চারুলতা’ও সেই তালিকা থেকে বাদ যায়নি। অথচ, বেশির ভাগ সমালোচনাই কিন্তু ওঁর ছবির মানের সঙ্গে তুল্যমূল্য ছিল না। আর সেখানেই ছিল ওঁর বিরক্তি। উনি বলতেন, ‘কেউ যদি আমার সিনেমা সম্পূর্ণ বুঝে তার বিরূপ সমালোচনা করে, তবে ঠিক আছে। কিন্তু ছবিটি না বুঝেই সমালোচনা হয় বেশি।’ আমারও মনে হয়, সত্যজিৎ রায়ের সিনেমার সমালোচনা করার জন্যও একটা যোগ্যতা প্রয়োজন।
তবে ইউনিটের মধ্যে, সত্যজিৎ রায়ের পরিচিতির মধ্যে একটা প্রচলিত কথা ছিল যে, সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা কলকাতার মতো শহরে চলবে না, চলবে মফস্সলে, সত্যজিতের মফস্সলে। সত্যজিৎ রায়ের মফ্স্সল মানে কান-বার্লিন-ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসব। অর্থাৎ বিদেশে আদৃত হবে সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা, কিন্তু দেশে নয়। হয়তো দেশের মানুষ তখনও সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা গ্রহণ করার উপযুক্ত হয়ে ওঠেননি। এ ছাড়া আর তো কোনও যুক্তি পাই না।
আপনি সত্যজিৎ রায়ের তিনটি ছবিতে তিন রকমের চরিত্র করেছেন। ‘চারুলতা’ অত্যন্ত সংবেদনশীল একটি ডেলিকেট চরিত্র, ‘মহানগর’-এ একজন সাধারণ মেয়ে যে নিজের একটি ঋজু সত্তা আবিষ্কার করে কিন্তু তার মায়া হারায় না, আর ‘কাপুরুষ’-এ একজন মেয়ে, যে পরিস্থতি-নির্বিশেষে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত— এই তিনটি চরিত্র বোঝানোর সময় কি সত্যজিৎ রায় চরিত্র-বিশেষে খুব আলাদা করে কিছু বলতেন বা বোঝাতেন?
দ্যাখো, এখানেই হচ্ছে পরিচালক আর অভিনেতার মুন্সিয়ানার ব্যাপার। উনি যে খুব আলাদা করে বোঝাতেন বা আমি খুব আলাদা করে ভাবতাম তা নয়। মূল কথাটা হল— উনি চরিত্রের মধ্যে একটা বিশ্বাসযোগ্যতা অর্পণ করতে পারতেন আর আমি অভিনেতা হিসেবে সেই চরিত্রটাকে ফিল করতে পারতাম। আর তার পর সেটে উনি ডিরেকশন দিতেন আর আমি অভিনয় করতাম। এর বাইরে আলাদা করে সাংঘাতিক আলোচনা, বিশ্লেষণ, এসব খুব ছিল না। আর ওঁর চিত্রনাট্য এত সম্পূর্ণ হত যে, আলাদা করে কোনও কিছু ভাবতে হত না। একদম মাপা ডায়লগ, মাপা চরিত্র, মাপা এডিটিং— কোথাও কোনও কিছু এক সুতো বেশি নয়, কোথাও কম নয়। আর অতিরিক্ত তো কিছু নয়ই। একটা উদাহরণ দিই। ‘মহানগর’ ছবিতে সুব্রতর বাবা, অর্থাৎ আরতির শ্বশুর প্রিয়গোপালের মুখে একটা সংলাপ শুরু হয়— ‘আগে যেখানে ছিলাম…’ এই একটি মাত্র শব্দ ‘আগে’ দিয়ে উনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন দেশভাগের কথাটা। আর কিন্তু কোনও সংলাপ, কোনও আতিশয্য, কোনও থরো-থরো ইমোশন দিয়ে ব্যাপারটার মাত্রাতিরিক্ত একটা অস্তিত্ব তৈরি করেননি। এইটাই হচ্ছে সত্যজিৎ রায়ের বৈশিষ্ট্য। অঙ্কের মতো পরিষ্কার থাকত ওঁর মাথাটা।
আপনি তো একই সহ-অভিনেতার সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে অভিনয় করেছেন আবার অন্য পরিচালকের ছবিতেও অভিনয় করেছেন। কোনও পার্থক্য বুঝেছেন কি?
এই তুলনাটা করাটা একটু অন্যায় হবে। কারণ, এক-একজন পরিচালক, অভিনেতার কাছ থেকে এক-এক রকম অভিনয় চান। একজন অভিনেতা হিসেবে আমার কর্তব্য সেই রকম অভিনয়ই করা, যা আমার পরিচালক চাইছেন। তবে হ্যাঁ, একই সহ-অভিনেতার সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন ছবিতে অভিনয় করলে দুজনের মধ্যে একটা পারস্পরিক বোঝাপড়া হয়ে যায় এবং সেই ছাপটা অভিনয়ের ওপরেও পড়ে। মুশকিল হচ্ছে, আমার বিভিন্ন সহ-অভিনেতার সঙ্গে অভিনয়ের সময় কোন পরিচালকের পরিচালনার প্রভাবটা বেরিয়ে আসছে, সেটা আমার অবচেতনেই থেকে গেছে বোধহয়, আলাদা নাম করে বলতে পারব না।
সত্যজিৎ রায়ের কোনও সিনেমার কোনও চরিত্র দেখে মনে হয় বা আফশোস হয় যে, ওই চরিত্রটা করতে পারলে ভাল হত?
না। যে তিনটি চরিত্র আমি করেছি, আমি তাতেই খুশি ও তৃপ্ত। আসলে, সব জায়গায় তো রাজনীতি থাকেই। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিও ব্যতিক্রম নয়। আর রাজনীতির ব্যাপারে আমি কোনও কালেই স্বচ্ছন্দ নই। কিন্তু একটা ভুল বোঝাবুঝির রাজনীতির কারণেই ওঁর সঙ্গে আমার দূরত্ব তৈরি হয় এবং আমি মানিকদাকে বলি যে, ওঁর ছবিতে আর কোনওদিন অভিনয় করব না। উনি আমাকে তার পরেও বহু বার বিভিন্ন ছবিতে অভিনয় করতে অনুরোধ করেছেন, কিন্তু আমি করিনি। শেষবার উনি আমায় ‘ঘরে-বাইরে’ ছবিতে বিমলার চরিত্রে অভিনয় করতে বলেছিলেন, কিন্তু আমি করিনি।