উত্তর— নর্থ। একই সঙ্গে, ‘জবাব’ও। প্রথমটা তো পরিষ্কার, কিন্তু দ্বিতীয়টা? জবাব? আসলে জবাবের ধারণার মধ্যে একজন শ্রোতার উপস্থিতি অনুমান করে নেওয়া যায়, সঙ্গে সেই সমস্ত প্রশ্নও— যা করা হয়েছে বা ভাবা হয়েছে। ফলে, ‘উত্তর’ হচ্ছে ‘প্রতিক্রিয়া’। এখানে প্রতিক্রিয়ার কথা বলার দরকার হল কেন? এটা খানিকটা কাকতালীয় ঘটনা, আমি এখন যে-প্রবন্ধটা পড়ছি তার প্রায় প্রতিটা পরিচ্ছেদেই এই ‘প্রতিক্রিয়া’ শব্দটার মুখোমুখি হতে হয়েছে আমাকে— প্রবন্ধটা বিভিন্ন ধরনের উদ্দীপকের প্রতি উদ্ভিদের ‘প্রতিক্রিয়া’ নিয়ে, নাম ‘নির্বাক জীবন’। উদ্ভিদেরা নির্বাক, আমরা সেটাই ভাবি— জগদীশচন্দ্র বসু চাইতেন উদ্ভিদেরা যেন ‘তরুলিপি’র মাধ্যমে সাড়া দিয়ে তাদের ইতিহাস এবং আত্মজীবনী নিজেরাই লিখে রাখে। উত্তরবঙ্গও ছিল খানিকটা এইরকম— নীরব, চুপ করিয়ে রাখা এবং কলকাতার লেখালিখির ঐতিহ্য থেকে বহু দূরে। ভারত ও বাংলার রাজনৈতিক ভাবনার মধ্যে— উত্তরের জীবনের প্রতি এই উদাসীনতা যেন ঢুকে রয়েছে, ফলে সিমাস হিনির একটা কবিতায় এই লাইনগুলো যখন প্রথম পড়ি, আমার মনে হয় উত্তরের লোকদের এটাই নিয়তি:
অন্ধকারের ভেতরেই গড়ো।
একটানা আক্রমণে
আলোর ঝরনা নয়,
অরোরা বোরিয়ালিস আশা করো।
কবিতাটার নাম ‘উত্তর’, আর এই লাইন ক’টা আমি সেই সব মানুষদের জন্য ধর্মোপদেশ হিসেবে নিয়েছিলাম, শিল্প-সংস্কৃতি-সাহিত্যের ক্ষেত্রে যাদের জীবন ছিল আমারই মতো, অবহেলিত: ‘অন্ধকারের… গড়ো’; ‘একটানা আক্রমণে… আশা করো’। তাই কোনও আলোই আমাদের ওপরে এসে পড়েনি। আমরা খবরের কাগজ আর টিভির পর্দায় আমাদের ছোট্ট শহরটার নাম দেখব বলে হা-পিত্যেশ করে থাকতাম। কিন্তু লাগাতার গণ্ডগোল যেরকম স্বল্পপরিচিত এলাকাতেও রাষ্ট্রীয় মনোযোগ এনে দেয়, আমরা তার থেকেও অনেক দূরে থাকায়, খারাপ খবর দেওয়া প্রচারমাধ্যমগুলোর কাছে উপেক্ষিতই থেকে গেছিলাম। আমরা ছিলাম ‘উন্নতমানের বর্বর’, কলকাতার এক দর্শনের-অধ্যাপকের স্ত্রী এই কথাটাই বিকৃত করে বলেছিলেন যে, উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকজন তো বাঁদরের মতো গাছ থেকে লাফ দেবে (আমাদের বংশপরিচয় বড়ো করে দেখাতে তিনি বলেছিলেন ‘ডারউইনের বাঁদর’; অবশ্য সেই বিশেষণ প্রশংসার না নিন্দার, আজও ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি)। পাহাড়, নদী আর আকাশ তাদের প্রশংসার দাম পেত, কিন্তু আমরা? আমরা ছিলাম ‘ভাগ্যবান’— সেটাই আমাদের একমাত্র প্রতিভা: ভাগ্য, এই এলাকায় থাকার সৌভাগ্য (কখনওই তাকে আমাদের পছন্দ হিসেবে ভাবা হয়নি)।
আমরা যে কলকাতার উপগ্রহ, কোনও রকম জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়াই নিজেরা বুঝতে পেরে গেছিলাম। যখন জেলাভিত্তিক চাকরির জন্য আবেদন করতাম, পরীক্ষা আর ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্য সেই কলকাতায় যেতে হত। এমনকী উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরির ইন্টারভিউও হয়েছিল কলকাতায়। ‘এমনকী’ বললাম শুধু এই কারণেই— জায়গা আর তার নামটার ওপর জোর দেব বলে। কখনও কখনও আমার এও মনে হত, দার্জিলিং মেলটা রয়েছেই শুধুমাত্র উত্তরবঙ্গের বেকারদের কলকাতায় নিয়ে যাওয়া, আর সেখান থেকে নিয়ে আসার জন্য। ট্রেনটার কামরার মধ্যে দু’ধরনের কথাবার্তা শোনা যেত, যার ভেতর থেকে খুব সহজেই কেউ বক্তার বাসস্থান বুঝে নিতে পারে: ‘শিয়ালদা স্টেশন থেকে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি রোডে কীভাবে যাব?’; ‘বাইরে কি খুব ঠান্ডা? মাফলারের দরকার আছে?’ এই বাইনারির ভেতরে ছিল আমাদের ইতিহাস: কলকাতা হচ্ছে কাজের জায়গা, ‘মস্তিষ্ক’; আর উত্তরবঙ্গ ভাল লাগার, ‘হৃদয়’। এই চরিত্রাঙ্কন এখানেই শেষ হত না। এর জের গিয়ে পড়ত ইন্টারভিউয়ের ওপরেও।
পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় আমার কাছে হিমালয়ের খবরাখবর জানতে চাওয়া হয়েছিল। পঁচিশ বছর বয়সের প্রথম চাকরির পরীক্ষা হিসেবে, লোকে যেভাবে দাদুর শরীরস্বাস্থ্যের কথা জানায়, আমিও সেভাবে পাহাড়ের কথা বলতে শুরু করি। পরের প্রশ্ন ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস নিয়ে: ‘সেই ক্যাম্পাস কি আশির দশকের মতো এখনও রোমান্টিক আছে?’ আমার স্কুলে পড়াকালীন সেই ক্যাম্পাস কেমন দেখতে ছিল এটা না-জানার ফলে যখন উত্তরের জন্য আমতা-আমতা করছি, সে-সময়ে প্রশ্নকর্তা সাহায্য করার চেষ্টা করেন: ‘তুমি কি কখনও ক্যাম্পাসের শালজঙ্গলের মধ্যে প্রেমিকের হাত ধরে সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে গাওনি?’ আমি মাথা নাড়ি— না, এবং সেই মুহূর্তে নিজের ওপরেই রাগ হয়। সেসব করে থাকলে আজ হয়তো তাঁরা আমায় চাকরিটা দিতেন!
এই ঘটনারই নানান রকমফের আমি অনেকের মুখ থেকে শুনেছি— কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিপ্রার্থী তো আছেই, পাশাপাশি ব্যাঙ্ক আর ইঞ্জিনিয়ারিং-এর লোকজনও রয়েছে। আবেদনপত্রে লেখা বাড়ির ঠিকানার মধ্যেই আমাদের ভূমিকা আগে থেকে ঠিক হয়ে যায়— ট্যুরিস্ট গাইডের মতো গতেবাঁধা একটা জীবন চালানোর। পুরোটাই হাসিকান্নার খেলা— একদিকে রাগ, অন্যদিকে নিজেদের ইচ্ছে আর বিশ্বাসের বিরুদ্ধে গিয়ে কাজ করার অসহায়তা।
এই কলামের মধ্যে দিয়ে তাই চেষ্টা করব পাঠকের সামনে আমাদের অন্য জীবনটা তুলে আনার— পড়ার, খাওয়ার, লেখার, হাসির, আঁকার, গান গাওয়ার, তর্কের আর চলাফেরার।
‘বাই-বাই, মিরান্ডা’, দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময়ে এস. পি. মুখার্জি রোডের সেই প্রশ্নকর্তা আমাকে বলেছিলেন। কিন্তু তাঁর এই চরিত্রনির্মাণের লক্ষ্যে যতটা না আমি ছিলাম, তার চেয়েও অনেক বেশি জায়গা জুড়ে ছিল শেক্সপিয়রের নাটকের সেই দ্বীপটার মতো একটা এলাকা— যে-এলাকায় আমি থাকতাম।