ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • শান্তিনিকেতন ডায়েরি: পর্ব ১২


    নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় (January 22, 2022)
     

    কবিতার মুহূর্ত 

    শান্তিনিকেতনের আকাশ, মাটি, বাতাসের দিকে তাকাতে পারলে খুঁজে পাওয়া যায় কবিতার মুহূর্তদের। যেসব মুহূর্তরা ক্ষণস্থায়ী কিন্তু মনে একটা গভীর দাগ রেখে চলে যায়। যেন জাপানের সতেরো মাত্রার হাইকু কবিতা। আপাততুচ্ছ মুহূর্তদের রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতায় চিরকালীন করে তুলেছিলেন, জাপানের মহান কবিদের মতোই। চিন আর জাপান ভ্রমণের সময় তাঁকে স্বাক্ষরের দাবি মেটাতে অনেক সময় কাগজে, রেশমের কাপড়ে, পাখায় ছোট-ছোট কবিতা লিখে দিতে হয়েছিল। এই ছোট কবিতার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এতটাই যে, হাঙ্গেরি থেকে ‘রোটাপ্রিন্টার’ কিনে ওইসব কবিতা নিজের হাতের লেখায় সংকলিত করে প্রকাশ করেছিলেন তাঁর দ্বিভাষিক অণু কবিতার বই ‘লেখন’। জাপানের ছোট কবিতার প্রশংসা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বাঙালির দীর্ঘকবিতা পড়ার অভ্যাসের কথা মাথায় রেখে বলেছিলেন, এইসব ছোট কবিতার স্বাদ গ্রহণ করা ‘আয়তনের উপাসক’ বাঙালির পক্ষে হয়তো কঠিন। নিজের ইংরেজি অণু কবিতার সংকলন Stray Birds রবীন্দ্রনাথ উৎসর্গ করেছিলেন জাপানে তাঁর আশ্রয়দাতা রেশম ব্যবসায়ী ও শিল্পবেত্তা হারা তোমিতারোকে। রবীন্দ্রনাথ দুঃখ করে লিখেছিলেন, গীতাঞ্জলি-র কবিতাগুলো আয়তনে ছোট বলে তাঁকে কথা শুনতে হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের সারাজীবনে লেখা ছোট কবিতার ভিতর কোনগুলো শান্তিনিকেতনের আলোবাতাস থেকে উঠে আসা বলা মুশকিল। কিন্তু যে-শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ তাঁর অর্ধেক জীবন কাটিয়েছিলেন, সেখানে সেইসব ছোট কবিতার মুহূর্তরা যে লুকিয়ে থাকে, চোখ আর মন খোলা রাখলে যেন আজও তা বোঝা যায়। 

    আমার নিজের কথাই ধরা যাক। রোজ-রোজ চলার পথে শান্তিনিকেতনের প্রকৃতি, ঋতুর আবর্তন, তার রূপ, রস, গন্ধ, বর্ণ, স্পর্শকে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই আমার। সেই সবই যেন হঠাৎ এক একটা ধাক্কা দিয়ে চলে যায় আমাদের। সম্বিত ফিরে এলে মনে হয়, তবে কি খুঁজে পেলাম একটা কবিতাই? কতবার যে এরকম মনে হয়েছে, তার ঠিক নেই। তারই কয়েকটা সাজিয়ে দিলে মনে হতে পারে কবিতার মুহূর্তরা এখনও জেগে আছে শান্তিনিকেতনে। 

    জাল পেতে 
    মাকড়সা ধরেছে শুধু 
    রাতের শিশির।

    ঘন কুয়াশার চাদরে ঢেকে রয়েছে বাগান। অন্য দিনের চেয়ে শীতও যেন বেশি। ফাল্গুনের কাঞ্চন তখনও ইতিউতি ছড়িয়ে বাগানের রুক্ষ জমিতে। চারপাশ ভেজা-ভেজা। দেখি বকুল গাছের ডালে বিস্তৃত এক মাকড়সার জাল। তার কেন্দ্রে বসে এক বিমর্ষ মাকড়সা, পোকার বদলে রাত জেগে যে ধরেছে শুধু বিন্দু-বিন্দু শিশির। শিশিরে পড়ে আছে ভোরের সূর্য। 

    ছায়া সরে গেলে
    বুঝি
    আমি সরে গেছি

    বসেছিলাম গাছে-ঘেরা কাঠের বারান্দাটায়। পাতার ফাঁক বেয়ে নামা ঝিরি-ঝিরি চাঁদের আলো। সামনে আমার ছায়া। যেন আমি নেই, শুধু আমার ছায়া। হঠাৎ ছায়া সরে গেলে নিজেকে খুঁজে দেখি, আসলে তো সরে গেছি আমি!

    বাড়ি ফেরার রাস্তায় 
    বৃদ্ধ শামুক 
    এপার থেকে ওপার হবার চেষ্টায়।
     

    বর্ষার শান্তিনিকেতন ভরে থাকে শামুকে-শামুকে। রাস্তায় হঠাৎ চলে আসা আসা গাড়ির ফেলে যাওয়া আলোয় তারা জ্বলে ওঠে কখনও। সন্তর্পণে পা ফেলা, এই বুঝি পায়ের নীচে গুঁড়িয়ে গেল কোনও নিরীহ শামুক— হয়তো বাড়ি ফিরছিল, হয়তো-বা তার জন্যে কোথাও অপেক্ষায় বসে আর কেউ! পূর্বপল্লীর পিচরাস্তায় তেমনই এক বৃদ্ধ শামুকের সঙ্গে দেখা। শ্লথগতি। রাস্তার এপার থেকে ওপার হবার চেষ্টায়।      

    ফুলকপি হাতে নিয়ে 
    শীতের ঘরোয়া ক্ষেত দাঁড়িয়ে দুপুরে 
    এইটুকু দেখে আমি চলে যাই দূরে। 

    ব্যস্ততায় নিজের বাড়ি বুড়ি ছুঁয়ে ফিরে আসতে হয় প্রায়ই। অল্প সময়ে দেখে ফিরে আসা, জানলাগুলো বন্ধ কি না, গাছে নতুন ফল এল কি না, জলের স্তর নেমে গেল কুয়োর কতটা নীচ অব্ধি! তেমনই একদিন, ক্ষেতে ফুটফুটে এক ফুলকপি, যেন আমারই অপেক্ষায়। নীরব অথচ কী ব্যাকুলতা, আমি দূরে যাওয়ার আগে কিছু বলে যাওয়ার জন্যে। কে জানে কী কথা!  

    জোনাকি 
    হঠাৎ হারায়
    চাঁদের বুকে।

    জোনাকিটা ঘুরছিল বেশ বাগানেই। হঠাৎ দেখি, নেই! এদিকে নেই, সেদিকে নেই, কোত্থাও নেই! একটু পরই বেরিয়ে এল চাঁদের আলোর আড়াল থেকে, আবার!  চাঁদের আলোর আড়াল! 

    খারাপ কথা শুনতে শুনতে 
    একটা বুনো ফুলের কিছু 
    যায় আসে না। 

    বাড়ি ফেরার রাস্তায় ফুটে থাকে কিছু বুনো ফুল। গরুর পাল, দামাল ছেলের দল নির্বিচারে মাথা মুড়িয়ে দিয়ে যায় তাদের। বেপরোয়া জীবন আবার মাথা তোলে দুমড়ে যাওয়া ডালের এপাশ-ওপাশ থেকে। আবার আসে একগুচ্ছ ফুল!   

    আমার আগে 
    কাদায় পড়ে
    আমার ছায়া। 

    বর্ষায় রাস্তার ছোট-ছোট ডোবাগুলো ভরে আছে জলে। পা দিলেই কাদা! ছিল বাড়ি ফেরার তাড়া। আমার ছায়া গিয়ে পড়েছে কাদায়, আমার আগে আগে! 

    অতিথিরা এলে 
    বুনো বিড়ালটা আসে 
    বাড়ির লোকের মতোই। 

    কোথায় থাকে, কে তাকে খবর দেয় কে জানে! নিরালা আমার বাড়িতে কদাচিৎ অতিথিরা এলে সেই ধূসর বনবিড়াল ঠিক চলে আসে। যেন আমারই বাড়ির কেউ। এসেছে, অতিথিরা এল বলে। 

    পাখিরা কেঁদেছে, 
    আমরা ভেবেছি 
    গান।
     

    ভোরে ঘুম ভেঙেছিল পাখিদের গানে! তারপর মনে হল, পাখিরা কি গানই গায় শুধু? কাঁদে না কখনও? 

    ফুলবদলের অবকাশে
    দমকা হাওয়ায় ফুলদানিতে 
    বাঁশপাতাটি।
     

    সাজাচ্ছিলাম ফুল। দরজা খোলা। সামনে এলোমেলো ডালপালা, ফুল। ঝোড়ো হাওয়া। বাঁশের একটা পাতা এসে গেঁথে গেল ফুলদানিতে, দমকা হাওয়ায়! কে সাজাল তাকে?  

    খেতে-পাওয়া খেতে-না-পাওয়া দুটো কুকুর 
    সমান আদর চায় 
    বসন্তের বারান্দায়।  

    দুটো কুকুর আসে রোজ। একটা খেতে পায়, অন্যটা অনাহারে রোগা! বসন্তের বাতাস সেদিন বারান্দায়। ওরা এসেছে সেদিনও। খাবারের কথা ভুলে, যেন শুধু সমান আদরের অপেক্ষায়!  

    যেখানে পাতারা ছিল 
    সেখানে ছায়া ছিল পাতাদের কোনও একদিন,
    সর্বস্ব নিয়ে গেছে হেমন্তের হাওয়া।

    বাড়ির তালা বন্ধ করে ফিরে আসার সময় হাল্কা আলোয় বারান্দায় রোজই চোখে পড়ে কিছু পাতার ছায়া। কখনও কম্পমান, কখনও স্থির। বাড়িটাকে একা রেখে চলে আসার আগে যেন সেই ছায়াটুকু এক পিছুটান। একদিন বারান্দায় সেই পাতাদের ছায়া আর নেই। আলো আছে, শুধু সেই ছায়াগুলো নেই! তাকাই উপরে। আর পাতাগুলো নেই! নিয়ে গেছে হেমন্তের হাওয়া! 

    জাপানের কবি মাৎসুও বাশো বলেছিলেন, পাইনগাছকে জানতে গেলে যেতে হয় পাইনের কাছে, বাঁশকে জানতে গেলে যেতে হবে বাঁশের কাছে। প্রকৃতি আর কবিতার কাছে যাওয়ার সেই অনন্ত সুযোগ আজও রয়ে গেছে শান্তিনিকেতনে। তার নীল দিগন্তে খোলা কবিতার উদার, বিজন বাতায়ন।

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook