ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • সামথিং সামথিং: পর্ব ২৩


    চন্দ্রিল ভট্টাচার্য (January 22, 2022)
     

    শূকরুণ কাহিনি

    বেতাল: মহারাজ, এখুনি এই ধাঁধার ঠিক উত্তর না দিলে তোমার মাথা চুরমার হয়ে যাবে। যদি একটা শুয়োরের হৃৎপিণ্ড একটা মানুষের বুকে বসিয়ে মানুষটাকে বাঁচিয়ে তোলা হয়, তা ভাল না খারাপ? 

    বিক্রম: যাব্বাবা, এ আবার বলার কী আছে? অফ কোর্স ভাল। মানুষটা বেঁচে গেল তো। 

    বেতাল: শুয়োরটা মরে গেল, তার বেলা?

    বিক্রম: এটা একটু আদিখ্যেতা হয়ে গেল না? কোটি কোটি শুয়োরকে মেরে ফেলা হচ্ছে বেকন সসেজ হ্যামের লোভে, আর মাত্তর হাজারখানেক শুয়োরকে মারা হচ্ছে তাদের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গ তুলে মানুষের দেহে বসিয়ে বাঁচাবার চেষ্টায়। শুয়োরকে যদি হৃৎপিণ্ডের জন্য মারা না হত, মাংসপিণ্ডের জন্য তো হতই, আজ নয় কাল। 

    বেতাল: প্রথমত তো বেকন সসেজ মাটন চিকেন, মানে আমিষ আদৌ খাওয়া উচিত কি না সে প্রশ্ন উঠবে। তাছাড়া জানো কি, যে-শুয়োরদের প্রত্যঙ্গ নেওয়া হবে ঠিক হয়, তাদের পালন করার প্রসেস আলাদা? তাদের সারা জীবনটা বাঁচতে হয় একা, চার দেওয়ালে আটকা, কোনও ইনফেকশন যাতে না হয় তাই একটা জীবণুমুক্ত বাড়াবাড়ি-কড়াকড়ি কুঠুরির মধ্যে? আর যদি শুয়োরটার একাধিক প্রত্যঙ্গ বা টিস্যু নেওয়া হবে ঠিক হয়, তখন তার ওপর অনেক যন্ত্রণাদায়ক পরীক্ষা চালানো হয়, কাটাছেঁড়া করা হয়? শুয়োররা কিন্তু বুদ্ধিমান, সামাজিক প্রাণী, আর তাদের আবেগের বেশ ঘোরপ্যাঁচও আছে। 

    বিক্রম: দ্যাখো ভাই, এসব শৌখিন আপত্তি ইউরোপে টিআরপি পায়, ভারতে সাইকেলের হ্যান্ডেলে গাদাগাদি করে মুরগিদের উল্টো-ঝুলিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, শুয়োরের পেছনে শিক ঢুকিয়ে তাকে খুন করে খাওয়া হয়। 

    বেতাল: আরে! কোথাও কোথাও সাংঘাতিক-খারাপ কাণ্ড করা হয়, এ তো মোটামুটি-খারাপ কাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার সাফাই হতে পারে না! ও-পাড়ায় মানুষকে সেদ্ধ করে মারা হয়, আমরা তো খাঁড়া দিয়ে এক কোপে গলা কেটে মারি, এ যুক্তিতে কি নরহত্যা সাপোর্ট করা যায়? ব্রিটেনের ‘ফার্ম অ্যানিম্যাল ওয়েলফেয়ার কাউন্সিল’ আজ থেকে প্রায় ৪০ বছর আগে বলেছিল, জন্তু পালতে গেলে নিশ্চিত করতে হবে: তারা যথেষ্ট খাবার আর জল পাচ্ছে, অস্বাচ্ছন্দ্যে থাকছে না, তাদের আঘাত লাগলে বা অসুখ হলে চিকিৎসা হচ্ছে, তারা নিজেদের মতো করে বাঁচছে— মানে ঘোড়া ছোটার জায়গা পাচ্ছে গরু চরে বেড়াতে পারছে, আর তারা ভয়ে নেই মানসিক কষ্টে নেই। 

    বিক্রম: ওরে দরদ-ওথলানো ভাই আমার, এই থিমে আপত্তি আজকের নয়। মানুষের উন্নতির টেবিলে অন্য প্রাণীদের অসহ অত্যাচার করে মেরে ফেলা হচ্ছে লাগাতার, সবাই জানে। কিন্তু তা বন্ধ করলে মানুষের প্রগতি থেমে যাবে। ল্যাবরেটরিগুলোয় তালা মেরে বাড়িতে বাড়িতে পশুপ্রেমী সংস্থা খুললে, দুরারোগ্য অসুখের ওষুধগুলো বেরোবে না। হ্যাঁ, এক যদি জিজ্ঞেস করো, ‘মানুষের জীবন অন্য জন্তুদের জীবনের চেয়ে মূল্যবান, কে বললে?’ তাহলে আলাদা কথা। তা তোমার যদি মনে হয়, শুয়োরের মধ্যে থেকে রবীন্দ্রনাথ বা শোপেনআওয়ার বা মোৎজার্ট বা চ্যাপলিন জন্মাতে পারে, সে অপেক্ষায় রইলাম। 

    বেতাল: এ যুক্তিতে কিন্তু প্রতিভাহীন নিরেস মানুষদেরও চ্যাপলিনের সুবিধের জন্যে বলি দেওয়া যেতে পারে, হরিপদ কেরানির মুন্ডু কেটে তার রক্ত দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে বাঁচাবার চেষ্টা ন্যায়সঙ্গত চেহারা পায়। 

    বিক্রম: আরে ধুর, মানুষ আর জন্তু তো এক নয়, জন্তুদের মৃত্যুভয় নেই, ওরা জানেই না যে একদিন ওদের অস্তিত্ব থাকবে না।

    বেতাল: স্রেফ সেইজন্যে ওদের অস্তিত্ব যখন খুশি লোপ করে দেওয়া যায়? বাহবা। 

    বিক্রম: তাহলে তুমি কী খেয়ে বাঁচবে? আদর্শ? নিজ-মহত্ত্ব? গাছ খেলেও তো প্রাণনাশ হচ্ছে। তবে বলতে হয় প্রকৃত জ্ঞানোদয়ের পর একটা জায়গায় চুপচাপ বসে মরে যাওয়াই সবচেয়ে নৈতিক ক্রিয়া। কিন্তু কয়েকজন সাধক ছাড়া আর কেউই তা করেননি, এমনকী যে বড় মানুষদের নাম আমরা করলাম তাঁরাও না। তাঁরা বিভিন্ন গাছ ও জানোয়ার খেয়েদেয়ে, জানোয়ারদের গা থেকে বের করা জিনিসের জামাকাপড় পরে, মাটি দিয়ে হেঁটে পোকাটোকা মাড়িয়ে, তারপর এমন সব লেখা লিখেছেন যা ছাপতে লাখো গাছ কাটতে হয়েছে। তাই ন্যাকামি ছাড়ো, সত্যি যদি শুয়োরের হৃৎপিণ্ডের সাহায্যে মানুষ বহুদিন বাঁচে, তাকে আলিঙ্গন করতে শেখো। ৭ জানুয়ারি ২০২২ বিজ্ঞানের ক্যালেন্ডারে ইযাব্বড় দিন, কারণ এই প্রথম একটা মানুষ, একটা শুয়োরের জিন-সম্পাদিত হৃৎপিণ্ড ধারণ করল, আর মনে তো হয় বেঁচে গেল, যদি না ক’দিনের মধ্যে শরীর ঝামেলা শুরু করে।

    বেতাল: হ্যাঁ, তার মানে এবার আরও গাদা গাদা জন্তুর চাষ শুরু হবে, মনুষ্য-চিকিৎসার জন্য। তাদের ছিঁড়ে-ফুঁড়ে থেঁতো-ঘোঁতো করা হবে, শুধু তা-ই নয়, তাদের জিন থেকে ক্রমাগত অমুক ছেঁটে তমুক জুড়ে দেওয়া হবে। একজন তাঁর লেখায় জিজ্ঞেস করেছেন: কোনও বুদ্ধিমান প্রাণীর সম্মতি ব্যতিরেকে তার জিনে হাত দেওয়া যায়? তার সন্তানকেও একই ভাগ্যের জন্য প্রস্তুত করা যায়? মানুষের এত মৃত্যুভয়? 

    বিক্রম: যিনি এসব লিখেছেন, তিনি কি সম্মতি নিয়ে মশা মারেন? কিংবা তাঁর বাবাকে দেখে ডাক্তাররা যদি বলেন, মৃত্যু নিশ্চিত, একমাত্র শুয়োরের অমুক অঙ্গটা ট্রান্সপ্লান্ট করে শেষ চেষ্টা করা যায়— তখন তিনি কি শুয়োরটার কথা ভেবে বাবাকে ভাসিয়ে দেবেন? 

    বেতাল: উনি ব্যক্তিগত জীবনে কী করবেন, তার ওপর তত্ত্বটা নির্ভর করে না। ভাবতে হবে, কী করা উচিত? 

    বিক্রম: প্রথমত মৃত্যুভয় সেরা ভয়, এবং তা থেকে বাঁচতে মুঠোয় পৃথিবী গুঁড়ো করে রস বের করে ফেলা উচিত। Do not go gentle into that good night. Rage, rage against the dying of the light.

    বেতাল: রেজ করা মানে কি অন্য প্রাণীকে ধরে ধরে নন-ভেজ করা?

    বিক্রম: এ ঝগড়া তো ঘুরে ঘুরে একই পয়েন্টে আসবে। ইউনিভার্সিটি অফ মেরিল্যান্ড মেডিক্যাল সেন্টার বলবে, এত বড় কাণ্ডটা ঘটিয়েছি, পৃথিবীতে প্রথম একজন মানুষ এভাবে প্রাণ পেল, ইয়াহু। আর মানেকা গান্ধী বলবেন, ছোঃ!

    বেতাল: আরও অনেকে ছ্যাঃ বলছে। কারণ যে ডেভিড বেনেট-কে এত ঘটা করে বাঁচানো হল, ক’দিন পরেই জানা গেল, সে একটা ক্রিমিনাল।

    বিক্রম: অ্যাঁ?

    বেতাল: হ্যাঁ, ডেভিড ১৯৮৮ সালে একজন ২২ বছরের লোকের পিঠে বারবার ছুরি মেরেছে। 

    বিক্রম: শাস্তি হয়নি?

    বেতাল: হয়েছিল। ১০ বছর জেল। তারপর সে তো ১৯৯৮-তে ছাড়া পেয়ে গেছে। এদিকে ছুরি খাওয়া লোক ১৯ বছর হুইলচেয়ারে বন্দি ছিলেন, তারপর মারা গেছেন। প্রতিদিন কষ্ট পেয়েছেন। এবার তাঁর আত্মীয়রা স্তম্ভিত ক্ষুণ্ণ ও প্রতারিত বোধ করছেন, বলছেন, আমাদের প্রিয়জনের গোটা জীবন নষ্ট করে দিল যে, সেই অপরাধীকে এত ঘটা করে বাঁচানো হল? মনে রাখতে হবে, একলক্ষ ছ’হাজার মার্কিন লোক অর্গ্যান ট্রান্সপ্লান্টের জাতীয় ওয়েটিং লিস্টে আছেন। প্রত্যেকদিন ১৭জন মারা যাচ্ছেন, প্রত্যঙ্গ না পেয়ে। আর একটা ছুরি-মারা লোক কিনা…

    বিক্রম: আরে ছুরি তো শুধু শুধু মারেনি। নিশ্চয়ই একটা কারণ ছিল। 

    বেতাল: কারণ থাকলেই ছুরি মারা যায় বুঝি? এক্ষেত্রে কারণটা শোনো। ডেভিডবাবুর বউ ওই লোকটির কোলে বসে পড়েছিলেন। 

    বিক্রম: এই খেয়েছে!

    বিক্রম: যিনি এসব লিখেছেন, তিনি কি সম্মতি নিয়ে মশা মারেন? কিংবা তাঁর বাবাকে দেখে ডাক্তাররা যদি বলেন, মৃত্যু নিশ্চিত, একমাত্র শুয়োরের অমুক অঙ্গটা ট্রান্সপ্লান্ট করে শেষ চেষ্টা করা যায়— তখন তিনি কি শুয়োরটার কথা ভেবে বাবাকে ভাসিয়ে দেবেন? 

    বেতাল: উনি ব্যক্তিগত জীবনে কী করবেন, তার ওপর তত্ত্বটা নির্ভর করে না। ভাবতে হবে, কী করা উচিত? 

    বেতাল: কোনখানটায় খেলো? বউয়ের দোষ হল? না কি তুমি এটাকে চেষ্টা করেও জাস্টিফাই করতে পারবে না: স্রেফ বউ তার কোলে বসেছে বলেই এভাবে মানুষকে আঘাত করা যায়।

    বিক্রম: হুঁ, লোকটা তো সুবিধের মনে হচ্ছে না।

    বেতাল: এই অসুবিধের লোকটাকে বাঁচাতে কতগুলো রোগীকে বঞ্চিত করা হল, জীবন থেকে। আর শুয়োরটাকে তো মেরে ফেলা হলই, সে-কথা আর তুলছি না। আর কিছু না হোক, সরকার কি এই সাংঘাতিক বিরল চিকিৎসা-প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে একটু ভাল করে ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করতে পারে না? 

    বিক্রম: তোমার মতে কি ক্রিমিনালদের মেরে ফেলা উচিত?

    বেতাল: একেবারেই না। কিন্তু সমাজে অ-ক্রিমিনালদের জীবনের মূল্য কি ক্রিমিনালের জীবনের চেয়ে বেশি নয়?

    বিক্রম: এক মিনিট। তুমি বললে না, ডেভিড ১০ বছর জেল খেটেছে? তাতে তো বোঝা গেল, আদালত যতটা শাস্তি তার অপরাধের যোগ্য বলে মনে করেছে, তা সে ভোগ করেছে। তাহলে এখনও তাকে ক্রিমিনাল বলছ কেন?

    বেতাল: অপরাধ করেছে বলে!

    বিক্রম: তার মানে? যে লোকটা একবার অপরাধ করবে সে সারাজীবন ‘অপরাধী’ তকমা বয়ে বেড়াবে এবং তার যে-কোনও কাজকেই শুধু সেই নিরিখে বিচার করা হবে? তার মানে তো বলছ, কোনও মানুষই আসলে সংশোধিত হতে পারে না। অথচ সে সংশোধনাগারে গেছে, সমাজ তার কাছ থেকে যা আদায় করার করেছে। এবার সমাজেরই অনুমান, সে তার কুকাজের পুনরাবৃত্তি করবে না। অথচ অপারেশনের পর তাকে ডাকা হচ্ছে ক্রিমিনাল বলেই! এর মধ্যে স্ববিরোধিতা নেই?

    বেতাল: আরে চুলোয় যাক বড় বড় কথা! যে সারাজীবন সৎ, আর যে কাউকে খুন করেছে বা ধর্ষণ করেছে এবং তারপর জেল খেটেছে, তারা এক? তুমি তোমার মেয়ের সঙ্গে ধর্ষকের বিয়ে দেবে এই ভরসায় যে, জেলের ঘানি টেনে সে ইদানীং ‘সংশোধিত’?

    বিক্রম: আমি কী করব তা বড় কথা নয়, দেখতে হবে কী করা উচিত। মানুষ খারাপ কাজ করলে সে আর কক্ষনও কোনওদিনও ভাল হিসেবে গৃহীত হবে না, এটা প্রকাণ্ড নিষ্ঠুর সিদ্ধান্ত। এই বর্বর ধারণা অনুযায়ী: মানুষ কখনও অনুতপ্ত হতে পারে না, আন্তরিক ভাবে ক্ষমা চাইতে পারে না, চেষ্টা করে নিজেকে বদলে নিতে পারে না। ‘লে মিজারেবল’ তো পড়োইনি, সে ছাড়ো, আমাকে বলো: যে রাষ্ট্র যুদ্ধ করেছে, সেখানে তাহলে বেড়াতে যাব না? ইংরেজরা আমাদের ওপর পৈশাচিক অত্যাচার করেছে আর ধনরত্ন লুট করেছে বলে লন্ডনে চাকরি পেলেও নেব না? সাহিত্য, ইতিহাস, এমনকী কমন সেন্স আমাদের পইপই করে কী শিখিয়েছে? মানুষ একমেটে নয়, সে একটানা একই চিন্তাভাবনার পুঁটলি থাকে না, তার মধ্যে লাখখানেক বাঁক, সহস্র সম্ভাবনা বগবগ করছে। 

    বেতাল: তাহলে একটা লোককে দেখিয়ে আমরা বলি কেন, এ ভাল লোক, এ খারাপ লোক?

    বিক্রম: খুব ঠিক করি না। কারণ তার এক-আধটা কাজ আমরা দেখেছি, জীবনেই অধিকাংশ মুহূর্তেই সে কী করে, তা দেখিনি। তবে যখন ওরকম ব্ল্যাংকেট-ভাল বা খারাপ বলি, সাধারণত কোনও বিশেষ আচরণের বারংবারতা দেখে বলি। হয়তো মঙ্গলবারেও খ্যাঁকখ্যাঁক করল, বুধবারেও। আগের পার্টিতে থাকতেও ঘুষ নিত, এখনও। ডেভিড যদি প্রায়ই ছুরি দিয়ে লোক কোপাত, বোঝা যেত সে সংশোধিত হচ্ছে না। কিন্তু একটা লোক এইমাত্র পাঁচমাথা কদর্য ঝগড়া ও নিরীহ লোককে চূড়ান্ত অপমান করে, পাঁচ মিনিট পরেই অ্যাকসিডেন্টে আটকে পড়া অচেনা লোককে নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে গাড়ির তলা থেকে হেঁচড়ে বের করে আনতে পারে। 

    বেতাল: তার মানে মানুষের কোনও এসেন্স নেই, কোর নেই, কেন্দ্র-ধুকধুকি নেই?

    বিক্রম: আছে হয়তো, কিন্তু একবার যৌন ঈর্ষায় দাউদাউ করে তার মনের চোখ অন্ধ হয়ে গেছে বলে তার গোটা মর্মস্থল চির-নষ্ট, এ-কথা ভাবলে তো সেই এসেন্সের গন্ধটাই পাচ্ছ না ধরতে হবে। এই বিতর্কে মেরিল্যান্ডের ডাক্তাররো কী বলছেন?

    বেতাল: প্রায় তোমার মতোই কথাবার্তা। মানুষের যখন অর্গ্যান ট্রান্সপ্লান্ট করা হয়, আমরা তার শারীরিক দুরবস্থাটা দেখব, কার এখুনি ট্রান্সপ্লান্ট না হলে সে মরে যাবে, তাকে আমরা প্রেফারেন্স দেব। আর কিচ্ছু দেখব না।

    বিক্রম: একদম ঠিক। ডাক্তারের দৃষ্টিকোণ তো এটাই হবে। একমাত্র অসুস্থতার ভিত্তিতেই ঠিক হবে, কাকে অপারেশন টেবিলে নিয়ে যাব।

    বেতাল: তাই? বিজ্ঞানের তার মানে মূল্যবোধ নিয়ে কোনও মাথাব্যথা থাকবে না? এটাও কি নিষ্ঠুরতারই ঢালাও সমর্থন নয়? গিনিপিগের দেহে অসুখ ঢুকিয়ে দেব, কুকুরের কিডনি কেড়ে নিয়ে দেখব তার কী হয়, রিসার্চ শেষ হয়ে গেলে পাইকারি হারে প্রাণীগুলোকে মেরে ফেলব, তারপর বলব প্রগতির কথা মাথায় রাখলে দরদ বোধ করলে চলে না। অ্যাটম বোম আবিষ্কার করব, আর বলব, রাষ্ট্রনায়করা জাপানকে যুগ যুগ ধরে পঙ্গু করে দিলে আমার দোষ কোথায়? এরপর ধর্ষিতা আর ধর্ষক একইসঙ্গে হাসপাতালে এলে, ধর্ষকের চোট বেশি হলে, তাকে সেবা করা হবে, ধর্ষিতাকে স্ট্রেচারে ফেলে রেখে। 

    বিক্রম: কী মুশকিল। বিজ্ঞানকে নিজের জায়গায় তীব্র ফোকাস করতে হয়। নইলে পুরোটা ছেতরে যাবে। একজন ডাক্তার স্রেফ একটাই জিনিস ভাববে, রোগের তীব্রতা কার বেশি। সে যদি এখন রোগীর ঠিকুজি-খুলুজি খুলে বসে, কে বউ পিটিয়েছে আর কে মিষ্টি বিলিয়েছে, তাহলে তার নিরাময়ের কাজটা করবে কখন? 

    বেতাল: কিন্তু সেই ঠিকুজি কি একটা ব্যক্তির বিচারে ইম্পর্ট্যান্ট নয়?

    বিক্রম: ব্যক্তির বিচারই তো বিজ্ঞানের জগতে ইম্পর্ট্যান্ট নয়। ডেভিড বেনেট এখুনি একটা ট্রান্সপ্লান্ট না পেলে মরে যেত। তাই তাকে হৎপিণ্ড দেওয়া হল। যদি দেখা যেত টমাস বা ফিলিপ এখুনি মরে যাচ্ছে, তাকে দেওয়া হত। তাদেরও ক্রিমিনাল রেকর্ড ঘাঁটা হত না। যদি যে লোকটাকে ডেভিড ছুরি মেরেছে, তিনিও আসতেন, আর তাঁর শারীরিক দরকার বেশি হত, তাঁকে অ্যাটেন্ড করা হত।

    বেতাল: এই চরম স্বার্থপর ও সুবিধেজনক অবস্থানটা উপভোগ করার অধিকার বিজ্ঞানকে কে দিল? যেখানে ধর্ম রাজনীতি সংস্কৃতি— সবাইকে অনেকগুলো জটিল ও সংলগ্ন বিষয় ক্রমাগত বিবেচনা করে চলতে হয় এবং তাতে ব্যর্থ হলে কৈফিয়ত দিতে হয়, সেখানে এই জ্ঞানশাখাটি কোন শাহেনশা যে, ফুরফুরে ও হাত-পা-ছড়ানো একটা পরিচ্ছন্ন ময়দান পাবে, যেখানে ঘাড় গুঁজে একবগ্গা ঢঙে শুধু নিজের শাস্ত্রটায় সাঁতরাবে আর তার সঙ্গে যুক্ত যে কোনও দার্শনিক প্রশ্নকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে বলবে, ওসব দেখার দায়িত্ব আমার নয়? এমনকী নিজের কাজের পরিণামের দায়ও যে নেয় না, ধুস কো-ল্যাটারাল ড্যামেজ তো হতেই পারে বলে কাঁধ ঝাঁকায়, সে তো সভ্যতার বেসিক নীতিই লঙ্ঘন করে!

    বিক্রম: আচ্ছা, ধরা যাক, ডাক্তাররা বললেন, ডেভিডের বুক থেকে শুয়োরের হার্ট ছিঁড়ে নিচ্ছি, ভাল লোককে দিচ্ছি। তাহলে সেইদিন থেকে নির্ঘাৎ এই নিয়ম প্রচলিত হবে: ভাল লোককে আগে ট্রিটমেন্ট করতে হবে, খারাপ লোককে পরে? বা, ভাল লোককে বেশি মেডিক্যাল সুবিধে দিতে হবে এবং খারাপ লোককে কম? রোগীকে ডায়ালিসিস যন্ত্রের সুযোগ নিতে দেওয়া হবে কি না, তাকে পেসমেকারের মতো দামি জিনিস বিনামূল্যে দেওয়া উচিত কি না, এসব সিদ্ধান্ত নিতে তার গোটা অতীত নিক্তিতে মাপতে হবে? তা করতে যে ২৩১৪ দিন লাগবে, তাতে যদি রোগী মরে যায়? আর কোনটা ভাল কোনটা খারাপ তা নিয়ে আপেক্ষিক তর্ক-বিতর্কের কথা, একটা লোকের ৪৩২৬৭৮টা খারাপ আর ২৩৬২৭টা ভাল কাজের ওয়েটেজ-সহ নম্বর প্রদানের গ্যাঁড়াকলের কথা তো ছেড়েই দিলাম। আচ্ছা, ধরা যাক আমি হাসপাতালে গেলাম, একটা ডাকাত আমার গর্দানে কোপ বসিয়েছে, তা কোনওক্রমে একটা রক্ত-সুতোয় ঝুলছে। ইমার্জেন্সিতে আমাকে বলল, অমুক লোক নালিশ করেছে আপনি তার বাবাকে অপমান করেছেন, আপনার প্রাক্তন স্ত্রী বলেছেন আপনি প্রায়ই চরম নিষ্ঠুর টিটকিরি মারেন এবং আপনার বস বলেছেন আপনি কাজে নিপুণ হলেও কলিগের নমে চুকলি কাটেন, এর ভিত্তিতে আপনার স্টিচ হবে ওই ১৩ বছরে বাচ্চাটার হাঁটু ছড়ে যাওয়া ট্রিট করার পরে, কারণ ওই বাচ্চাটা এখনও ৩৪টার বেশি খারাপ কাজ করেনি। আর সেই অপেক্ষা করতে করতে আমি মুন্ডু খসে মরে গেলাম। সে কাজ ঠিক না ভুল? 

    বেতাল: তাহলে ভাল ও খারাপ বিচার করা সহজ নয় বলে তাকে এড়িয়ে যাব? অ-সহজ কম্ম থেকে পালানোই সভ্য মানুষের কাজ? ভাবতে গিয়ে ওখানটা গিঁট্টু পড়ে যাচ্ছে বলে ওইদিকের ভাবনাটা থামিয়ে ভান করব ওটা গুরুত্বহীন? আর বিজ্ঞান একটা এমন একটেরে একলষেঁড়ে পবিত্র তাঁবুতে বসে থাকবে, যেখানে তাকে ছোঁয়া যাবে না, তার নামে অভিযোগ করা যাবে না, তাকে জবাবদিহি করতে হবে না? এ তো সেই মধ্যযুগে গির্জারই মতো ক্ষমতাভোগ হল। বিজ্ঞান আধুনিক পৃথিবীতে অন্য ধারাদের টেক্কা দিয়ে ১০ গোলে জিতছে বলেই তো তার বরং আরও দায়িত্ববান হওয়া উচিত, আরও মরমি হতে শেখা উচিত।

    বিক্রম: আরে ধুর, তুমি যা বলছ তা তো পুরো ইমপ্র্যাকটিকাল! বাস্তবে সম্ভব নয়। যদি ডেভিড বেনেটকে তার ছুরি-মারার ঘটনার কারণে চিকিৎসা রিফিউজ করা হত, তাতে একটা ভয়াবহ উদাহরণ প্রতিষ্ঠিত হত সমাজে, যে-সমাজ নিয়ে তোমার এত মাথাব্যথা! যে-লোকটা চিকিৎসা করাতে আসত, আরেকটা লোক তার চরিত্র নিয়ে নালিশ ঠুকে দিলেই চিকিৎসা বন্ধ হযে যেত। পুরো জিনিসটা আর অপারেট করত না, গোটা স্বাস্থ্য-ব্যবস্থাটা ভেঙে পড়ত। এটা ঘিলুতে ঢুকছে না?

    বেতাল: ব্যবহারিক অসুবিধে হলেই নীতি তার প্রশ্ন থামাবে কেন? বউকে চাকরি না করে সারাদিন বাসন মাজালে সংসারের সুবিধে হয় বলে তো নারীবাদ হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারে না। দলিতদের দিয়ে মেথরের কাজ করিয়ে নিতে পারলে মোটামুটি গোটা সমাজ নির্ঝঞ্ঝাটে সাফসুতরো থাকতে পারে বলে তো জাতিভেদ বজায় রাখার বাক্সে টিক দেওয়া যায় না। নীতি অনুযায়ী মানুষ তার ব্যবহারকে বদলাবে, না উল্টোটা? 

    বিক্রম: দুটোই করবে। সবচেয়ে বড় কথা হল, সব ধাঁধার একটা নির্দিষ্ট উত্তর হয় না। হয়তো একটা উত্তরের ঝাঁক হয়, পিন্ডি হয়, সে-গুটলি থেকেও সতত প্লাস-মাইনাস চলে, এবং তা খামচে খাবলে কোনও সিদ্ধান্তে যদি-বা আসা যায়, পাঁচ মিনিট পরেই নিজেরই সন্দেহ উপস্থিত হয়, ঠিক করলাম তো? তাই তুমি যে একদম গোড়ায় বললে, টকাস করে এক-লাইনের সমাধান না বাতলালেই আমার মাথা ফেটে যাবে, সে-থ্রেট করা উচিত হয়নি।

    বেতাল: আরে না না, ওটা তো আমাদের গল্পের একটা চালু লব্জ। আমি তোমার ঘাড়ে চড়ে বেড়াই, তোমার মাথা কেন, গোড়ালি মচকালেও আমার লস। অবশ্য মাথা ফেটে গেলে ক্ষতি কী? একটা শুয়োরের মাথা ট্রান্সপ্লান্ট করে নিলেই চলবে! খুব তফাত হবে বলে তো মনে হয় না।

    বিক্রম: ভ্যাগ শালা! 

    ছবি এঁকেছেন সায়ন চক্রবর্তী

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook