ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • হিয়া টুপটাপ, জিয়া নস্টাল: পর্ব ২


    শ্রীজাত (March 27, 2021)
     
    কাল আমাদের দোল  

    তাহলে ওই কথাই রইল? পুশকান আর সোনাই নিয়ে আসবে পেঁয়াজ, টুসি আনবে অল্প কিছু আলু, বড় টুম্পা নিয়ে আসবে বাটি আর ছুরি, আমি নিয়ে যাব আচারের বয়াম, রাজা আনবে আমচুর, আর ছোট টুম্পা ওদের একতলার বারান্দাটা দেবে। এই রইল কথা।

    গরমটা পড়ব-পড়ব বলেও পড়ছে না, এদিকে বসন্তের ছমছমে গা-শিরশিরে হাওয়াটাও পাড়া থেকে তাঁবু গুটিয়ে নেয়নি। এরকম একখানা সময়ে তার আগমন। দোল। সারা বছর ধরে এই একটা দিনের অপেক্ষায় থাকতাম বন্ধুবান্ধবেরা। ছোট, মধ্যবিত্ত, হ্যারিকেন-জ্বলা, গলা-সাধা পাড়ায় দোল ছিল যাচ্ছেতাই-এর সেরা অজুহাত। সারা বছর ওই এক রঙের স্কুল-ইউনিফর্ম পরার যে বিরক্তি, তা আমরা সক্কলে মিটিয়ে নিতাম ওই একটি দিনের একবেলায়, যত খুশি রং মেখে ভূত হয়ে। তাই দোল আসছে মানেই দেরাজ থেকে বার করে এনে ভাঁজ-খাওয়া হাতা-ছেঁড়া জামাদের সমাদর, দোল আসছে মানেই কে কী রং কিনব হিসেব কষে ফেলা, দোল আসছে মানেই একটা ধোঁয়া ধোঁয়া গোলাপি আকাশের স্বপ্নে ঘুম যাওয়া। তবে এত কিছুর পরেও, এ-লেখা কিন্তু দোল নিয়ে নয়। দোলের সেমিফাইনাল নিয়ে। সব খেলারই সেমিফাইনাল থাকে। দোল খেলারই বা থাকবে না কেন? তার নিজস্ব সেমিফাইনালের নাম ছিল ন্যাড়া পোড়া বা বুড়ি পোড়ানো। জানি না, আজকালকার পাড়ায় এসব আর দেখা বা শোনা যায় কি না। অবশ্য এও তো জানি না যে, আজকাল পাড়া টিকে আছে আর ক’খানা। কিন্তু আমাদের পাড়ায় দোলের ঠিক আগের সন্ধেবেলা জাঁকিয়ে নেমে আসত ন্যাড়া পোড়া। আর ক’দিন থেকেই তার আয়োজনে লেগে পড়তাম আমরা কয়েকজন হাফপ্যান্ট আর ফ্রকের বন্ধুবান্ধবী। 

    ওই, যেমন গোড়াতেই বললাম, পুশকান আর সোনাই নিয়ে আসবে পেঁয়াজ, টুসি আনবে অল্প কিছু আলু, বড় টুম্পা নিয়ে আসবে বাটি আর ছুরি, আমি নিয়ে যাব আচারের বয়াম, রাজা আনবে আমচুর, আর ছোট টুম্পা ওদের একতলার বারান্দাটা দেবে। এইরকমই কথা হয়ে আছে। শুনতে সোজা লাগছে ঠিকই, কিন্তু তখন ছোটখাটো রোজগারের সংসার থেকে চারটে আলু, দুটো পেঁয়াজ বা চার চামচ তেল জোগাড় করে আনাটাও ভারি দুঃসাহসের কাজ ছিল। নেহাত আমাদের বাবা-মায়েরা আমাদের আনন্দের দামের কাছে সবকিছুকেই ছোট করে দেখতেন, তাই আমতা-আমতা গলায় কথাগুলো আগে থাকতে গেয়ে রাখলে, দিনের দিন মালমশলা ঠিকঠাকই মিলে যেত। কিন্তু সমস্যা তো আলু-পেঁয়াজ-তেল নিয়ে নয়, সমস্যা তার আগের জোগাড়ের। 

    ধরেই নিচ্ছি সকলে জানেন, ন্যাড়া বা বুড়ি পোড়ানো কী ব্যাপার। অবাঙালিরা একেই হোলি কা দহন বলে থাকেন, বিষয় একই। নানা রঙে মেতে ওঠার ঠিক আগমুহূর্তে জীবনের সমস্ত অশুভকে পুড়িয়ে ছারখার করে দেওয়া। শুদ্ধ হয়ে নিয়ে দোলের আবির গায়ে মাখা। এই হল ব্যাপার। এর জন্যে লাগে খালি জমি, বেশ কিছু শুকনো ডালপালা আর পাতা। এসব জড়ো করে তাঁবুর মতো দেখতে একটা ব্যাপার বানানো হয়, যাকে বুড়ির ঘর বলতেই অভ্যস্ত ছিলাম আমরা। তারপর সেই ঘরে আগুন দিয়ে দেওয়া। ব্যাস, সব পুড়ে ছাই। ওই ছোটবেলায় শুভ-অশুভ বুঝতাম না, আর এখন তো দুটোই গুলিয়ে গেছে। কিন্তু এটুকু বুঝতাম, মানুষ চিরকাল অন্ধকারের মধ্যে আগুন জ্বালতে মজা পেয়েছে। এমন নিখাদ আলো, এমন আশ্চর্য উত্তাপ আর কিছুতে সে পায় না। আদিম যুগেও পেত না, আজও পায় না। শুদ্ধ হতে হলে তাকে সেই আগুনের কাছেই আসতে হয়। তা এহেন বুড়ি পোড়ানোয় আমাদের অতিরিক্ত আনন্দ ছিল সেই আগুনে আলু পুড়িয়ে, আচ্ছা করে জম্পেশ মেখে সেটাকে খাওয়া। তাই এত আয়োজন। কিন্তু সেই সন্ধের মুখে হবে বুড়ি পোড়ানো, তার জন্য দুপুর থেকেই আমাদের লেগে পড়তে হত কাজে। 

    কাজ কিন্তু কম নয়। প্রথমে, জমি খুঁজে বার করা। সে-আমলে অবশ্য এসব পাড়ায় ছোটখাটো জমি এদিক- ওদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে খালি পড়ে থাকত। পাড়ারই কারও কারও অল্প জমি কেনা, এমনি পড়ে আছে। থাকতে থাকতে তার পাঁচিলে শ্যাওলা, মাটিতে আগাছা জমে গেছে। আমরা সেসব জানতাম, কোনটা কার জমি। এঁদের মধ্যে যিনি একটু নরম গোছের, তাঁকেই গিয়ে বলতে হত, তদবির করতে হত, এক সন্ধের জন্যে জমিটা পাওয়া যাবে কি না। এক বাড়ি-দু’বাড়ি ঘুরে ‘না’ শুনলাম আমরা বাচ্চাদের দল। কিন্তু জেদ। কিন্তু প্রত্যয়। তিন নম্বর বাড়ির জেঠু হয়তো রাজি হয়ে গেলেন। হাসিমুখে ফিরে আসছি, সে-সময়ে বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণের মতো বললেন, ‘একদম নোংরা করবি না কিন্তু, সাবধানে করবি সব। আর পরে পরিষ্কার করে দিবি’। আমরা হেসে ঘাড় নেড়ে বেরিয়ে এসেই বলাবলি করতাম, বরং বুড়ি পোড়ানোর আগেই পরিষ্কার করতে হবে ওঁর জমি। যা নোংরা হয়ে আছে! আমাদের পেল বলে তবু একটু সাফসুতরো হয়ে গেল, এই যা।

    তখন সকলের বাড়িতেই খুরপি, চাঁছি এইসব থাকত। তারই কয়েকখানা নিয়ে কোমর বেঁধে আমাদের একদল নেমে পড়ল জমি সাফাই অভিযানে। কিন্তু শুধু জমি পেলেই তো হবে না, যথেষ্ট শুকনো পাতা না পেলে বুড়ির ঘর হবে কী দিয়ে? তাই আরেক দল ঠা-ঠা রোদের দুপুর-পাড়ায় লেগে পড়ল পাতা খোঁজার কাজে। যে পাড়ায় থাকতাম আমরা, তার ডাকনাম ছিল নারকেলবাগান। নামটা মিথ্যে নয়, কেননা গোটা পাড়া জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা নারকেলগাছের সংখ্যা আমরা গুনে শেষ করতে পারতাম না। তাই বসন্তের শেষে শুকনো পাতা খুব যে দুর্লভ ব্যাপার ছিল, তা নয়। সুতরাং এ-রাস্তা ও-রাস্তা ঘণ্টাখানেক ঘুরেফিরেই আমরা দিব্যি পাতার পোশাক জোগাড় করে ফেলতে পারতাম।

    বিকেল হয়ে সন্ধে নামার মুখে সক্কলে ঘেমেনেয়ে ধুলোবালি মেখে জমিতে হাজির। একদিকে আগাছা সাফ করে ডাঁই। এরপর জুটবে ছাই। সেসব আমাদেরই পরিষ্কার করতে হবে, কিন্তু তার আগে বচ্ছরকার মোচ্ছব বুড়ি পোড়ানো। যার জন্যে এত কাঠখড়। মাটিতে একটা ছোট্ট গর্ত খুঁড়ে তার মধ্যে কাঁচা আলু রেখে দিলেই কেল্লা ফতে। বড় টুম্পা আমাদের চাইতে বয়সে দু’ক্লাস উঁচু, তার বুদ্ধিও তাই। সে দারুণ বুদ্ধি করে তাদের রান্নাঘর থেকে দু’খানা শুকনো লঙ্কা নিয়ে এসেছে। আলুর গায়ে গায়ে তাদেরও শুইয়ে রাখা হল গর্তে। ততক্ষণে ইয়া বড় বড় শুকনো নারকেল পাতা জড়ো করে কিছু একটা বানানো গেছে, যেটাকে তাঁবু আখ্যা দিলে আর কেউ না হোক, পিকাসো ভারি খুশি হতেন। পাখিদের বাড়ি ফেরার ডাক শুনছি তখন, শুনছি কোনও ঝাপসা মেয়ের গলায় সাধা ভূপালী, এরই মধ্যে আমরা আগুন দিলাম বুড়ির ঘরে। আগুন আর মানুষের তফাত হল, আগুন বড় হতে একেবারে সময় নেয় না। দেখতে দেখতে সেই পোড়ো জমি সন্ধের অন্ধকারে উদ্ভাসিত হয়ে উঠত অনামী এক আগুনে, যার সাক্ষী থাকতাম আমরা ক’জন। কখন যে সকলের মুখ থেকে বেরিয়ে আসত সেই মন্ত্র, ‘আজ আমাদের ন্যাড়া পোড়া, কাল আমাদের দোল…’ নিজেরাই টের পেতাম না যেন।

    কাট টু, ছোট টুম্পাদের একতলার টানা বারান্দা, গ্রিলে ঘেরা। অপটু হাতের কাটা পেঁয়াজকুচি সহযোগে পোড়া আলু মাখা হচ্ছে অতি যত্নে। সঙ্গে মিশছে আচারের তেল আর আমচুর। একেবারে শেষে মরিচপোড়া-র মাস্টার স্ট্রোক। গোল হয়ে বাটির চারপাশে বসেছি সকলে। টুসি মেখে গোল্লা পাকিয়ে আমাদের হাতে তুলে দিচ্ছে। তারপর চেখে দেখার পালা। সেই পোড়া আলুমাখার স্বাদ যে কী ছিল, তা লিখে বোঝানোর ক্ষমতা আমার নেই। সারা রাত সেই স্বাদ জিভে লেগে থাকত। এখন বুঝি, সারা জীবনের জন্যেই আটকে গেছে সেই স্বাদ, আমাদের মনে। 

    আজ সেই আগুনের আঁচ থেকে অনেকটা দূরে সরে এসেছি সকলেই, সন্ধের পাখি-ফেরা আকাশ দেখার সুযোগও কম হয়। অনেক রকমের আগুনে পুড়ে যেতে হয়েছে সকলকেই, ঢেকে যেতে হয়েছে অনেক আগাছায়। কেবল দোল এগিয়ে এলে আজও মনে হয়, সহজে জ্বালানো ছোট্ট একটা আগুন আজ কত কঠিন হয়ে গেছে আমাদের কাছে। জ্বলতে পারি, তবু জ্বালিয়ে উঠতে পারি না আর। 

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook