সকাল থেকে এসে পর্যন্ত পাঁচটি মানুষ একটি বাড়ির মধ্যে আবদ্ধ হয়ে আছি। পাঁচজনেরই উদ্দেশ্য এক। এক এবং অদ্বিতীয়। গুরু কখনও ঘুম থেকে ওঠে বেলা ন’টার সময়। কখনও আটটার সময়, আবার কখনও ভোর চারটের সময়। যেদিন দেখি গুরু বেলা পর্যন্ত ঘুমোচ্ছে, সেদিন বুঝতে পারি সারারাত তার ঘুম হয়নি।
একদিন জিজ্ঞাসা করেছিলাম— কি জন্যে ঘুম এল না আপনার?
গুরু বলেছিল— কি জানি, নানারকম বাজে কথা মাথায় আসতে লাগল।
— কি বাজে কথা?
— ছবির কথা, ছেলের কথা, লন্ডনের কথা, আরো সব কত কী কথা যে মাথায় আসতে লাগল তার ঠিক নেই—
বললাম— ঘুমোবার আগে এক-দুই তিন-চার করে একশো পর্যন্ত গুনতে পারেন না?
— ওসব করে দেখেছি—
— মাথায় বালিশ না দিয়ে ঘুমোবার চেষ্টা করেছেন কখনও?
— সে রকমও করে দেখেছি—
আমি নিজেও অনিদ্রার রোগী। আমারও সহজে ঘুম আসে না। ঘুমের মধ্যে গল্পের জট্গুলো ছাড়াবার চেষ্টা করি। যত ছাড়াতে চেষ্টা করি, ততই জট্ পাকিয়ে যায়। শেষকালে যখন আর কিছুতেই ঘুমোতে পারি না তখন বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ি। উঠে বাড়িময় পায়চারি শুরু করে দিই, আর তারপর যখন কিছুতেই কিছু হয় না, তখন আবার বিছানায় শুই। মুখ গুঁজে পড়ে থাকি বিছানার ওপর। তখন যা একটু ঘুম আসে। পরদিন মাথা ধরে থাকে। তখন কিছু ভালো লাগে না। তখন কেউ এসে কথা বললে অভদ্র ব্যবহার করি, রেগে যাই। তারা কিছু বুঝতে পারে না। ভাবে, আমি অভদ্র। ভাবে, আমি কথা বলতে জানি না। ভাবে, আমি মানুষ ভালোবাসি না।
কিন্তু গুরুকে দেখেছি অন্য রকম। সারা রাত ঘুম না-হবার পরও রেশ অবিচলিত। কোথাও কিছু বোঝার উপায় নেই। কিন্তু আমি বুঝতে পারতাম তার মনের ভিতরে কি কষ্ট, শরীরের ভেতরে কি গ্লানি পোষা রয়েছে।
এক-একদিন বলতাম— আপনার ঘুম না হলে পরের দিন কষ্ট হয় না?
গুরু বলত— অভ্যেস হয়ে গেছে।
আর অভ্যেস না হলেই চলবে কেন? সকাল থেকেই তো আরম্ভ হয়ে যেত তার কাজ। বোম্বাইতে থাকতে সকাল সাতটার মধ্যে তৈরি হয়ে নিতাম আমি। তারপর গুরু নিজের গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে বসত। এক মুখ পান, পরনে লুঙ্গি, সাদা আদ্দির পাঞ্জাবি। পালি হিল পেরিয়ে গাড়ি গিয়ে পড়ত সান্তাক্রুজে, সান্তাক্রুজের ধার দিয়ে রেল-লাইনের ব্রিজের তলা দিয়ে একেবারে এয়ারপোর্টের পাশ দিয়ে সোজা আন্ধেরীর বাজার। সেই বাজারের পাশ দিয়ে একেবারে স্টুডিওতে। বোম্বাইতে থাকবার সময় এইটেই ছিল নিত্যনৈমিত্তিক রুটিন। গাড়িটা গিয়ে ঢুকতো একবারে সোজা ভিতরে, স্টুডিওর ভিতরে। ‘গুরু দত্ত ফিল্ম স্টুডিও’। স্টুডিওর ভেতরে গিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে হতো। ম্যানেজার গুরুস্বামীর ঘর পেরিয়ে গুরুর এয়ার-কন্ডিশন ঘর।
হয়তো সেদিন রবিবার। কিংবা হয়তো কোনো ছুটির দিন সেটা। স্টুডিওতে কেউ নেই। ফাঁকা সব। কিন্তু আমরা দুজনে গিয়ে বসতাম সেই ঘরে। চারদিকে অসংখ্য বই আর ম্যাগাজিন। তখন গুরু আর আমি একাকার হয়ে যেতাম গল্পের জগতের মধ্যে!
গল্প, গল্প আর গল্প! এক-এক সময়ে মনে হত গুরু বোধহয় জীবনে সবচেয়ে ভালোবাসত গল্প। আমার মতো গল্প-পাগল আর একজন মানুষকে যদি কোথাও দেখে থাকি তো সে হচ্ছে গুরু। কবে কোন ছোট বয়সে মোপাসাঁর কোন গল্প গুরু পড়েছে, কবে লন্ডনের কোন রাস্তার ধারে রেস্টুরেন্টে বসে কি দেখেছে, তারই গল্প। আর আমিও আমার জীবনের সব পড়া গল্পগুলোর কাহিনী এক-এক করে বলে যেতাম। গুরুর সব গল্প মনে থাকত, আমারও মনে থাকে। গল্প আমি ভুলি না। ভুলতেও পারি না।
কিন্তু সেদিন যখন লোনাভালায় সেই বাড়িটাতে গুরুকে পান্তাভাত খেতে দেখলাম, তখন একটু অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। এ তো পশ্চিমবঙ্গের খাওয়া। এ তো বাঙালির গরিব লোকের খাদ্য।
গুরু বললে— আমি সাউথ ইন্ডিয়ান, পান্তাভাতই তো আমাদের খাওয়া—
বললাম— আমিও খাই, আমার পান্তাভাত খেতে ভালো লাগে—
গুরু বললে— ঠিক আছে, কাল থেকে আপনারও এই ব্যবস্থা হবে—
অন্য যারা ছিল তাদের কারোরই এ-সম্বন্ধে আগ্রহ নেই। তারা ভালো-ভালো বিলিতি ডিশ খেতে ব্যস্ত, তারা গুরুর পান্তাভাত খাওয়া দেখে হাসছিল, কিন্তু আমার ভালো লাগল। মনে হল গুরুর সঙ্গে আমার মিলটা যেন।