সন্ধেবেলা আমাদের আসর বসল আবার। বাড়িটার পেছন দিকে মস্ত একটা বাগান। সেই বাগানের সামনে বারান্দা। সেই বারান্দার ওপর খালি মেঝেতে বসে গুরু দত্ত সমস্ত গল্পটা মুখে বলতে লাগল। আব্রার শোনে আর বিজ্ঞের মতো ঘাড় নাড়ে। রাত বারোটা পর্যন্ত আলোচনা হওয়ার পর আমি বললাম— এবার উঠি—
— এরই মধ্যে উঠবেন?
বললাম— কাল ভোরবেলা থেকে যে আমাকে আবার আমার ‘দেশ’-এর উপন্যাসের কিস্তি লিখতে হবে—
অগত্যা আমাকে সবাই ছেড়ে দিল। কিন্তু ঘুম এল না নিজের বিছানায় শুয়ে-শুয়েও। মনে হল ওদের আড্ডা তখনও যেন চলছে। যখন গেল, আমি উঠে পড়লাম। তাড়াতাড়ি কাগজ-কলম নিয়ে লিখতে শুরু করেছি হঠাৎ অমলেন্দু এসে হাজির। বললে— বিমলদা কালকে এক কাণ্ড হয়েছে—
বললাম— কী কাণ্ড?
অমলেন্দু বললে— আপনি তো শুতে চলে গেলেন, তারপর আব্রার আল্ভিও শুতে চলে গেল। আর তারপর আমিও বিছানায় গিয়ে শুয়েছি। হঠাৎ গুরু দত্ত আমাকে ডেকে পাঠালেন—
আমি অবাক হয়ে গেলাম। বললাম— গুরু দত্ত?
অমলেন্দু বললেন— হ্যাঁ গুরু আমাকে ডেকে বললেন— অমলেন্দুবাবু আপনার কি ঘুম পেয়েছ খুব?
অমলেন্দু বললে— না—
— আমার ঘুম আসছে না। একটু গল্প করুন না বসে-বসে। এখন তো মাত্র রাত একটা—
বললাম— তারপর?
অমলেন্দু বললে— তারপর রাত পর্যন্ত হুইস্কি খেয়েছে, আর আমার সঙ্গে আবোল-তাবোল গল্প করেছে কেবল—
বললাম— কি আবোল-তাবোল গল্প?
— গুরু আপনার কথা বলছিল, আপনার সম্বন্ধে আমার কী মত?
বুঝলাম ঘুম আসেনি বলে যাকে হোক একজঙ্কে নিয়ে সময় কাটাতে চেয়েছে। তাই আর কাউকে না পেয়ে অমলেন্দুকে নিয়েই গল্প করেছে। কিন্তু অবাক হয়ে গেলাম এই ভেবে যে কেন ঘুম আসে না ওরও?
কোনো রকমে লেখাটা লিখে দুপুরে খাওয়ার টেবিলে কথাতা তুললুম। বললাম— কাল নাকি আপনার ঘুম আসেনি রাত্রে?
গুরু বললে— কে বললে আপনাকে? অমলেন্দু?
বললাম— হ্যাঁ, কিন্তু আমাকে কেন ডাকলেন না—
— না, আপনার ঘুম পাচ্ছিল বললেন, তাই আর কষ্ট দিলাম না—
আমি বললাম— না, এবার থেকে কথা রইল যখনই আপনার রাত্রে গল্প করবার ইচ্ছে হবে, তখনই আমায় ডাকবেন। আপনার সঙ্গে গল্প করতে আমার ভালোলাগে—
বললাম— হুইস্কিটা ছেড়ে দিয়ে দেখুন তো তাতে ঘুম আসতে পারে—
— তা ছেড়ে দিয়েও দেখেছি। তাতেও ঘুম আসে না—
খুব অবাক হতাম যে শরীরের উপর অত অত্যাচারের পরও কেন সে ঘুমোতে পারত না? আসলে এ বোধহয় সাক্সেস-এরই কুফল। সাক্সেসই বোধহয় মানুষকে তাড়িয়ে বেড়ায়, মানুষের ঘুম কেড়ে নেয়, তাকে অশান্তি আর যন্ত্রণার মধ্যে ঠেলে দেয়।
মিস ভালেকর তাদের মধ্যে একজন, যারা গুরু দত্তের জীবনে একটা-না-একটা দিকের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। দেখতাম যখন কোনো কাজের কিছু টাইপ করাবার হত, ম্যাগির ডাক পড়ত। তা সে অফিসেই বা কি আর বাড়িতেই বা কি! তখনও আমি ঘনিষ্ঠ ভাবে চিনতাম না ম্যাগিকে। সামান্য চোখে দেখা শুধু। যখনই দরকার হয়েছে গুরু ডেকেছে ম্যাগিকে আর ডিক্টেশন নিয়ে গেছে।
কিন্তু এবার আরো ঘনিষ্ঠভাবে দেখা হল। শুধু দেখা নয়, মেলামেশাও হল। দেখলাম মিছিমিছি আড়ষ্ট হয়েছিলাম। ম্যাগি সে-রকম মেয়েই নয়। এসেই একেবারে সকলের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে গেল।
এখনও এক-একবার ভাবি লোনাভালায় সেই দেড় মাস কী আনন্দে কেটেছে। অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করার পর সবাই যখন বেলা দশটা-এগারোটা-বারোটা পর্যন্ত ঘুমোচ্ছে, আমি তখন আমার নিজের ঘরে বসে ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ লিখছি। বেলা একটা পর্যন্ত সেই লেখায় ডুবে থাকি। গুরু হয়তো শেষ রাত্রের দিকে তখন কোনো রকমে একটু ঘুমিয়ে নিচ্ছে। তখন জেগে থাকতাম শুধু আমি আর আমার লেখা। আর ওদিকে তখন রতন দাড়ি কামিয়ে ফিট্-ফাট্ হয়ে তৈরি হয়ে নিচ্ছে। কখন সাহেব তাকে ডাকবে ঠিক নেই। সাহেব ডাকলেই রতনকে দৌড়ে যেতে হবে, ‘কী চাই’ জিগ্যেস করতে হবে। সিগারেটও চাইতে পারে, নাও চাইতে পারে। আরো একজন তখনও জেগে থাকত লোনাভালায়, তার নাম ‘জন্’।
জনও এক অদ্ভুত চরিত্র। বেচারি গুরু দত্তকে খুশি করার জন্য তার বিদ্যে-বুদ্ধির ঝুলি ঝেড়ে বার করে দিত। খাবার টেবিলে ডিশগুলো দেখে অবাক হয়ে যেতাম। সে সব চেহারা কখনো দেখিনি জীবনে। এক-একটা প্লেটে এক-একরকমের দৃশ্য। কোনোটা জন্তু-জানোয়ারের মতো চেহারা, কোনোটা ফুলের মতো, কোনোটা আবার রঙিন।
একে আমার পরিপাক-যন্ত্রটা দুর্বল, তার ওপর জনের উজাড় করা বিদ্যে আর সকলের তার উপর দুর্জয় লোভ। সামনে সুদৃশ্য-সুখাদ্যের সম্ভার সাজিয়ে রেখে শুক্রাচার্য হওয়ার সংযম আমার নেই। বড়ো লোভ লাগত। আমি প্রত্যেকটা খাবারের নাম জিগ্যেস করতাম।
বলতাম— এটা কী রেঁধেছ, জন্?
— ওটা মার্মলেড, হুজুর—
— আর এটা?
খাদ্য যত মুখরোচক হত, লোভ তত দুর্বার হয়ে উঠত সকলের। জন্ প্রাণপণে আমাদের খাইয়ে সুনাম কেনবার চেষ্টা করছে, আর আমি ত্রাহি-ত্রাহি করছি নিজের মনে। কিন্তু পরিপাক-যন্ত্রের দুর্বলতার কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা করার মতো জিনিস নয়। তাতে সকলের চোখে ছোটো হয়ে পড়বার ভয় আছে। ভাবতাম, সাদাসিধে মাছের ঝোল আর ভাত যদি পেতাম তো বেঁচে যেতাম। কিন্তু একথা বলব কাকে?
সবাই যে খাচ্ছে মন দিয়ে। সবাই তো নির্বিবাদে হজম করে যাচ্ছে। খেতে খেতেও সমস্তক্ষণ গল্পের আলোচনা। সমস্তক্ষণ গল্পের বিশ্লেষণ চলে। আমাদের গল্প যেমনভাবে হোক দাঁড় করাতেই হবে। সাতশো চার পাতার বইকে দু-ঘণ্টার ছবিতে পরিণত করতেই হবে। খাবার টেবিল থেকে উঠেই আবার গিয়ে কাগজ-কলম নিয়ে বসা। আমি যেটুকু লিখছি লিখব, আব্রার সেটুকু হিন্দিতে অনুবাদ করবে। তারপর আমার লেখাটা ম্যাগিকে দিয়ে টাইপ করিয়ে নেবে অমলেন্দু। যেন কারখানার মতো কাজ চলছে আমাদের। গুরু গড়গড়া মুখে দিয়ে তামাক খাবে, পান খাবে। আবার ফাঁক পেলেই সিগারেট। আর মুহুর্মুহু চা। দিনে মাথাপিছু চোদ্দো কাপ চা। অত চা-ই কি জীবনে আমিও কখনো খেয়েছি?
আর তারপর যখন সন্ধের অন্ধকার ঘনিয়ে আসবে, তখন রতন নিয়ে আসবে বোতল। নিয়ে আসবে গেলাস। কি করে যে হিন্দি ছবির স্ক্রিপ্ট লেখা হয়, তা আমার দেখা হল সেদিন। কিন্তু গুরুকে খুশি করা সোজা কথা নয়! ডায়লগে একটু ভুল হলেই গুরু ধরে ফেলে। বলে— না, বিমলদা আপনার বইতে তো ওরকম নেই—
কিন্তু আটকাল এসে এক জায়গায়।
গুরু বলল— বিমলদা, শেষটা কি করবেন?
বললাম— কেন, বইতে যেমন আছে সেরকম—
গুরু বললে— আমাকে এই ছবিটাতে একটু পয়সা উপায় করতে দিন। আমি ‘কাগজ কা ফুল’ ছবিতে তিন লক্ষ টাকা লোকসান দিয়েছি। এ-ছবিতে আর লোকসান দিতে পারব না—
— কিন্তু ‘সাহেব বিবি গোলাম’ ছবিতে যে-রকম শেষ আছে, সে-রকম শেষ করলে কি আপনার লোকসান হবে মনে করেন?
গুরু বললে— আসলে আমার ভয় হচ্ছে যদি ছবিটা না চলে, যদি ‘কাগজ কা ফুল’-এর মতো এ ছবিটাতেও লোকসান হয়। আপনি জানেন না বিমলদা, ছবি না চললে যে কি টেনশন হয়, তা আপনি ধারণা করতে পারবেন না। রাতের পর রাত আমার ঘুম আসে না, স্লিপিং পিল খেয়েও ঘুম আসে না। এছাড়াও আছে স্টুডিও চালানোর খরচ। স্টুডিও চালাতে মাসে চল্লিশ হাজার টাকা খরচ লাগে, তার ওপর আছে স্টুডিওর লোকজনের মাইনে। ছবি চলুক না চলুক প্রতিমাসে আমাকে মাইনে দিতেই হবে। নিজের সুনাম আর টাকার জোগাড়ের চিন্তায় আমি পাগল হয়ে যাই—
বললাম— তাহলে আপনি শেষটা আপনার মতো পালটে নিন, আমার কোনো আপত্তি নেই। আমার ‘সাহেব বিবি গোলাম’ উপন্যাস শুধু পশ্চিমবঙ্গের কেন, সারা ভারতবর্ষের পাঠক-পাঠিকা পড়ে নিয়েছে। এ উপন্যাস তাদের মনের মধ্যে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে। আপনি আপনার সিনেমা যেভাবে ইচ্ছে শেষ করতে পারেন, আমার উপন্যাসের তাতে কোনো ক্ষতি হবে না—