প্রিয় সুবিমল: পর্ব ১

বন্ধুত্ব ও বোঝাপড়া

আপনার সংগ্রহে থাকা চিঠিগুলো দিন না! সম্পাদনা করে প্রকাশের ব্যবস্থা করি!’ ‘দেব, দেব! এত ভেতরে আছে যে, খুঁজতে হবে। শরীর আর দেয় না আজকাল!’ গত সাত-আট বছরে একাধিকবার এই কথোপকথন হয়েছে আমাদের। শেষ কয়েক বছর অবশ্য শারীরিক দুর্বলতার কারণেই সেদিকে মন দিতে পারেননি। দেবেনই-বা কী করে! তেতলার ঘরে স্তূপীকৃত বই ও পত্রপত্রিকা— প্রায় সত্তর বছরের সংগ্রহ— সেই পাহাড় ঠেলে চিঠিপত্র খুঁজে বের করা কি সোজা কথা! অতএব, হয়নি। তবে তাঁর মুখে শুনতাম বিভিন্ন চিঠির গল্প। শুনে মনে হত, সেগুলি প্রকাশ্যে এলে বেশ হয়!

গত ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ প্রয়াত হলেন সুবিমল বসাক, ছিয়াশি বছর বয়সে। তারও বেশ কিছুদিন পর, বাড়ির লোকের সম্মতিতে তাঁর তেতলার ঘরে অভিযান। বেরিয়ে এল একের পর এক দুর্মূল্য লেখা ও নথিপত্র। সেইসঙ্গে, তাড়া-তাড়া চিঠি। বাংলা-ইংরেজি-হিন্দি সব ভাষারই। সংখ্যায় কম করে হলেও দেড় হাজার। পোস্টকার্ড, ইনল্যান্ড লেটার, এয়ার মেল। বিগত শতকের পঞ্চাশের দশক থেকে শুরু করে এই শতকের গোড়া পর্যন্ত বিস্তৃতি সেইসব চিঠির। এত চিঠির মধ্যে থেকে আলোচনাযোগ্য চিঠিগুলি বেছে আলাদা করাই এক চ্যালেঞ্জ। হিন্দি ও ইংরেজিগুলি সরিয়ে প্রাথমিকভাবে রাখা গেল। তারপরও যত বাংলা চিঠি পড়ে রইল, তার সংখ্যা অগুনতি। সামান্য কয়েকটি ইতিপূর্বে প্রকাশিত হলেও, অধিকাংশই অপ্রকাশিত। অপ্রকাশিত চিঠির সেই ভাণ্ডার থেকে নির্দিষ্ট কয়েকটি চিঠি নির্বাচন করে এই ধারাবাহিকের পরিকল্পনা।

সুবিমল বসাক (জন্ম ১৯৩৯)— হাংরি জেনারেশনের অন্যতম গদ্যকার। অনুবাদক হিসেবেও তাঁর পরিচিতি নেহাত কম নয়। রয়েছে বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থও। সমান্তরাল সাহিত্যজগৎ ও লিটল ম্যাগাজিন বৃত্তের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই লেখকের সংগ্রহে থাকা চিঠিপত্রগুলিও সমান উল্লেখযোগ্য। এমন সব ব্যক্তির চিঠি খুঁজে পেয়েছি, যা কল্পনাতীত। আবার, বেশ-কিছু চিঠি অতীতে দেখলেও, বর্তমান অনুসন্ধানে নাগালে এল না আর। যেমন শাবানা আজমির কয়েকটি চিঠি। বাবা কাইফি আজমিকে নিয়ে শাবানা-র বই ‘আব্বা’-র বাংলা অনুবাদ করেছিলেন সুবিমল; সেই সূত্রে বেশ কয়েকবার চিঠি চালাচালি হয়েছিল তাঁদের। কয়েক বছর আগে চিঠিগুলি আমায় দেখিয়েছিলেন তিনি, অথচ এখন আর খোঁজ পেলাম না।

তারপরও, সুবিমলকে লেখা কয়েকজন উল্লেখযোগ্য বাঙালি কবি-সাহিত্যিকের চিঠি ধাপে-ধাপে প্রকাশ্যে আনার প্রথম পদক্ষেপ এই পর্ব। কয়েকটি চিঠি বিষয় ও সাহিত্যের ইতিহাসের প্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ, কয়েকটি আবার বিষয়ের দিক দিয়ে উল্লেখযোগ্য না-হলেও পত্রলেখকের পরিচিতির কারণে বিশেষ হয়ে উঠেছে। অনেক ক্ষেত্রে আবার দুটিই সমান গুরুত্বপূর্ণ। তবে অনেক চিঠিরই প্রেক্ষিত ধোঁয়াশায় ঢাকা। বয়ান পড়েও বোঝার উপায় নেই। সেসব ক্ষেত্রে পত্রলেখকের গুরুত্ব বিবেচনা করে বয়ানটি প্রকাশ্যে আনাতেই সীমিত থাকবে কাজ। আবার, কখনও সুবিমলের ডাইরি ও অন্যান্য লেখাপত্র মিলিয়ে প্রেক্ষিতটি বুঝে নিতে চাওয়ারও প্রয়াস থাকবে আমাদের। প্রায় পঞ্চাশ বছর নিয়মিত ডাইরি লিখেছেন সুবিমল, ফলে চিঠির প্রেক্ষাপট বুঝতে সেই দলিলগুলি প্রয়োজনীয় হয়ে উঠতে পারে।

তেতলার ঘরে সুবিমল, ২০১৫

এই ধারাবাহিকের প্রথম চিঠিটি সুবিমলের সংগ্রহে থাকা সাহিত্য-সংক্রান্ত প্রথম চিঠিও বটে— ১৯৫৮ সালের। লেখক সাগরময় ঘোষ। ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক তখন তিনি। বয়ান পড়ে বোঝা যায়, উনিশ বছরের তরুণ সুবিমল রমাপদ চৌধুরীর কয়েকটি গল্প সম্পর্কে প্রশ্ন করে চিঠি লিখেছিলেন ‘দেশ’-এর দপ্তরে, তারই জবাব এটি। বস্তুত, কৈশোর থেকেই লেখালিখিতে জড়িয়ে পড়েন সুবিমল; পঞ্চাশের দশকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে পত্রপত্রিকায় নিয়মিতভাবে তাঁর গল্প প্রকাশ পেতেও শুরু করে (সেই সূত্রে তাঁকে পঞ্চাশের গদ্যকার হিসেবেও দাবি করা যায়)। তবে সেইসব গল্পে নিজস্বতার ছাপ বিশেষ নেই, সমকালীন গতানুগতিক সাহিত্য-ট্রেন্ডেরই ছাপ। ১৯৬৩ পর্যন্ত চলেছিল সেই পর্ব। তারপর, ’৬৩-তে পাটনা থেকে কলকাতায় এসে হাংরি আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ার পরে তাঁর লেখার বাঁকবদল ঘটে ও নিজস্ব রচনাশৈলীর জন্ম। একজন লেখকের এই তীব্র বাঁকবদলও পরবর্তীতে গবেষণার বিষয় হতে পারে।

যাই হোক, সাগরময় ঘোষ চিঠিটি লিখেছিলেন পোস্টকার্ডে, লেটারহেডে ‘দেশ’ পত্রিকার নাম। বয়ানটি পড়ে নেওয়া যাক—

১৩।১১।৫৮

সবিনয় নিবেদন,
                আপনার ২৬।৯।৫৮ তারিখের পত্র পাইয়া আপনার বক্তব্য বিষয়ে অনুসন্ধান করিয়া যাহা জানিলাম তাহা আপনাকে জানাইতেছি।
  রমাপদ চৌধুরী ‘পিয়াপসন্দ’ গ্রন্থে ‘দরবারী’র কোন গল্পই স্থান পায় নাই। ‘অভিসার রঙ্গনটী’ গ্রন্থটি বহুকাল পূর্বে মুদ্রিত হওয়ার পর পুনরায় প্রকাশ করা হয় নাই বলিয়াই ‘পিয়াপসন্দ’ গ্রন্থে সেগুলি মুদ্রিত হইয়াছে। সম্ভবত গ্রন্থের ভূমিকায় তাহা উল্লেখ করা হইয়াছিল। ‘আপন প্রিয়’ বা ‘কখনো আসেনি’ গ্রন্থে ‘দরবারী’ বা ‘পিয়াপসন্দের’ কোন গল্পই স্থান পায় নাই বলিয়াই লেখকের বিশ্বাস। দৃষ্টান্ত উল্লেখ করিয়া গল্পের নাম জানাইলে লেখক উপকৃত হইবেন।

নিবেদক
সাগরময় ঘোষ

হাংরি আন্দোলনের প্রাক্‌-পর্বের এই চিঠির পাশাপাশি, পরবর্তীকালের অর্থাৎ ষাটের দশকের তিনটি চিঠিও তুলে ধরা হল। লেখক হাংরি আন্দোলনের অন্যতম জনক মলয় রায়চৌধুরী। বস্তুত, মলয়ের লেখা অজস্র চিঠির মধ্যে থেকে, আপাতত বেছে নেওয়া হল এই তিনটি চিঠিই। সুবিমল বা মলয় কেউই আজ জীবিত নেই আর, ফলে সব ক্ষেত্রে প্রেক্ষাপট বুঝে নিতে চাওয়ার পরিসর ক্ষীণ।

কোলকাতা

প্রিয় ডিয়ার: ট্রায়াম্‌ফ্‌! ট্রায়াম্‌ফ্‌! ১০,০০০ টাকার জামিন দিয়ে পুলিশ হেফাজত থেকে বেরিয়ে এসে, এখানে চীফ প্রেসিডেনসী ম্যাজিসট্রেটের এজলাসে আত্মসমর্পণ কোরে ২০০ টাকার জামিন দিয়ে বিচারাধীন। চার্জশীট তৈরি হচ্ছে, শুনলুম, কেবল আমার বিরুদ্ধে। কয়েকজন বন্ধু আমার বিরুদ্ধে বয়ান দিয়েছেন, ড্যাম ইট, আমি একলা আমার কাছে যথেষ্ট, কেসের গতিবিধি থেকে আমি ভবিষ্যত ঘোষণা করছি, তুমি দেখে নিও। ডি.সি. ডি.ডি. বলেছেন, দাদাকে এবং দেবীকে, “মলয় রায়চৌধুরী একটা সিংহের বাচ্চা, বাকি সবকটা নেংটি ইঁদুর।” পি.কে. সেন বাবাকে বলেছেন “মলয়, জিনিয়াস, তবে ডাইভারটেড।” আমার ২১টা আঙুল হঠাৎ কলাগাছ হয়েছে, পথে-পথে লেজ নাড়িয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। কেসের জন্যে চাকরিটা গেছে। হাজার ছ্যাঁদা তৈরি হয়ে গেছে টাকার লোভে। মুক্তির দাম ৩০০০ টাকা চাওয়া হচ্ছে। হাঃ হাঃ! মানুষের স্বাধীনতা কাকে বলে? এসট্যাবলিশমেন্টকে থাপ্পড় লাগালে তার মুন্‌ডু তাহলে ঘুরে যায় হে!
   লালবাজারে আমার বক্তব্য টেপরেকর্ড করা হল। আশেপাশে নানান ব্যাজ লাগানো অফিসার। একজন বুড়ো অফিসার ওই ফাঁকেই মুন্‌ডু ঝুলিয়ে ঘুম দিয়ে নিলে। ও.সি. অনিল ব্যানারজি উপদেশ দিলো “সাহিত্য কোরে কি হবে মশাই? বরং আই.এ.এস. দিন।” কে.কে. দাস, এস.আই. লালবাজার ঘুরিয়ে দেখালো, কনট্রোল রুমটা সম্পর্কে স্কুলে থাকতে সুরাবর্দীর কথা শুনেছিলুম।
   তুমি মেদিনীপুরে আর কদ্দিন থাকছো? ওখানে একটা বিপর্যয়কর অর্গির তোড়জোড় করো। প্রদীপ সুবো ফেরার। শইলেশ্বর সুভাষরা সমস্ত অভ্যুত্থানের জন্যে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে আমাকেই দায়ী ঠাওরাচ্ছে। ও.কে.। আমিই দায়ী, আমি একলা বরদাস্ত কোরবো। একলা নিজেকে সন্দেহাতীতভাবে ক্ষমতাবান মনে হয়।
   একটা জার্নাল রাখা আরম্ভ কোরেছি; কোলকাতার পেল্লাই সাহিত্যিক আর সমালোচকদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাত কথাবার্তার রোজনামচা। এরা সব কাওয়ার্ড, ইডিয়ট, পাতি বুর্জোয়া আর অসৎ। অনেকে নিশ্চই এদেশ বা সেদেশের ইনফর্মার। এরা এতোটা ভুগছে যে, বিশ্বাস কোরতে পারে না আমরা শ্রম বেচে সে-টাকায় কাগজ বের কোরতে পারি। তুমি তো রক্ত বেচে ছিলে।
   আমি আমার অ্যারেস্ট আর ট্রায়ালের খবরটা রালফ্‌ গিনজবার্গের পত্রিকাকে বিক্রির চুক্তি করলুম চড়া দামে। TIME পত্রিকার প্রশান্ত সরকার কাফে ডি মোনিকো-তে ইনটারভিউ নিলো, ওখানে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ওঁরা কৃত্তিবাস-কে হাংরিয়ালিস্ট আন্দোলনের পুরোধা বোঝাতে চেষ্টা কোরছিলেন রিপোর্টারদের!! পাবলিসিটির লোভে এখন সকলেই হাংরিয়ালিস্ট হতে চাইছে।
   তোমার এখন কলকাতায় আসা দরকার। সকলে একজোট না হলে কোনো অর্গিই জমেনা। তুমি নবাবপুরের ভাষায় একটা গ্রন্থের পরিকল্পনা কোরেছিলে তার কি হল? আমি এমন উত্তেজিত রয়েছি যে হুহু কোরে হাজার হাজার কথাবার্তা মগজে ঢুকে পড়ছে ফি-মুহূর্তে।
   ভালোবাসা নিও। ইতি

মলয় রায়চৌধুরী
১১/১১/৬৪

৪ সেপ্টেম্বর ১৯৬৪, পাটনার বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার হন মলয়। নিয়ে আসা হয় কলকাতায়। পরবর্তী ঘটনাক্রম সম্পর্কে মলয় লিখেছেন এই চিঠিতে। সুবিমল বসাক তখন চাকরিসূত্রে কলকাতা থেকে দূরে— মেদিনীপুরে। চিঠিতে উল্লেখ রয়েছে সমীর রায়চৌধুরী (দাদা), দেবী রায়, প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য, শৈলেশ্বর ঘোষ, সুভাষ ঘোষ প্রমুখ হাংরিদের।

নেপালে সুবিমল বসাক (বাঁ-দিকে) ও মলয় রায়চৌধুরী, ১৯৬৭

সুবিমলের ডাইরিতে এই চিঠি নিয়ে কোনও উল্লেখ নেই, কেননা যেদিন চিঠিটি লেখেন মলয় (১১ নভেম্বর), সেদিনই অফিস থেকে ছুটি নিয়ে মেদিনীপুর থেকে কলকাতায় আসেন সুবিমল। পরের দিন ব্যাঙ্কশাল কোর্টে, দেবী রায়ের শুনানির সময়ে, মলয়ের সঙ্গে দেখা। বস্তুত, হাংরি জেনারেশনের বিতর্কিত সংখ্যাটির পর, সুবিমল-সহ ১১ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলেও, গ্রেফতার করা হয় ছ-জনকে— মলয় রায়চৌধুরী, সমীর রায়চৌধুরী, প্রদীপ চৌধুরী, দেবী রায়, শৈলেশ্বর ঘোষ ও সুভাষ ঘোষ। জামিনে ছাড়া পেয়ে যান প্রত্যেকেই। ১৯৬৫ সালে, মামলা দায়ের হয় একমাত্র মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে।

১৬.৬.৬৬

সুবিমল,

        অতো বড়ো সম্পাদকীয়ের কি দরকার! তাছাড়া সব কথা সম্পদকীয়তে অতো খোলাখুলি লিখেও লাভ নেই। প্রচ্ছদের ওপরেই এই কথাগুলো দিতে পারো:- “অমরত্ব!! অমরত্ব চাওয়া মানে পৃথিবীর ও মানুষের ধ্বংস অস্বীকার। নইলে সাহিত্য কেন সময়কে অসীম করে তুলতে চাইবে! কাকে সাহিত্য বলা হবে বা কাকে সাহিত্যেতর তা বিচারের আর কোনো দরকার নেই। প্রতিষ্ঠিত সমস্ত কিছুকে উপড়ে ফেলে দেয়াই এখন মনুষ্যত্ব। সাহিত্যের পেছনে আজ ইতিহাস লেলিয়ে দিতে হবে। কারণ সংস্কৃতি বা সভ্যতার প্রগতি বলে কিছু নাই। সাহিত্য, এটা মনে রাখা দরকার, গেনজি বা আন্ডারউয়েরের কারখানা নয়। যন্ত্রের ভেতরে পশুত্ব এনে দিলে যন্ত্রও মানুষ হয়ে যায়। যুদ্ধ নয়; যুদ্ধ নয়; ভালোবাসাই সাহিত্য।”
     শুম্ভু রক্ষিতের লেখাটা ভালোই কিন্তু ব্যক্তিবিশেষের সম্পর্কে না হলে ছাপা যায় না।
     বহরমপুরে পান্ডুলিপি পাঠাবার সময়ে লিখে দিও মলয় কোলকাতায় এসে জেব্রার পান্ডুলিপি পাঠাবে।
     অ্যালেন $10 পাঠিয়েছে আর খবরের কাগজের মতো করে ছাপা ওর বিরাট কবিতা Wichita Vortex Sutra.
      আমার সম্পর্কে লেখাটাকে সাইক্লোস্টাইল করিয়ে দিও।
      পোস্টকার্ড টাইপ করে সমস্ত কনসুলেটগুলোকে চিঠি পাঠিয়ে দিও।

ইতি
মলয়

মলয় এ-চিঠিতে যে সম্পাদকীয়ের কথা বলেছেন, তা প্রকৃতপক্ষে সুবিমল বসাক সম্পাদিত ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যা তথা সংকলনের (১৯৬৬)। মলয়ের পরামর্শ অনুযায়ী, দীর্ঘ সম্পাদকীয় থেকে ছেঁটে, চিঠিতে উদ্ধৃত গদ্যাংশটিই প্রচ্ছদে রেখেছিলেন সুবিমল, সামান্য অদল-বদল করে। পরবর্তীতে, ‘আত্মার শান্তি দু-মিনিট’ (১৯৮৫) বইয়েও এই টুকরো অংশটি গ্রন্থিত করেন সুবিমল। অ্যালেন অর্থে অ্যালেন গিন্সবার্গ। ‘জেব্রা’— মলয় রায়চৌধুরী সম্পাদিত পত্রিকা।

বেয়ারিং পেয়েছি সুবিমল।
ছাপা অবস্থায় এসব দেখে বেশ স্যাডিসটিক মৌতাত পাওয়া গেল। তোমার চিঠিটাও আশানুরূপ গরম দেখলুম, যা বছর কয়েক আগে থাকতেই হলে তোমাকে তখন থেকেই সমীহ কোরতো সকলে, যাক এবার থেকে কোরবে। সকলের সম্পর্কেই তোমার খোলাখুলি মতামত ছুঁড়ে মারা উচিত। এমনকি, সকলের সম্পর্কে একটা লেখা লিখে পান্ডুলিপিটা ফালগুনীকে পড়তে দিতে পারো।
ত্রিদিবের ঠিকানায় আরো ৪০ টাকা পাঠিয়েছি, Letters এর কাভারের জন্যে আর HGর স্টিচিঙের জন্যে। HGটা ভালো গেট আপে বের করার চেষ্টা কোরো।
আসার সময় শ দুয়েক HG এনো, বাই পোস্ট কাৎ করে দেবো। ঘরনী আর অত্বর পাঠিও।
যেখানে যা বেরোচ্ছে HG সম্পর্কে তার একটা বিব্‌লিওগ্রাফী মেনটেন কোরো।
Avanat Garde বেঁচে ছিল ১ কপি, কৃষ্ণ ধরকে পাঠালুম মার্কসীয় জমায়েতে গোলা বাধাবার জন্যে।
অশোকনগরে চায়ের দোকানে বাসুদেবঃ “সত্যদা আপনার লেখাটা কদ্দুর?”
খালাসীটোলার সামনে সুভাষের কলার সুনীল চেপে ধরলে সুভাষ ভয়েঃ “প্রণবদা একটা পান খাওয়ান না, দেখুননা এঁরা কি কান্ড করছেন।”
নতুন হাংরিদের কাছ থেকে লেখা যোগাড় করে নিও।
আসার সময় ত্রিদিবকে সঙ্গে এনো।
আমার মনে হয়, HGটা কফি হাউসের প্রতিটি টেবিলে পাঁপড়ের মতো বিলিয়েও দেয়া যেতে পারে। ভেবে দেখো, ওখানের হালচাল অনুযায়ী যা হয় কোরো।
ত্রিদিবের প্রোজটায় মাঝেমাঝে হঠাৎ ডায়ালগ থাকলে ভালো হয় আর প্যারাগ্রাফগুলো অতো দীর্ঘ কেন? ত্রিদিবকে তুমি বারোজের লেখা পড়াওনা নাকি?
পয়সা বাঁচলে HGর কাভার ল্যাক ভারনিশও করতে পারো।
ফালগুনীর কাছ থেকে লেখা অবশ্যই নিও।

মলয় রায়চৌধুরী
২৬।৬।১৯৬৮

HG অর্থে হাংরি জেনারেশন পত্রিকা। মলয় তখন পাটনায়; কলকাতার যাবতীয় কাজকর্ম সামলাতেন সুবিমলই। চিঠিতে বিভিন্ন নির্দেশও সে-কারণেই দেওয়া। এই চিঠিতে উল্লিখিত ব্যক্তিনামগুলি হল ফালগুনী (রায়), ত্রিদিব (মিত্র), বাসুদেব (দাশগুপ্ত), সুভাষ (ঘোষ)। বাকি নামগুলি— সত্য, প্রণবদা ও সুনীল, যথাক্রমে সত্য গুহ, প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায় ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়— এমনটাই অনুমান আমাদের।

সুবিমল বসাক ও মলয় রায়চৌধুরীর বন্ধুত্ব ও বোঝাপড়া হাংরি আন্দোলন ছাপিয়েও বিস্তৃত হয়েছিল বহুদূর। ষাটের দশকে লেখা মলয়ের আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ চিঠি রয়েছে, যা প্রকাশ্যে আসবে পরবর্তী কোনও পর্বে।

(প্রতিটি চিঠির বানান অপরিবর্তিত)

ছবি সৌজন্যে: তন্ময় ভট্টাচার্য