বিনিদ্র: পর্ব ৪৭

পর্ব ৪৬

সেই মাদ্রাজের মহাবলীপুরমে এই প্রথম দেখলাম যে গুরু মনেপ্রাণে অশান্তিই চায়, অশান্তি না পেলে যেন তার শান্তি হয় না। কিংবা জিনিসটা ঘুরিয়ে বললে বলতে হয়, অশান্তি দূর করবার জন্যেই অশান্তি ডেকে আনা।

চন্দ্রগেশমের কথা আগেই বলেছি, তাকে নিয়ে একটা গল্পও লিখেছিলাম। গল্পটা বেরিয়েছিল গল্প নালেখার গল্প নাম দিয়ে। দেশ পত্রিকার ১৯৬৩ সালের পুজো সংখ্যায়। মিস্টার চন্দ্রগেশম এক অদ্ভুত চরিত্র। সন্ধেবেলা গুরু যেই স্টুডিও থেকে আসত, সেই সময়ে একতলা থেকে উঠে এসে বসত আমাদের টেবিলে। টুরিস্ট হাউসটার দোতলায় বিরাটবিরাট দুটি ঘর। আমরা দুজন সেই দুটি ঘরে রাত্রে শুই। সারাদিন আমি আমার ঘরে বসে এককদশকশতক লিখি। বই তখন শেষ হয়ে আসছে, সুতরাং উত্তেজনাআগ্রহউদ্বেগ চরমে। সঙ্গে সঙ্গে সিনেমার সিনারিও লেখার তাগিদ আছে।

কিন্তু গুরু এলেই আমার আর লেখার কাজ চলত না, একেবারে সোজা আমার ঘরে চলে আসবে। বলবে আসুন

আসুন মানে গল্প করতে আসুন। দোতলায় বিরাট বারান্দা আর খোলা ছাদ দুপাশে।

সেই বারান্দায় সারসার বেতের আরামচেয়ার পাতা, আর মধ্যেখানে একটা গোল টেবিল। তার চারপাশে কাঠের চেয়ার অনেকগুলো।

সেইখানেই গুরুর চাপরাশি আনবে হুস্কির বোতল, বরফ আর গেলাস। চন্দ্রগেশম এসেই একটা চেয়ারে বসে বলবেআজকে কি খাবেন ডিনারে?

গুরুর ইচ্ছে হত চন্দ্রগেশমকেও একটু খাতির করে, একটু হুইস্কি দেয়। কিন্তু বললে যদি চন্দ্রগেশম অপরাধ নেয়?

গুরুর সঙ্গে গল্প আলোচনা করতে আমার যত ভালো লাগত, এমন আর কারো সঙ্গে ভালো লাগেনি। গল্প অনেকেই লেখেও বটে। এক-একজন লোককে দেখেছি উপন্যাস নিয়ে মশগুল হয়ে আছে। কিন্তু তাঁদের সবাই যে গল্প বোঝে, এমন নয়। আইনস্টাইনের ‘থিওরি অব্ রিলেটিভিটি’ যেমন সবাই বোঝে না, তেমনি গল্পও সবাই বোঝে না। গল্প বুঝতে গেলে রসবোধের দরকার হয়। সেই রসবোধ হয়তো একজন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপকেরও না থাকতে পারে, আবার রসবোধ থাকতে পারে এমন একজন লোকের যে কখনও স্কুল-কলেজ- ইউনিভার্সিটির চৌকাঠও মাড়ায়নি

একদিন গুরু বলেই ফেললএকটু হুইস্কি খাবেন মিস্টার চন্দ্রগেশম?

নিস্পৃহ গলায় চন্দ্রগেশম বললেডিনারে কি খাবেন তাই বলুন।

কিন্তু গুরু তার নিজের কথার জের টেনে আবার বললেহুইস্কি দেব একটুখানি?

চন্দ্রগেশম তেমনি নিস্পৃহ গলাতেই বললেদিন, তবে সামান্য

চাপরাশি যথারীতি সোডা মিশিয়ে দিয়ে হুইস্কির গেলাস এগিয়ে দিয়েছে চন্দ্রগেশমের দিকে। নজর পড়তেই চন্দ্রগেশম্বলে উঠল হেঃ হেঃ, সর্বনাশ করে দিলে একেবারে।

আমি বললামকেন, কি হল?

চন্দ্রগেশম বললেএঃ, হুইস্কির সঙ্গে কখনও সোডা মিশিয়ে খাই না আমি

গুরু বললেতাহলে কি জল মিশিয়ে খান?

না, শুধু হুইস্কি খাই। জলও মেশাই না, সোডাও মেশাই না

গুরু আর আমি দুজনে অবাক হয়ে গেলাম। চন্দ্রগেশম বললে আমি ঊটি ইউরোপিয়ান ক্লাবে বাইশ বছর বার ম্যানেজারের চাকরি করেছি, কখনও কোনও সাহেবকে সোডা মিশিয়ে হুইস্কি খেতে দেখিনি

গুরুর হুকুমে তখুনি আবার নতুন করে নির্জলা হুইস্কি তার গেলাসে ঢেলে দেওয়া হল। চন্দ্রগেশম এক চুমুকে সমস্তটা নিঃশেষ করে দিয়ে গেলাসটা টেবিলে রেখে দিলে। আমি নির্বাক বিস্ময়ে তখন দৃশ্যটা দেখছি। শেষকালে থাকতে পারলাম না। জিজ্ঞেস করলামআপনি কি রোজ হুইস্কি খান?

চন্দ্রগেশম বললেরোজ খাবো কি করে? এখানে কি হুইস্কি পাওয়া যায়? আটা তো ড্রাই জায়গা, তা ছাড়া হুইস্কি খাওয়ার পয়সা কোথায় পাবো? আমি তো মাত্র দুশো টাকা মাইনে পাই এখানে

আগে কত বছর খেয়েছেন?

বাইশ বছর?

বাইশ বছর ধরে খেয়েছেন তবু আপনার নেশা হয়নি?

এক অদ্ভুত চরিত্রের মানুষ। গুরু বললেএখানে যদি কোনোদিন পার্টি দিই তো আপনি একটু সাহায্য করবেন?

এমন একজন এক্সপার্ট লোকের সন্ধান পেয়ে গুরু যেন উত্তেজিত হয়ে উঠল। আমি প্রমাদ গুণে জিজ্ঞেস করলামসত্যিই আপনি পার্টি দেবেন নাকি?

গুরু বললেভাবছি দেব

বললামবেশ তো আছি নিরিবিলিতে। কাজকর্ম হচ্ছে। আর কাজ করবার জন্যেই তো এখানে এসেছি আমরা। পার্টি হলে তো সে দিনটাই নষ্ট!

চন্দ্রগেশম নিজের কাজে চলে যাবার পর গুরু বলতে লাগলআমার মনটা খুব ফাঁকাফাঁকা লাগছে। সামনের উনিশে অগাস্ট মেয়ে নীনার ফার্স্ট বার্থ ডে। ওই দিনেই আমার মেয়ের এক বছর বয়স পুরো হবে। গীতাও লন্ডনে। মাকে আমার বাড়িতে রেখে এসেছি মেয়েকে দেখবার জন্য। নীনাকে দেখবার জন্যে মনটা ছটফট করছে

বুঝলাম, গুরু ঠিক এভাবে এই নিরিবিলিতে আর থাকতে পারছে না। সে অসহ্য হয়ে উঠেছে এই কদিনেরই মধ্যে। আমার এখানে যত ভালো লাগছে, তার তত খারাপ লাগছে। গল্প লেখা এগোচ্ছে, ওদিকে তার শুটিংও চলছে। তাস খেলতে পাচ্ছে না। আমি তাকে সমস্ত আপদ থেকে দূরে রেখেছি।

কথা বলতে বলতে গুরু ঝোঁকের মাথায় একের পর এক অনেক গ্লাস হুইস্কি খেয়ে ফেলেছে তখন। সেই অবস্থাতেই বললেআর এখানকার খাওয়াও আর আমার ভালো লাগছে না

বললামকেন?

গুরু বললেএকদিনও হাতে গড়া রুটি করে না, ডাল করে না। কেবল রোস্ট, কেবল চিকেন, কেবল মাটন, ফিশ্আর এগ্‌-ফ্রাই। আমি এবার থেকে নিজে রান্না করব

আমি তো অবাক। বললামকিন্তু আমার তো এখানকার খাওয়া খারাপ লাগছে না, বরং খুব ভালো লাগছেচন্দ্রগেশম সমুদ্র থেকে টাটকা মাছ ধরে রান্না করে দেয়। রকম আর কোথায় পাব?

গুরু বললেদেখবেন, আমি ডাল রাঁধব, চচ্চড়ি রাঁধব, সেটা আরো কত ভালো লাগবে

গুরুর যে রান্না ভালো লাগছে না, তা সত্যিই আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি। তবে সকালবেলা আমি যখন ব্রেকফাস্ট খেতে যেতাম ম্যানেজার চন্দ্রগেশম প্রায়ই অভিযোগ করত যে মিস্টার দত্ত কিছুই তো খান না।

আসলে মহাবলীপুরম্‌-এর সেই রেস্টহাউসে বোর্ডার বলতে আমরা কেবল দুজন। যারা ওখানে যেত তারা কেউই এক ঘন্টাদুঘন্টার বেশি থাকত না। কোথায় ফ্রান্স কি ব্রিটেন কি আমেরিকা থেকে, বিরাট স্টেশনওয়াগনে করে একদল টুরিস্ট আসত। এসে বারান্দার ওপরেই হ্যাম্পার বক্স খুলে যা হোক কিছু লাঞ্চ করে নিত। আর তারপরেই কস্টিউম্পরে আধাউলঙ্গ অবস্থায় সমুদ্রে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ত! তারপর কিছুক্ষণ ঝাঁপাই জুড়ে আবার কোটপ্যান্ট গাউন পরে দল বেঁধে চলে যেত। ষোল বছর থেকে শুরু করে সত্তরআশি বছরের বুড়োরা পর্যন্ত এমনি করত দিনের পর দিন। একলাএকলা বসে বসে আমি তখন এককদশকশতক লিখতাম আর মাঝে মাঝে ওদের কেলিকলাপ দেখতাম।

সেদিন স্টুডিও থেকে ফেরবার পর দেখি গুরুর চাপরাশি একটা বিরাট প্রেশারকুকার একটা স্টোভ আর এক টিন কেরোসিন তেল আর এক বোতল স্পিরিট কিনে নিয়ে এসেছে। আমি জিজ্ঞেস করলামএগুলো কি?

গুরু বললেরান্নার সরঞ্জাম। আমি আজ নিজে রাঁধবো

তবু বুঝতে পারলাম না। বললামরাঁধবেন মানে?

ডালরুটিচচ্চড়ি রাঁধবো। এদের রান্নাটা খুব খারাপ। স্টু আর কারিচপকাটলেট করতে জানে। সব আমার ভালো লাগে না

কিন্তু তরকারি কই? ভেজিটেবল?

গুরু বললেকাল থেকে তিন দিন শুটিং নেই আমার, আমাকে স্টুডিওতে যেতে হবে না। কাল বাজারে গিয়ে আলুবেগুনপালংশাক কিনে আনব

আমি সত্যিই প্রথমে বিশ্বাস করিনি যে গুরু সত্যিসত্যি রাঁধবে। সন্ধেবেলা যথানিয়মে আমাদের আলোচনা চলতে লাগল। অর্থাৎ গল্পের আলোচনা। গুরুর সঙ্গে গল্প আলোচনা করতে আমার যত ভালো লাগত, এমন আর কারো সঙ্গে ভালো লাগেনি। গল্প অনেকেই লেখেও বটে। একএকজন লোককে দেখেছি উপন্যাস নিয়ে মশগুল হয়ে আছে। কিন্তু তাঁদের সবাই যে গল্প বোঝে, এমন নয়। আইনস্টাইনেরথিওরি অব্রিলেটিভিটিযেমন সবাই বোঝে না, তেমনি গল্পও সবাই বোঝে না। গল্প বুঝতে গেলে রসবোধের দরকার হয়। সেই রসবোধ হয়তো একজন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপকেরও না থাকতে পারে, আবার রসবোধ থাকতে পারে এমন একজন লোকের যে কখনও স্কুলকলেজইউনিভার্সিটির চৌকাঠও মাড়ায়নি। ওটা প্রারব্ধ। ওটা পূর্ব জন্মার্জিত। অবশ্য যদি পূর্বজন্ম স্বীকার করা যায়। ওটা স্কুলকলেজে শেখাবার জিনিস নয়।

কিসে গল্প হয় আর কিসে গল্প হয় না, তা নিয়ে ঝুড়িঝুড়ি বই লেখা হলেও এখনও দেখেছি শিক্ষিতদের মধ্যে দিনেদিনে রসবোধের অজ্ঞতা পাহাড়প্রমাণ। নিয়ে এখন দুঃখ করা ছেড়ে দিয়েছি, আর সার বুঝে নিয়েছি যে নিয়ে হতাশ হওয়ার কারণ নেই, কারণ বিপুলা পৃথ্বীঃ আর নিরবধি কাল। সেইজন্যই গুরুর সঙ্গে আমার ভালোরকম বনতো। গল্প সম্বন্ধে একটু আলোচনা করার দরকার হলেই সেই মাদ্রাজবোম্বাই থেকে আমাকে ট্রাঙ্ককলে ডাকতো। হঠাৎ একদিন গুরু বলতসময় আছে আপনার?

আমি জিজ্ঞাসা করতামকেন? কিছু দরকার আছে

গুরু বলতহ্যাঁ, যদি কাজ না থাকে তো একবার আসতে পারবেন? একটা কাজ আছে

আমি সেই দিনেই চলে যেতাম গুরুর কাছে। গিয়ে জিজ্ঞেস করতামকি কাজ?

গুরু বলতকাজ কিছু নেই, এমনই গল্প করতে ইচ্ছে হল

গল্প করবার আর যেন লোক ছিল না তার বাড়িতে। গীতা ছিল, তরুণ ছিল, অরুণ ছিল। তাছাড়া ছিল তার হাজারহাজার দায়দায়িত্ব। বন্ধুবান্ধবেরও তো অভাব ছিল না তার। কিন্তু তবু একলা থাকতে তার ভয় করত। একলা থাকলেই মনটা ছটফট করত। তখন কোথাও দূরে বাইরে চলে যেত গাড়ি নিয়ে, কেউ জানত না তার গতিবিধি। কিংবা পাওয়াই লেকে গিয়ে মাছ ধরত। কিংবা চলে যেত লন্ডন। বা প্যারিস। সারা পৃথিবী চষে ফেলেও তবু যে তার একাকীত্ব ঘুচতো না।

একবার মনে হত ওয়াহিদা রেহমানকে ডাকে। কিন্তু ওয়াহিদা রেহমানের সঙ্গে তখন সম্পর্ক ছেদ করে দিয়েছে গুরু। তার ছায়া পর্যন্ত মাড়ায় না সে। না, ওয়াহিদার সঙ্গে মেলামেশা করলেই যদি তোমরা আমাকে চরিত্রহীন বল তো আর তার সঙ্গে মিশব না। যদি মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশা করবার জন্যই কাগজেকাগজে আমার বদনাম হয়, তো কোনও মেয়ের সঙ্গেই আমি আর মিশব না। গীতা কড়া নজর রাখে দূর থেকে। রতনকে ডেকে জিজ্ঞাসা করেআজ সাহেব কোথায় গিয়েছিল রতন?

রতনও তেমনি। রতন যেন কাঠের পুতুল। তার মুখ দিয়ে রক্ত বার করা সোজা, কিন্তু কথা কেউ বার করতে পারবে না।

সে বলতনা দিদি, সাহেব তো কোথাও যায়নি

গীতা জিজ্ঞেস করততাহলে কাল রাত দুটো পর্যন্ত কোথায় ছিল?

রতন কখনও বলত কে আসিফ সাহেবের বাড়িতে, কখনও বলত স্টুডিওতে।  

পুনঃপ্রকাশ
মূল বানান অপরিবর্তিত