‘টেস্ট ক্রিকেট ইজ দ্য বেস্ট ক্রিকেট’— জাতীয় বহুক্লিশে বাক্য পেরিয়ে যে একফালি সবুজ, তার ওপর ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন রবীন্দ্র জাদেজা। অপরাজিত। পাশ থেকে সরে গেছে একে একে সবাই। বার্ধক্যে এসে জীবনের দিকে চেয়ে থাকার যন্ত্রণা ও প্রশান্তির যৌথ কোলাজ তাঁর চোখে মুখে। স্কোরবোর্ড বলছে, ভারত ম্যাচটা হেরে গেছে। ক্রিকেট গ্রাউন্ডের পাশে যে ঐতিহাসিক ও সুবিশাল ম্যানুয়াল স্কোরবোর্ড, সেখানেও জাদেজার নামখানা একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
লর্ডস টেস্টের শেষে মোটামুটি বিশ্বের আপামর ক্রিকেটপ্রেমী মনে মনে বিস্মিত হয়েছেন, সোশ্যাল মাধ্যমে ঝড় বয়েছে টেস্ট ক্রিকেটের এই জাদুময়তা নিয়ে। ক্রিকেট ফর্ম্যাটের রাজা; টি-টোয়েন্টি-ওয়ানডের সবুজের ভিড়ে মাথা উঁচিয়ে থাকা এই টেস্ট ক্রিকেট নিয়ে বিস্ময়ের প্রধান কারণ এই যে, একটা সময়ে যখন মনে করা হচ্ছিল, ক্রিকেটের এই দীর্ঘ ফর্ম্যাটটি আদৌ টি-টোয়েন্টি আসার পর স্বমহিমায় থেকে যেতে পারবে কি না, তখনই টেস্ট ক্রিকেট বুঝিয়ে দিয়েছে তাঁর অস্থিমজ্জায় আছে রোমাঞ্চ, কখনও তাঁর প্রমাণ দিতে সে নিয়ে এসেছে ঐশ্বরিক ইনিংস খেলা বেন স্টোকসকে, কখনও টেল এন্ডারদের সঙ্গে নিয়ে লড়ে যাওয়া প্যাট কামিন্সকে বা কখনও প্রায় দেড়দিন ব্যাট করে অপরাজিত থেকে যাওয়া রবীন্দ্র জাদেজাকে।
আরও পড়ুন: লিভারপুলের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে যে অদম্য ইতিহাস! লিখছেন শ্রুতায়ু ভট্টাচাৰ্য…
একুশে জুলাই বললেই এই মুহূর্তে আমাদের মননে-চিন্তনে যে রাজনৈতিক সমাবেশের চালচিত্রখানা সাজিয়ে দেয়, তার থেকে অনেকটা দূরে দৃষ্টি ফেললে, বা বলা ভাল, প্রায় ১৪০ বছর পিছিয়ে গেলে, লর্ডসের মাঠে আর-এক চরিত্রকে আমরা খুঁজে পাব। খুঁজে পাব এক সেনানীকে, যাঁর হাত ধরেই লর্ডসের ময়দানে প্রথমবার টেস্ট ক্রিকেট তাঁর আসল রং-রূপ-গন্ধ-স্পর্শ নিয়ে হাজির হয়েছিল।

ডক্টর হেনরি জেমস হারবার্ট স্কট, নামটা অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটে অসম্ভব পরিচিত— এমনটা আজ আর বলা যায় না। ১৮৮৪ সালে লর্ডসের মাঠে অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের মধ্যে যে টেস্ট ম্যাচটি হয়েছিল, যেটিকে লর্ডসে খেলা প্রথম স্বীকৃত টেস্ট বলে ধরা হয়, সেই ম্যাচে খেলেছিলেন স্কট। অথচ, হেনরি স্কটের ক্রিকেটের বৃত্তে এসে লর্ডসে টেস্ট ম্যাচ খেলে ফেলাটাই ছিল এক বিস্ময়। ডাক্তারিতে ছিল প্রবল আগ্রহ, কলেজ ক্রিকেট খেলে জনপ্রিয়তার শুরু, তারপর এক অদ্ভুত খাতে বইতে শুরু করল হেনরি স্কটের জীবন। একদিকে যেমন তিনি ভিক্টোরিয়ার হয়ে ক্রিকেট খেলা শুরু করলেন, সেখান থেকে সুযোগ পেলেন ইস্ট মেলবোর্ন ক্রিকেট ক্লাবে, অন্যদিকে চিকিৎসক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার ইচ্ছেও বাড়তে লাগল ভেতরে ভেতরে। এই প্রবল ইচ্ছের জোরেই ক্রিকেট ছাড়ার কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি হয়ে গিয়েছিলেন সরকারি মেডিক্যাল অফিসার। তাঁর কাছে দূরদূরান্ত থেকে রোগী আসতেন অস্ত্রোপচার করাতে, আর অস্ট্রেলিয়ার ইস্ট-মেলবোর্নের ডাক্তারদের মধ্যে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সংক্রামক ব্যাধির বিশেষজ্ঞ।
এই হেনরি স্কট তখন তরুণ, ২৫ বছরের দামাল ক্রিকেটার— এই সময়েই একদিন এল সুবর্ণ সুযোগ। অস্ট্রেলিয়ার প্রতিনিধিত্বের সুযোগ। ১৮৮৪ সালে অস্ট্রেলিয়া দল যখন ইংল্যান্ডে গেল, সে দলে ভরসাযোগ্য ব্যাটার হিসেবে গেল ডক্টর স্কট এবং তারপরই এই সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, লর্ডস টেস্ট। অস্ট্রেলিয়া টসে জিতে ব্যাট করতে নামল। ইংল্যান্ডে তখন উইলিয়াম গিলবার্ট (ডব্লুজি) গ্রেসের আমল। দুরন্ত দল। বোলিং-এ টেড পিয়েট-জর্জ উলেট। যথারীতি অজি ব্যাটিং-এ ধস নামল এবং ১৫৫ রানের মাথায় ৮ উইকেট পড়ে গেল।
এবার শুরু হল স্কটের অদম্য লড়াই। হ্যারি বয়েলের মতো টেল এন্ডারকে সঙ্গে নিয়ে স্কট একা লড়তে থাকলেন, যেন ডেভিড-গোলিয়াথের অসম লড়াই। টেড পিয়েট ৬ উইকেট নিয়ে ফুঁসছেন, সেখানে উইকেট বাঁচিয়ে লড়াই!

নাছোড় স্কট অস্ট্রেলিয়াকে টেনে নিয়ে গেলেন ২২৯ রানের সম্মানজনক স্কোরে। ইংল্যান্ডের পাল্টা ৩৭৯ রানের জবাবে দ্বিতীয় ইনিংসে ফের ইংল্যান্ডের ব্যাটিং ধস। ৯০ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে যখন ইনিংস হার কার্যত নিশ্চিত তখন আবার সেই অসম লড়াই শুরু করলেন স্কট। অস্ট্রেলিয়ার এপিডেমিক স্পেশালিস্ট ডাক্তার যেভাবে লড়ে যেতেন রোগীদের জীবন বাঁচাতে, সেভাবেই লড়লেন শেষ ইনিংসে, ইংল্যান্ডকে ইনিংসে হার থেকে বাঁচাতে। ৯০ রান থেকে প্রায় সারা বেলা ব্যাট করে টেল এন্ডারদের সঙ্গে নিয়ে পৌঁছলেন ১৪৯ রানে।
কিন্তু উল্টোদিকের ব্যাটাররা একে একে সকলেই উইকেট খোয়াতে অপরাজিত স্কটকে দেখতে হল মাত্র ৫ রানের জন্য ইনিংস পরাজয়।
হেনরি স্কট তখন তরুণ, ২৫ বছরের দামাল ক্রিকেটার— এই সময়েই একদিন এল সুবর্ণ সুযোগ। অস্ট্রেলিয়ার প্রতিনিধিত্বের সুযোগ। ১৮৮৪ সালে অস্ট্রেলিয়া দল যখন ইংল্যান্ডে গেল, সে দলে ভরসাযোগ্য ব্যাটার হিসেবে গেল ডক্টর স্কট এবং তারপরই এই সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, লর্ডস টেস্ট।
উইসডেন লিখেছিল- “Scott once more proved how well he merited a place in the team. He was admirably supported by Boyle, and before parting was effected 69 runs were put on for the last wicket. Scott played cool, confident, skilful cricket.”
এই সিরিজের পর স্কট ইংল্যান্ডেই নিজের ডাক্তারির পড়াশোনা পুরোদমে শুরু করেন ও ১৮৮৮-তে অস্ট্রেলিয়া ফিরে পাকাপাকিভাবে ডাক্তার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান।
টেস্ট ক্রিকেটের সর্বোচ্চ বিনোদন কী? রানের ফোয়ারা? চার-ছক্কার হারিকিরি? নাহ্! সম্ভবত লর্ডসের মাটিতে, ক্রিকেট মক্কার শ্রেষ্ঠ ময়দানে ১৪০ বছর আগে ডক্টর হেনরি জেমস হারবার্ট স্কট, যাকে অজি জনতা, ইংল্যান্ডে খেলতে গিয়ে ঘুরে বেড়ানোর জন্য মজা করে ‘টু-পেনস ট্রাভেলার স্কট’ বা ‘টুপ’ স্কট নাম দিয়েছিল, তিনিই আমাদের প্রথম শিখিয়েছিলেন, দেখিয়েছিলেন যে, টেস্ট ক্রিকেট আদতেই মানুষের স্বাভাবিক স্নায়ু সঞ্চালনের বিরুদ্ধে এক অবিশ্বাস্য লড়াই, টেস্ট আসলেই পরীক্ষা নেয় ক্রিকেটীয় স্নায়ুর, ব্যক্তি-সংযমের। তাই টুপ স্কটের এই দু’টি ইনিংস লর্ডসের টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসের ছাঁচ, আজও।
আজ ১৪০ বছর পর, টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে, যে ম্যাচগুলি আমাদের চোখে ভেসে ওঠে, যেমন ২০০১ সালের ইডেন টেস্টের দ্রাবিড়-লক্ষ্মণের লড়াই, ১৯৬০-’৬১ সালে ব্রিসবেনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলিং এর বিরুদ্ধে ম্যাকায়-এর সেই ৮৯ রানের ইনিংস, হেডিংলেতে বেন স্টোকসের রাজকীয় ইনিং কিংবা গাব্বায় ঋষভ পন্থ-পূজারার ঐতিহাসিক ম্যাচ জেতানো ব্যাটিং— প্রত্যেক ক্ষেত্রেই কিন্তু দর্শকদের আড্রিনালিন রাশকে ধরে রেখেছে ক্রিকেট ময়দানের ভেতর লড়ে যাওয়া প্লেয়ারের অবিশ্বাস্য স্নায়ুর কাঠিন্য। এক মুহূর্তের চ্যুতি, যেখানে নিশ্চিত পরাজয়। এই মুহূর্তে কেউ জিতেছেন, কেউ হেরেছেন, কিন্তু টেস্ট ক্রিকেট আজ দেড়শো বছর পরেও যে বিপুল জনপ্রিয়তা, কেবলই এই ইস্পাতকঠিন স্নায়ুর লড়াইয়ের কারণেই— টেস্ট ক্রিকেটের কাঠামোর মধ্যেই লুকিয়ে এই লড়াইয়ের যাবতীয় গোলা-বারুদ, হালের কোনও ক্রিকেট ফর্ম্যাটই যাকে দমাতে পারছে না।