মেসি, ময়দান, মুনাফা

মেসি। কলকাতা আসবেন। কলকাতা উত্তাল। বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ফুটবল স্টার। উদ্যোক্তাদের ঘন ঘন হুংকার। বহুমূল্য টিকিট বিক্রি হল ঝড়ের বেগে। হাতখরচের টাকা বাঁচিয়ে, ওভারটাইম কাজ করে মধ্যবিত্ত ছুটল টিকিটে কেটে মেসিকে দেখতে। কেউ মেদিনীপুর থেকে। কেউ ঝাড়্গ্রাম থেকে। বাঁকুড়া থেকে। কেউ বা অন্য স্টেট থেকে। তারপর? হায়! এ যেন সেই খুড়োর কল। ছুটছেন। নাগাল পাচ্ছেন না। সামান্য চোখের দেখার নাগালটুকুও।

আচ্ছা, মেসি কলকাতায় এসেছিলেন ঠিক কী উদ্দেশ্যে? যে-কোনও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ক্রীড়া ব্যক্তিত্বকে কম্পিটিটিভ টুর্নামেন্ট বাদে বিশ্বের বহু দেশে নিয়ে যাওয়া হয় কয়েকটি উদ্দেশ্যে। যেমন, ফিফা অনুমোদিত কোনও আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী ম্যাচ খেলাতে। যেমনটা মেসি এই কলকাতার বুকেই খেলে গিয়েছিলেন, ২০১১ সালে। ভেনিজুয়েলার বিপক্ষে। সৌভাগ্যক্রমে, আর্জেন্টাইন অধিনায়ক হিসেবে মেসির অভিষেক দেখার সুযোগ হয়েছিল তিলোত্তমার। সে-ম্যাচ আয়োজন করা হয়েছিল একেবারে আন্তর্জাতিক ফুটবলের নিয়ামক সংস্থার প্রোটোকল মেনে।

২০১১ সালে আর্জেন্টিনা-ভেনিজুয়েলা ম্যাচে মেসি

আরও পড়ুন: ফলো দ্য শাড়িজ, নিউ ইয়র্কে রাস্তা চিনতে চাইলে এই কথাই বলেছিল পুলিশ! তপশ্রী গুপ্তর কলমে ‘ডেটলাইন’ পর্ব ৩৭…

প্রদর্শনী ম্যাচ ছাড়াও আরও কিছু ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক ক্রীড়া-ব্যক্তিত্বরা বিভিন্ন দেশে আমন্ত্রিত হন। যেমন, ২০১০ সালে হাইতিতে ভয়ানক ভূমিকম্পের পর ইউনিসেফের উদ্যোগে, তাঁদের গুডউইল অ্যাম্বাসাডর হিসেবে মেসিকে নিয়ে যাওয়া হয় সেখানে। যেখানে মেসি দীর্ঘ সময় হাইতির দারিদ্রসীমার নিচে থাকা শিশুদের সঙ্গে কাটান৷ আঙ্গোলার বিরুদ্ধে একটি ম্যাচ খেলেন ও সেই ম্যাচের পারিশ্রমিক ইউনিসেফের আফ্রিকা শাখার মাধ্যমে আফ্রিকার শিশুদের ফুটবলের উন্নতিকল্পে দান করেন। এই কলকাতার বুকে মারাদোনাকেও আনা হয়েছিল, সেই উদ্যোগের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন এই মেসি ইভেন্টের এক প্রধান উদ্যোক্তা। কিন্তু মারাদোনা কলকাতা কেন এসেছিলেন? ভারতে ফুটবলের প্রসারের উদ্দেশ্যে। এই শহরে তিনি ফুটবল ক্লিনিক করেন তরুণ ফুটবল প্রতিভাদের নিয়ে। চ্যারিটি ম্যাচে উপস্থিত থাকেন। ফ্যান এনগেজমেন্ট করেন মোহনবাগান মাঠে পায়ের জাদু দেখিয়ে। মারাদোনার কলকাতা সফরে এসে উদ্বোধন করে গেলেন মহেশতলার ফুটবল অ্যাকাডেমি। এই শহরে একই কারণে এসেছেন রোমারিও, চুরাশির নেহরু কাপে চিফ গেস্টের পদ আলো করে এসেছেন ববি মুর, নব্বইয়ের নেহরু কাপে অতিথি হয়ে এসেছেন ইউসেবিও, নিজের বিদায়ী ম্যাচ খেলতে এসেছেন কিংবদন্তি অলিভার কান। বেসরকারি উদ্যোগে এদেশে বিশ্বকাপে সোনার বল জয়ী ডিয়েগো ফোরলান এসেছেন অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা তরুণ ফুটবলারদের স্কাউটিং-এর উদ্দেশ্যে একটি ইভেন্টে। ইতিহাসের পাতা ঝাড়লে এমন উদাহরণ অসংখ্য।

কিন্তু, মেসির এই GOAT ট্যুর একেবারে ব্যতিক্রমী। কারণ এর আগে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই ফ্যান এনগেজমেন্টের বিষয় থাকলেও সেটিই একমাত্র প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল না। মেসি কলকাতায় থাকলেন সর্বসাকুল্যে ১২ ঘণ্টা। দীর্ঘ বিমানযাত্রার ক্লান্তি কাটাতে হোটেল রুমেই রইলেন সাড়ে ছয় ঘণ্টা। বাকি ঘণ্টাপাঁচেক সময়ের মধ্যে এক-দেড় ঘণ্টা চলল বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে মিট এবং মূর্তি উন্মোচন, যার পুরোটাই হল ত্রি-স্তরীয় নিরাপত্তায় ঘেরা পাঁচতারা হোটেলে। সর্বসাকুল্যে এক থেকে দেড় ঘণ্টা সময় মেসির বরাদ্দ ছিল হাজার হাজার কিলোমিটার দূর থেকে ন্যুনতম সাড়ে চার হাজার টাকারও বেশি দামে টিকিট কেটে মাঠে আসা সাধারণ জনতার জন্য। এই ইভেন্টে ভারতের সব লোকেশন মিলিয়ে যা খরচ হয়েছিল উদ্যোক্তাদের, তার প্রায় সত্তর শতাংশ এসে গিয়েছিল স্পন্সরশিপ থেকে। বাকি নন-স্পন্সর্ড খরচ ওঠার কথা টিকিট থেকে, এখন ‘দ্য উইক’-এর রিপোর্ট অনুযায়ী প্রায় ১০০-১৫০ কোটি টাকা রেভেনিউ এসেছে উদ্যোক্তাদের, যা ওই ত্রিশ শতাংশ খরচের চেয়ে অনেক অনেক বেশি। এতে যে বিপুল লাভবান হচ্ছেন উদ্যোক্তারা, তাতে সন্দেহ নেই।

এবার আসল প্রশ্নে ফেরা যাক। মেসির এই ইভেন্ট একেবারে ব্যক্তিগত উদ্যোগে করা, বৃহত্তর উদ্দেশ্য যেখানে নেই সেখানে যে মুনাফার অঙ্ক বেশ মোটা হবে— এ-ও আশ্চর্যের নয়। কিন্তু, তারপরেও, কেবলমাত্র ফ্যান এনগেজমেন্ট ইভেন্ট হিসেবেও মেসির কলকাতা ভ্রমণকে বিতর্কের বাইরে রাখা যেত। উদ্যোক্তারা যে সর্বসাকুল্যে একঘণ্টা সময় পেয়েছিলেন দর্শকের সামনে মেসিকে নিয়ে আসার, সেই সময়ে ম্যানেজমেন্টের এই বিপুল গাফিলতি কেন? এই ইভেন্ট যেখানে সরকারি ইভেন্ট নয়, সরকারের পুলিশ ও প্রশাসন যেখানে কেবলই আইনরক্ষকের ভূমিকায়, সেখানে বড়-মেজ-ছোট হোমরাচোমরা ব্যক্তিত্বরা ঠিক কী করছিলেন যুবভারতীতে? কেন ফ্যান এনগেজমেন্টের জন্য বরাদ্দ সময়ে মেসির ব্যক্তিগত সিকিউরিটি-সরকারি নিরাপত্তারক্ষী বাদে বাকিরা তাঁকে ঘিরে নির্লজ্জের মতো ছবি তুলে গেলেন? সেলফি তুলে গেলেন? উদ্যোগপতি কি ভুলে গেলেন যে, গ্যালারিতে থাকা অগণিত মানুষ মেসির সঙ্গে রাজনৈতিক নেতা ও সাংবাদিকদের সেলফি তোলার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য হাজার হাজার টাকা ব্যয় করেননি।

কলকাতা সফরের কয়েকণ্টার মধ্যে তো মেসি হায়দরাবাদে গেলেন, সেখানে কীভাবে এত চমৎকার ফ্যান এনগেজমেন্ট ইভেন্ট আয়োজিত হল? মেসি যেখানে উঠতি ফুটবলারদের কাছে স্বপ্নের সওদাগর, সেখানে হায়দরাবাদের মতো কলকাতাতেও কি ময়দানের কিশোর ফুটবল শিক্ষার্থীদের মেসির সঙ্গে একসঙ্গে কয়েক মিনিট সময় কাটানোর সুযোগ দেওয়া যেত না? একটিবার যুবভারতীর গালিচায় মেসির পায়ে বল দেখলে জনতা মারমুখী হয়ে উঠত কি?

মেসির এই ইভেন্ট একেবারে ব্যক্তিগত উদ্যোগে করা, বৃহত্তর উদ্দেশ্য যেখানে নেই সেখানে যে মুনাফার অঙ্ক বেশ মোটা হবে— এ-ও আশ্চর্যের নয়। কিন্তু, তারপরেও, কেবলমাত্র ফ্যান এনগেজমেন্ট ইভেন্ট হিসেবেও মেসির কলকাতা ভ্রমণকে বিতর্কের বাইরে রাখা যেত। উদ্যোক্তারা যে সর্বসাকুল্যে একঘণ্টা সময় পেয়েছিলেন দর্শকের সামনে মেসিকে নিয়ে আসার, সেই সময়ে ম্যানেজমেন্টের এই বিপুল গাফিলতি কেন?

উদ্যোগপতির ব্যক্তিগত মুনাফার জন্য এই ইভেন্ট আয়োজন যতখানি কুরুচিকর, ততটাই দৃষ্টিকটূ এই তথাকথিত ভিআইপি-দের বালখিল্যতা। বিশ্বের কোনও উন্নত শহরেই, সে নিউ ইয়র্ক হোক বা মেক্সিকো সিটি, বার্লিন হোক বা প্যারিস, মেসিকে কেবল একঝলক চোখের দেখা দেখার জন্য, মানুষ হাজার হাজার টাকার টিকিট কাটবে না। এই শহরের হাজার অপ্রাপ্তির শুষ্ক ফাটলে ফেরেস্তার মতো আসেন আন্তর্জাতিক তারারা। সেই সুযোগে মুনাফার গুড় ওঠে ক্ষমতাশীলদের ঘরে।

সবশেষে, এই কলকাতা, এই তিলোত্তমা, ফুটবলের মক্কা, যে শহরে বিশ্বের সর্বাধিক আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বরা এসেছেন, ফুটবলে পেলে-মারাদোনা তো বটেই, এমনকী, নেলসন ম্যান্ডেলা, ফিদেল কাস্ত্রো, হো চি মিন-এর মতো মহীরুহরা নির্বিঘ্নে ঘুরে গেছেন, যে-শহর এদেশের বুকে এককালে ছিল প্রকৃত অর্থেই আন্তর্জাতিক মননের শহর, আন্তর্জাতিক চিন্তাশীল ব্যক্তিত্বদের জন্মস্থান, তা আজ পরিণত হয়েছে নিম্নমেধাচর্চার পীঠস্থানে। আর্জেন্টিনার বহুলচর্চিত সংবাদমাধ্যমে এই ঘটনার পাতাজোড়া নিন্দা, রয়টার্স, বিবিসি-র মতো সংবাদমাধ্যমের কপিতে এই ঘটনার উল্লেখ কলকাতার আন্তর্জাতিকতার পুরনো কফিনে শেষ পেরেকটা পুঁতে দিল।