টেস্ট ম্যাচ শেষ। জয়-পরাজয়ের বাইনারির বাইরেও ইডেন এখনও কুসুম-কুসুম তপ্ত হয়ে আছে যেন। হারের ময়নাতদন্ত। পিচ-বিতর্ক। অবিশ্যি ইডেন ও পিচ-বিতর্ক নতুন না। ক্রিকেটীয় উত্তাপের আগুনে হাত সেঁকার মতো শীত এসে গেছে শহরে। এবার যেন একটু তাড়াতাড়ি। আর সেই শীতের দুপুর। কমলালেবুর কোয়া। আর ইডেন। শঙ্করীপ্রসাদ বসু লাল বলকে ভেবেছিলেন লাল আপেল। আর ভগবানের প্রিয় ধনুর্ধর সন্তান আদমের অধঃপতনের জন্য শয়তান ও ইভের যৌথ চক্রান্তের কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন বার বার। এবং আদমের পতনের পর অনেক চেষ্টায় আবার স্বর্গোদ্যানে উঠেছিলেন আবার— সে-স্বর্গোদ্যান থেকে তাঁকে স্থানচ্যুত করা অসাধ্য— তাই এই স্বর্গোদ্যানই যে ইডেন— ক্রিকেটের নন্দনকাননের নামকরণে এই ছিল তাঁর ব্যাখ্যা। প্রায় দু’শো বছর আগে গভর্নর জেনারেল লর্ড অকল্যান্ডের বোন ফ্যানি ইডেনের নামে ইডেন গার্ডেন্সের ঐতিহাসিক নামকরণের চেয়েও শঙ্করীপ্রসাদ বসুর এহেন কল্পনাই আসলে ইডেনের ক্রিকেট-রোম্যান্টিসিজমের আখর। বিশ্বের তাবড় স্টেডিয়ামের চেয়ে ইডেন এখানেই আলাদা। ইতিহাসের পরতে-পরতে সোনালি রূপকথার এইসব মায়াময় গলি ঘুরেই ইডেনকে নিয়ে লেখা হয়েছে কত গল্পগাছা!
ইডেন বললেই মনে আসে প্রেসবক্স, কমেন্ট্রিবক্স আর চিরকালীন ম্যানুয়াল স্কোরবোর্ডের কথা। অজয় বসু যখন স্যুট-টাই-কোট পরে ইডেন উদ্যানের কমেন্ট্রিবক্সে ভরাট স্বরে বলতেন, ‘নমস্কার! ইডেন থেকে বলছি আমি অজয় বসু। মেঘমুক্ত আকাশের তলায় ভারত এবং ইংল্যান্ডের খেলোয়াড়রা সারিবদ্ধ হয়েছেন রাজ্যপালের সঙ্গে করমর্দনের জন্য…’, ঠিক তখন রেডিয়োয় কান-পাতা বাঙালি যেন চোখের সামনে দেখতে পেত এক অবারিত মাঠ, যার ওপর উপচে পড়ছে হলদে আলোর মদিরা। ইডেনে খেলা মানেই কলকাতায় সাজো-সাজো রব…
আরও পড়ুন: ইডেন শুধু আমার কাছে স্পেশাল নয়, গোটা ভারতীয় দলের কাছেই বিশেষ মাঠ!
লিখছেন ভি ভি এস লক্ষ্মণ…
ক্রিকেটের পসরা নিয়ে একশো বছরেরও বেশি সময়ে ইডেন যে কেবল মায়াবী রং নিয়ে এসেছে তা নয়, বরং ইডেনের টেস্ট ইতিহাসকে বর্ণময় করেছে বদলার গল্প। চক্রব্যূহে ডন ব্র্যাডম্যান। ব্রিটিশ ক্রিকেটের ছাই পুনরুদ্ধারে রক্তের স্বাদ পেয়ে যাওয়া চাণক্য ডগলাস জর্ডিন। লাল বলের কুরুক্ষেত্রে যেন জর্ডিনের সামনে সারথি হয়ে এগোচ্ছেন হেরল্ড লারউড। অজি অপমানের বদলার ছক অবশ্যি হয়ে গিয়েছিল আগেই। পিকাডিলি হোটেলের ছাদে ওয়ানের গ্লাস হাতে চলছে ব্র্যাডম্যান নিধনের ছক। ডগলাস জর্ডিন ছাড়া বাকি তিনজন যথাক্রমে নটিংহ্যাম শায়ারের অধিনায়ক আর্থার কার, বিল ভোস এবং কুখ্যাত বা বিখ্যাত হেরল্ড লারউড। এই মিটিং-এর পর যে রক্তস্নান দেখেছিল টেস্ট ক্রিকেট, অজি আভিজাত্যে যে-ধাক্কা দিয়েছিল জার্ডিন-লারউডের ব্রিটিশ ঔদ্ধত্য, তার একটা বদলার স্ক্রিপ্টের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল অনেকগুলো বছর। আর সেই বদলার মঞ্চ হিসেবেই যেন এল ইডেন।

তিনের দশকে ব্রিটিশ-অজি চিরন্তন দ্বৈরথের সেই বডিলাইনের অপমান পুড়ে ছাই হয়ে গেল সাতাশির বিশ্বকাপ ফাইনালে। উত্তাল কলকাতার বুকে ট্রফি তুললেন ব্র্যাডম্যানের অপমানের বদলা নিতে নিজেকে নিউ সাউথ ওয়েলসের মাটিতে একটু-একটু করে গড়ে তোলেন অ্যালান বর্ডার। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্লাইভ লয়েড জমানার পর সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ওই প্রথম অজি আধিপত্যের শুরু। ইডেনের এই ম্যাচ তাই ক্রিকেটের ইতিহাসে এক বাঁকবদলের স্মারক। ইডেনের বাইশ গজ শুষে নিয়েছিল ইতিহাসের ঘ্রাণটুকু। কীভাবে যেন বদলার ইতিহাস ওইদিন থেকেই আরও বেশি করে আগলে রাখল ইডেন উদ্যান। একটা দশক পেরিয়ে ফের ইডেন দেখল শতাব্দীর অন্যতম সেরা টেস্ট। স্টিভ ওয়ের অপ্রতিরোধ্য অস্ট্রেলিয়া। ডজনখানেকের ওপর টেস্টে কোনও পরাজয় নেই। অন্যদিকে প্রায় ধুঁকতে থাকা ভারত। প্রথম দুই ইনিংস, এমনকী তৃতীয় ইনিংসের মাঝামাঝি অবধিও কার্যত নিশ্চিত ভারতের ইনিংস ডিফিট। কিন্তু, তারপর?
শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ লেগস্পিনার শেন ওয়ার্নকে ম্যাচের আগেই ড্রেসিংরুমে শ্যাম্পেন আনিয়ে রাখার পরেও ম্যাচ শেষে অপমানের লালমুখ নিয়ে মাথা নীচু করে ফেলতে হল অখ্যাত শিখ তরুণের সামনে। রিকি পন্টিং-এর ফার্স্ট স্লিপ থেকে ক্রমাগত চেঁচিয়ে যাওয়া অজি স্লেজিং কবজির মোচরে মিড-অফের পাশ দিয়ে বাউন্ডারি পার করে দেন একবারও বিশ্বকাপে সুযোগ না পাওয়া হায়দ্রাবাদী তরুণ। স্টিভ ওয়ের দেশে পনেরো থেকে ষোলো হতে চলা টেস্ট জয়ের খবর ছাপা হয়ে যাবার পরেও প্রেস থেকে তাকে চিরনিদ্রায় পাঠিয়ে দেন এক ধ্রুপদী কর্ণাটকী। রাহুল দ্রাবিড়! ইডেনের সঙ্গে দ্রাবিড়ের সেই সখ্য আজও যেন অটুট।

১৯৬২ সালের প্রথম ব্রিটিশ বধ। কলোনিয়াল ইতিহাসের ছায়ার ভেতর দাঁড়িয়ে, সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া জাতির প্রথম ইডেনে টেস্ট জয়, তাও ১৮৭ রানে। তেরো বছর পর, অপরাজেয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ; অ্যান্ডি রবার্টস-বার্নার্ড জুলিয়েনের ওয়েস্ট ইন্ডিজ হার মানল ইডেনে। এই শতকে ইডেন দেখল ক্রিকেটের বরপুত্র সচিন তেণ্ডুলকরের পেনাল্টিমেট টেস্ট ম্যাচ; দেখল ২০০৫-এ সৌরভের ভারতের সামনে ইনজামামের পাকিস্তানকে।

ভারতের সাম্প্রতিক টেস্ট হারের পর বিশ্লেষকরা বিস্ফোরক ইডেনের পিচ নিয়ে। তাঁদের দাবি, ইডেনের পিচ খেলার অযোগ্য। নইলে কি আর আড়াই দিনে টেস্ট শেষ হয়? অবিশ্যি এ-দাবি নতুন না। এক যুগ আগে প্রবীণ পিচ কিউরেটর প্রবীর মুখার্জি তৎকালীন অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনির কথামতো টার্নিং ট্র্যাক বানাতে নিমরাজি ছিলেন বলে রাতারাতি তাঁকে পদ থেকে সরিয়ে ফেলার ঘটনাও দেখেছে ইডেনের গালিচা। ১৯৯৬ সালের সেই বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের লঙ্কাকাণ্ডের পরেও পিচ-বিতর্ক কম হয়নি। তবে এবারে ব্যতিক্রম হল, কোচ গৌতম গম্ভীর পোস্ট ম্যাচ ইন্টারভিউতে বুক বাজিয়ে স্বীকার করেছেন যে, এই পিচ তাঁরাই চেয়েছিলেন এবং নিজেদের ব্যর্থতায় তাঁরা ম্যাচ হেরেছেন। জাতীয় দলের কোচের এমন দায় স্বীকারের নজিরও যে খুব একটা দেখেনি ইডেন গার্ডেন্স। এও তো এক নতুন পাওয়া! সব পাওনা কি আর স্কোরবোর্ডে লেখা থাকে?
তবু, ইডেনে টেস্ট ম্যাচ আসে। হাতে গোনা। ভারতের নবনির্মিত স্টেডিয়ামগুলির জৌলুসের পাশে তাই কার্যত ফিকে ইডেন; কিন্তু কৌলীন্যে? দেশের শ্রেষ্ঠ রণভূমি ইডেন-ই। সাদা ট্র্যাকপ্যান্ট, শীতের সকালে লাল বল-উইলোর চুম্বনের শব্দ আর ছড়ানো গ্যালারি… ইডেনে টেস্ট ম্যাচ সত্যিই শেষ হওয়ার না, তা আবহমান…



