‘অযান্ত্রিক’

‘ঋত্বিক’ বইতে সুরমা ঘটক, স্মৃতিচারণ করছেন—


বিজ্ঞাপন

‘অযান্ত্রিক’-এর কথা ভাবলে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে আসে মন। ছোটগল্প লেখকদের মধ্যে সুবোধ ঘোষের নাম বিখ্যাত। এবং তার বিখ্যাত গল্পগুলোর মধ্যে অযান্ত্রিক একটি। সেই গল্প নিয়ে ছবি করার সুযোগ এল আকস্মিকভাবে। একটি ভাঙা গাড়ি আর তার ড্রাইভার বিমল আর ছোটনাগপুরের উপত্যকা ও প্রাকৃতিক সম্পদকে মূলধন করে শুরু হল ‘অযান্ত্রিক’ ছবি। প্রথম শট নিয়ে ছবি আরম্ভ করার পরেই চিঠিতে জানলাম খুব ভালো শট হয়েছে।

                                         রাঁচী

                                            ২.৭.৫৭

      আজ দুপুরে এখানে এসে পৌঁছোলাম। দুরাত কাটছে গ্র্যাণ্ডট্রাঙ্ক রোডের ওপরে। সঙ্গে জগদ্দল প্রচণ্ড ঝামেলা করছে। বহু কষ্টে এলাম। পুরো ইতিহাস গিয়ে বলব।

      আজ প্রথম শট নিয়ে ছবি আরম্ভ করলাম। খুব ভাল শট্‌ হয়েছে। কত বছর বাদে আবার সুযোগ এল জীবনে, খালি মনে হচ্ছে। জানিনা এ সুযোগের সদ্‌ব্যবহার করতে পারব কীনা। বৃষ্টি নেই এক ফোঁটা, হয়তো গল্পবদল করতে হবে।

      আজ তোমার কথা খুব মনে হয়েছে। আর মার কথা। মা বেঁচে থাকল না আজ পর্যন্ত। থাকলে শান্তি পেত।

ঋত্বিক কখনও চলচ্চিত্রকে ‘রুপোলি পর্দা’ মনে করেননি। বিধবার সাদা না-কাচা কাপড়ের মতো, আটপৌরে ছিল তাঁর পর্দা।

‘অযান্ত্রিক’-এর মূল নায়ক একটা গাড়ি। শেভ্রলে ১৯২০ মডেল। কিন্তু নাম তার জগদ্দল। মানে, যে ভারী; নড়ে না, চড়ে না। আশ্চর্য বৈপরীত্য! আর আমরা যাকে ছুটে বেড়াতে দেখি পর্দাজুড়ে, মাঠপ্রান্তরে, পাহাড়ে, নদীতে। ছোট-ছোট ঝরনা পার হচ্ছে, পাথর ডিঙোচ্ছে। কী তার তেজ! এ কি ঋত্বিক নিজেই! যার গায়ে ছোট বাচ্চারা কাদা ছুড়ে মারতে যায়; যেন বাঙালিসমাজ। যেন চলচ্চিত্রের সংস্কার তার গায়ে কাদা ছেটাচ্ছে। বিমল, তখন দু’হাতে আগলে রাখছে তাকে। তার সারা গায়ে কাদার ছোপ। সুখময় কাদা। এ-দৃশ্য দেখলে আমাদের বুক ভেঙে যায়।

বিমল একটা ক্রিস্টান সমাধির পাশে থাকত। ছোটু সেখানে নিয়ে যায় বরকর্তাকে। দেখা যায়, বিশাল একটা চার্চের ঘণ্টার ফাঁক থেকে ওরা সামনে হেঁটে যাচ্ছে। আমার মনে পড়ে যায়, বুনিয়েলের চলচ্চিত্র ‘নাজারিন’। এ-দৃশ্য আমরা দু’বার দেখি। এ কি সভ্যতার ঘণ্টাধ্বনি! বার বার সভ্যতা প্রকাশ পেয়েছে ছবিজুড়ে। জীবনচক্রের কথা। কালচক্রের কথা। ওঁরাওদের উৎসবে, জগদ্দলের চলনে। তার স্থবিরতায়। তার কাটা শরীরের চলে যাওয়া, ঠেলায় করে। আবার ফিরে আসা, ছোট্ট শিশুর হাতে বেঁচে ওঠা, হর্নের শব্দে। বিমলের মুখ, হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।

আরও পড়ুন: ঋত্বিকের নতুন বাড়ির খোঁজ শুরু হয়েছিল ‘নাগরিক’ থেকেই!
লিখছেন প্রবুদ্ধ ঘোষ…

জগদ্দলের প্রান্তরজুড়ে অপূর্ব ছুটে চলা। বিশাল পর্দার কখনও এক কোণে, কখনও একেবারে প্রান্তে, কালো শরীর নিয়ে অপূর্ব জেগে থাকা। জগদ্দল যেন তার প্রেমিক, তার অর্ধাঙ্গিনী, সবটাই মান-অভিমানের খেলা। আদর করে তার গা মুছিয়ে দেওয়া। ছবির শুরুই হয় এক পাগল বরকে দিয়ে, যে তার টোপর আর ধুতি সামলাতে ব্যস্ত। সতীন্দ্র ভট্টাচার্য, গঙ্গাপদ বসু বরকর্তা। অসাধারণ ক্যামেরায় ফ্রেম ধরা।মুখের উপর, ঘাড়ের উপর, ক্যামেরা উঠে পড়েছে। বিকৃত মুখের নানা চেহারা। সমস্তই বিগ ক্লোজ-আপ। পুরো ছবিতে একাধারে বিগ ক্লোজ, অন্যদিকে অনবরত লং শট। দুটো যেন দুটো প্রান্ত। ঋত্বিকের সমস্ত চলচ্চিত্রে এই ক্যামেরার অবস্থান বেশ বিচিত্র। এবং অনন্যভাবে একার। বেশির ভাগ সময়ে হেড স্পেস, মানে কপালের ওপর থেকে, ওপরের শূন্য অংশটা পর্দাজুড়ে। আলোকচিত্রীকে বলতেন, একবারে নীচ থেকে ধরবি। এরা সবাই তো প্রান্তিক মানুষ। জগদ্দলেও থাকত একেবারে সীমানা ধরে। ঋত্বিকের আটখানা চলচ্চিত্রকে আমি আমার আঁকার খাতায় কালো-সাদা কাঠ-কয়লায় ধরে রাখার চেষ্টা করেছি। কাঠ-কয়লা কারণ, এরা কর্কশ ভাষায় কথা বলে। নরম, পেলব ভাষায় বলে না। শুধুমাত্র ‘কোমল গান্ধার’ ব্যতিক্রম। সেখানে অনসূয়া যেন দেবীমূর্তি। অপূর্ব তার গ্রীবা। লম্বা রাজহাঁসের মতো। দীর্ঘ। ক্যামেরা ধরছে মাটি ঘেঁষে। এ এক অসাধারণ উপলব্ধি আমার। ‘অযান্ত্রিক’-এও তাই। বিমলের আনন্দ, বিমলের উদ্‌বেগ, বিমলের অসহায়তা, হতাশা— সমস্তই ধরা হয়েছে বিগ ক্লোজে।

ছবির দৃশ্যে কালী বন্দ্যোপাধ্যায়

আমার একটা ধন্দ লাগে, চলচ্চিত্রশিল্পী-পরিচালকেরা কি এভাবে আগেই বুঝে যান দর্শকমনের চলনকে! কীভাবে আলোকচিত্রের ভাষায় মেওন চিত্ররচনা করতে পারেন? চিত্রকরদের সহজাত একটা বিষয় থাকে, তারা আগেভাগেই দৃশ্যের জন্ম বা মৃত্যু দেখতে পারে। এর পাশে আলোকচিত্রী ও চলচ্চিত্র-পরিচালকরাও একই গোত্রীয় হয়ে যান। আমাকে এটা বিস্মিত করে। তখনই বুঝতে শিখি। ছবি শুধু তুলি দিয়ে আঁকা হয় না; আলোছায়া, লেন্স দিয়েও আঁকা যায়। প্রথাগত ধারণা ভেঙে যায় মুহূর্তেই। চলচ্চিত্রের বহু দৃশ্য মহড়া দিয়ে, প্রস্তুতি নিয়ে তৈরি করা যায় না। আবেগ, উদ্‌বেগ, রাগ, দুঃখ মুহূর্তেই রচনা হয়ে যায়। মানুষের শরীর, মুখ, তখন তার পট বনে যায়। মানুষের মন তাকে রচিত করলেই, তা যতক্ষণ না দৃশ্য হচ্ছে ততক্ষণ তা অদৃশ্যই থেকে যায়।

ঋত্বিকের কাজ দেখতে-দেখতে আমার উপলব্ধি হয় বার বার— একজন সফল শিল্পী কেমন হয়, তা এই কাজ না দেখলে বুঝতে পারতাম না। সম্পূর্ণ শিল্পী বা অসম্পূর্ণ শিল্পী কাকে বলে, কী তার লক্ষণ, এগুলো চর্চার বিষয়। একজন সম্পূর্ণ শিল্পী তার সমস্ত চলনকে সংগীত-শব্দের ছন্দ ও ছন্দহীনবাহবে ধারণ করেন। যখন চলচ্চিত্র গৃহীত হচ্ছে, তখন তো কখনওই তাতে শব্দ থাকে না। সংগীতের সহযোগিতা হয়তো কখনও-কখনও নেওয়া হয়। লিপসিংক করার খাতিরে। কিন্তু পরিচালক সমস্ত শব্দকেই গভীরভাবে শুনতে পান। সেই শোনাকে সংগ্রহ করে রাখেন। এটা একটা রসায়ন। রাসায়নিক ক্রিয়া, দৃশ্য, শব্দের সংঘাত। এই সংঘাত ঋত্বিক তার সমস্ত কর্মকাণ্ডে অজস্রবার ঘটিয়েছেন। নানা আঘাতের শব্দ। বেতের শব্দ। ধোপার কাপড় কাচার শব্দ। ধাতুতে-ধাতুতে আঘাতের শব্দ। করাত কাটার শব্দ। সমস্তই অস্বাভাবিক শব্দ কিন্তু স্বাভাবিক। এটা মনে রাখতে হবে, চলচ্চিত্রে শব্দ কিন্তু সংযোজিত হয়। পুনর্নির্মাণ করা হয়। সেই শব্দের তাল-লয়-ছন্দ আছে। দৃশ্যেরও তাল-লয়-ছন্দ আছে। যে-লয়ে দৃশ্যগ্রহণ করা হচ্ছে, তা সবটাই পরিচালকের মনের ক্রিয়া। অবশ্যই সম্পাদনায় এই লয় সৃষ্টি করা হয়। তাল সৃষ্টি করা হয়। এমনকী যদি কোনও এমন মুহূর্ত থাকে, একটা রাগ ধ্বনিত হতে-হতে থেমে গেল, দৃশ্যে কিছু ঘটনার প্রয়োজনে আবার তা যখন শুরু হয়, ধ্বনি যখন ফিরে আসে, তার মধ্যে এই নিস্তব্ধতার তাল ছিল, লয় ছিল, ছন্দ ছিল। মানে নিস্তব্ধতা, শুধু নিস্তব্ধতা নয়। সে জীবন্ত সংগীত। সংগীত শুধু কানে শোনার নয়, সংগীত উপলব্ধির। কোনও পরিচালক যদি এই নিস্তব্ধতার সংগীতকে বুঝতে না শেখেন, তখন তার চলচ্চিত্রের তাল কাটতে বাধ্য। ঋত্বিক এটা জানতেন।

ছবির দৃশ্যে জগদ্দল

দৃশ্য-সংগীতের অর্থ কী? সাধারণভাবে আমরা যখনকোনও দৃশ্যের মুখোমুখি হই, তা আমাদের দৃশ্য উপলব্ধি করার অভ্যাস বা অনভ্যাসের দোরগোড়ায় যায়। ঋত্বিক যে-সময়ের মানুষ, অর্থাৎ চার/পাঁচের দশকের, তিনি যখন চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেন পাঁচের দশকের গোড়ায়, প্রথম ছবি ‘বেদেনী’ প্রকাশিত হয়নি। অসম্পূর্ণ ছিল। যান্ত্রিক ত্রুটির জন্য অত পরিশ্রম বৃথা যায়। কুড়িদিন শুটিং-এর সব কাজ পণ্ড হয়। তারপর ‘নাগরিক’, ১৯৫২/’৫৩, যা তাঁর মৃত্যুর আগে প্রকাশিতই হয়নি। নানা জটিলতায়। এক সময়ে প্রিন্ট হারিয়ে যায়। মৃত্যুর দু’বছর পর হঠাৎ খুঁজে পাওয়া যায় একটা প্রিন্ট, পরিত্যক্ত অবস্থায়। ‘অযান্ত্রিক’ ১৯৫৭/’৫৮, যা প্রথম প্রকাশিত ছবি। ১৯৫৯ সালে ভেনিসের আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবেও এই ছবি প্রদর্শিত হয়। বোঝাই যাচ্ছে, সেই পাঁচের দশকের দর্শক, চলচ্চিত্রবোদ্ধারা কত নবীন ছিলেন পরিচালকের তুলনায়। তারা বুঝবে কী করে দৃশ্যের তাল-লয়-ছন্দ? ঋত্বিকের যে-কোনওভাবেই দেশি-বিদেশি চলচ্চিত্র দেখার সুযোগ ঘটেছিল। এবং নিজস্ব ভাষা নির্মাণে একটা অসাধারণ শৌখিন যাত্রাপথ বানাতে পেরেছিলেন এককভাবে। এটা ঠিক, ওঁরা তিন বন্ধু একসঙ্গে ওই যাত্রায় অংশীদার ছিলেন— ঋত্বিক, মৃণাল ও তাপস; মানে ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন ও তাপস সেন। মৃণাল সেন চলচ্চিত্র নির্মাণে মন দেন, তাপস সেন আলোয়। অসাধারণ সব উদ্ভাবনী আলো-চিত্র নির্মাণ করেন মঞ্চে। সে-কাহিনি ভিন্ন। মঞ্চের আলো আর চলচ্চিত্রের আলোয় তফাত থাকলেও, ঋত্বিক যেহেতু প্রথমত মঞ্চের মানুষ, মঞ্চকে অসম্ভব ভাল বুঝতেন, তাই এটা কোনও বিরোধ সৃষ্টি করেনি। তা আমরা পরে ‘কোমল গান্ধার’-এ প্রত্যক্ষ করব।

আমরা দৃশ্যের সংগীত নিয়ে কথা বলছিলাম। ‘অযান্ত্রিক’-এ প্রকৃতি, তার আকাশ, পাহাড়, নদী, বনাঞ্চল এই সংগীত নির্মাণে প্রভূত সাহায্য করেছে। ঋত্বিক তাকে ব্যবহারও করেছেন। উনি প্রকৃতির এই সংগীতকে বুঝতেও পেরেছিলেন, শুধু ওঁরাওদের মাদলের তাল নয়, গাছের পাতার মর্মরধ্বনি, পাহাড়ি ঝরনার কুলকুল বয়ে যাওয়া, বিমলের উদাত্ত কণ্ঠে কালীর ভজনা করা সবই একসঙ্গে অর্কেস্ট্রার মতো বেজে ওঠে।

মঞ্চের যে আলোর উজ্জ্বলতা, তা ক্যামেরায় চিত্রবদ্ধ করা যায় না। যেহেতু তার উজ্জ্বলতা চোখের দেখার ওপর নির্ভর করে প্রক্ষিপ্ত হয়। চোখ আর ক্যামেরার লেন্স দুই ভিন্ন বস্তু। কৃত্রিম লেন্স কোনওদিনই চোখের বিকল্প হয়ে উঠতে পারবে না। ডিজিটাল যুগেও, যদিও পরিস্থিতি এখন একেবারেই ভিন্ন, তাও, চোখ যা দেখতে পায়, এমনকী, তথাকথিত অন্ধকারেও যা দেখতে পায়, ক্যামেরার লেন্স তা এখনও পারে না। পাঁচের দশক তো অনেক পিছিয়েই ছিল। এমনকী, তখন জুম লেন্সও তেমন লভ্য ছিল না। এই অবস্থায় দৃশ্যের সংগীত আবিষ্কার, তার তাল-লয়-ছন্দ আবিষ্কার বেশ দুরূহ কাজ ছিল। প্রথমত, চলচ্চিত্র একটি চলমানতার কথা বলে। প্রতিটি দৃশ্য থেকে দৃশ্যের যাত্রা এই চলমানতায় সহযোগী হয়ে ওঠে। অর্থাৎ, আমরা যখন তা প্রত্যক্ষ করছি, তখন আমাদের মনে, স্বাভাবিক ক্রিয়ার নিজস্ব চলমানতার একটি চলন নির্মিত হয়ে যায়। আমরা ছুটতে থাকি, মনে মনে। ছবি আমাদের সেই ছোটাকে আরও ত্বরান্বিত করে। মনের সঙ্গে তাল মেলায়। এবার যেভাবে দৃশ্যগ্রহণ করা হচ্ছে, সেভাবেই এই ছন্দকে ধরে রাখা পরিচালকের কাজ। তিনি তাঁর নিজস্ব ছন্দকে নিজেই ধারণ করে রাখেন, অবশ্যই সহযোগীরা থাকেন। চিত্রনাট্য থাকে। এছাড়াও সংলাপ বা অন্যান্য খুঁটিনাটি তো থাকেই। তার বিবরণে যাচ্ছি না। কম্পোজিশন বলে একটি পরিভাষা আছে। এই কম্পোজিশনের নিজস্ব ইতিহাস আছে। তা যেমন পাশ্চাত্য চিত্র-ইতিহাস দ্বারা নির্মিত, তেমনই পাশ্চাত্য চলচ্চিত্রও এর নেপথ্যে আছে। স্থিরচিত্রের ফ্রেম একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ চিত্রভাষা। তার মধ্যেও চলমানতা থাকে, তবে তা তার নিজস্ব পরিধিতেই আটকে। চলচ্চিত্রর ফ্রেমে একটা আগের-পরের গল্প থাকে। তা একপ্রকার অসম্পূর্ণ। তা চলমানতায় সম্পূর্ণতা পায়। এটাই তার বৈশিষ্ট্য, একটা কৌতূহল জাগানো। এর থেকেই তার কম্পোজিশন বা দৃশ্য-কাঠামোর জন্ম। সেখানে স্পেস, শূন্যতা, বস্তু ও বস্তুর আন্তসম্পর্ক সবই কাঠামোর অঙ্গ। লিনিয়ার পারস্পেকটিভ বলে একটি বস্তু আছে। দূরে-কাছের বিষয়, চোখের বিভ্রম ইত্যাদি। এর চিত্রগত ইতিহাস ও আলোকচিত্রগত ইতিহাস সম্পূর্ণ ভিন্ন। চিত্র একধরনের কল্পিত দেখা, কৃত্রিম দেখা। আলোকচিত্র সেক্ষেত্রে, কৃত্রিম হলেও, অকৃত্রিমভাবে নির্মিত। পারিপার্শ্বিক আলোছায়ার সাহায্যে একটি চিত্রের নির্মাণ। এখানেও একধরনের কৃত্রিম নির্মাণ আছে। তবুও এর একধরনের বাস্তবতার সূত্র থাকে। বাস্তবের বাস্তবতা। কিন্তু এখানে চিত্র-ইতিহাসের প্রভাব প্রভূত। উনিশ শতকের শেষভাগে যখন, ইউরোপে শিল্পীরা স্টুডিওর বাইরে বেরলেন, ছবি আঁকলেন প্রকৃতির মধ্যে বসে, তখন থেকে দেখা ভিন্ন হল। সেই দেখায় শিল্পীর অবস্থান নির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

অন্যদিকে, চলচ্চিত্রে, জায়গা নিল ক্যামেরা, মানে তার চোখ। শিল্পীর চোখ দু’টি চোখে দেখত, ক্যামেরা একচোখে। তফাত এখানেও হল। ক্যামেরার নেপথ্যে, আলোকচিত্রী ও পরিচালকের মন কাজ করতে শুরু করল অনেক পরে। বিশ শতকের প্রায় মধ্যভাগে, যদিও শুরু প্রথমভাগে। এই মনকে বুঝতে দর্শকদের বহু সময় লাগল। আজও তারা বোঝে না। কারণ এই বোঝাবুঝিতে সংস্কার আছে। স্থানীয় সংস্কৃতি আছে, রাজনীতি আছে, অর্থনীতি আছে। দর্শক এসব দ্বারা আক্রান্ত, শিল্পীও আক্রান্ত। এখানে দূরত্ব রয়ে গেছে আজও। ঋত্বিককে কেন বোঝা যায়নি, তার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে এটা অন্যতম। ঋত্বিকের বিষয়, ক্যামেরার চলন, ছন্দ ও সংগীতের ব্যবহার কোনওটাই প্রচলিত ছিল না। ওঁর সমসাময়িকরাও বোঝেননি, ভয় পেয়েছেন, আতঙ্কিত হয়েছেন, বদনাম দিয়েছেন। ঋত্বিক তাই জীবদ্দশায় জনপ্রিয়তা পাননি, তবুও দমে যাননি।

আমরা দৃশ্যের সংগীত নিয়ে কথা বলছিলাম। ‘অযান্ত্রিক’-এ প্রকৃতি, তার আকাশ, পাহাড়, নদী, বনাঞ্চল এই সংগীত নির্মাণে প্রভূত সাহায্য করেছে। ঋত্বিক তাকে ব্যবহারও করেছেন। উনি প্রকৃতির এই সংগীতকে বুঝতেও পেরেছিলেন, শুধু ওঁরাওদের মাদলের তাল নয়, গাছের পাতার মর্মরধ্বনি, পাহাড়ি ঝরনার কুলকুল বয়ে যাওয়া, বিমলের উদাত্ত কণ্ঠে কালীর ভজনা করা সবই একসঙ্গে অর্কেস্ট্রার মতো বেজে ওঠে।

ঋত্বিক একদিকে যেমন ঠাসবুনটের মতো প্রচণ্ড আঁটোসাঁটো ফ্রেম ধরতেন, তেমনই বিপরীতে খোলা উন্মুক্ত আকাশকে দুঃসাহসের মতো, পাখির ওড়ার মতো করে খুলে রাখতেন ফ্রেম। আমাদের দৃশ্যের অংশ করে দিত, আমরা দৃশ্যের গভীরে চলে যেতাম। প্রকৃতিকে অসম্ভব ভাল বুঝতেন ঋত্বিক, তার আলোছায়া, তার কালো কালো আকাশ, জল, সবই সংগীতের মতো। একটা গ্রাফিক কোয়ালিটি, বলিষ্ঠ দেখা, এবং তার গতিময়তা, চলচ্চিত্রের কাহিনিকে দ্রুততা দিত। জগদ্দল মাইলের পর মাইল ছুটছে, তার বিরামহীন ছোটা, যেন প্রকৃতির সন্তান। নাম জগদ্দল হলেও তার ক্ষতি নেই, যে স্থবির নয়, সদা চলমান। শেষকালে যখন ও পিছলে পড়তে শুরু করল, ঢালুতে পিছলে গড়িয়ে গেল, যেন তার জীবনদীপ স্তদ্ধ হওয়ার উপক্রম হল। তাও বিমল চেষ্টা করে। একবার জীবন দান করে। সে একবারই, তাও বৃথা হল চেষ্টা। সে কাঁটাপুকুরে জীবন দেয়।

প্রকৃতি এই ছবিতে দৃশ্যের সংগীত নির্মাণ করেছিল

এক বিশিষ্ট শিল্পী একবার অভিযোগ করেদিলেন, ঋত্বিক নাকি মদ খেয়ে ছবি কাটতে ভুলে যেতেন। কী অশিক্ষিতর মতো কথা! উনি আরও বলেছিলেন, এখনকার পরিচালকদের এক স্বভাব হয়েছে, যখনতখন ছবিতে সাঁওতাল ঢুকিয়ে যাওয়া, ওটা যে সাঁওতাল নয়, ওঁরাও, তা অবশ্য ওঁর জানার কথা নয়। ওঁর এইসব আগডুম-বাগডুম কথায় মন্তব্যে যদিও লোকজন খেপে যায়। প্রায় আক্রমণ করতে যায়, তখন তিনি আবার বিষয়টা আরও জটিল করার জন্য বলেন, আজকাল একটা সমস্যা হয়েছে, সিপিএম ও ঋত্বিককে নিয়ে কিছু বললেই লোকে মারতে আসে। এটা দিল গত শতাব্দীর নব্বই দশকের কথা। উনি ‘অযান্ত্রিক’ নিয়ে মত দিচ্ছিলেন নন্দন প্রেক্ষাগৃহে। উনি এটাও জানতেন না, ছবির নাম ‘অযান্ত্রিক’ কেন, আর গাড়িটির নাম, বিমল কেন জগদ্দল রেখেছিল। খুবই স্বাভাবিক, এ-বঙ্গে, শিল্পীদের মধ্যে নানা ধরনের অশিক্ষিত মানুষ অবস্থান করেন। সভাটি ভেঙে যায়। আসলে এই ধরনের চলচ্চিত্র দেখা, চর্চা করা, অনুধাবন করার নিয়মিত অভ্যাস না থাকলে, একপেশে কোনও একটি কাজে পারদর্শী হলেই, সামগ্রিকভাবে বোঝা যায় না। চলচ্চিত্র একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাষা। কলা-আলোচক সন্দীপ সরকার খুবই অবজ্ঞাভরে একবার বলেছিলেন, চলচ্চিত্র কোনও শিল্পমাধ্যমই নয়। এই ধরনের অশিক্ষিতরা একথা চিরকালই বলে এসেছে। এরা বেশিদিন বাঁচেনি বলে বোঝেনি, শিল্পের ভাষা কীভাবে তার দিগন্ত ছাড়াচ্ছে। ডানা মেলছে। শিল্পের যে যে বিশেষ গুণের জন্য তাকে অন্যতম বিশেষ মাধ্যম বলা হয়, সংগীত-নৃত্যকলা ইত্যাদির পাশে রাখা হয়, তার সবক’টা গুণই চলচ্চিত্রের মধ্যে বর্তমান। শুধুমাত্র কিছুটা শিল্প-শিক্ষিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। তাতে আলোছায়া আছে, রেখার অমোঘ উপস্থিতি আছে, ভাস্কর্য আছে, কথকের ভূমিকা আছে, সংগীতের মুদ্রা আছে, স্থাপত্য আছে। একান্ত আবেগতাড়িত মুহূর্ত আছে।

ড্রাইভার বিমল ছিল একজন শিল্পী। সে নিজে জগদ্দলের পরিচর্যা করত, তার হৃদয়কে সে বুঝত। রোগভোগ হলে সারিয়ে তুলত। একথা বুঝত ছোট্ট সুলতানও, যে খদ্দের ধরত এক আনা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে। সে একবার চালনের আসনে বসে। বিশাল বিপত্তিও ডেকে আনে। শিল্পী শুধুমাত্র রংতুলির কারবারি হয় না। মোটর মেকানিকও শিল্পী হয়। বিমল, চলন্ত ট্রেনে উঠে পড়া হাসিকে দৌড়তে দৌড়তে কিছু কথা বলে। তার উত্তর সে পায় না। ওই উত্তর তার পাওয়ার কথা নয়।

ঋত্বিকের বার্তাও কেউ শুনতে পায়নি। সমাজ ও সভ্যতা খুবই নির্মম। সামান্য এক ড্রাইভার, প্রান্তিক মানুষ, প্রান্তেই থাকে, গরিব, কত টাকাই বা তখন ভাড়া হত, কুড়ি, দশ, পনেরো টাকা। পঞ্চাশ দশকে অবশ্য টাকার মূল্য অনেক ছিল। আমরা দু’টাকার থেকে বড় নোট চোখে দেখতাম না, দশ টাকা-ই অনেক টাকা। তাই দু’টাকা মণে জগদ্দল বিক্রি হয়ে যায়। ২০০০ সালে, ১২০০ টাকায় আমার বাহন, অ্যাম্বাসাডর বিক্রি করে দিতে হয়। কাঁটাপুকুরে।

একটা সমাধিক্ষেত্রও এই ছবিতে অনেক বার্তা দিয়ে যায়। রবি চ্যাটার্জীর শিল্প নির্দেশনা অসাধারণ ছিল। সমগ্র পরিবেশ এত বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছিল, এর মাঝে এক বিশেষ চরিত্র হয়ে উঠেছিল পাগল, যা ব্যক্তিগত জীবনে ঋত্বিক দেখেছিলেন। তার একমাত্র সম্বল একটি পুরনো গামলা, সেও একদিন গাড়ির চাকার তলায় চলে যায়, দুমড়েমুচড়ে যায়, ছবির শেষে সে একটা নতুন গামলা উপহার পেয়ে এই পুরনো গামলার শোক ভুলে গেল।

এখানে উল্লেখ থাক, ষাট দশকে, আরও একটি বাংলা চলচ্চিত্র হয়েছিল, এই ছবির হুবহু অনুকরণে, যা দেখতে দেখতে ঋত্বিক মাঝপথে রাগ ও বিরক্তিতে উঠে যান।