তারপর কী হল?’ গল্পকথনের সময়ে এইটুকু বলে দিলেই গল্প শেষ, না কি গল্পর ‘মজা’ শেষ? এই তর্ক ঘিরেই চলতে থাকে ‘স্পয়লার’ বিষয়ক আলোচনা। তবে বর্তমান সময়ে সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে ‘স্পয়লার’ শব্দটা সিনেমা-সিরিজের সঙ্গেই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছে; তবে ‘স্পয়লার’ বিষয়টি কেবলমাত্র সিনেমা কিংবা সিরিজ নামের অডিও-ভিজুয়াল মাধ্যমের সঙ্গেই জড়িয়ে নেই। শব্দের অক্ষরিক অর্থ বলছে, যে-কোনও মিডিয়ামেই (যেখানে কোনও কাহিনি বর্ণনা করা হচ্ছে), স্পয়লার থাকতে পারে। সে দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের ‘ঠাকু’মার ঝুলি’ই হোক, ফেলুদা-ব্যোমকেশ-কিরীটির কাহিনির মূল আততায়ীই হোক বা কোনও সিনেমা-সিরিজের কাহিনিক্রমের অপ্রত্যাশিত ‘বাঁকবদল’— দেখা যাচ্ছে, ‘স্পয়লার’ শব্দের প্রায়োগিক পরিধি অনেকটাই।
তবু আমরা দেখব— আজকাল কোনও সিনেমা/সিরিজের সমালোচনার সময়ে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিরোনামে— ‘স্পয়লার অ্যালার্ট’ লিখে দেওয়া থাকে (অর্থাৎ সিনেমা/সিরিজটি আগে দেখে থাকলে, তবেই লেখাটি পড়ুন, নইলে আপনিই বিপদে পড়বেন)। কোথাও আবার লেখা থাকে, ‘নো স্পয়লার্স অ্যাহেড’ (অর্থাৎ নিশ্চিন্তে পড়ুন, আপনার সিনেমা দেখার আনন্দ, উত্তেজনা এই লেখাটি পড়লে নষ্ট হবে না)। এখন প্রশ্ন হল, ‘স্পয়লার’ যদি আদপেও কেউ জেনে যান, তাহলে কি তিনি সত্যিই ‘সিনেমাটি’র রস উপভোগ করা থেকে বঞ্চিত হবেন? পাশাপাশি আর-একটি বিষয়ও জরুরি হয়ে দাঁড়ায়— সিনেমা কি তাহলে সম্পূর্ণ ‘স্পয়লার’ কেন্দ্রিক? এবং মানুষ গোটা ছবিটি দেখেন ওই ‘নির্দিষ্ট’, ‘অপ্রত্যাশিত’, ‘বাঁকবদল’ দেখবেন বলেই? তা তো আদপে নয়! তবুও কেন ‘স্পয়লার’ নিয়ে এত বাড়াবাড়ি? এত রক্ষণশীলতা? এর উত্তর খুঁজতে একটু ইতিহাসের পাতা ওলটানো যাক।
আরও পড়ুন: একজন নির্দোষ অপরাধীর গল্প, সিনেমায় কীভাবে অনুবাদ করেছিলেন আলফ্রেড হিচকক? লিখছেন অতনু ঘোষ…
১৯৬০ সালে প্রকাশিত ‘দ্য ওম্যান ইন হোয়াইট’ উপন্যাস প্রসঙ্গে লেখক উইলকি কলিন্স সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়ে সমালোচকদের অনুরোধ করেন যে, তাঁরা পাঠপ্রতিক্রিয়া লেখার সময়ে কাহিনির মূল বিষয়গুলো যেন জনসমক্ষে প্রকাশ না করে দেন। ‘স্পয়লার’ নিয়ে রক্ষণশীলতার নিদর্শন হিসেবে এটিকেই অন্যতম প্রধান উদাহরণ হিসেবে ধরা যেতে পারে। কিন্তু, এ তো গেল উপন্যাসের কথা, সিনেমায় এ-নিয়ে মাতামাতি কবে থেকে শুরু হল?
তথ্য বলছে, ১৯২৬-এ মুক্তিপ্রাপ্ত রোনাল্ড ওয়েস্ট-এর ‘দ্য ব্যাট’ চলচ্চিত্র শুরুর আগে টাইটেল কার্ডে এই মর্মে বিবৃতি ছিল— “আপনি কি একটা কথা গোপন রাখতে পারেন? ছবিতে ‘ব্যাট’ আসলে কে, সেটা অনুগ্রহ করে সিনেমা হল থেকে বেরিয়েই প্রকাশ করে দেবেন না। পরবর্তী দর্শকদের উপভোগের জন্য রহস্য-আখ্যানটির ধাঁধাটুকু বজায় রাখুন।” এখানে উল্লেখ্য, ‘দ্য ব্যাট’ চলচ্চিত্রটি ১৯২০ সালে প্রদর্শিত ব্রডওয়ে থিয়েটারের একটি প্রযোজনা থেকে অনুপ্রাণিত। সেই প্রযোজনার লেখক ছিলেন রবার্টস রাইনহার্ট ও অ্যাভেরি হোপউড। এখানেই আর-একটি বিষয় উঠে আসে। ব্রডওয়ে থিয়েটার-এ যখন বহু মানুষ প্রযোজনাটি দেখেছেন, তাঁদের অনেকেই নিশ্চয়ই গল্পের বাঁকবদল সম্পর্কে অবগত। এই মানুষগুলোর অনেকেই আবার সিনেমাটি দেখবেন, তাঁদের কাছে তাহলে ‘স্পয়লার’ কোনটা?


আসলে ‘স্পয়লার’ বিষয়টা সম্পূর্ণ একমুখী নয়। ধরা যাক, কোনও বিশেষ জনপ্রিয় সাহিত্যের চলচ্চিত্রায়ন হচ্ছে। সে ‘হ্যারি পটার’, ‘শার্লক হোমস’, ‘মিস মার্পেল’-ই হোক বা ‘ফেলুদা’। অনেক দর্শকই ছবিটি দেখতে যান গল্পটি আগে থেকে পড়ে। তাঁরা তো জানেন শেষ পর্যন্ত কী হচ্ছে, তাহলে কি তাঁদের কাছে ‘স্পয়লার’-জাতীয় কোনও বিষয়ের অস্তিত্ব বা চমক নেই? না কি তা আছে, কিন্তু সম্পূর্ণ অন্য আঙ্গিকে? যিনি গল্পটি আগে থেকে জেনেই সিনেমা দেখতে গিয়েছেন, তাঁর কাছে আলাদা করে কীই-বা এমন অনুভূতি হবে, যা তাকে ছবিটি দেখার জন্য একই রকম উত্তেজক, ভাললাগার অনুভূতি দেবে? তা হল— ‘গল্প বলার ধরন’ বা সিনেমার পরিভাষায় ‘ন্যারেটিভ স্টাইল’। আসলে ‘স্পয়লার’-এর মধ্যে যে নিহিত উত্তেজনা, তা অনেকটাই নির্ভর করে গল্প কীভাবে বলা হচ্ছে তার উপর। এ-প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, সত্যজিৎ রায় যখন ‘সোনার কেল্লা’কে চলচ্চিত্রায়িত করলেন, তখন হু-ডান-ইটের চেনা ছকের বাইরে এসে শুরুতেই চিনিয়ে দিলেন অপরাধীকে।
ফিরে আসা যাক ইতিহাসে। ‘দ্য ব্যাট’-এর পর, ১৯৫৫ সালে হেনরি জর্জ ক্লুজো নির্মিত ফরাসি চলচ্চিত্র ‘Le Diabolique’ ছবিটির শেষেও একটি টাইটেলে কার্ড প্রদর্শিত হয়, যেখানে স্পয়লার দেওয়াকে রীতিমতো ‘শয়তানি’ বলে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ‘শয়তানি করবেন না! সিনেমায় যা দেখলেন, সেটা আপনার বন্ধুদের বলে দিয়ে তাঁদের আগ্রহ নষ্ট করবেন না। আপনার বন্ধুদের তরফেই আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা রইল।’
এর পর আসা যাক আলফ্রেড হিচকক নির্মিত ‘সাইকো’ ছবিটির প্রসঙ্গে। ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত রবার্ট ব্লট-এর উপন্যাস ‘সাইকো’ অবলম্বনে, ১৯৬০ সালে ছবিটি নির্মাণ করেন হিচকক। ছবিটি নিয়ে দু’টি গল্প ছড়িয়ে। এক, সিনেমা দেখার শেষে হিচকক নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছিলেন— কেউ যাতে কোনওভাবেই আগেভাগে বেরিয়ে, অভিনেত্রী জ্যানেট লে যে আগেই মারা যাচ্ছেন, সেটা যেন বলে না দেয়। আর-একটি গল্পও ছড়িয়ে। হিচকক নাকি মূল উপন্যাসটির সমস্ত কপি কিনে নিয়েছিলেন বাজার থেকে, যাতে কেউ আগে থেকে গল্প না জানতে পারে।


স্পয়লারকে কেন্দ্র করে বিজ্ঞাপনের উদাহরণও রয়েছে। নিল জর্ডন পরিচালিত ‘The Crying Game’ ছবিটির বিজ্ঞাপনী প্রচারে লেখা হয়— ‘The movie everyone is talking about, but no one is giving away it’s secrets.’ লক্ষণীয়, এখনও পর্যন্ত কিন্তু ‘স্পয়লার’ শব্দটার কোনও হদিশ নেই। যা বলা হচ্ছে, তা স্পয়লারের ব্যাখ্যা, কেন্দ্রীয়বিষয়। তাহলে ‘স্পয়লার’ শব্দটুকু জনপ্রিয় হল কবে থেকে?
১৯৮৩ সালে ‘স্টার ট্রেক ২: দ্য রথ অফ খান’ মুক্তি পাওয়ার চারদিন পর, একটি ‘ইউসনেট’ থেকে সমালোচনা প্রকাশিত হয়, যার শিরোনামে লেখা ছিল ‘SPOILER ALERT’। আজ আমরা স্পয়লার নিয়ে যে ‘বাড়াবাড়ি’ দেখি, তার সূচনা সাতের দশকের শেষ ভাগ ও আটের দশকের থেকেই। এরপর যখন ‘মারভেল ইউনিভার্স’ চলচ্চিত্র জগতে এল, সে-সময়ে ‘স্পয়লার’ এতটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল, মানুষ কিংবা প্রযোজনা সংস্থা— সবার কাছেই মাথা ব্যথার বিষয় হয়ে উঠল স্পয়লার, কারণ ‘স্পয়লার’ ব্যবসার প্রভূত ক্ষতি করতে শুরু করেছিল। অতএব ভাবা শুরু হল, কীভাবে ‘স্পয়লার’-এর কবল থেকে বাঁচা যায়।
বিচিত্র সমস্ত পন্থা অবলম্বন করতে শুরু করল প্রযোজনা সংস্থাগুলি। ধরা যাক ছবির ট্রেলারে যা দেখানো হবে, মূল ছবিতে গিয়ে সেটাই আমূল বদলে দেওয়া হল। রবার্ট জেমিক্স-এর ‘কাস্ট অ্যাওয়ে’, ডেভিড লেইচ পরিচালিত ‘ডেডপুল ২’ এর অন্যতম উদাহরণ। আবার, ডেভিড ফিঞ্চার পরিচালিত ‘সেভেন’ ছবিতে, অভিনেতা কেভিন স্পেসির ভূমিকা লুকিয়ে রাখা হয়। ছবিটির বিজ্ঞাপনী প্রচার, সাংবাদিক সম্মেলন— কোথাও-ই আগে থেকে কেভিন স্পেসির মতো প্রথম সারির জনপ্রিয় অভিনেতার কথা প্রকাশ্যে আনা হয়নি। উদ্দেশ্য একটাই, যিনি ছবির মূল অপরাধী, তাকে লুকিয়ে রেখে শেষে দর্শককে ‘চমক’ দেওয়া।

অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে স্পয়লার শুধুমাত্র কাহিনির বাঁকবদলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। গল্প ছাড়িয়েও অন্য নানা বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। বিশেষ করে লক্ষণীয়— যে-স্পয়লার এক সময়ে ‘সিনেমা-ব্যবসা’য় ক্ষতির নামান্তর ছিল, তাকেই হাতিয়ার করে সিনেমার বিজ্ঞাপনী প্রচার শুরু হল। ‘স্পয়লার’-এর কোপে পড়েছেন অনেক অভিনেতারাও। ‘স্টার ওয়ার্স’-এর পঞ্চম এপিসোড ‘দ্য এম্পেয়ার স্ট্রাইকস ব্যাক’-এর ‘স্পয়লার’ দিয়ে দেওয়ার জন্য— এক সময়ে ডেভিড প্রাউস-এর মতো অভিনেতাকে ব্যান করে দেয় প্রযোজনা সংস্থা। ‘স্পয়লার’ দিয়ে দেওয়ার জন্য প্রযোজনা সংস্থার কোপে পড়েন মার্ক রুফালোর মতো অভিনেতাও। ‘দ্য টুনাইট শো উইথ জিমি ফ্যালন’-এ অতিথি হয়ে এসে, ‘অ্যাভেঞ্জার্স এন্ড গেম’-এর নাম প্রযোজনা সংস্থার ঘোষণার আগেই, প্রকাশ্যে বলে দেন তিনি।
সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে স্পয়লার যে হু হু করে বাড়বে, সে-ই তো স্বাভাবিক! কিন্তু স্পয়লার যে সামগ্রিকভাবে সিনেমার ‘রস’ নষ্ট করে, তা বোধহয় সঠিক নয়। পাশাপাশি স্পয়লার তো শুধুমাত্র ‘থ্রিলার’, ‘হরর’-এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, সিনেমার অন্য ঘরানার ক্ষেত্রেও ‘স্পয়লার’ থাকতে পারে। জঁ লুক গোদারের ‘ব্রেথলেস’ ছবিতে নোয়া ধাঁচের থ্রিলারের ইঙ্গিত থাকলেও স্পয়লার কি এহেন ছবির অভিজ্ঞতায় কোথাও কোনও দাগ কাটতে পারে? না কি কেবলই আখ্যানের ভেতর লুকিয়ে থাকা চমক, বা ‘টুইস্ট’-এর তাৎক্ষণিক উত্তেজনা নষ্ট হওয়ার অনুঘটক হতে পারে স্পয়লার? এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে দর্শকের নিজস্ব অনুভাব-বিভাব প্রক্রিয়ার মধ্যে।




