কোনও এক স্থিতিস্থাপকতা আমাদের রক্তে প্রবেশ করেছে। অর্থ হয়, মানুষগুলো সব রবারের তৈরি এক-একটা বডি। পেটে লাথি মারলে সিঁটিয়ে যায়। কুঁচকে যায়। দেশপ্রেমের উগ্র টান মারলে টানটান হয় হেবি। তারপর সেই একরিয়েলিটি। স্টার জলসা। যৌনতা। ইনস্টাগ্রাম রিলস। আদতে, আমাদের সয়ে গেছে সব। অক্সফোর্ড ইউনিয়ন সোসাইটি-র একটি সভায় স্লোভেনিয়ান দার্শনিক স্ল্যাভো জিজেক বলছেন: ‘হোয়াট মেক্স মি রিয়েলি স্যাড টুডেইজ, আই ক্যান নট ইউজ দিজ ওয়ার্ড বাট এক্সপ্লোডিং শেমলেসনেস!’ ইদানীং, যে কোনও খাবারের দোকানে কান পাতলেই শোনা যায়, ঝরে ঝরে পড়ছে। আসলে ঝরে ঝরে পড়ছে আমাদের বেহায়াপনা। যেন একটা বিবস্ত্র একবিংশ শতাব্দী লাট খাচ্ছে, নিজের মাংস খুবলে খাচ্ছে নিজেই, তারপর সানগ্লাস পরে সেলফি তুলছে অজস্র! আর আমরা? একটা আশ্চর্য অসাড়তার ভেতর দাঁড়িয়ে স্মার্টফোন হাতে ভিডিও করছি।নির্লজ্জের মতো!
স্ল্যাভো জিজেক বলছেন: থিংস হুইচ ইন পাবলিক স্পেস ওয়ের ইমপসিবল ইভেন ইন টেন ইয়ার্স অ্যাগো, ইউ ক্যান সে দেম পাবলিকলি টুডে। এরপর জিজেক যে উদাহরণ দিয়েছিলেন, শুনে থ মেরে যায় স্নায়ু। এক ইজরায়েলি সৈন্য, ব্যাটেল-ট্যাঙ্ক দিয়ে পিষেছিলেন কয়েকশো নিরস্ত্র প্যালেস্তিনীয়ের জ্যান্ত শরীর। তারপর সেই সৈন্য আত্মহত্যা করে। ইজরায়েলি ডিফেন্স ফোর্স সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছে, একজন সৈন্যর এথিক্স এতখানি দৃঢ় হবে কেন? কেন সেই এথিক্স এখনও ক্রিয়াশীল? বেহায়া কোথাকার!
এ-কথা বলা হল পাবলিক স্পেসে। সদর্পে। তেমনই নিউজ চ্যানেল, যা একধরনের পাবলিক স্পেস— দিনকয়েক আগে সম্প্রচার করেছে একটি ধর্ষণের ভিডিও। এইবার মিডিয়া এথিক্সের প্রসঙ্গে যদি আসি, তাহলে তৈরি হয় দুর্দান্ত কিছু মিম। বলতে চাইছি, সেই ধর্ষণের ভিডিও বহু মানুষ খুঁজে খুঁজে দেখেছেন। কনজিউম করেছেন। কেন করেছেন? মিডিয়া দেখিয়েছে তাই? শুধু তাই নয়। আছে একধরনের প্লেজার। মানসিক সুখ। ইরানে ব্যালিস্টিক মিসাইল ছুড়ে যে সুখ অনুভব করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প! সেই যুদ্ধের ভিডিও দেখতে চেয়েও কিন্তু আমাদের জিভ হরদম লকলকে। লিংক চাই। লিংক। অর্থাৎ, অদেখা বলে এ-পৃথিবীতে আপাতত কিস্যু নেই। সবটাই খুল্লমখুল্লা।
আরও পড়ুন: রিল কীভাবে বদলে দিচ্ছে আমাদের গান শোনার অভ্যেস?
লিখছেন আদিত্য ঘোষ…
প্রায় পনেরো বছর আগে, দিবাকর ব্যানার্জি একটি ছবি তৈরি করেন। ‘লাভ, সেক্স অউর ধোঁকা’। ছবিটি অদ্ভুত। শুটিং-এ ব্যবহৃত হয়েছিল হ্যান্ডিক্যাম। নাইট ভিশন ক্যামেরা। স্পাই ক্যামেরা। সিসিটিভি ফুটেজ। সিনে-ক্যামেরা ছেড়ে হঠাৎ এই ধরনের ক্যামেরা কেন? ছবিটির নির্মাণ-প্রক্রিয়া যে সময় শুরু হচ্ছে, বিশ্ব-বাজারে তখন নানাবিধ এমএমএস ক্লিপ ট্রেন্ডিং! অধিকাংশই সেক্সটেপ। একটি সাক্ষাৎকারে দিবাকর বলছেন, যে লিকড ভিডিওগুলো আমরা কনজিউম করছি, তা দু’জন ভীষণ ব্যক্তিগত ও অকপট মুহূর্তের। কনসেন্টের কোনও বালাই নেই। কারণ পুরোটাই, এক অথবা দুজন মানুষের অগোচরে ঘটে চলেছে। এহেন ভিডিও সাধারণত কনজিউম করেন যারা, উদ্দেশ্য থাকে কেবলমাত্র যৌনসুখ। জুতসই কোনও প্রেক্ষাপট অথবা গল্প তৈরি করে, আমি চেয়েছিলাম দর্শক যেন ওই ভিডিওর চরিত্রগুলোর সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়! তবেই অস্বস্তি অথবা পাপবোধ অনুভূত হবে শরীরে। তবেই মনে হবে, খুব ডিস্টার্বিং ভিডিও!

দিবাকর ব্যানার্জি যে রাজনীতির কথা বলেছিলেন, তা কিন্তু ওই জিজেকের বলা ‘এক্সপ্লোডিং শেমলেসনেস’ থেকেই উদ্ভূত! সম্প্রতি, এক বাঙালি অভিনেতার এমন একখানি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। অদেখার প্রতি আমাদের অনিবার্য আকর্ষণ আরও একবার চাগাড় দিয়ে উঠেছে। কী দেখব, আর কী দেখব না—এই বিষয়ে নীতিপুলিশি করব বলে লিখতে বসিনি! কিন্তু একটি ধর্ষণের ভিডিও আপনি দেখছেন, কারণ আপনার চয়েজ— তাহলে সেই চয়েজের অভিঘাত বিপুল। সেই মুহূর্ত থেকেই, এথিক্স যায় ভোগে। একটা ভিডিও থেকে অন্য ভিডিও। আমাদের মনগুলো হাইজাম্প দেয়। স্থাণু হয় না কোত্থাও।
চোখের সামনে সর্বক্ষণ কোনও ভিডিও ঘুরছে। দেখুন বন্ধুরা, বাজারে গিয়ে কাতলা মাছ কিনলাম, না তেলাপিয়া। দেখুন বন্ধুরা, একটা বিরিয়ানির হাঁড়ি খোলা হচ্ছে। আপনি দেখছেন, কুৎসিত গরমের মধ্যে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। কুড়ি-পঁচিশটা স্মার্টফোন তাকে ঘিরে ধরেছে। যেন গিলে খেয়ে নেবে। অথচ সে পালাতে চাইছে না। বিরিয়ানির হাঁড়ি খুলছে আইফোনের সিনেম্যাটিক শটে! বিছানায় শুয়ে, দারুণ উপভোগ করছেন। কিন্তু কেন করছেন? সারবস্তু কী এ-ভিডিওর? গোপাল কীভাবে ঘুমোল, শাশুড়ির সঙ্গে কেন পুঁইশাক নিয়ে ঝগড়া করলাম, প্রেমিকা কী সারপ্রাইজ দিল— একটা গোল্লা পাকিয়ে পাবলিকের সামনে গড়াগড়ি খাচ্ছে। এই সমস্তটাই কিন্তু অপটু হাতে তৈরি আনাড়ি ভিডিও। তবু ভাল লাগছে। ফলস্বরূপ, আমাদের দর্শন গুলিয়ে যাচ্ছে। যাবতীয় ব্যক্তিগত— ভ্যানিশ!
দেখা এবং অদেখা— দুইয়ের রাজনীতি আসলে জটিল। তামাম দুর্নীতির কতশত দৃশ্য আমাদের দেখা হয়েছে। সাধারণ মানুষের হাতে ভিডিও সেখানে মোক্ষম অস্ত্র। ক্ষমতাও বলা চলে। সম্প্রতি এড শেরানের একটি গান খুব ভাইরাল। স্যাফায়ার। দেখলাম, সেই গানে ইনস্টাগ্রাম রিল বানিয়েছে বাংলাদেশের এক নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষ। সোশ্যাল মিডিয়ায় অতি জনপ্রিয় তিনি। অর্থাৎ, গানের কনজিউমার কোনও শ্রেণির ভেদ-বিভেদের তোয়াক্কা করছে না। সব ধরনের মানুষের কানে সে পৌঁছচ্ছে। অথচ পৌঁছনোর পরে কী করবে— তা ভেবে আকুল। ঠিক তেমনভাবেই, ব্রিটিশ রক ব্যান্ড ‘কোল্ডপ্লে’-র একটি কনসার্টের যে ভিডিও ভাইরাল হল, মার্কেটে সেই ভিডিওর খুব কাটতি। কারণ প্লেজার। অবদমিত কোনও সুখ। কারণ আমরা বুঝেছি, সেই ভিডিওতে একধরনের অবৈধতা আছে। গোপনীয়তা আছে। তাই আমরা দেখতে চাইছি। না দেখলে রক্তে যেন বান ডাকবে।
শেষ করি, দেবাশিষ মাখিজার একটি ছোট ছবির কথা বলে। নাম, ‘আগলি বার’। এ-ছবিও শুট করা হয়েছে স্মার্টফোন এবং ল্যাপটপের ক্যামেরায়। ভিডিওয় দেখা যাচ্ছে, জাভেদ নামের একটি প্রেমিকার সঙ্গে ভিডিও কলে ব্যস্ত। প্রেম করছে। কিছু সময় পরে, আচমকা ভিডিও কেঁপে ওঠে। স্ক্রিন ব্লার হয়ে যায়। ওপার থেকে মেয়েটি বলে, জাভেদ! কী হয়েছে? তৎক্ষণাৎ একটি লোক ফোনটা তোলে। জান্তব মুখ। কপালে গেরুয়া তিলক। আমরা বুঝি জাভেদকে সে খুন করেছে।
এই যে অদেখা, অথচ সত্যের মতো ভায়োলেন্স দেবাশিষ মাখিজা খুলে দিলেন আমাদের সামনে, সেই অদেখার লিংক কেমন? প্লেজার কেমন? আদৌ বলা সম্ভব?