শিক্ষার্থী হিসেবে রমাদা (রমাপ্রসাদ বণিক)-র কাছে আমি পৌঁছতে পারি ’৮২, ’৮৩ সাল নাগাদ। রমাদার সবচেয়ে বড় গুণ— কাজ ছাড়াও মানুষের সঙ্গে, বিশেষ করে দলের সদস্যদের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক তৈরি করে ফেলতেন। বারবার একটা কথা বলতেন, থিয়েটার করে যদি আনন্দই না পাওয়া যায়, আর থিয়েটার করে যদি দলের সদস্যদের সঙ্গে যোগস্থাপনই না-হয়, তাহলে থিয়েটার করে লাভ কী! গোড়ার দিকে এইরকম মনোভাব ছিল ওঁর। এতটাই পারফেকশনিস্ট ছিলেন, একটা ‘হ্যাঁ’ কিংবা ‘না’-র মতো সংলাপও যতক্ষণ না পর্যন্ত ঠিক হবে, ততক্ষণ কাজ চালিয়ে যেতেন।
একটা সময় পর্যন্ত আচার্য শম্ভু মিত্রর কোলে মাথা রেখে মানুষ হওয়া ব্যক্তিত্ব উনি। ফলত, শম্ভু মিত্রর কাছ থেকে ওঁর যা-যা পাওয়া, সবটাই নিজের থিয়েটার-ভাবনার প্রয়োগে ব্যবহার করতেন। পরবর্তীতে যখন উৎপল দত্তর নির্দেশনায় নাট্য আকাদেমি-তে ‘দ্য টেম্পেস্ট’ অভিনীত হল, তখন আমি একটু মজা করেই বলেছিলাম, ‘এইবার তোমার ‘বহুরূপী’-র বারোটা-টা বাজবে।’ কারণ সে-সময়ে উৎপলদা (উৎপল দত্তর) কাজ সম্পর্কে আমার সম্যক ধারণা ছিল, সেখান থেকেই কথাটা বলা। উনি যখন বুঝলেন তার সুবিধেটা, সঙ্গে-সঙ্গে অ্যাডাপ্টও করলেন।
এই ক্ষমতাটা ওঁর ছিল, অন্য ভাবনার ক্ষেত্রগুলোর কাছাকাছি পৌঁছতে পারতেন। আটের দশকে যে-অবস্থানে উনি ছিলেন, তা থেকে ধীরে-ধীরে বদলাচ্ছিলেন রমাদা। অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়েরও খুব প্রিয় পাত্র ছিলেন, ভীষণই সম্মান করতেন অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাটককে। এই যে বিভিন্ন নাট্যধারার সঙ্গে জুত করে নেওয়া, এটা ওঁর ভেতর সাংঘাতিক ছিল। যদিও যে-দর্শনে শেষাবধি বিশ্বাস করেছেন, তা শম্ভু মিত্রর থেকেই পাওয়া।
থিয়েটারের জন্য তৎকালীন সময়ে যে আত্মত্যাগ উনি করেছিলেন, তা আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আর ভাবতে পারা যাবে না। সিরিয়ালের পরিচালক হিসেবে ততদিনে প্রতিষ্ঠিত তিনি। কিন্তু থিয়েটারের জন্য কেবল, তেরো পর্বের সিরিয়াল নির্দেশনার কাজ তিনি ছেড়ে দিতে পেরেছিলেন। তখন কিন্তু অফিস ক্লাবের থিয়েটার নির্দেশনা ছাড়া ওঁর অন্য কোনও রোজগার ছিল না। তা সত্ত্বেও এই দার্ঢ্য তিনি দেখাতে পেরেছিলেন। ওঁর কাছ থেকে এই জীবনদর্শনটাও শিক্ষণীয়।
একজন শিক্ষার্থী যদি খুব মন দিয়ে ওঁর কথা শুনতেন, তাহলে সামগ্রিক থিয়েটারের একটা স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যেতে পারত। ঘাড়ে ধরে নয়, কিন্তু সেই ধারণাটুকু তাঁর মগজে গেঁথে দেওয়ার কাজটা রমাদা জানতেন।
রমাদা চলে যাওয়ার পর ওঁর অভিনয়-শিক্ষার ধারা যে খুব একটা বাহিত হয়েছে, তা নয়। এমনকী, পরে যখন আবার থিয়েটারের দল তৈরি করলেন রমাদা, তখনও খুব একটা উত্তরাধিকার তৈরি হয়নি। তবে আমাদের কয়েকজনকে রমাদা হাতে ধরেই তৈরি করেছিলেন, যাঁরা বিভিন্নভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। এই ধারাবাহিকতার দিকটা দেখলে আবার উৎপলদা, উৎপল দত্তর কাছাকাছি কেউ নেই।