তাঁর সম্পর্কে ব্রিটানিকার আন্তর্জাল সংস্করণে লেখা আছে: influential in stimulating Western appreciation of classical Indian music। এমনটাই তো হওয়ার কথা ছিল। নিতান্ত শিশুকালেই ভারতীয়সংগীত এবং সংস্কৃতি দলের এক ক্ষুদে সদস্য হিসেবে যাঁকে ঘুরে বেড়াতে হয়েছিল পৃথিবীবিখ্যাত সব সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে, নেহাতই আপতিক যোগে দেখে ফেলেছিলেন পৃথিবীর তাবড় শিল্পিত প্রতিভাদের, তিনি যে কালে-কালে ভারতীয়সংগীতের এক সর্বোত্তম প্রতিনিধি হয়ে উঠবেন সেটা একরকম স্থির করাই ছিল যেন। ভারতীয়সংগীতকে যাঁরা বিশ্বতোমুখী করেছেন তাঁদের মধ্যে একেবারে প্রথমেই যাঁরনাম না থাকলে ইতিহাস বিকৃতির দায় বর্তাবে আমাদের উপর, তিনি বিশ শতকের সমবয়সি উদয়শঙ্কর (১৯০০-১৯৭৭)। কিন্তু উদয়-রবির এই যে বিশ্বমুখিনতা। তার পেছনে এঁদের পিতা শ্যামশঙ্কর রায়চৌধুরীর অবদান রয়েছে।
রবিশঙ্কর তাঁর স্মৃতিতে অনেকবারই শৈশবে নিজের বাবার প্রতি একটা বিরূপতার কথা বলেছেন, কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গে তাঁর বিশ্ববীক্ষা আর জ্ঞান ও শিল্প-অন্বীক্ষার উত্তরাধিকার যে তাঁরা বহন করছেন, সে কথাও বলেছেন একইসঙ্গে।
যশোরের কালিয়া গ্রামে ১৮৭৭ সালে এক ব্রাহ্মণ-জমিদার পরিবারে জন্মানো মানুষটি কেবল জমিদার হয়েই জীবন কাটাতে চাননি। সংস্কৃত, বাংলা, ইংরেজি, ফরাসি-সহ বেশ কয়েকটি ভাষায় দক্ষ শ্যামশঙ্কর কলকাতা-বারাণসী হয়ে মাত্র একুশ বছর বয়সে একটি দেশীয় রাজ্যের (পিপলোদা,মধ্যপ্রদেশ) সচিব পদে যোগ দেওয়া, ঝালাওয়াড় (উদয়পুর, রাজস্থান— উদয়পুরে জন্ম বলেই বড় ছেলের নাম উদয়শঙ্কর) রাজ্যের নানা দায়িত্ব পেরিয়ে বিদেশমন্ত্রী হওয়া এবং পাকাপাকিভাবে বিশ্বমানব হয়ে ওঠা— এসবই তাঁর পুত্রদের প্রণোদিত করেছিল সন্দেহ নেই। বেনারসে শ্যামশঙ্কর রীতিমতো ধ্রুপদে তালিম নিয়েছিলেন, বিদেশে তিনি নিয়মিত নৃত্যে এবং অভিনয়ে (প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ১৯১৫ সালে লন্ডনে নিজেরই তৈরি ‘Hindu Mystic Ballet’ মঞ্চস্থ করেছেন যুদ্ধে অংশ নেওয়া ভারতীয় সৈন্যদের জন্য, The Great Moghul’s Chamber of Dreams মঞ্চস্থ করেছেন ১৯২৪-এ। ১৯২৪-এর ২০শে মার্চ ‘The Times’ পত্রিকা তাঁর সম্পর্কে লিখেছিল— based on native melodies collected by Pandit Shyam Shankar, and orchestrated by Western musicians.) অংশ নিয়েছেন। লিখেছেন একাধিক বই (‘Wit and Wisdom of India, Buddha and His Teachings’, ইত্যাদি)। আদব-কায়দায় বিশ্বমানব হয়েও তাঁর মধ্যে একজন বাঙালি ভারতীয় বাস করেছে সবসময়। জীবনে নিজের সন্তানরা যাতে এক-একজন স্বয়ং সম্পূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠে নিজের ক্ষমতায় সেদিকেও তাঁর দৃষ্টি ছিল। নিজের সন্তানদের উদ্দেশ্যে লিখেছিলেন— ‘My children I wanted to be self-reliant in the same way as I trained myself without a father’s care and protection. I sought to combine a Sannyasi’s non-attached life with a family life. Anyhow the world is my real family— I have never been narrow in my views or in my ambition to do some good to the world and to my mother-country, which outweighed all the other conditions in my life.’ এমনকী রবিশঙ্করের জীবনে যে এক গভীর আধ্যাত্মিক অনুসন্ধান ছিল সেটা তাঁর বাবার থেকেই পাওয়া— নিজেও বলেছেন সেকথা।

একথা বাহুল্য যে শ্যামশঙ্করের পুত্রদের জীবনে তাঁর প্রভাব যথেষ্ট— একইসঙ্গে ভারতীয় এবং বিশ্বমানব হয়ে ওঠা। ১৯৩০-এর ৩১ অক্টোবর মাত্র সাড়ে দশ বছর বয়েসে রবিশঙ্কর তাঁর বড় দাদা উদয়শঙ্করের দলের সঙ্গে প্যারিসে পৌঁছালেন। তার আগে বেনারসে থাকার সময়েই তাঁর অন্য দুই দাদা রাজেন্দ্র আর দেবেন্দ্রর সাহচর্যে ভারতীয় সংগীতের দুনিয়ায় তাঁর প্রবেশ ঘটে। কিন্তু প্যারিসে পৌঁছে তিনি যেন বিশ্বসংগীত এবং সংস্কৃতির এক মহাসমুদ্রে অবগাহনের সুযোগ পেলেন। উদয়শঙ্করের মতো এক সংস্কৃতি পুরুষ ছিলেন তাঁর রোল মডেল। উদয়শঙ্করের সূত্রে তাঁদের প্যারিসের ডেরায় আসতেন বিখ্যাত নর্তকী সিমকি, বিষ্ণুদাস শিরালী, তিমিরবরণ ভট্টাচার্য-সহ বহু কৃতবিদ্য সংগীত সাধক, চলত মহড়া— রবিশঙ্করের নিজেই বলেছেন তিনি একটা স্পঞ্জের মতো এই সব শব্দ আর অভিজ্ঞতাকে শুষে নিয়েছেন। তরুণ ইহুদি মেনুইনকে তিনি এই সময়েই দেখেছেন প্রথম— পরে যে মেনুইনের সঙ্গে তাঁর এক দীর্ঘস্থায়ী সাংগীতিক যাত্রা শুরু হবে, তার বীজ তো এই সময়েই উপ্ত হয়েছিল। রবিশঙ্করের প্রথম প্যারিসবাস তাঁকে বিশ্বমানব করে তুলল— শিশু রবীন্দ্রশঙ্কর (বাবা-মায়ের আদরের ‘রবু’, যে নামে তাঁর গুরু আলাউদ্দিনও তাঁকে ডাকতেন) শিল্পী রবিশঙ্কর হয়ে ওঠার পথে এগিয়ে চললেন।
এখানে একটা কথা বলে নেওয়া দরকার যে— শুধু সংগীত আর সংস্কৃতি নয়, বাংলা, ইংরেজি আর ফরাসি ভাষা ও সাহিত্যে তাঁর যে গভীর প্রবেশ ছিল তার শুরু এখানেই। প্রথমবার ইয়োরোপ থেকে দেশে ফেরার পরে ইম্প্রেসারিও হরেন ঘোষ তাঁদের দলকে নিয়ে গিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করাবার জন্য। সেই অভিজ্ঞতা রবিশঙ্কর নিজেই এক সাক্ষৎকারে বলেছেন— তিনি আইনস্টাইন, রোমাঁ রোলাঁর মতো বিশ্বখ্যাত মানুষদের দেখেছেন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্ব যেন তাঁকে সম্মোহিত করেছিল, মানুষের যে ওইরকম একটা ব্যক্তিত্ব হতে পারে, সেটা তাঁর বোধের বাইরে ছিল। সেই সাক্ষাতেই রবীন্দ্রনাথ তাঁকে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন— ‘বাবার মতো বড়ো হোয়ো, দাদার মতো নাম কোরো।’ (সাক্ষাৎকারের অংশটি এখানে শুনে নিতে পারেন: https://youtu.be/xg4Rvg67WwY
এই নিবন্ধে রবিশঙ্করের গুটিকয়েক রেকর্ডিং-এর কথা উল্লেখ করা হবে, যেগুলি সচরাচর আলোচিত হয় না।


দ্বিতীয়বার ইউরোপ ভ্রমণে রবিশঙ্কর একেবারে সরাসরি উদয়শঙ্করের দলভুক্ত হয়ে গেলেন একজন কুশীলব হিসেবেই। অন্তর্জাতিক মঞ্চে তাঁর শুরুটা নৃত্যশিল্পী হিসেবেই— দাদার দলে তিনি নিয়মিত নৃত্যে অংশ নিয়েছেন (এর আগেই ভারতে ফিরে বালাসরস্বতীর নাচে মুগ্ধ হয়ে প্রেমেও পড়েছিলেন রবি)। পুত্র দেবেন্দ্রশঙ্করকে একটা চিঠিতে শ্যামশঙ্কর লিখেছেন (১৪ই জুলাই, ১৯৩৪)— ‘For Robin dancing comes first, music second, correct knowledge of languages third. He must work very, very hard to master the art of dancing and become the world’s best dancer someday.’ কিন্তু নাচের পাশাপাশি বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রে তিনি হাত পাকাচ্ছেন রীতিমতো। বাংলায় তাঁর একমাত্র আত্মজীবনী ‘রাগ-অনুরাগ’-এ লিখেছেন— ‘আমি তখন নহাতই নাবালক। সেতার ধরে নাড়াচাড়া করি। এরপর শুরু হল আমার একে-তাকে নকল করা। মনে তখন ভাবতাম কতই না বাজাই। একটা ভুঁইফোড় ওস্তাদ আর কি!’ কিন্তু রবিশঙ্করের প্রথম প্রকাশিত রেকর্ডে তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন একজন এসরাজ বাদক হিসেবেই।
১৯৩৫-এর নভেম্বরে ইউরোপ-আমেরিকা যাত্রায়, উদয়শঙ্করের দলের সঙ্গে ছিলেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানও। সেই যাত্রায় রবিশঙ্কর আলাউদ্দিনের স্নেহ এবং প্রশ্রয়ও পেয়েছেন— এই যাত্রা শেষেই তিনি পাকাপাকিভাবে আলাউদ্দিনের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৩৭-এ নিউ ইয়র্কের ভিক্টর টকিং মেশিন কোম্পানি উদয়শঙ্করের দলের একটি অ্যালবাম প্রকাশ করে ‘Hindu Music (‘Shan Kar and His Company’)নামে— তিনটে বারো ইঞ্চির এবং তিনটে ১০ ইঞ্চির ৭৮-আরপিএম শেল্যাক। রেকর্ডিং-এর তারিখ ২২.০২.১৯৩৭। এই রেকর্ডিংগুলি ১৯৬৮ সালে Victrola লেবেলে Radio Corporation of America (RCA) প্রকাশ করে একটি দীর্ঘ-বাদন ডিস্ক (Long Playing Disc) হিসেবে। এই বৃন্দবাদনে রবিশঙ্কর বাজিয়েছিলেন এসরাজ। আমাদের হাতে ১৯৩৭ এবং ১৯৬৮-র দুটো রেকর্ডই রয়েছে। দেখতে পাচ্ছি রবিশঙ্করের নাম রয়েছে ‘রবীন্দ্র’ (Rabindra) হিসেবে। যদিও ১৯৩৭-এর অ্যলবামে রবীন্দ্র ঠিক কোন্ যন্ত্র বাজিয়েছিলেন তার উল্লেখ নেই, কিন্তু ১৯৬৮-তে সেই অ্যলবামের কভার-নোটে দেখছি জেমস লায়নস (Editor, The American Record Guide এবং Board Chairman, The Society for Asian Music)লিখছেন—“It remains to be mentioned that the young musician identified only as Rabindra, who plays the esraj (a Muslim adaptation of the violinlike sarangi, has since achieved a measure of fame comparable to his brother’s. Today he is known as Ravi Shankar.’ বলা বাহুল্য ১৯৩৭-এর কিশোর (১৭ বছর বয়স তখন তাঁর) রবীন্দ্র ১৯৬৮-তে মহীরুহতে পরিণত হয়েছেন।
১৯৬৮-র আগেই তিনি সত্যজিতের তিনটি ছবির সুর করেছেন, ইউরোপে তাঁর একাধিক রেকর্ড প্রকাশিত হয়েছে, অসংখ্য আন্তর্জাতিক উৎসবে তিনি পরিচিত এবং কাঙ্ক্ষিত নাম, ভারত সরকারের তরফে পদ্মভূষণ এবং সংগীত নাটক অকাদেমি পুরস্কার পেয়েছেন, তপন সিংহের ‘কাবুলিওয়ালা’ ছবির সংগীত পরিচালনার জন্য পেয়েছেন Silver Bear Extraordinary Prize of the Jury (১৯৫৭, বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব), মেনুইন (মেনুইনের সঙ্গে তাঁর যৌথ অ্যালবাম ‘West Meets East’ ১৯৬৭-র জানুয়ারিতে প্রকাশিত হয়ে ১৯৬৮-র ফেব্রয়ারিতে প্রথম গ্র্যামি পুরস্কার জিতেছে) এবং জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছেন, বম্বে এবং আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রে একাধিক ছবিতে সুর সংযোজনার কাজ করেছেন [ধরতি কে লাল (১৯৪৬), নীচা নগর (১৯৪৬), অনুরাধা (১৯৬০, রাষ্ট্রপতি পুরস্কার), গোদান (১৯৬৩), Chappacqua(১৯৬৫/৬৬), Alice in Wonderland (১৯৬৬, বিবিসি), Charly (১৯৬৮)]। ১৯৩৭-এর সেই অ্যালবামের কয়েকটি টুকরো এখানে রইল:
১. রাগ তিলং—https://youtu.be/2leSCMutAaU?si=sRdUL9bO7n2RpJ76
২. রাগ মালকোশ (গন্ধর্ব নৃত্য)—https://youtu.be/__5ZKs4RiII?si=lXcZpsfk8YzIbH5f
৩. রাগ ভৈরব (ইন্দ্র নৃত্য)—https://youtu.be/HF5YLf7kjM0?si=K1t6u9FIxij_bgbW
৪. রাগ মিশ্র-কাফি: https://youtu.be/VrMJXvXD7zE?si=7PbBDx_Fo33iqMJF
আগ্রহী শ্রোতারা শুনে দেখতে পারেন Chappacqua-র কয়েকটি টুকরোও:
১. https://youtu.be/Z6EZSR2UZTs?si=HKVPjpDQ1shgKQMe
২. https://youtu.be/EPIZWztMs8A?si=bvwgi-bQsWy_ueZ2
আর-একটি প্রায় ভুলে যাওয়া রেকর্ডের কথা বলে এই লেখা শেষ করব। এই লেখায় আগেই উল্লেখ করেছি শ্যামশঙ্করের একটি চিঠির কথা— ‘do some good to the world and to my mother-country।’ যদিও তাঁর জন্ম অবিভক্ত ভারতের বেনারসে, তবু তাঁর বাবার দিক থেকে তাঁরা যশোরের মানুষ [মা হেমাঙ্গিনীর (জন্ম ১৮৮৬) পরিবার প্রবাসী জমিদার]। পূর্ব বাংলার প্রতি তাঁর এক নিবিড় টান ছিল। ১৯৭১ সালে যখন পূর্ব পাকিস্তানে মুক্তিযুদ্ধ চলছে আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ জন্ম নেওয়ার অপেক্ষায়, সে-সময়ে রবিশঙ্কর বিট্লসের সঙ্গে যৌথভাবে নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ারে আয়োজন করেছেন (পয়লা আগস্ট) The Concert for Bangladesh— সেখানে একত্রিত করেছিলেন জর্জ হ্যারিসনের দলকে, আমি আকবর খান, আল্লারাখা কুরেশি, বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন, বিলি প্রেসটনের মতো বিখ্যাত সব সংগীতজ্ঞদের। তাঁরই প্রণোদনায় জর্জ হ্যারিসন তাঁর বিখ্যাত ‘Bangla Desh’ গানটি লেখেন এবং সেই অনুষ্ঠানে পরিবেশন করেন। এই অনুষ্ঠানের পাশাপাশি রবিশঙ্কর জর্জ হ্যারিসনের কোম্পানি অ্যাপ্ল রেকর্ড্স থেকে প্রকাশ করেন ‘জয় বাংলা’ (৯ আগস্ট) নামে একটি ৭ ইঞ্চির এক্সটেনডেড প্লে (ইপি, রেকর্ড নম্বর Apple 1838) রেকর্ড, যার জন্য বাংলায় দু’টি গান লিখেছিলেন রবিশঙ্কর স্বয়ং—
১.জয় বাংলা (https://youtu.be/NRT1AL2D7SU)
জয় বাংলা জয় বাংলা জয় বাংলা জয় জয় (দু’বার)
জয় বাংলা জয় জয় (দু’বার)
আমরা গাহি বাংলাদেশের জয়গান
গাহি বাংলাদেশের গান
রূপ রস গন্ধে ভরা নদী টলমল সবুজ ধরা (দু’বার)
বীর(?উচ্চারণ পরিষ্কার নয়)দর্পে মহীয়ান
বাংলাদেশের জয়গান গাহি বাংলাদেশের গান (দু’বার)
আমরা গাহি বাংলাদেশের বাংলাদেশের জয়গান
গাহি বাংলাদেশের গান
দেশকে স্বাধীন করার তরে বিপদ নিয়ে নিজের পরে
কত জনে দিল প্রাণ
বাংলাদেশের জয়গান গাহি বাংলাদেশের গান
কত আদরের বাংলা ভাষা জনগণের ভালোবাসা
রাখি সবে তার মান
বাংলাদেশের জয়গান গাহি বাংলাদেশের গান
জাত ধর্ম ভেদ ভুলে গাইছে সবাই পরান খুলে
প্রেমের ঐক্যতান
আমরা গাহি বাংলাদেশের জয়গান…
২. ও ভগবান খোদাতালা
ও ভগবান খোদাতালা
হায় হায় হায়
ওরে হায় হায় হায়
ও ভগবান খোদাতালা মোদের ছেড়ে কোথা গেলা
যত রোগ শোক তুফান বন্যা
মোদের উপরে কী অন্যায়
কেন এই অবিচার অবহেলা
ও ভগবান খোদাতালা
কত মরল কেই বা গোনে
মোদের কান্না কেইবা শোনে
আর কত বলো সইব ঠেলা
ও ভগবান খোদাতালা মোদের ফেলে কোথা গেলা
হায় হায় হায়…
এই রেকর্ডে রবিশঙ্কর স্বয়ং গান দু’টি গেয়েছিলেন, সঙ্গে ছিলেন তাঁর পুত্র শুভেন্দ্রশংকর এবং সংযুক্তা ঘোষ (বিখ্যাত তবলা শিল্পী শঙ্কর ঘোষের স্ত্রী এবং খ্যাতিমান বিক্রম ঘোষের মা)। বাদ্যযন্ত্র সহযোগে ছিলেন রবিশঙ্কর স্বয়ং (সেতার), আলি আকবর খান (সরোদ), আল্লারখা কুরেশি (তবলা), জি এস সচদেব (বাঁশি), হরিহর রাও (একতারা)। এই রেকর্ড প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে সবই বিক্রি হয়ে যায়, পরে অবশ্য কলকাতাএ এইচএমভি এর একটি ভারতীয় সংস্করণও প্রকাশ করে। এই রেকর্ডের উলটো পিঠে ছিল মিশ্র-ঝিঁঝিট রাগে রবিশঙ্কর (সেতার) আলি আকবর খান (সরোদ) এবং আল্লারাখার (তবলা) বৃন্দ-বাদন।

এই লেখা লিখতে গিয়েই মনে পড়ছে ১৯৮২ সালে দিল্লিতে নবম এশিয়ান গেমস্-এরজন্য সংগীত সৃষ্টি করেছিলেন রবিশঙ্কর। এইচএমভি একটি দীর্ঘ-বাদন রেকর্ড (রেকর্ড নম্বর ECSD 3065) হিসেবে সেটিও বাজারে এনেছিল।এছাড়াও তিনি রবীন্দ্রনাথের ‘সামান্য ক্ষতি’ (রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ, ১৯৬১), ‘চণ্ডালিকা’ ((১৯৬২-৬৩)এবং ‘শিশু ভোলানাথ’-র জন্যও সুর করেছিলেন বিভিন্ন সময়ে, কিন্তু প্রকাশিত রেকর্ডে সেগুলি ধরা নেই।



ভারতীয় সংগীতের একজন সত্যিকারের আন্তর্জাতিক মানুষ রবিশঙ্কর। আমাদের দেশের আরও বহু শিল্পী আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পৌঁছেছেন তাঁদের নিজেদের ক্ষমতায় এবং যোগ্যতায়। কিন্তু আন্তর্জাতিক পরিসরে ভারতীয় সংগীতকে সফলভাবে পৌঁছে দিয়েছেন প্রথমে উদয়শঙ্কর এবং তারপরে আরও বিস্তৃত পরিসরে রবিশঙ্কর। তাঁদের পথ ধরে অনেকে এই রাস্তায় চক্রমণ করেছেন এবং এখনও করছেন, ভবিষ্যতেও করবেন। প্রথম সলতে পাকানো এবং প্রদীপ জ্বালানোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন শঙ্কর ভ্রাতৃদ্বয়। শেষ করি এই কথা বলে—১৯৬১ সালে রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষে ‘শ্যামা’র যে আন্তর্জাতিক ধ্বনিমুদ্রিত রূপ প্রকাশিত হয় বিশ্বব্যাপী (আমার হাতে তার ফরাসি সংস্করণটি রয়েছে) তার পরিচিতি দিয়েছিলেন স্বকণ্ঠে ইয়ুদি মেনুইন— সেও তো রবীন্দ্রশঙ্কর রায়চৌধুরীর অবদান।


