‘চারুবাসনা’ শিল্প প্রদর্শশালায়, শিল্পী অশোক মুখোপাধ্যায়ের বেশকিছু সংখ্যক শিল্পকর্ম নিয়ে, শিল্পী যোগেন চৌধুরীর পরিকল্পনায় অনুষ্ঠিত হয়ে গেল এক শিল্প প্রদর্শনী— ‘The Rhythms of Life’। ২২ মার্চ থেকে ৩০ মার্চ অবধি শিল্পীর ৬৭ টি শিল্পকর্ম এখানে প্রদর্শিত হয়েছিল, যা আমি বিশ্বাস করি, সকল দর্শককে মুগ্ধ করেছে।

এই প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত শিল্পকর্মগুলি— শিল্পীর জীবনের একটি বৃহৎ অধ্যায়ের সাক্ষ্য বহন করে। ৪০-এর দশক থেকে ৬০-এর দশক পর্যন্ত এক সুদীর্ঘ সময়ে, শিল্পী রচিত কাজগুলি এখানে প্রদর্শিত হয়েছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে, আধুনিক ভারতীয় শিল্পকলা তার নিজস্ব ভাষা প্রতিষ্ঠা করার জন্য সচেষ্ট হয়ে ওঠে। শিল্পীরা তাঁদের নিজস্ব শিল্পভাবনাকে প্রকাশ করতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। অশোক মুখোপাধ্যায়ের শিল্প, সেই প্রয়াসেরই এক অন্যতম দৃষ্টান্ত। বলা বাহুল্য যে, প্রদর্শিত কাজগুলি শুধু যে শিল্পীর শিল্পমননের এক সুস্পষ্ট ধারণা তৈরি করতে সাহায্য করে, তাই নয়, তৎকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থানও যেন স্পষ্ট হয়ে ওঠে তাঁর ছবিতে।
আরও পড়ুন: হারিয়ে যাওয়া বাংলার সংস্কৃতি— জীবন্ত হয়ে উঠেছিল এই প্রদর্শনীতে। লিখছেন অর্পণ ঘোষ
ছবিগুলির বিষয়বস্তুর মধ্যে প্রাধান্য পেয়েছে— মানুষের মুখাবয়ব, নিসর্গ, বিভিন্ন পশু, ইত্যাদি। জল রং, গুয়াশ, তেল রঙের সাহায্যে, শিল্পী যে চিত্রজগৎ সৃষ্টি করেছিলেন, তা শিল্পীর স্বকীয়তা, স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি ও গভীর মননশীলতার পরিচয় বহন করে।



স্বল্প পরিসরে করা এক-একটি চিত্র যেন— বিশাল এই কর্মময় জগতের অণুচিত্র হয়ে ওঠে। দর্শকের দৃষ্টি, এক চিত্র পরিসর থেকে অন্য চিত্রপরিসরে সরে যেতে থাকে; কখনও মানুষের বেদনা, কখনও তার প্রেমাতুর দৃষ্টি, কখনও সেখানে যন্ত্রণাক্লিষ্ট আর্তি, কোথাও বিপন্নতা, কোথাও বিহ্বলতার অভিব্যক্তি, সকল কিছুর মধ্যে যেন জীবনের কথন ফুটে ওঠে। ছবির রেখা কোথাও অত্যন্ত দৃঢ, কোথাও ক্ষিপ্র, কোথাও ধীর, রেখার সাবলীলতা কোনও ভাবেই ক্ষুণ্ণ হয় না। ছবিতে বর্ণের পরিমিত ব্যবহার এবং রেখার সঙ্গে বর্ণের অপূর্ব সমন্বয় শিল্পীর দক্ষতার পরিচায়ক। ‘বেঙ্গল স্কুল’ শিল্প ধারা ও শিল্পীর নিজস্ব স্বকীয়তার এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে চিত্রকর্মগুলি।
ভারতীয় চিত্রকলায় যে ‘narrative’-এর সম্ভার আমরা দেখি বিভিন্ন স্থাপত্যে, চিত্রে, ভাস্কর্যে, যেন সেই ধারাকেই সম্মান জানিয়ে, শিল্পী নিষ্ঠার সঙ্গে তাঁর প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতাগুলোর একটা নিপুণ ‘narrative’ গড়ে তুলেছেন। চিত্রপটগুলো আলাদা হলেও, যেন তারা শিল্পীর ভাবনার টানাপোড়েনে একটি নিখুঁত আখ্যান রচনা করেছে।

মনে পড়ছে, প্রদর্শনীর দুটি ছবি – ‘A Tree’ (১৯৪৬) ও ‘Landscape’ (১৯৬৩) – দু’টি ছবিতেই মূল বিষয়বস্তু হল একাকী বৃক্ষ। আধুনিক ভারতীয় শিল্পের অন্যতম পথিকৃৎ, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের একান্ত নিভৃত স্বগতোক্তি – ‘খোয়াই ও একটি তালগাছ- ঐ হলাম আমি’- শিল্পীর স্বতন্ত্র অস্তিত্বকে প্রকাশ করে। শিল্পী অশোক মুখোপাধ্যায়ের একাকী বৃক্ষ কি সেই একই কথা বলে? মনে প্রশ্ন জাগে। তাঁর স্বতন্ত্র শিল্পভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গি কি আধুনিক শিল্পজগতের মূলধারা থেকে সরিয়ে তাঁকে এক ধ্যানমগ্নতায় নিমজ্জিত করেছিল? ১৯৫৫ সালে শিল্পীর চিত্রিত ‘Landscape’ -এর রিক্ততা যেন জীবনের রিক্ততার রূপক হয়ে ওঠে ।

শিল্পীর ছবিতে, পাশ্চাত্য চিত্ররীতি ও ভারতীয় মননশীলতার এক অনবদ্য মেলবন্ধন লক্ষণীয়, যা আধুনিক ভারতীয় শিল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। দুর্ভাগ্যবশত, আধুনিক ভারতীয় শিল্পকলার সমালোচনায় অশোক মুখোপাধ্যায়ের নাম প্রায় আলোচিত হয়নি। হয়তো নিভৃতচারী ছিলেন বলে, তাঁর ছবি জনসমক্ষে আসেনি, তাদের বিশ্লেষণও হয়নি। বলা যায়, ভারতীয় শিল্প ইতিহাসের এক অজানা অধ্যায় উন্মোচিত হয়েছে এই প্রদর্শনীতে।