ভাষা ও ভাষ্য

Trump with Liberian Delegates

ভাষা অতি বিষম বস্তু মাত্র নয়, ভাষা অতি বিষম অস্ত্রও বটে। এক ভাষা দিয়ে অন্য ভাষার নাক কাটার ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। ইংরেজির কথাই ধরুন না কেন! এই তো সেদিনও ইংরেজি ভাষার কৌলীন্য  ধ্রুপদি গ্রিক-লাতিন জানা ভদ্রলোকেরা স্বীকারই করতেন না। বহু লড়াই করে-টরে ইংরেজি কুলীন হল। কুলীন হওয়ার অন্য কারণও ছিল। বাণিজ্যে শুধু লক্ষ্মীরই অধিষ্ঠান হয় না, ভাষা-সরস্বতীরও অধিষ্ঠান হয়। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাণিজ্যে ফুলে-ফলে ফেঁপে উঠল, তখন বণিকের ইংরেজি ভাষার মান বৃদ্ধি হল। প্রথম দিকে এদেশের সিভিল সার্ভেন্টদের অবশ্য ভারতীয় ভাষা রপ্ত না করলে চাকরি থাকত না। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে পড়ে সাহেবদের ভারতীয় ভাষায় পরীক্ষা-পাশ করতে  হত। পরীক্ষায় ফেল করলেই চাকরি নট। গভর্নর জেনারেলের হুকুম। পরে অবশ্য অবস্থা বদলে গেল। এদেশে ইংরেজি শেখার ধুম পড়ল। অ্যাংলিসিস্ট সাহেবরা ওরিয়েন্টালিস্ট সাহেবদের হারিয়ে দিল। সুতরাং, সময় যত এগিয়েছে, সাহেবদের ভারতীয় ভাষা শেখার বালাই তত কমেছে। অপর দিকে ভারতীয়দের মধ্যে অনেকেই মনে করেছে, ইংরেজি ভাষা জানাই সব জানা। ইংরেজদের কলোনির দৌলতেই ইংরেজি ভাষার কৌলীন্য লাভ তারপর এখন তো ইংরেজি আর ইংরেজি। ভারতবর্ষে ও স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতে ইংরেজি বিদ্যাচর্চার ফল-ফলন্ত নিয়ে নানা গুরুতর গবেষণা হয়েছে। আবার একথাও সত্য, ইংরেজি এখন গুরুত্বপূর্ণ ভারতীয় ভাষা। ভারতীয় ইংরেজির নিজস্ব চরিত্র আছে।   

তবে যাই হোক, ইংরেজি জানা সাদা শাসকদের নাক উঁচু ভাব কোথাও কোথাও কমেনি। বরং দক্ষিণপন্থী সাদা শাসকেরা কালো ও বাদামি দেশের প্রধানদের ভাষা ব্যবহার নিয়ে একটু বেশিই প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে কৌতুক প্রিয়। আমেরিকার ট্রাম্প প্রবল প্রকাশক্ষম কণ্ঠের অধিকারী। সদ্য তিনি পশ্চিম আফ্রিকার ছোট্ট দেশ লাইবেরিয়ার প্রধানের ইংরেজি ভাষা জ্ঞান নিয়ে ফুট কেটেছেন। বলেছেন এখানকার রাষ্ট্রপ্রধানের ইংরেজি বেশ ভাল। এই সার্টিফিকেট সম্বন্ধে সংবাদমাধ্যম সরব। লাইবেরিয়া আগে আমেরিকার কলোনি ছিল। আমেরিকার ‘কৃষ্ণাঙ্গ দাসেরা’ জনবিরল এই দেশটির  প্রতিষ্ঠাতা। সেখানকার সরকারি ভাষা ইংরেজি। আমেরিকার কবল মুক্ত হয়ে এখন স্বাধীন প্রজাতন্ত্র। ট্রাম্প আমেরিকার শাসক। তাই কৃষ্ণাঙ্গদের ইংরেজি নিয়ে তিনি মত প্রকাশ করছেন। প্রশংসা আসলে প্রশংসা নয়। ভাবখানা এই ‘যাক যাক, এতদিন ইংরেজি তো তেমন জানতে না এখন তো বেশ শিখেছ।’ ভাষা নিয়ে এই মন্তব্যে অবশ্য লাইবেরিয়ার সরকারি মুখপাত্র খুব বেশি কথা বলেননি। তাঁদের বক্তব্য মিডিয়ার উচিত দুই দেশের মধ্যে যে ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে, তাই নিয়ে কথা বলা। এই ইংরেজি বিতর্ক মুলতুবি থাক।

আরও পড়ুন: ফ্রান্সের স্বাধীনতার ধারণা কি আফ্রিকার ক্ষেত্রে খাটে না?
লিখছেন দোয়েলপাখি দাশগুপ্ত,,,

সরকারি মুখপাত্রের পক্ষে এ-কথা বলাই বুদ্ধিমানের কাজ। কারণ প্রয়োজন বড়ো বালাই। বড়ো শক্তি আমেরিকার রাষ্ট্রপ্রধানকে চটিয়ে কি লাভ!

সাধারণভাবে অবশ্য এই বিতর্ক-সূত্রে পুরনো একটি বইয়ের কথা মনে পড়ে যায়। ফ্রানজ ফ্যানন (Frantz Fanon)-এর ‘ব্ল্যাক স্কিন, হোয়াইট মাস্কস’   (Black Skin, White Masks) বহুপঠিত বই। পুরনো কথা মাঝে মাঝে তাজা হয়ে ওঠে। পরাধীন ভারতীয়রা অ্যাংলিসিস্ট মেকলের কথা শুনতে অভ্যস্ত ছিলেন। বাদামি চর্মের একদল ভারতীয়কে নির্মাণই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য— গাত্রবর্ণ বাদামি হলেও রুচিতে এই ভারতীয়রা সাহেব হবেন। এই ভারতীয় সাহেবদের মাধ্যমে দেশের বাকি মানুষেরা শিক্ষিত হবেন এই ছিল মেকলের আশা ও কল্পনা। স্বাদেশিক ভারতীয়রা এই মেকলেপন্থার বিরোধিতা করেছিলেন। ভাষা হিসেবে ইংরেজি শিখতে তাঁরা কসুর করেননি, তবে তার বেশি নয়। স্বাদেশিকতার স্টাইল স্টেটমেন্টে তাঁরা অনবদ্য। ধুতি চাদরে বাঙালি বিদ্যাসাগর, পরবর্তী কালে আফ্রিকা থেকে ফিরে এসে প্রায় একই বস্ত্রে গুজরাটের গান্ধী নিজত্ব প্রদর্শন করেছিলেন। সাহেবের নাকের সামনে বিদ্যাসাগরী চটি তুলে ধরা কিম্বা গান্ধীর গোল টেবিল বৈঠকে ভারতীয় বস্ত্রে যোগদান নিজত্বের প্রকাশ। ফানন বিষয়টিকে আরেকভাবে দেখছিলেন। তাঁর লেখায় কৃষ্ণবর্ণের মানুষরা সাদা মুখোশ পরতে বাধ্য হচ্ছেন। বাধ্য হওয়ার বিষয়টিকে স্বীকার করছেন না, সাদা মুখোশকে  দেশের মানুষের কাছে গর্বিত মুখ বলে প্রমাণ করতে চাইছেন। ফ্যানন সংবেদী কাটা-কাটা বাক্যে লেখেন, ‘কালো মানুষ সাদা মানুষ হতে চায়।… সাদা মানুষেরা তাঁদের শ্বেতত্বে বন্দী। কালো মানুষেরা তাঁদের কৃষ্ণত্বে বন্দী।’

মুক্তি কোথায়? মুক্তি মিলবে ভাষা ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে পরিগ্রহণের নমনীয় মানসিকতায়, ভাষা-সংস্কৃতির মধ্যে আদান-প্রদানে। আমেরিকার কথা থাক। দেশের কথায় ফেরা যাক। শ্বেত সাহেবরা এদেশে এসে ভারতীয় ভাষাগুলির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্পর্ক এক রকম ভাবে তৈরি করে দিয়েছিলেন। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে সাহেব সিভিল সার্ভেন্টদের ভারতীয় ভাষা চর্চা করতে হত। সব ভারতীয় ভাষা নয়, গুরুত্বপূর্ণ ভারতীয় ভাষাগুলি তাঁদের চর্চার বিষয়। ভাষা ভাষার গুণে গুরুত্ব লাভ করে না। ভাষীর সংখ্যা, ভাষীদের সাংস্কৃতিক অর্থনৈতিক গুরুত্ব এসব বাইরের কারণে এক ভাষা অন্য ভাষার মাথা কাটে। ফোর্ট উইলিয়ামে ভারতীয় ভাষাগুলির মধ্যে বাংলা চর্চার যোগ্যতা অর্জন করেছিল। সেই তালিকায় অহমিয়া আর ওড়িয়ার ঠাঁই ছিল না। এই দু’টি ভাষার মানুষদের ওপর এককালে বঙ্গভাষীদের কেউ কেউ দাদাগিরি ফলিয়েছেন। এখন চাকা ঘুরেছে। বাংলা ভাষার আগেই অহমিয়া আর ওড়িয়া ধ্রুপদি ভাষার তকমা পেয়েছিল। ভাষার গুণে নয় রাজনৈতিক কারণে। ভাষাকে কেন্দ্র করে ভারতীয় জনগোষ্ঠীগুলির আত্মপ্রতিষ্ঠার যে রাজনীতি তার নানা রূপ। ভারতে বাঙালিদের এখন নানা কারণে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। সেজন্য সুযোগ বুঝে বাংলা ভাষার প্রতি বিদ্বেষ দেখাচ্ছেন অনেকে। বাংলা ভাষা-সংস্কৃতির নাক কাটার নানা আয়োজন। বাংলা বললে বাংলাদেশি বলে দাগিয়ে দেওয়ার চল। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির এ-এক বিচিত্র রূপ— জটিল, বহুমাত্রিক। কোনও একরকম ব্যাখ্যা দেওয়া কঠিন।

রেজি জানা সাদা শাসকদের নাক উঁচু ভাব কোথাও কোথাও কমেনি। বরং দক্ষিণপন্থী সাদা শাসকেরা কালো ও বাদামি দেশের প্রধানদের ভাষা ব্যবহার নিয়ে একটু বেশিই প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে কৌতুক প্রিয়। আমেরিকার ট্রাম্প প্রবল প্রকাশক্ষম কণ্ঠের অধিকারী। সদ্য তিনি পশ্চিম আফ্রিকার ছোট্ট দেশ লাইবেরিয়ার প্রধানের ইংরেজি ভাষা জ্ঞান নিয়ে ফুট কেটেছেন। বলেছেন এখানকার রাষ্ট্রপ্রধানের ইংরেজি বেশ ভাল। এই সার্টিফিকেট সম্বন্ধে সংবাদমাধ্যম সরব।

ভারতের যে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, তাতে ভাষা-সংস্কৃতির বিভিন্নতাকে স্বীকার করার কথা। অথচ তা আর হচ্ছে কোথায়? ট্রাম্প যেভাবে লাইবেরিয়ার ইংরেজি নিয়ে ফুট কাটেন সেই একই মানসিকতা ভিন্ন রূপে এই ভারতেও হাজির। লাইবেরিয়া সাদা মুখোশকে মুখ বলে মেনে নিয়ে প্রয়োজন মেটাতে চাইতে পারেন। ভারতে বাঙালিদের বাংলা বলার ওপর একরকম অলিখিত নিষেধাজ্ঞা জারি করা হচ্ছে, আবার কখনও বা বাঙালির হিন্দি বলা নিয়ে নানা আলোচনা। সত্যজিৎ লালমোহনবাবুকে দিয়ে বাঙালির হিন্দি বলিয়ে দিব্য রসিকতা করতে সমর্থ হয়েছিলেন, কারণ তখন স্বাধীন দেশে বাঙালির আত্মপরিচয়ের সংকট এভাবে তৈরি হয়নি। বাঙালি লালমোহন ‘সোনার কেল্লা’ ছবিতে হিন্দিভাষীদের ওপর দাদাগিরি করেছিল, বাজে হিন্দি বলেও দাদাগিরি করতে অসুবিধে হয়নি। একালে হত। হিন্দি অস্মিতার বাজার এখন প্রবল। এই বাজারে কেউ যদি বাঙালির হিন্দি বলার প্রশংসা করেন ও তিনি যদি শক্তিশালী সর্বভারতীয় কেউ-কেটা হন তাহলে বিষয়টিকে সন্দেহের চোখেই দেখতে হবে। 

ভাষার লড়াই, চোরাটান, প্রতিযোগিতা, এক ভাষা দিয়ে অন্য ভাষার নাক কাটা চলছে। তারই মধ্যে কেউ কেউ নানা ভাষার আয়োজনে সাংস্কৃতিক দেওয়া-নেওয়া বজায় রাখছেন। ‘চৌরঙ্গী’ সিনেমায় উত্তমকুমার কৌতুক করে বলেছিলেন হোটেলে চাকরির শুরুতে তিনি প্রেমচাঁদের মতো ইংরেজি, রবীন্দ্রনাথের মতো হিন্দি আর শেকসপিয়রের মতো বাংলা বলতেন। তারপর বলতে বলতে শেখা। আফ্রিকা থেকে ফিরে গান্ধী ভুল হিন্দি বলতেন। তারপর বলতে বলতে শেখা। নোয়াখালির দাঙ্গার সময় গান্ধী বাংলা শিখছিলেন। মানুষের সঙ্গে মেশার জন্য শেখা। 

একদিকে লড়াই, ঠাট্টা, অন্যদিকে সহনশীল দেওয়া-নেওয়া। কোনটা বেছে নেবেন, তা আপনার মর্জি। প্রতিটি মানব-ভাষাই অসংখ্য বাক্য সৃজনের সম সামর্থের অধিকারী। মানুষ অনেক রকম, ভাষাও অনেক রকম।