শ্রম, শিশু, দায়িত্ব

Child Labour

দাদা তাকে ক্রমাগত হেনস্থা করে বলে, প্রতিশোধ নিতে কৃষ্ণ (সাফিক সৈয়দ) নামের শিশুটি, দাদার মোটরবাইকে আগুন ধরিয়ে দেয়। তার জন্য, রেগে— তার মা, তাকে অ্যাপোলো সার্কাসে নিয়ে যান। আদেশ দেন, ক্ষতিপূরণ হিসেবে, ৫০০ টাকা এনে দিতে পারলে, তবেই সে বাড়ি ফিরতে পারবে।

কৃষ্ণ রাজি হয়ে, সার্কাসে কাজ শুরু করে। কিন্তু, সার্কাস যে এদিকে তাঁবু গোটানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে! মালিক কৃষ্ণকে একটি কাজে পাঠায়, কিন্তু সে যখন ফিরে আসে, দেখে— সার্কাসের পুরো দলটিই চলে গেছে! একা কৃষ্ণ— যার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই তখন, আর মায়ের টাকাও শোধ করতে হবে— কাছের বড় শহর, মুম্বইয়ের দিকে রওনা দেয় সে। সেখানে পৌঁছে, তার সামান্য যা জিনিসপত্র ছিল, সেগুলোও চুরি হয়ে যায়।

কৃষ্ণ, চোরদের পিছু নেয় এবং আশ্চর্যজনক ভাবে, তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বও হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত, সে রেলস্টেশনের কাছে, ফকল্যান্ড রোডের, কুখ্যাত লালবাতি এলাকায় গিয়ে পড়ে। ওই চোরদের একজন ছিল্লাম (রঘুবীর যাদব)। সে মাদক বিক্রেতা এবং নিজেও আসক্ত। কিন্তু কৃষ্ণকে সে, গ্রান্ট রোডের একটা চায়ের দোকানে কাজ পাইয়ে দেয়।

আরও পড়ুন: ‘বাঘ বাঁচলে প্রজাপতিও বাঁচবে’, ভাল্মিক থাপারের ভাবনা ছিল এমনটাই! লিখছেন শুভময় মিত্র…

বাবা (নানা পাটেকর) নামের একজন স্থানীয় মাদক ডিলার, ছিল্লামের মতো আসক্তদের নিয়োগ করে। বাবার স্ত্রী, রেখা (অনিতা কানওয়ার) একজন যৌনকর্মী। তাদের একটি ছোট মেয়ে আছে— মঞ্জু (হানসা বিঠল)। রেখা বিরক্ত, যে তাকে এমন পরিবেশে মেয়েকে বড় করতে হচ্ছে। বাবা তাকে, অন্য কোথাও নতুন জীবন শুরু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কিন্তু তা পূরণ করতে পারেনি, বা করবেও না।

কৃষ্ণ এখানে একটি নতুন নাম পায়—‘চায়পাও’। কৃষ্ণের মূল উদ্দেশ্য, বাড়ি ফেরার জন্য, প্রয়োজনীয় টাকা জমানো। কিন্তু সে শীঘ্রই টের পায়, এই পরিবেশে তার টাকা জমানো প্রায় অসম্ভব। সে ‘সোলাসাল’ (ষোড়শী) নামের একটি কিশোরীর প্রতি আকৃষ্ট হয়।

‘সোলাসাল’-কে সম্প্রতি পতিতালয়ে বিক্রি করা হয়েছে। কৃষ্ণ, মেয়েটির ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয় এবং তার সঙ্গে পালানোর চেষ্টা করে, ধরা পড়ে যায়। এরপর কৃষ্ণ চায়ের দোকানে কাজের পাশাপাশি, বিভিন্ন ছোটখাটো কাজ করে, টাকা জমানোর চেষ্টা করে। সে ছিল্লামকে সাহায্য করে। ছিল্লাম মাদক ছাড়া বাঁচতে পারে না। কিন্তু এক বিদেশি সাংবাদিকের সঙ্গে একটি বিশৃঙ্খল সাক্ষাৎকারের জন্য, বাবা তাকে চাকরি থেকে ছাঁটাই করে দেয়।

একটা ছোট অপরাধের জন্য, কৃষ্ণকেও চায়ের দোকানের চাকরি হারাতে হয়। টাকার জন্য, শেষে কৃষ্ণ আর তার বন্ধুরা দিনেদুপুরে, এক বৃদ্ধ পার্সি ব্যক্তির বাড়িতে ঢুকে লুঠ করে। পরে কৃষ্ণ দেখে, তার জমানো টাকা, ছিল্লাম মাদক কেনার জন্য চুরি করে নিয়েছে। এবং বেশি পরিমাণ মাদক সেবনে, ছিল্লামও মারা যায়। ১৯৮৮ সালে নির্মিত মীরা নায়ারের ‘সালাম বম্বে’ সিনেমায় শিশুশ্রমে জর্জরিত ছেলেটির, অবাক করা নাম রাখা হয়েছে, কৃষ্ণ।

পুরাণ, শাস্ত্রে— কৃষ্ণচরিত্রের মূল আকর্ষণ তাঁর শৈশব। বৃন্দাবনে নন্দের লাল কত রকম দুষ্টুমি করত, অথচ সকলের প্রশ্রয় থাকত তাতে, কারণ সে যে শিশু।

সেসব মহাকাব্যের কথা হলেও, আজও যে-কোনও জাতির ভবিষ্যৎ হল শিশুরা, কারণ তারাই বড় হয়ে, দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখবে। প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব শিশুদের যথাযথ যত্ন নেওয়া। যদি ভারতের ‘শ্রম-সমস্যা’ ক্রমাগত শিশুদের ব্যবহার করে সমাধান করা হয়, তবে জাতির ভবিষ্যৎ বিপন্ন।

এই শিশুরা, নিরক্ষর তৈরি হবে এবং বিকশিত হতে পারবে না, যা শেষ পর্যন্ত দেশেরই পতন ডেকে আনবে। ২০০১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, ৫-১৪ বছর বয়সি মোট শিশুর সংখ্যা, ২৫.২ কোটির মধ্যে। কর্মরত শিশুর সংখ্যা, ১.২৬ কোটি। জাতীয় নমুনা সমীক্ষা সংস্থা (এনএসএসও) ২০০৪-০৫ সালে, পরিচালিত একটি সমীক্ষায় কর্মরত শিশুর সংখ্যা অনুমান করা হয়েছিল ৯০.৭৫ লক্ষ। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, ৫ থেকে ১৪ বছর বয়সি কর্মরত শিশুর সংখ্যা আরও কমে, ৪৩.৫৩ লক্ষে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ভারতে, ১০ বছর বয়সের নীচের শিশুদেরও, বিভিন্ন জায়গায় উপার্জনের জন্য কাজ করতে দেখা যায়।

সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হল, কিছু ক্ষেত্রে, এই শিশুরা বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করে, কারণ তাদের বাবা-মা হয়তো ঋণ নিয়েছিলেন এবং তা শোধ করতে পারেননি! এছাড়াও, অনেক শিশু মাত্র ৫ বছর বয়স থেকে, পরিবারের সঙ্গে খামারে কাজ শুরু করে। শিশুদের প্রায়ই বিপজ্জনক পেশায় নিয়োগ করা হয়।

খনির কাজ, নির্মাণ বা কারখানার শ্রম, বাজি কারখানার কাজ, যেখানে দুর্ঘটনা বা বিষাক্ত পদার্থের সংস্পর্শে আসার কারণে আঘাত, প্রতিবন্ধকতা এমনকী প্রাণহানির মতো উচ্চ ঝুঁকি থাকে, সেসব জায়গায় দেশের শিশুরা কাজ করতে বাধ্য হয়। অতিরিক্ত শব্দ, ধুলো, রাসায়নিক পদার্থ বা চরম তাপমাত্রা শিশুদের শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা, ত্বকের রোগ এবং অন্যান্য দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ হয়।

আজও যে-কোনও জাতির ভবিষ্যৎ হল শিশুরা, কারণ তারাই বড় হয়ে, দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখবে। প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব, শিশুদের যথাযথ যত্ন নেওয়া। যদি ভারতের ‘শ্রম-সমস্যা’ ক্রমাগত শিশুদের ব্যবহার করে সমাধান করা হয়, তবে জাতির ভবিষ্যৎ বিপন্ন।

শুধু তাই নয়, শ্রমে জড়িত শিশুরা, বিশেষ করে শোষণমূলক বা নির্যাতনমূলক পরিস্থিতিতে, মানসিক আঘাত, উদ্বেগ, বিষণ্নতা এবং আত্মবিশ্বাসের অভাব অনুভব করে, যা তাদের মানসিক সুস্থতায় দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে। তারা শিক্ষার সুযোগ এবং সহপাঠীদের সঙ্গে মেলামেশা থেকে বঞ্চিত হয়। এইসব মানসিক চাপ ও আঘাত শিশুদের মধ্যে আচরণগত সমস্যা ডেকে আনতে পারে। তারা আক্রমণাত্মক হয়ে পড়ে। নিজেদের গুটিয়ে নেয় এমনকী, মাদকাসক্তিতেও জড়িয়ে পড়ে।

শিশুশ্রম ভারতের সামাজিক পরিবেশে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। কাজ করতে বাধ্য হওয়া শিশুরা, শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কঠোর পরিশ্রমের জন্য, শারীরিকভাবে প্রস্তুত না হওয়ায়, শিশুদের দৈহিক গঠনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বেশিরভাগ শিশুশ্রমের মূল কারণ হল, অভিভাবকদের অসচেতনতা।

পাচারকারীরা প্রধানত এমন অভিভাবকদের টার্গেট করে, যারা অশিক্ষিত। কিন্তু শিক্ষিত বাড়িতেও, স্বনির্ভর করে তোলার উদ্দেশ্যে, অকারণ যখন শিশুশ্রম ও গৃহহিংসা হাত ধরাধরি করে চলে কিংবা রিয়ালিটি শোগুলো জিততে যখন শিশুরা প্রাণপাত পরিশ্রম করতে বাধ্য হয়, তখন— কোন আইন তাদের সুরক্ষা দিতে পারে?’

১৯৭৯ সালে, ভারতসরকার শিশুশ্রমের সমস্যা সমাধানের জন্য, ‘গুরুপদস্বামী কমিটি’ গঠন করে। কমিটি পর্যবেক্ষণ করে, যতদিন দারিদ্র্য থাকবে, শিশুশ্রম সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করা কঠিন হবে এবং তাই, আইনি পদ্ধতিতে এটিকে বিলুপ্ত করার চেষ্টা বাস্তবসম্মত হবে না। কমিটি মনে করেছিল, সেই পরিস্থিতিতে একমাত্র বিকল্প, বিপজ্জনক ক্ষেত্রে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করা এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে কাজের শর্ত নিয়ন্ত্রণ ও উন্নত করা।

কমিটির সুপারিশ ছিল, কর্মরত শিশুদের সমস্যা মোকাবিলার একটি বহুমুখী নীতি প্রণয়ন। গুরুপদস্বামী কমিটির সুপারিশে, ১৯৮৬ সালে দেশে শিশুশ্রম (নিষেধ ও নিয়ন্ত্রণ) আইন প্রণীত হয়। এই আইন অনুযায়ী, কিছু নির্দিষ্ট বিপজ্জনক পেশায় শিশুদের নিয়োগ নিষিদ্ধ এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে কাজের শর্ত নিয়ন্ত্রণ। এই আইনের অধীনে বিপজ্জনক পেশা ও প্রক্রিয়ার তালিকা ধীরে-ধীরে সম্প্রসারিত করা হয়েছে। পরবর্তীকালে, ২০১৬ সালে এই আইনটি সংশোধন করা হয়। শিশুশ্রম (নিষেধ ও নিয়ন্ত্রণ) সংশোধনী আইন ২০১৬-এর মাধ্যমে।

এতে ১৪ বছরের কম বয়সি শিশুদের সব ধরনের কাজে নিয়োগ নিষিদ্ধ করা হয় এবং ১৪-১৮ বছর বয়সি কিশোর-কিশোরীদের জন্য তালিকাভুক্ত বিপজ্জনক পেশা ও প্রক্রিয়ায় নিয়োগ নিষিদ্ধ করার বিধান রাখা হয়। ভারতে অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা চালু আছে এবং মিড-ডে মিলের ব্যবস্থাও রাখা আছে প্রতিটি স্কুলে।

কিন্তু, শিশুশ্রমের কবল থেকে তাদের বাঁচাতে, স্কুলগুলো যে আগলে রাখার কাজ করতে পারে, সেই সদিচ্ছাটুকু কোন সরকারের আছে? কোথাও মিড-ডে মিল রান্না হয়, কোথাও চাল-ডাল বিতরণ করে দেওয়া হয়। মিড-ডে মিলের জন্য বরাদ্দ অর্থ, কখনও আবার গায়েব হয়ে যায়। সব থেকে অমানবিক ব্যাপার হল, যেহেতু পাঁচ থেকে চোদ্দ বছর বয়সের মধ্যে মিড-ডে মিলের ব্যবস্থা— চোদ্দ পার করলেই, সেই ছেলেটি বা মেয়েটি আর মিড-ডে মিল পাবে না! এছাড়া, চাষের সময়ে বহু শিশুই স্কুলে আসতে পারে না, খেতখামারে বাড়ির অভিভাবকদের সাহায্য করে বলে। এহেন পরিস্থিতিতে, ‘ড্রপ-আউট’-এর সংখ্যা বাড়ে এবং বহু শিশু পারতপক্ষে শিশুশ্রমেই ফিরে যেতে বাধ্য হয়।

আজ বিশ্ব শিশুশ্রম দিবস। খুব দুঃখজনক যে শিশুশ্রম বিরোধী আইন ভারতে থাকা সত্ত্বেও শিশুশ্রমিকের সংখ্যা দেশে খুব একটা কমছে না। অনেক উজ্জ্বল ভবিষ্যত অঙ্কুরেই বিনষ্ট হচ্ছে। কিন্তু ভারতকে যদি আরও উন্নত হতে হয়, তবে তার শিশুদের যত্ন করতে হবে। মীরা নায়ারের ‘কৃষ্ণ’ যেন কোনও শিশু না তৈরি হয়। মহাভারতের কৃষ্ণই সব শিশুর শৈশবের আদর্শ হয়ে ওঠা দরকার।