যে-সময় গুরু দত্ত ছবি বানিয়েছেন, পাঁচের দশক থেকে ছয়ের দশক, আরও বিশেষভাবে বললে ১৯৫১ থেকে ১৯৬২ পর্যন্ত, সেই সময়ে ওঁর করা ছবির মধ্যে আবেগের যে অভিব্যক্তি ও অভিঘাত ছিল, যে অস্তিত্ববাদী সংকট ছিল এবং সর্বোপরি, শিল্পের পণ্যায়ন নিয়ে ওঁর যে বক্তব্য রয়েছে— সেই সবকিছুই ওঁকে অভিনব করে তোলে।
শুধু বিষয় বা কনটেন্টের নিরিখে বলা নয় এ-কথা, ওঁর ফর্মের ভেতর দিয়েও এই ধারণাগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ওঁর ছবির আলোর ব্যবহার দেখলেও বোঝা যায়, কীভাবে বিষাদ খেলা করে যায় গুরু দত্তর কাজে। এই বিষাদই গুরু দত্তর কাজকে মহৎ করে তোলে। ওঁর নির্দেশিত ছবি, মানে ‘পেয়াসা’ বা ‘কাগজ কে ফুল’ তো আছেই, ওঁর প্রযোজিত এবং অভিনীত ছবিও, যেমন ‘চৌধভি কা চাঁদ’ বা ‘সাহেব বিবি গোলাম’-ও যেন ট্র্যাজেডিতে জারিত হয়ে থাকে। বিশেষ করে মহিলা চরিত্রদের যে ট্র্যাজেডি, তা দর্শককে কোথাও যেন পেড়ে ফেলে।
গুরু দত্তর ছবির কথা বললে গানের প্রসঙ্গ আসবেই। গুরু দত্তর মেকিং, ক্রাফট চলচ্চিত্রকার হিসেবে আমাকে খুবই টানে, আরও অনেককেই টানে যেভাবে। কিন্তু গানগুলো সবসময় আমাদের ছুঁয়ে থাকে। সে ‘আর পার’ হোক, ‘পেয়াসা’ হোক বা ‘কাগজ কে ফুল’— ও পি নায়ার থেকে শচীনদেব বর্মনদের সুর এই ছবিগুলোকে যেন অন্য উত্তরণ দিয়েছে।
আরও পড়ুন : রাজেন তরফদারের ছবি সংরক্ষণই এখন সময়ের দাবি!
লিখছেন গৌতম ঘোষ…

গুরু দত্তর ছবিতে প্রথম থেকেই নয়্যারের একটা সরাসরি প্রভাব রয়েছে। তার সঙ্গে মিশে গিয়েছে অস্তিত্বের সংকট. শিল্পী হিসেবে বঞ্চিত হওয়ার দুঃখ, স্বীকৃতি না পাওয়ার দুঃখ। ওঁর প্রথমদিকের সরাসরি নয়্যার ছবিগুলো, ‘বাজি’, ‘জাল’, ‘বাজ’ বা ‘আর পার’, বাদ দিলেও ‘পেয়াসা’ বা ‘কাগজ কে ফুল’-এর ট্র্যাজেডিতেও সেই নয়্যারের ছায়াটা মিশে রয়েছে। সেটার কারণ খুঁজলে হয়তো দেখা যাবে, গুরু দত্তর ব্যক্তিগত জীবনে বিষাদের ছায়াই সেখানে পটভূমি হয়ে দাঁড়িয়ে। ওঁর অবসাদ হয়তো ওঁর ছবির মধ্যেও ধরা পড়েছে, কিন্তু তার মধ্যে মিশে রয়েছে আঁকাড়া সততা। সেই সততাই, ওঁর ছবিতে দুঃখকে ব্যাপৃত করে তোলে, বিষাদকে সিনেমায় মহৎ করে তোলেন গুরু দত্ত। ‘পেয়াসা’ বা ‘কাগজ কে ফুল’ হয়তো সমসময়ে সেই মাপের স্বীকৃতি পায়নি, কাল্ট হয়ে উঠেছে পরে, ধীরে ধীরে, কিন্তু কেবল ভারতীয় নয়, বিশ্ব সিনেমার ইতিহাসেও, এই দুটো ছবি আর্কাইভে থেকে যাবে।
ওই সময়ের অন্য পরিচালকদের মধ্যে দাঁড়িয়ে গুরু দত্ত একদম স্বতন্ত্র। বিষাদের কাব্যিক প্রকাশ ওঁর কাজ থেকে শেখার। এখনও যে গুরু দত্তর ছবির প্রাসঙ্গিকতা ফুরয়নি, তার কারণ বিচার করতে গেলে বলতে হয়, সামগ্রিকভাবে মানুষ, বিশেষত শিল্পীরা, এখনও অবসাদের সঙ্গে লড়াই করে রোজ। তাই, গুরু দত্তর মহৎ দুঃখর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে মানুষ, সবসময় না হলেও, কখনও কখনও।

ওই সময়ের অন্য পরিচালকদের মধ্যে দাঁড়িয়ে গুরু দত্ত একদম স্বতন্ত্র। বিষাদের কাব্যিক প্রকাশ ওঁর কাজ থেকে শেখার। এখনও যে গুরু দত্তর ছবির প্রাসঙ্গিকতা ফুরয়নি, তার কারণ বিচার করতে গেলে বলতে হয়, সামগ্রিকভাবে মানুষ, বিশেষত শিল্পীরা, এখনও অবসাদের সঙ্গে লড়াই করে রোজ। তাই, গুরু দত্তর মহৎ দুঃখর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে মানুষ, সবসময় না হলেও, কখনও কখনও। কখনও মানুষ একা হতে চায়, কখনও সে একা হয়ে যায়। এই একা হয়ে পড়ার বেদনার অমন শৈল্পিক প্রকাশ মানুষকে কখনও ছেড়ে যায় না। একদিকে আবেগের আবেদন, অন্যদিকে ওই কাব্যিকতার ব্যপ্তি বিশেষ করে ওই ছবিদুটোকে (‘পেয়াসা’ বা ‘কাগজ কে ফুল’) অবিস্মরণীয় করে রাখবে।
গুরু দত্ত মহৎ চলচ্চিত্রকার। হিন্দি ছবির নিরিখে দেখলে বিমল রায়, রাজ কাপুর, হৃষিকেশ মুখার্জিদের মতো করেই ওঁকে মনে রাখতে হবে। খুব কম ছবি হয়তো করেছেন, কিন্তু কে ক’টা ছবি বানাল, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ, কে ক’টা ছবি বানাতে পারল। সেইখানেই গুরু দত্ত অনন্য হয়ে থেকে যাবেন। শিল্প মুনাফার কাছে আত্মসমর্পণ করবে, এই ধারণার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল গুরু দত্তর কাজ, সবসময়। শিল্পীর বেদনা তাই তাঁর ছবির সম্পদ হয়ে ওঠে। সততা থেকে, অনুভব থেকে ছবি বানাতেন গুরু দত্ত, কোনও উদ্দেশ্য সাধনের পরিকল্পনা করে ছবি বানাতেন না। গুরু দত্ত তাই শিল্পী হিসেবে সেই উচ্চতাতেই থাকবেন সবসময়, এ নিয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই কোনও।