গৃহকোণ ও শিল্পভুবন

Sunayani Devi

বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে, অন্দরমহল বা জেনানা হয়ে ওঠে স্বদেশি আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। বাহিরমহলে পুরুষের যাতায়াত, নারীরা সেখানে অদৃশ্য। এই সমীকরণের পালাবদল ঘটে স্বদেশিয়ানার রূপায়ণে। ভারতীয় পুরুষ বহির্জগতে ইংরেজ মালিকদের অধীনস্থ, পর্যুদস্ত ইংরেজ শাসনের ভারে; কিন্তু অন্দরমহলে তাদের প্রতিপত্তি। অন্দরমহল মোটমাট ব্রিটিশের আওতার বাইরে; সেখানে সাবেকিয়ানা, দেশীয় রীতি-রেওয়াজ বহাল। তাই এই অন্দরমহলই হয়ে ওঠে অন্তরমহল। এককথায়, এই অন্দরমহলের পালাপার্বণ, ব্রতকথা, আলপনা ও কাঁথার কাজ হয়ে ওঠে দেশীয় শিল্পচর্চার প্রধান উৎস।

গৃহের ধারণা যখনই হয়ে উঠল স্বদেশিয়ানার অভিন্ন অংশ, তখনই ভদ্রমহিলার আবির্ভাব; যে কিনা প্রবেশ করেছে বাহিরমহলে এবং এই সূত্রেই পারিবারিক পরিমণ্ডলের বাইরের ভদ্রলোকেরও প্রবেশ দেখা যায় এই অন্দরমহলে।

এই প্রেক্ষাপটেই শুরু হয় জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির বিচিত্রা সভা বা বিচিত্রা ক্লাব। রবীন্দ্রনাথ যাকে ‘গৃহবিদ্যালয়’ বলে অভিহিত করেছেন। তথাকথিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থার বাইরে গড়ে ওঠে এই গৃহবিদ্যালয়। এখানে নারী-পুরুষের অবাধ প্রবেশ। শিল্প, সাহিত্য ও সংগীতচর্চার পীঠস্থান হয়ে ওঠে জোড়াসাঁকো। এখানেই বহু শিল্পীদের মাঝে রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতৃ-দুহিতা সুনয়নী দেবীর যাত্রা শুরু। গার্হস্থ হয়ে ওঠে শিল্পচর্চার এক অভিন্ন অঙ্গ, কারণ গার্হস্থ ও পরিবার হয়ে ওঠে শিল্পচর্চার মূল অনুপ্রেরণা ও মূল বিষয়। সুনয়নীর কথায়, ‘ওরা কাজ করে বহির্জগতের শোরগোলের মধ্যে, আমি কাজ করি অন্তর্জগতে।’

আরও পড়ুন : বেঙ্গল স্কুলের যে অখ্যাত শিল্পীদের আমরা আজও চিনি না!
লিখছেন সুশোভন অধিকারী…

সুনয়নীর কোনও নির্দিষ্ট শিল্পচর্চার স্টুডিও ছিল না। রোজের গৃহকাজের মধ্যেই চলত ওঁর চিত্রচর্চা। ১৮৭৫ সালের ১৮ জুন ওঁর জন্ম; জন্ম হয় গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সৌদামিনী দেবীর ঘরে। মৃত্যু: ১৯৬২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি। শিল্পীর ঘর, ভাইয়েরা সব শিল্পচর্চায় মগ্ন; অবনীন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ ও সমরেন্দ্রনাথ। পূর্ণিমা ঠাকুরের কথায়, সুনয়নী কিছুদিনের জন্য অসিতকুমার হালদারের কাছে আঁকা শেখেন।

তাঁর পিসিমা কুমুদিনীর ঘর এক অলীক মায়ায় ঘিরে রাখত তাঁকে, অনুপ্রেরণা দিত। কুমুদিনীর ঘরভর্তি পাখি ও রবি বর্মার পৌরাণিক ছবি। দেশীয় ধারার চর্চায় নতুন করে পুরাতনকে আবিষ্কার করা হচ্ছে। ফিরে দেখা হচ্ছে ভারতীয় নন্দনতত্ত্বকে, চিত্রসূত্র ও ষড়ঙ্গের হাত ধরে; ভারতীয় ও পারস্যের অণুচিত্র, প্রাচীন মূর্তিকলা ও স্থাপত্য, চীন-জাপান-ইন্দোনেশীয় শিল্পকলা ও ভারতীয় লোকশিল্পকে। সুনয়নীর ছবিতে এই সমস্ত কিছুরই প্রভাব দেখা যায়। ছবিতে সূক্ষ্ম, স্বচ্ছ জলরঙে গড়ে ওঠে স্বপ্নিল এক আবহ।

এই গৃহবিদ্যালয়ের কোনও বাঁধাধরা সময় বা নিয়ম ছিল না। পারিবারিক আদান-প্রদান ও কথোপকথনের খোলামেলা আবহ উৎসাহ জোগায় শিল্পচর্চায়। সুনয়নীর শিল্পচর্চা এগিয়ে চলে তাঁর ভাইদের সাহচর্যে। ‘প্রবাসী’ পত্রিকা স্বদেশি শিল্পচর্চার এক মূল অঙ্গ হয়ে ওঠে— বলা যেতে পারে, বইয়ের আকারে চলমান এক প্রদর্শশালা— যা ঘরে-ঘরে পৌঁছে দিয়েছিল এই নতুন শিল্পের ফসল। ‘প্রবাসী’ ও ‘প্রবাসী’-র মতো নানা পত্রিকা অন্দরমহলে পৌঁছে দিয়েছিল এই নতুন শিল্পপ্রয়াস। সুনয়নীও নকল করতেন ওখানে প্রকাশিত ছবির। সারাদিন চলত তাঁর রং-তুলির খেলা, যতক্ষণ না পর্যন্ত তাঁর স্বামী ফিরে আসতেন সন্ধেবেলায়।

রং ও কাগজের খেলায় হঠাৎ-ই আবিষ্কার করতেন নতুন কোনও আকার। কখনও-বা তিনি জানান, ‘আমার বেশির ভাগ ছবি আমি স্বপ্নে দেখেছি— তারপর ছবি এঁকেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘স্বপ্নে ঈশ্বরের অনুরোধে আমি এঁকেছি মা ও শিশু, সরস্বতী, লক্ষ্মী, মহাদেব ও রাধাকৃষ্ণ।’ যদিও বলা যায়, পুরাণকথার প্রভাব ছিল ছবিতে ও লেখায়, যা কিনা তদানীন্তন শিল্পচর্চায় পাওয়া যায়; যেমন, ভগিনী নিবেদিতার ‘ক্রেডল টেল্‌স অফ হিন্দুইজম’-এ, যার চিত্রায়ণ করেছিলেন নন্দলাল বসু।

সুনয়নীর সবচেয়ে শিল্পনিমগ্ন সময় ছিল ১৯২৩ থেকে ১৯৪০। ১৯২৩ সালে বার্লিনের ক্রাউন প্রিন্স প্যালেসের ন্যাশনাল গ্যালারিতে অবনীন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ, নন্দলাল বসু, এস এন দে, ক্ষিতীন্দ্রনাথ মজুমদারের সঙ্গে প্রদর্শিত হয় তাঁর ছবি।

রং ও কাগজের খেলায় হঠাৎ-ই আবিষ্কার করতেন নতুন কোনও আকার। কখনও-বা তিনি জানান, ‘আমার বেশির ভাগ ছবি আমি স্বপ্নে দেখেছি— তারপর ছবি এঁকেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘স্বপ্নে ঈশ্বরের অনুরোধে আমি এঁকেছি মা ও শিশু, সরস্বতী, লক্ষ্মী, মহাদেব ও রাধাকৃষ্ণ।’ যদিও বলা যায়, পুরাণকথার প্রভাব ছিল ছবিতে ও লেখায়, যা কিনা তদানীন্তন শিল্পচর্চায় পাওয়া যায়; যেমন, ভগিনী নিবেদিতার ‘ক্রেডল টেল্‌স অফ হিন্দুইজম’-এ, যার চিত্রায়ণ করেছিলেন
নন্দলাল বসু।

পৌরাণিক ছবি ছাড়াও দেখা যায়, পশু-পাখিদের। অবনীন্দ্রনাথ তাঁকে একঘেয়েমির কথা বলেন; বলেন পশু-পাখি আঁকার কথা। সুনয়নী আঁকলেন ঘোড়া। এমন ঘোড়া, যা দেখে আমিনা আহমেদ করের মনে হয় মার্ক শাগালের কথা। ওঁর কাজ দেখে তাঁর মনে হয়, প্রাচ্যের শিল্পী Chien Hsuan-এর ‘Boneless’ শৈলীর কথা; এমন এক শৈলী, যাতে কোনও রেখা দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়নি অবয়বগুলো। জোড়াসাঁকোর জাপানি শিল্পের প্রভাব সুনয়নীর ছবিতেও বহুল। কখনও তাঁর অগ্রজ সন্তান যদি ছবি নষ্ট করে দেয় তো কখনও তিনি নিজেই নষ্ট করেন আত্মপ্রত্যয়ের অভাবে। আবার কখনও-বা নাতির আবদারে আঁকেন জাপানি পুতুল।

সুনয়নীর ছবি তাঁর প্রাত্যহিক জীবন থেকে উঠে আসে। তাঁর পুত্রবধূ মণিমালার কথায়, ‘উনি রান্না-বান্নার আয়োজন করতেন, সব্জী কাটতেন নিজের হাতে। তারপর সেই সব্জী ধোয়ার জলে তুলি ধুতেন।’ এইভাবেই ছবি আঁকার প্রয়াস তাঁর রোজকার নানা গৃহস্থালি কাজের অংশ। তিনি তাঁর পুত্রবধূদেরও ছবি আঁকা শেখাতেন।

বাড়ির ছাদে দাঁড়ানো তাঁদেরই বাড়ির কোনও এক মেয়ে জোছনা উপভোগ করছে, আকাশ ধুয়ে যাচ্ছে চাঁদের আলোতে, আর তা ওয়াশের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন তিনি। তাঁর ছবিতে পোষ্যদের ভিড়। হিন্দু দেব-দেবী ছাড়াও যিশুখ্রিস্টের দেখা পাওয়া যায় তাঁর ছবিতে। বাদ্যরত মানুষও উপস্থিত থাকেন, যা কিনা মনে করিয়ে দেয় ঠাকুরবাড়ির কীর্তন ও আরও নানান গানের আসর। তাঁর ছবির বিশেষত্বের মধ্যে দেখা যায়, টানা চোখার ভাবুকতা। গগনেন্দ্রনাথের কথায়, ‘সুনয়নীর মতো চোখ ও ভ্রু কেউই আঁকতে পারে না।’ যামিনী রায়ও প্রভাবিত হন তাঁর চোখের টানা চোখের মায়ামমতায়।

গৃহকোণের রোজকার কথা, গল্প, বাড়িতে ভিড় করা মানুষেরা ধরে রেখেছে এক নারীর চোখে খুব কাছ থেকে দেখা তাঁর দৈনন্দিন জীবন। শিল্পকলায় নারী যখন হয় পৌরাণিক, ধার্মিকতায় মোড়া বা নগ্ন পণ্যের মতো, তখন সুনয়নীর এই অতি-নিকট মনের কথাগুলো এবং বৃদ্ধ বয়সের এক নারীর করা নিজের পোর্ট্রেট তদানীন্তন ছবিতে উপস্থিত উপভোগ্য নারী-চিত্রায়ণের প্রতি এক প্রতিবাদ— যা ভরপুর এক সৃষ্টিশীল ও মননশীল শিল্পীর স্বকীয়তায় ও নিজস্ব বিশ্লেষণে উজ্জ্বল।