বিশ্ব শরণার্থী দিবসের মাত্র কয়েকদিন আগে, নতুন করে শুরু হল আরও একটা যুদ্ধ। এটা বিশ্বের সবচেয়ে বড় কনসেনট্রেশন ক্যাম্প গাজা-য় ইজরায়েলের একতরফা গণহত্যার মতো নয়৷ প্রকৃতই যুদ্ধ। আতশবাজির মতো আকাশ থেকে নেমে আসা মুহুর্মুহু মিসাইলের নীচে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটোছুটি করছেন মানুষ। তেহরানের রাস্তায় তেল ভরার জন্য সুদীর্ঘ গাড়ির মিছিল। রাতারাতি সংসারের জিনিসপত্র যেটুকু পারা যায় গুছিয়ে নিয়ে নগরী ছেড়ে পালাচ্ছেন গৃহী মানুষজন। ইরানের মিসাইল থেকে বাঁচতেও ছোটাছুটি করছেন তেল আভিভের বাসিন্দারা, যাঁদের রাষ্ট্রটাই গড়ে উঠেছে ফিলিস্তিনি জনতাকে বাস্তুচ্যুত করে। ছোট্ট একফালি গাজা এখন ২০ লক্ষের বেশি অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষের কারাগার, একটু খাবারের আশায় দীর্ঘ অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে যাঁরা ইজরায়েলি বাহিনীর আচমকা খেয়ালের আক্রমণে ছিন্নভিন্ন হয়ে উড়ে যাচ্ছেন। এশিয়া যেন উদ্বাস্তু সমস্যার এক অনন্ত শোকগাথা।

২০২৩ সালের শেষে, বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর স্ত্রী সারার ঘনিষ্ঠ পরামর্শদাতা এবং অফিস ম্যানেজার জিপি নাভোন ইজরায়েলের সেনাবাহিনীর কাছে একটি আর্জি জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, অবরুদ্ধ গাজার বাসিন্দাদের হত্যা না করে বাঁচিয়ে রেখে বাড়ি-বাড়ি ঢুকে অত্যাচার করা হোক। কিন্তু আটক ফিলিস্তিনিদের জিভ যেন না কেটে ফেলা হয়। কারণ, ইজরায়েলিরা তাদের আর্তনাদ উপভোগ করতে চান। আটক আরবদের কান এবং চোখ যেন আস্ত রাখা হয়, যাতে তাঁরা দেখতে এবং শুনতে পারেন ইজরায়েলিদের উল্লাস।
আরও পড়ুন: যুদ্ধ আসলে একটি ‘সবল বনাম দুর্বল’ বাইনারি; লিখছেন কবীর চট্টোপাধ্যায়
এর আগেও ইজরায়েলের এমন বিকৃত উল্লাসের দৃশ্য গোটা পৃথিবী দেখেছে৷ প্যালেস্তাইনের নিরস্ত্র জনতার ওপর যখন বোমা পড়ছে, রকেট বৃষ্টি হচ্ছে, ঝলসে যাচ্ছে ফিলিস্তিনি শিশুর দল, সেই অপরূপ মনোরম দৃশ্য দেখার জন্য, তখন উঁচু পার্বত্য এলাকায় ইজরায়েলিদের ভিড়। পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবার এবং পানীয় নিয়ে তাঁরা ‘উপভোগ’ করছেন মারণ উৎসব— ২০১৪ সালের এই ছবি কোনও বিচ্ছিন্ন দৃশ্য নয়। জায়নবাদী ইজরায়েল রাষ্ট্র এভাবেই দশকের পর দশক উদযাপন করে আসছে লাগাতার গণহত্যা। তাই ইজরায়েলি রাষ্ট্র স্পষ্টতই বলতে পারে, ফিলিস্তিনিরা মানুষ নয়, নরপশু। কাজেই এই ‘না মানুষ’-দের যে দশকের পর দশক শরণার্থী হয়েই বাঁচতে হবে, শরণার্থী শিবিরে মানবেতর জীবনযাপন করতে হবে, সেই শরণার্থী শিবিরেও বোম পড়বে, খাবারের লাইনে দাঁড়ানো শরণার্থী শিশুদের গুলি করে খুন করা হবে একের পর এক— তাতে আর আশ্চর্যের কী!
‘ইউনাইটেড নেশনস হাই কমিশন অফ রিফিউজিস’ (UNHCR)-এর সাম্প্রতিক রিপোর্ট (https://www.unhcr.org/global-trends-report-2024) অনুযায়ী বিশ্বে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা এখন ১২ কোটির ৩২ লক্ষের মতো। এর মধ্যে ৭ কোটি ৩৫ লক্ষ, অর্থাৎ, ৬০ শতাংশ প্রায়, নিজের দেশের মধ্যেই উদ্বাস্তু হয়ে রয়েছেন, ৮৪ লক্ষের নাম রয়েছে শরণার্থীর খাতায়, ৬ লক্ষ মানুষের আন্তর্জাতিক আশ্রয় প্রয়োজন, এবং ‘ইউনাইটেড নেশনস রিলিফ অ্যান্ড ওয়ার্ক এজেন্সি’ (UNRWA)-র আওতায় আছেন ৬ লক্ষ ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু।



ইউরোপের রাজনৈতিক সমীকরণে উদ্বাস্তু সমস্যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ক্রমবর্ধমান শরণার্থী ও উদ্বাস্তু প্রশ্নের বিশাল ভূমিকা রয়েছে দক্ষিণপন্থী শক্তির উত্থানের পিছনেও। অথচ বিশ্বের ৭৩ শতাংশ উদ্বাস্তু ও শরণার্থী রয়েছেন কিন্তু নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোয়। UNHCR-এর হিসেবে সবচেয়ে বেশি উদ্বাস্তু ও শরণার্থী রয়েছেন ভেনেজুয়েলা থেকে, প্রায় ৬২ লক্ষ। এরপর আছে সিরিয়া, আফগানিস্তান, ইউক্রেন ও সাউথ সুদান। অন্যদিকে শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার হিসেবে (https://popstats.unhcr.org/refugee-statistics) সবার ওপরে ইরান, প্রায় ৩৫ লক্ষ শরণার্থী উদ্বাস্তুকে জায়গা দিয়েছে তারা। এর পরে রয়েছে যথাক্রমে তুরস্ক, কলম্বিয়া, জার্মানি ও উগান্ডা। দেশীয় জনসংখ্যার অনুপাতে সবচেয়ে বেশি-সংখ্যক উদ্বাস্তুকে আশ্রয় দিয়েছে লেবানন। পঞ্চম স্থানে জর্ডন। সিরিয়া-প্যালেস্তাইনের প্রতিবেশী লেবানন এবং জর্ডানে শরণার্থীর অনুপাত যথাক্রমে ৮ জনে একজন এবং ১৮ জনে একজন। শরণার্থী মাত্রেই নৌকো চড়ে সাগরে ভেসে পড়ার উপায় যেহেতু নেই, ৬৭ শতাংশ আন্তর্জাতিক শরণার্থীরই ঠাঁই হয় প্রতিবেশী দেশে। ভাগ্যিস হয়, না-হলে আরও কত আয়লান কুর্দির ছোট ছোট লাশে না জানি সেজে উঠত পৃথিবীর তটরেখাগুলি!
শিশুরা পৃথিবীর জনসংখ্যার প্রায় ২৯ শতাংশ। কিন্তু ওই বারো কোটির বেশি উদ্বাস্তু জনতার মধ্যে ৪০ শতাংশ শিশু। ২০১৮ থেকে ২০২৩-এর মধ্যে ২৩ লক্ষ শিশু জন্মই নিয়েছে উদ্বাস্তু পরিচয় কপালে এঁটে। পূর্ণবয়স্কদের মধ্যে পুরুষ ও নারীর অনুপাত প্রায় সমান সমান। যদিও আন্তর্জাতিক শরণার্থী হিসেবে দূরের দেশে, প্রথম বিশ্বের দেশে, যাঁরা পৌঁছতে পারেন, তাঁদের মধ্যে কিন্তু পুরুষের অনুপাত বেশি। যুক্তরাজ্য ও ইউরোপে শরণার্থীদের ৭০ শতাংশ পুরুষ। তার একটা বড় কারণ অবশ্যই শরণার্থীদের দীর্ঘ ও কঠিন যাত্রা। তারের বেড়া ও উঁচু দেওয়াল টপকে পালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে, বা অনির্দিষ্টকালের জন্য সমুদ্রে ভেসে পড়ার ক্ষেত্রে পুরুষদের সুবিধা বেশি। পাশাপাশি, সামাজিক রক্ষণশীলতা এবং পরিবারের মধ্যে পুরুষ সদস্যদের অগ্রাধিকারও আর-একটা কারণ, বড় কারণ। পালিয়ে যেতে অক্ষম শিশু এবং বৃদ্ধদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্যও আটকে পড়েন মেয়েরা।
যে শহর স্লোগান দিয়েছিল ‘তোমার নাম আমার নাম— ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম’, যে শহর আরাফত, পিট সিগার, ম্যান্ডেলা দেখেছে, সে এখন মর্গের মতো শান্ত৷ কলকাতা নামক এই মর্গে অতীতের সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলনের লাশগুলি শুয়ে আছে পাশাপাশি। কয়েকটি রুটিন মিছিল ছাড়া যুদ্ধ, গণহত্যা ও বাস্তুচ্যুতির পক্ষে কথা বলে না এই শহর।
ইউরোপের দেশগুলোয় সিরিয়া থেকে আসা শরণার্থীর ভিড় বিশেষভাবে বাড়তে থাকে ২০১৫ সালে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের পর। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর মধ্যে যে কমন অ্যাসাইলাম সিস্টেম চালু আছে, তার নিরিখে সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ এবং শরণার্থী বন্টন নিয়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে মতান্তর দেখা দেয়। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে শরণার্থীর ভিড় সামলাতে সবচেয়ে বেশি নাজেহাল হয় গ্রিস এবং ইতালি। অভিবাসন-বিরোধী মনোভাব বাড়তে থাকে। সঙ্গে-সঙ্গেই টাল খায়, ইউরোপের আন্তর্দেশীয় ঐক্যের সাজানো ধারণা। ইউরোপীয় ইউনিয়নের তৎপরতায় গ্রিস ও ইতালিতে উপনীত প্রায় ২০ লক্ষ শরণার্থীকে বিভিন্ন দেশের মধ্যে বন্টন, সীমান্তে বিধিনিষেধ বাড়ানো, এবং তুরস্কের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর হয়। কিন্তু শরণার্থী প্রবাহ আসতেই থাকে নিরন্তর।


কোনও মানুষই ফিরতে পারেন না, এমন নয়। সম্মিলিত রাষ্ট্রপুঞ্জের খতিয়ান অনুযায়ী, ২০২৪ সালে নিজ এলাকায় পুনর্বাসিত করা গিয়েছে প্রায় ৯৮ লক্ষ মানুষকে। অন্যত্র পুনর্বাসিত হয়েছেন প্রায় দুই লাখের কাছাকাছি। প্রায় ৮৯ হাজার উদ্বাস্তু অথবা দেশহীন শরণার্থী নতুন করে নাগরিকত্ব পেয়েছেন কোনও না কোনও দেশে। কিন্তু উদ্বাস্তু জনতার স্রোতের মুখে এই সংখ্যাগুলো বেশ ছোট।
২০২০ সালে করোনা অতিমারীর পর থেকে, একের পর এক আন্তর্জাতিক ও আভ্যন্তরীণ সংঘাত নতুন নতুন শরণার্থী গোষ্ঠীর জন্ম দিতে থাকে। সুদান এবং মায়ানমারের আভ্যন্তরীণ সংঘাত, ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গো-তে প্রবল অস্থিরতা, ইয়েমেনের দুর্ভিক্ষ, আফগানিস্তানে তালিবানদের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল— সমস্যা অন্তহীন। ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ লাগার পর শ্বেতাঙ্গ শরণার্থীর সার দেখে থতমত খেয়ে যায় ইউরোপের দেশগুলো। ২০২৩-এর শেষ থেকে গাজার ওপর ইজরায়েলের একতরফা যুদ্ধ। ২০২০-র তুলনায় ২০২৪-এ সিরিয়ান উদ্বাস্তু ও শরণার্থীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৮৯ শতাংশ বেশি।
কিন্তু এ গেল শুধুই যুদ্ধের কথা। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়া মানুষের সংখ্যা পৃথিবীতে ক্রমশই বাড়ছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের অনুমান অনুযায়ী ২০৫০ সালের মধ্যে ১৮ কোটির বেশি মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে পড়বেন পরিবেশ ও জলবায়ুগত বিপর্যয়ের কারণে, যার মধ্যে অন্যতম বন্যা এবং দাবানল। গত কয়েক বছরে কানাডা, পশ্চিম আমেরিকা, ও ইউরোপের কিছু কিছু দেশে দাবানলের প্রকোপ দেখেছে বিশ্ব। আগামিদিনে তা আরও বাড়বে।
এর পাশাপাশি ভুলে গেলে চলবে না যে, যুদ্ধ শুধু সরাসরিই মানুষ মারে না, একটা জায়গাকে সুদীর্ঘকালের জন্য বসবাসের অযোগ্য করে তোলা থেকে শুরু করে জলবায়ুর ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে আধুনিক অস্ত্র প্রযুক্তিসম্পন্ন প্রতিটি জীবনক্ষয়ী যুদ্ধ। সর্বান্তঃকরণে, সব দ্বিধা কাটিয়ে, যুদ্ধের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর শিক্ষা দেয় এই সময়। বিশ্ব শরণার্থী দিবস নিয়ে আবেগমাখা একটি লেখা, কিছু মূল্যবান চোখের জল, জরুরি বিষণ্ণতার চেয়েও বেশি দরকার প্রকৃত যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের শরিক হওয়া, বাস্তুচ্যুতির বিরুদ্ধে কথা বলা। বিশ্বের অধিকাংশ দেশ এখন যুদ্ধ ও গণহত্যার বিরুদ্ধে আন্দোলনে উত্তাল। লাখো মানুষ পথে নামছেন লন্ডন, প্যারিস, ব্রাসেলস, আথেন্স, নিউ ইয়র্কে, গোটা পশ্চিম এশিয়ায়, আফ্রিকায়, মধ্যপ্রাচ্যে।
অথচ যে শহর একসময়ে ম্যাকনামারকে ঢুকতে দেয়নি, যে শহর স্লোগান দিয়েছিল ‘তোমার নাম আমার নাম— ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম’, যে শহর আরাফত, পিট সিগার, ম্যান্ডেলা দেখেছে, সে এখন মর্গের মতো শান্ত৷ কলকাতা নামক এই মর্গে অতীতের সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলনের লাশগুলি শুয়ে আছে পাশাপাশি। কয়েকটি রুটিন মিছিল ছাড়া যুদ্ধ, গণহত্যা ও বাস্তুচ্যুতির পক্ষে কথা বলে না এই শহর। মিছিলগুলি যেন নিভে আসা বনভোজনের মতো, নিয়মরক্ষা।