খালি গলার জোর

Obituary of revolutionary Bengali singer Pratul Mukhopadhyay by Upal Sengupta.

সালটা মনে নেই, সময়টা নয়ের দশক। প্রেসিডেন্সি কলেজে আমরা ফেস্টের প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে গিয়েছি। সেখানে গান গাওয়া, স্কিট ইত্যাদি হত। তারপর সন্ধেবেলা হত গেস্ট পারফরমেন্স। বিভিন্ন ওয়েস্টার্ন ব্যান্ডের অনুষ্ঠান হত। সেসব শোনা নিয়ে আমাদের খুব আগ্রহও থাকত। হইহই করে, নেচেগেয়ে শুনতাম সেইসব গান। প্রেসিডেন্সির ডিরোজিও হলের সামনের বড় মাঠে অনুষ্ঠান হত। ইভেন্ট থেকে বেরিয়ে একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আজ কে গান গাইতে আসছেন?’ সে বলল, ‘প্রতুল মুখোপাধ্যায়।’ আমি বা আমরা তার আগে বিশেষ শুনিনি ওঁর গান। আমরা জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেমন গান করেন ইনি?’ সেই বন্ধু জানাল, ‘খালি গলায় গান করেন। শোন, মজা পাবি।’ আমরা ‘খালি গলায় গান করেন’ শুনে খানিক তামাশাই করলাম। বললাম, ‘চ, একটু হইচই করে ওঁকে স্টেজ থেকে নামিয়ে দিই। খালি গলায় আবার গান হয় নাকি!’ আসলে তখন আমরা কম্পিটিশনে প্রাইজ ইত্যাদি জিতছি, নিজেদের ওপর খুবই আত্মবিশ্বাস। তাই ওইরকম একটা মেজাজ নিয়েই প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গান প্রথম শুনতে গিয়েছিলাম।

গিয়েই শুনলাম, খালি গলায় হাততালি দিয়ে গাইছেন, ‘স্লোগান দিতে গিয়ে আমি চিনতে শিখি নতুন মানুষজন’। চুম্বকের মতো আটকে গেলাম আমরা! একজন সঙ্গে হারমোনিয়াম বাজাচ্ছেন, আর খালি গলায়, হাততালি দিয়ে প্রতুলদা একের পর এক গান গেয়ে চলেছেন, মাঝে কথাও বলছেন কিছু কিছু। মন্ত্রমুগ্ধর মতো শুনে গেলাম আমরা। ‘আলু বেচো ছোলা বেচো’, ‘ডিঙ্গা ভাসাও সাগরে’, ‘আমি বাংলায় গান গাই’ গেয়ে চলেছেন, গোটা মাঠ তাঁর সঙ্গে গলা মেলাচ্ছে। সেদিন বুঝেছিলাম, খালি গলা কতটা জোরালো হতে পারে! প্রতুলদাই সেটা বোঝালেন।

আরও পড়ুন : সোমবারের ব্লুজে লুকিয়ে সুরের বিষাদ! লিখছেন উপল সেনগুপ্ত…

এরপর আলাপ হল ধীরে ধীরে ওঁর সঙ্গে। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লেখা ‘গোঁসাইবাগানের ভূত’ যখন চিত্রায়িত হল, চন্দ্রবিন্দু তখন তার সংগীতের বরাত পেয়েছিল। অনিন্দ্যর মনে হয়েছিল, সেই ছবির টাইটেল ট্র্যাকটা প্রতুলদা গাইলে খুবই ভাল হয়। আমরা প্রতুলদাকে অনুরোধ করায় উনি খুব খুশি হন। সেই গান তিনি গেয়েছিলেন। সেই গানের রিহার্সালের জন্য একদিন আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। রিহার্সাল শেষ হতেই তুমুল আড্ডা হয়েছিল! পরপর গান গেয়েছিলেন। তার মধ্যে অনেক গান রেকর্ডও হয়নি হয়তো। এক-একটা অভিজ্ঞতা বলছেন, এক-একটা গান গাইছেন। প্রায় সাড়ে ১১টা, পৌনে ১২টা বেজে গেল। সে এক জমাটি ব্যাপার!

এই ছিলেন প্রতুলদা! প্রতুলদার গানের ধারাটা একেবারেই অনন্য। যন্ত্রানুষঙ্গের হইচই ছাড়াও যে অমন মাতিয়ে দেওয়া গান হতে পারে, তা প্রতুলদাই দেখিয়ে দিয়েছিলেন। এক সময়ে আধুনিক বাংলা গানের একটা জোয়ার এসেছিল। এফএম চ্যানেলগুলিও প্রোমোট করেছিল সেসব গান। কবীর সুমন, অঞ্জন দত্ত, নচিকেতা থেকে পরবর্তীতে ‘চন্দ্রবিন্দু’, ‘ভূমি’, ‘ক্যাকটাস’— সকলেই ছিল সেই জোয়ারে। তা বদলে গিয়ে এল ফিল্মি গানের ঢেউ। সেখানে মনকেমন বা প্রেমের গান বাড়তে থাকল। কিন্তু শুধুই যে তেমন গানই একমাত্র গান নয়, আরও অনেক রকমের গান হয়, সেই বার্তাটা দেওয়ার জন্যই প্রতুলদার মতো মানুষদের দরকার। ওঁর গানে, অনেকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার একটা ক্ষমতা ছিল। সেটাই ওঁর সবচেয়ে জোরের জায়গা। ‘আমি বাংলায় গান গাই’ তো ফেনোমেননই হয়ে উঠল। বাংলা ভাষার, বাংলা গানের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য এই গানের কোনও জুড়ি নেই এখনও, বোধহয় ভবিষ্যতেও থাকবে না।

মনে আছে, গুরুদাস কলেজে একবার একটি অনুষ্ঠানে প্রথমে প্রতুল মুখোপাধ্যায় গান গাইবেন, তারপর ‘চন্দ্রবিন্দু’। ততদিনে সময় অনেকটা বদলেছে, গান শোনার অভ্যেসও বদলেছে। যে কু-প্রবৃত্তি আমার জেগেছিল কলেজে, প্রতুলদার গান না শুনেই ওঁকে স্টেজ থেকে নামিয়ে দিতে চেয়েছিলাম, সেই একই প্রবৃত্তি ছিল ওই কলেজের ছাত্রছাত্রীদের। তারা হইচইয়ের গান শুনবে, এই গানে তাদের আগ্রহ নেই, এমন একটা ভাব তারা দেখাতে শুরু করল। প্রতুলদার গানের মাঝখানেই নানা বিড়ম্বনা তৈরি করতে শুরু করল, উঠে যেতে শুরু করল। সেদিন প্রতুলদা একটা কথা বলেছিলেন, যেটা সারাজীবন মনে থাকবে। বলেছিলেন, ‘গান গাওয়া যেমন অভ্যেসের ব্যাপার, চর্চার ব্যাপার, গান শোনাও তেমন।’ একজন গানের মাঝেই উঠে যাচ্ছিলেন, তাঁর উদ্দেশে প্রতুলদা বলেছিলেন, ‘গানের মাঝে কেউ উঠে গেলে কিন্তু আমি আবার শুরু থেকে গাইব।’ এরপর অবশ্য আর কেউ উঠে যাওয়ার সাহস দেখাননি! কিন্তু এইজন্যই এই ঘটনাটা মনে আছে, শ্রোতাদের জন্য এটা একটা চমৎকার শিক্ষা। প্রতুলদার বলা এই কথাটা যে কত সত্যি, অমনোযোগী শ্রোতা দেখলেই তা বোঝা যায়।

খালি গলায় হাততালি দিয়ে গাইছেন, ‘স্লোগান দিতে গিয়ে আমি চিনতে শিখি নতুন মানুষজন’। চুম্বকের মতো আটকে গেলাম আমরা! একজন সঙ্গে হারমোনিয়াম বাজাচ্ছেন, আর খালি গলায়, হাততালি দিয়ে প্রতুলদা একের পর এক গান গেয়ে চলেছেন, মাঝে কথাও বলছেন কিছু কিছু। মন্ত্রমুগ্ধর মতো শুনে গেলাম আমরা। ‘আলু বেচো ছোলা বেচো’, ‘ডিঙ্গা ভাসাও সাগরে’, ‘আমি বাংলায় গান গাই’ গেয়ে চলেছেন, গোটা মাঠ তাঁর সঙ্গে গলা মেলাচ্ছে।

সেই দিনেরই আরেকটি ঘটনা দিয়ে শেষ করি। দুটো অনুষ্ঠানের মাঝে গ্রিনরুমে বসে আড্ডা চলছে প্রতুলদার সঙ্গে। তার কিছু বছর আগেই পিট সিগার এসেছিলেন কলকাতায়, অনুষ্ঠানও করেছিলেন। আমরা সেই অনুষ্ঠানের টিকিট পাইনি, ঢুকতে পারিনি, ফলে খুব আফসোস ছিল। সেদিন শুনলাম, প্রতুলদাও সেদিন ঢুকতে পারেননি। প্রতুলদাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আপনার আফসোস হয় না ওইদিনের জন্য?’

প্রতুলদা উত্তর দিয়েছিলেন, ‘হয়, তবে আমার জন্য নয়, পিট সিগারের জন্য। আমি তো পিট সিগারের ভক্ত, কবে থেকে তাঁর গান শুনছি, সব গানই প্রায় মুখস্থ। কিন্তু এত দূর থেকে এসে পিট সিগার যে আমার গান না শুনেই ফিরে গেলেন! এতে লোকসানটা কার? আমার, না পিট সিগারের?’ কথাটা মজা করে বলা হলেও সত্যি। কারণ, এই সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানটা জারি থাকা দরকার।

এরকম একজন প্রাণবন্ত, মজার মানুষ চলে গেলেন, এর চেয়ে আফসোসের আর কী হতে পারে!