মানুষের ঢল রাস্তার অধিকার কেড়ে নিতে নেমেছে শুনলেই কেন জানি না, চোখের সামনে বার্লিন, ন্যুরেমবার্গে নাৎসি মিছিলের ছবি ভেসে ওঠে— হয়তো পথের ধারেই ফ্যাসিস্ট ঈশ্বর ইল দুচের সঙ্গে তার পেয়ারের রক্ষিতার অর্ধোলঙ্গ উল্টো মৃতদেহ ঝুলিয়ে পূর্বতন সমর্থকদের বিজয়োল্লাস, সাধারণ মানুষের প্রতিশোধের ছবিটিও আমাদের শৈশবে মোটামুটি টাটকা অভিজ্ঞতার অংশ ছিল বলেই। বামপন্থী হিসেবে কিউবায় অভ্যুত্থানের পর লা’বানায় ফিদেল এবং চে গেভারা-র সদলবলে প্রবেশের ছবি মানসপটে খেলে গেলে নিঃসন্দেহে বেশি খুশি হতাম, তবে অবচেতনে কোন জট পাকিয়ে বসে আছি, পূর্ব রণাঙ্গনে সোভিয়েত বাহিনীর অগ্রগতির ধূসর ফোটোগ্রাফের সঙ্গে কেন ওদেসায় মৃত নাবিকের শবদেহ দেখতে সর্পিল লাইন ধরে জড়ো কাতারে কাতারে মানুষের ভিড় মিলে মিশে আছে, মগজে ‘he died for a piece of bread’ আর ইভানের রুটির টুকরো ছিঁড়ে খাওয়ার দৃশ্যগুলিকে কখন একটিই নিরবচ্ছিন্ন আখ্যানে গেঁথে— তার খবর কে-ই বা রাখে।
তারও খানিক পরে সুধীন দত্ত— ‘আমাগো বিভাগের সম্পত্তি’— পড়ার পাশাপাশি দেখেছি বাবরি মসজিদ ভাঙতে একত্রিত দলিত করসেবক, গম্বুজের মাথায় গেরুয়া ফেট্টি জড়ানো নিম্নবর্ণের হিন্দুদের গুরুত্বপূর্ণ স্থানাধিকার।
অতএব, একই সঙ্গে মাথায় ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা সংবর্তের শব্দগুলো জবরদস্তি পঙক্তি ভাঙে, পরস্পরের সঙ্গে ঠোকা খেতে থাকে একটানা। জোর করে রফি, কিশোর, লতার গান ভেঁজে দেখেছি, লাভ হয়নি। স্বপ্নাবিষ্ট সভ্যতার নিশ্চিন্ত শিয়রে, লেগেছিল হাস্যকর… কূটাগার থেকে দেখা স্বস্তিকলাঞ্ছন, বালখিল্য নাৎসিদের সমস্বর নামসংকীর্তন মশালের ধূমায়িত আলোকে। সম্প্রতি শহরে রামনবমীর মিছিলের, থুরি, জাতিদাঙ্গায় প্ররোচনা এবং নিরস্ত্রদের সম্মুখ সমরের অবতীর্ণ হওয়ার আহ্বান দেখলাম ন্যুরেমবার্গকে হেলায় বাস্তুচ্যুত করল।
আরও পড়ুন : কে-ড্রামা নিয়ে দেশজুড়ে পাগলামি! নেপথ্যে কাজ করছে কোন মনস্তত্ত্ব?
লিখছেন শঙ্খদীপ ভট্টাচার্য…
ইদানীং, ভারতীয় রাজনীতি খুব একটা সূক্ষ্ম কূটনৈতিক গুটি সাজানো, পাল্টা চালের ওপর নির্ভরশীল নয়— হয়তো হাতি-ঘোড়ার জায়গায় গরুকে এখনও দাবার চৌষট্টি খোপে ঢোকানো যায়নি বলেই। ফলে গুঁতোনো বা চাট মারার আঙিনায় প্রতিদ্বন্দ্বীকে ফুসলিয়ে ফ্রেন্ডলি ম্যাচে নামাতে পারলেই মার দিয়া কেল্লা— যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন গিলে খায় অপ্রাসঙ্গিক বৃহৎ মৎস্য। দেশপ্রেম, ধর্মবিশ্বাস, ছুঁৎমার্গে আস্থা ছাড়াও হনুমান, জলহস্তী, টিকটিকি, বা দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ডের মতো গম্ভীর প্রজাতির পাখির ঐশ্বরিক ক্ষমতা নিয়ে, শিবনেত্র ‘দেশ’ একটানে খাদ্য, শিক্ষা, বাসস্থানের প্রশ্নগুলিকে আলোচ্য বিষয়ের তালিকা থেকে ছাঁটে। পাকিস্তানে লোক কত দুঃখে কালাতিপাত করিতেছে, চিনাদের আত্মিক উন্নতির কোনও উপায়ই কেন আর নেই, বা, রুশদের বাপেরা বৃষৎসর্গ শ্রাদ্ধ পশ্চাৎপিন্ডির ব্যবস্থা না হওয়ায়, কী নিদারুণ কষ্ট সহ্য করে পারগেটরি-তে খাবি খাচ্ছে— ইত্যাদিই এখন বাদানুবাদের বিষয়। সেদিন দেখলাম খবর হয়েছে, নারলিকর গীতা পড়তেন, এরপর যদি অ্যাস্ট্রো-ফিজিক্সের কোর্সে তিনশো নম্বরের গীতা ঢোকানো হয়— আশ্চর্য হব না।

এসবই ব্যক্তিগত পরিসরে ঢাকঢোল পিটিয়ে চলেছে এযাবৎকাল, কোনও অসুবিধে হয়নি আমজনতার। কে কীসে বিশ্বাস করবে, তার ওপর সরকারি বা কৌম-ব্যবস্থার একাংশ খবরদারি করবে না, সেটাই সংবিধান বাবদ স্থির হয়েছিল। যবে থেকে ধর্ম-ব্যবসায়ীরা ‘গজাল মেরে গোঁজাবে’ পন্থায় কনসেন্ট আদায়ের পথে নেমেছে, তবে থেকেই গোলমালের সূত্রপাত। তাদের শক্তি প্রদর্শনের জন্য এখানে ‘বাবরি মসজিদ’-এর ব্যবস্থা ছিল না কোনওকালেই! আর, শহর থেকে এককালে যেমন ‘দাস্তান-এ-আমির হামজ়া’-র গোটা-পনেরো সংস্করণ ছাপা হলেও, সেই বুনিয়াদের খোঁজ রাখা বা তাতে চিড় ধরানোর কোনও উপায় বিজেপি জাতীয় কোনও সংগঠনের জানা নেই। এখনও নেই। তারা সৈয়দ মুজতবা আলী-র নাম শোনেনি, ওয়ালীউল্লাহ, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, বেগম রোকেয়া প্রমুখ কোনও সন্ত্রাসবাদীর বোন বা খালা-ফুফু— সে ভাগ-বাটোয়ারার দায়িত্ব সামলানোর ক্ষেত্রেও সমান মাহের। এই যে ভারতী নামক পুলিশের কত্তা থেকে একটানা সমস্ত বিজেপির নেতারা পাশের রাজ্য থেকে ছেলে ঢুকিয়ে দেওয়ার ধমকি দিয়ে চলেছে, তার একটা কারণ বোধহয় এই দিগভ্রান্ত অবস্থাও। এতটাই অশিক্ষিতদের জুটিয়ে তৈরি সাংস্কৃতিক ভিত্তি উপড়ে ফেলার এই সৈন্যবাহিনী, যে, রাস্তায় সশস্ত্র প্রতিপক্ষ না পেলে এদের পক্ষে শত্রু চেনাও সম্ভব নয়। নাৎসিরা বই পুড়িয়েছিল, কারণ তারা জনগণের হাতে বই দেখে, নিজেরা বই পড়ে জেনেছিল, কারা একনায়কতন্ত্র থেকে শ্বেত-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লোক খ্যাপানোর কাজটি করে চলেছে। এখানে বই বলতে হনুমান চল্লিশা, এবং আমি বাজি রেখে বলতে পারি, একজন হিন্দুত্ববাদী নেতাও নিজের মাতৃভাষায় লেখা গোটা রামায়ণ পড়েনি— বিভিন্ন ভার্সনের কথা তো বাদই দিলাম। মহাভারত বলতে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণটি জানে, ওটাই গোটা কাউ বেল্ট জুড়ে ইন্সপিরেশন কিনা, তাই! ফের সেই একই মোডাস অপারেন্ডি— মহিলাদের অধিকার-সংক্রান্ত দাবিদাওয়ার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সওয়াল খাড়া করার বদলে চুলের মুঠি ধরে নিয়ে যাও রাস্তার ধারে আলোকোজ্জ্বল চত্বরে, সর্বসমক্ষে বামুনের ছেলেদের দিয়ে ধর্ষণ করাও, যৌনাঙ্গে রড ঢুকিয়ে খতমের পর পেট্রল ঢেলে পুড়িয়ে দাও— যাতে বিদেহী আত্মা মহাশূন্যে ডিগবাজি খেয়ে না ফেরে। ব্যস, মেয়েদের অধিকারের প্রশ্নটি বিলকুল সাফ— তারপর আসারাম, ডেরা সাচ্চা সৌদা ইত্যাদি ক্রিমিনালদের মতো জামিনে মুক্ত হয়ে বাইরে এসে আবার লীলাখেলা দেখাও, কারণ সরকার এদের বাকায়দা মুক্তি দেওয়ার সমস্ত উপায় এবং সরকারি মেশিনারি তৈরি করেই রেখেছে।
লড়াইটা অতএব, মাঠে-ময়দানে লড়া হচ্ছে। কোনও মিছিলের পুরোভাগেই কবি, ঔপন্যাসিক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, নাট্যকার ইত্যাদি বিশিষ্ট ঢপবাজির বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। নেই, কারণ চোখ বুজে একবার ভাবার চেষ্টা করুন, উত্তরপ্রদেশ জুড়ে গরিব মুসলমানের সবক’টা বস্তিতে বুলডোজার চালানোর প্রতিবাদে এলাহাবাদের রাস্তায় বুদ্ধিজীবীদের মিছিল বেরিয়েছে, গুলি এবং পুলিশের লাঠির আঘাতে চামড়া ফাটার আওয়াজে আপসে চোখ খুলে যাবে। ওদিকে এসব ন্যাকামো হয় না। ওদের শহরে ফ্যাসিবাদ-বিরোধী মিছিলে যোগ দেওয়ার জন্য অধ্যাপকরা ছাত্রদের সঙ্গে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় খালি করে বাসে চেপে খোলা ময়দান, রাজপথ, গলিঘুঁজিতে জামায়েত হননি নয়ের দশকে, পথে নামেননি বাবরি মসজিদ ধ্বংসের প্রতিবাদে। কোনও শহর উত্তাল হয়ে ওঠেনি তীব্র স্লোগানে, শিল্পীরা ছবি আঁকেনি, নতুন গান, নাটক লিখে সাধারণ মানুষের চেতনায় প্রবেশ করেনি কেউ। ছোটখাটো প্রতিবাদ যে সংঘটিত হয়নি, তা নয়, তবে তার সামাজিক অভিঘাত বাংলায় যেমন তীব্র আকার ধারণ করেছিল, তেমনটা আর কোথাও নয়। সোমনাথ হোড় থেকে চিত্তপ্রসাদ, জয়নুল আবেদিন প্রমুখ শিল্পীদের কাজ এক্ষেত্রে কতখানি সাহায্য করেছে, তা সত্যিই কীভাবে পরিমাপযোগ্য— জানা নেই, তবে সফদর হাশমিকে কংগ্রেসের গুন্ডারা খুন করার পর বাংলা জুড়ে নাট্যকর্মীরা রাস্তায় নেমে পড়ে দেখিয়েছিলেন, জনমত তৈরিতে শিল্পকে বাঙালি কতখানি শক্তিশালী হাতিয়ারে রূপান্তরিত করতে পারে।
হিন্দু সন্ত্রাসবাদীরা এটা জানে, আর সেই কথাটাই বারবার বলতে চাইছি। ওরা লড়াইটাকে মাথার ভেতর থেকে রাস্তায় নামিয়ে আনতে চাইছে, কলম-তুলির বদলে হাতে গুঁজে দিতে চাইছে বোমা-বন্দুক, অধিকারের আন্দোলনে শামিল হওয়ার বদলে ছোট দলে ভাগ হয়ে ধর্ষক, খুনি, মনু মানেসরদের জোট তৈরি করতে চাইছে। এদের ঝট করে লেলিয়ে দেওয়া যায় প্রতিবাদ মিছিল ভাঙতে, যেমন নাৎসি জার্মানিতে বা কিছুকাল আগে জেলেনস্কির ভাড়াটে ফ্যাসিস্টরা বুড়ো-বুড়ি থেকে শিশুদের খুন করেছে, জ্বালিয়ে দিয়েছে ট্রেড ইউনিয়নের মূল ভবনটি— আবার কাজ ফুরোলে নিকেশ করে দেওয়া সহজ কারণ এদের ‘সংঘবদ্ধ’ অস্তিত্বের ঠেকনা-স্বরূপ কৃষি সমবায়, শিক্ষক সমিতি বা কারখানার মজদুর সংগঠনের রাজনৈতিক জোট তৈরির ইতিহাস নেই। মদের ঠেক থেকে এদের উৎপত্তি, এবং মদের ঠেকেই ফিনিশ হয়ে যাওয়াদের দায় সরকারকে, বা রাষ্ট্রের যে অংশটি এদের ব্যবহার করে চলে— তাদের নিতে হয় না। ফলে, লড়াইটা রাস্তায় দানা বাঁধলে, এবং সমস্ত সমস্যা এবং প্রশ্নের মীমাংসা রাস্তাতেই হয়ে গেলে সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের বড়কর্তাদের বেজায় সুবিধে। যারা বলছে, পাশের রাজ্য থেকে ছেলে এনে ঢুকিয়ে দেব, তারা জানে, বহিরাগতরা সামান্য পারিতোষিক লয়ে ঘরে ফিরবে, নেহাত না পোষালে খানিক চিল্লামিল্লি করবে এবং ‘দিচ্ছি-দেব করবেন না, পিছনদিকে এগিয়ে যান’ বলে পাশ কাটানোও অসম্ভব নয়। ঘরের ছেলে লয়ে এর-তার ঘরে ঢোকালে, এবং তদপরবর্তী পর্বে ক্ষমতা দখল করলে একটানা ক্লাবগুলোকে ‘পোতিমা’ নিরঞ্জন থেকে সেক্কেটারির মানভঞ্জন অবধি মদের টাকা জোগাতে হবে— এবং একাটানা যে জুগিয়েই চলতে হয়, সে তো আমরা দেখছিই! গুজরাতি বেনিয়ারা অতখানি বেহিসেবি কখনওই নয়। তারা ‘কাজ তামাম, হিসাব বরাবর’ দর্শনে বিশ্বাসী।
কিছু গোলমাল আছেই। সেটা যার ক্ষেত্রসমীক্ষার গলদ থেকেই গোড়ার হিসেবনিকেশে জট পাকিয়ে থাকুক না কেন, বেশ বড় ধরনের সমস্যা তার ফলে তৈরি হয়েছে। বাঙালি কেবল কাঁধে ঝোলা ব্যাগ লয়ে, তুলি-কলম বাগিয়ে কাব্যচর্চা করে ফেরে, এই বিশ্বাসে ভর দিয়ে যারা পালাবদলের স্বপ্ন দেখছে, তারা হয়তো ভুলে গিয়েছে যে, বাঙালি শুধু ভাল বোমা বাঁধে তাই নয়, লক্ষে অবিচল বলে টিপও ভাল, মারেও খারাপ না। টিকি নেড়ে হলুদ ধুতি জড়িয়ে ঠেঙাতে এলে আস্ত ফিরে যাবেই— এমন সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। তবে সেটাও এই জমানায় প্রশ্ন হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ নয়। যারা একসময় খাদ্য আন্দোলন, শিক্ষকদের অধিকার আদায়, সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, শ্রমিকের হক প্রতিষ্ঠা থেকে জমির সমবন্টন অবধি লড়াইয়ের রাস্তা দখল করেছে, সেই বাঙালি টিকিতে ফুল-বাঁধা অশিক্ষিত ভেজিটেরিয়ানদের হাতে ওই একই রাজপথগুলো ছেড়ে দিল কী বলে? ভাবছেন পেরোকিয়াল, রেসিস্ট, এবং ধর্মীয় মৌলবাদীদের সুরেই প্রশ্নটা তুললাম, তাই তো? একেবারে না, কারণ সমস্যাটি বিহার থেকে আগত মানুষদের নিয়ে নয়। এই বাংলায় কমিউনিস্ট শাসনের ভিত্তি তৈরি করা থেকে তার প্রতিষ্ঠা অবধি অবাঙালি শ্রমিক-মজুরদের অবদান অস্বীকার করে— এমন সাহস কারও নেই। মুশকিল হল, তাদের গায়ে বহিরাগত তকমা সেঁটে নতুন পরিচয় আরোপের যে খেলাটি চলছে, সেটি একাধারে হিন্দু সন্ত্রাসবাদকে বাঁচিয়ে রাখার অর্থ জোগানোর লাইফলাইনও বটে। অবাঙালি কমিউনিটিকে নানা ভয়ে সন্ত্রস্ত করেই টাকা তোলা হয় হিন্দু জাগরণের নামে, নয়তো বড়বাজারের মুটে, শেয়ালদা হাওড়ার কুলি, টানারিকশাওলা, কয়লা-খাদানের মরণাপন্ন টিবি রুগি মজুর, জাকারিয়া স্ট্রিট, চিৎপুরের ঠেলাওয়ালা, বা ভাতের হোটেল থেকে চায়ের দোকানে একবেলা কোনওক্রমে একথালা ভাত জোটানো হাজার হাজার শিশু-শ্রমিকদের নিয়ে এদের ভাবার সময় আছে মনে করেন? এদের থেকে জোর করে পয়সা আদায় করা হয়, আর তাই দিয়ে চলে হনুমান-জাম্বুবানদের মন্দিরে ঘণ্টা নাড়ানো এবং সাধু-সেবায়েতদের ফুলে-ফেঁপে ওঠার কারবার।

এই নিরন্ন জনতাকে তৈরি রাখতে হিন্দু সন্ত্রাসবাদীরা মরিয়া, কারণ, বাংলায় ‘দলিত মার্সিনারি’ তৈরির কাজটি রাজনৈতিক কারণে বন্ধ হয়েছে স্বাধীনতার পরই। এখানে হিন্দুত্বের নামে খাপ খোলা যায়নি, ল্যাজ গুটিয়ে পালাতে হয়েছে। তা সে নবজাগরণই হোক, বা তার ফলে সৃষ্ট রাজনৈতিক ভাবনার ক্ষেত্রটি ক্রমশ সমাজের খুব বড় একটা অংশকে বেশ কিছু কুপ্রথা বর্জন করতে সাহায্য করেছিল বলেই হয়তো, জাতিভিত্তিক বিভাজনের রাজনীতি এখানে কিছু অঞ্চল বাদ দিলে, তেমন বড় মাপের সমস্যা নয়— হিন্দু সন্ত্রাসবাদীরা সেটিকে কাজে লাগিয়ে ততটা ফায়দা তুলতে পারে না তো বটেই। বাংলায় হিন্দুত্বের জয়গান গাইবে, অথচ বিবেকানন্দর ‘মুচি-মেথর আমার ভাই’ বলবে না, এমনটা অন্যত্র সম্ভব, এখানে নয়। হিন্দু ভদ্রলোক-অধ্যুষিত পাড়াতেও, ‘রবীন্দ্র সন্ধ্যা’-য় ‘কিশোর সংঘ’ ‘মেরে সপনোঁ কি রানি’ বাজালে ‘তরুণ দল’ ‘নজরুল নাইট’-এ বিদ্রোহী কবির ‘রানার ছুটেছে তাই ঝুমঝুম ঘণ্টা বাজছে রাতে’ বাজিয়েছে— এ আমার স্বকর্ণে শোনা। যেখানে অস্তিত্ব নির্মাণের আইকনগুলো সবসময় এমন জট পাকানো এবং নিজেরাই নিজেদের পাল্টে ফেলে, সেখানে কেবল হনুমান দিয়ে কাজ হবে না— সেটা বলাই বাহুল্য।
বাংলায় বাম আমলের ৩৪ বছরে কমিউনিস্ট সরকার জাতীয়তাবাদী প্রোজেক্ট ঘাড়ে তুলে নেচে বেড়ায়নি কেন, ইত্যাদি অভিযোগ তুলেছে গোটা দক্ষিণপন্থী ব্রিগেড। তেমনটা হলে নাকি চিন, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ইত্যাদি শত্রু-রাষ্ট্রগুলো ‘একদম ঠান্ডা’ হয়ে যেত। প্রশ্ন হচ্ছে, ভারতীয় রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা বাদ দিয়ে অন্য কোনও বুনিয়াদি প্রশ্নের ওপর কি জাতীয়তাবাদের সুরম্য প্রাসাদটি গড়ে তোলা যেত? এদেশে কখনওই বলা হবে না, চিনের ক্রীড়ানীতিটি এমন যে, তারা মার্কিন এবং রুশদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অলিম্পিকে পদক জয় করে, অতএব এসো আমরাও তেমন দেশ গড়ি। জাপানের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কথা হবে না। বুরকিনা ফাসো, মালি, কোতদিভোয়া ইত্যাদি রাষ্ট্রগুলি যেমন সিআইএ-র হাতে খুন হওয়া প্রেসিডেন্ট সাংকারার মতাদর্শ মোতাবেক নিজেদের মধ্যে আন্তর্জাতিক সীমা প্রায় সম্পূর্ণ ঘুচিয়ে কৃষি এবং শিক্ষায় বিনিয়োগ করছে, তেমন নজির তুলে ধরাও একটানা মন্দির বানিয়ে চলা সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়— সেই দর্শনের ভিত্তিতে জাতীয়তাবাদের খসড়া তৈরির কথা বাদই দিলাম।
বাংলায় হিন্দুত্বের জয়গান গাইবে, অথচ বিবেকানন্দর ‘মুচি-মেথর আমার ভাই’ বলবে না, এমনটা অন্যত্র সম্ভব, এখানে নয়। হিন্দু ভদ্রলোক-অধ্যুষিত পাড়াতেও, ‘রবীন্দ্র সন্ধ্যা’-য় ‘কিশোর সংঘ’ ‘মেরে সপনোঁ কি রানি’ বাজালে ‘তরুণ দল’ ‘নজরুল নাইট’-এ বিদ্রোহী কবির ‘রানার ছুটেছে তাই ঝুমঝুম ঘণ্টা বাজছে রাতে’ বাজিয়েছে— এ আমার স্বকর্ণে শোনা। যেখানে অস্তিত্ব নির্মাণের আইকনগুলো সবসময় এমন জট পাকানো এবং নিজেরাই নিজেদের পাল্টে ফেলে, সেখানে কেবল হনুমান দিয়ে কাজ হবে না— সেটা বলাই বাহুল্য।
বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে গত দশ বছরে কয়েক লক্ষ সরকারি স্কুল তুলে দেওয়া হয়েছে। অপারেশন সিঁদুর ছাড়া আর কোনও জাতীয় প্রোজেক্টের কথা মনে পড়ছে কি, যা গত দশ বছরে স্কুল তুলে দেওয়ার পাশাপাশি দেশবাসীকে ‘নেড়ে দিয়েছে?’ বাকিটা মন্দির, আইপিএল, আম্বানির ছেলের বিয়ে।
মিছিলের মাধ্যমে শহরের একরকম পরিচয় তৈরি হয়। অভয়াকে খুনের পর বিচার চেয়ে দেশের বিভিন্ন শহরে তেমন মিছিল হয়েছে, দিল্লি উত্তাল হয়ে উঠেছিল। ছাত্র আন্দোলনের শহরে ‘হোক কলরব’ নামক রাজনৈতিক পরিচয়-বিবর্জিত মিছিলে দেখেছিলাম তাদের জমায়েত, যারা কোনও পরিচয় তৈরি করার তাগিদ বোধ করেনি— মিছিলের বা নিজেদের কারও নয়। গিটার হাতে করে যে গেছে জমায়েতে যোগ দিতে, সে-ই ফিরে এসেছে বাড়িতে, তারপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অথবা ইউরোপে পাড়ি জমাতে অসুবিধে হয়নি, ঠিক যেমন কমিউনিস্ট পার্টির মেম্বারশিপ ত্যাগ করে আমাদের সময়ে বিশুদ্ধ পবিত্র বামেরা একসময় বিদেশে পাড়ি জমাত। এদের মিছিলে দেখি এখনও, সে মিছিল কোনও বড় বদলের ডাক দেয় না। দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির যৌনকর্মীরা আমূল পালাবদলের ডাক দিতে পেরেছিল, কারণ তাদের না ছিল বামনাইয়ের পিছুটান, না ছিল ‘কমিউনিস্ট পার্টি অফ দ্য ব্রাহ্মিন্স’-এর পশ্চাৎপদ রক্ষণশীলতার দায়।
মার না খেলে সংবিত ফেরে না। তবে পৈতে বর্জনের তরে হুইস্কি আর বিধবা ছাড়াও বাড়তি কয়েকটি উপাদানের প্রয়োজন সম্বন্ধে গুরুদেবগণ সম্যক কয়ে গিয়েছেন, সে-বিষয়ে অন্যত্র আলোচনা হবে।
বেঙ্গালুরুর কাছে দিনকয়েক আগে সাতজন রেপিস্ট জামিন পেয়ে হুডখোলা গাড়িতে রোড শো করল। যেভাবে রক্তমাখা তরোয়াল নাচিয়ে রামভক্তরা দলিত হত্যার পর বিজয় মিছিল করে উত্তরপ্রদেশে, এখানেও সেভাবেই এক আদিবাসী মহিলাকে এক ‘বিধর্মী’ পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক থাকার ‘অপরাধে’ মোট উনিশজন গণধর্ষণ করে। পুলিশ গোড়ায় ধর্ষণের মামলা দায়ের না করে গোটা ব্যপারটাই চেপে যাচ্ছিল, তবে সেটি গুরুত্বপূর্ণ নয়। ধর্ষকদের অনেকেই মুসলমান, এবং ‘ওই তো ওরাও করে’ ইত্যাদি মন্তব্যে সোশাল মিডিয়া ইদানীং সরগরম। ফের হিন্দু-মুসলমানে ভাগ হয়ে গেল ঘটনাটি। কাদের বেশি দোষ, কোন সম্প্রদায়ের ধর্ষক বেশি ছিল… ইত্যদি প্রশ্নে ঘুরে যাবে কেস। পুলিশ রোড শো করতে দিল কেন, কেন বিচার-ব্যবস্থা এদেশে মহিলাদের উলঙ্গ করে রাস্তায় ধর্মোন্মাদদের মিছিলে শাস্তি-স্বরূপ হাঁটানো থেকে চোখ ফিরিয়ে থাকে— সে নিয়ে প্রশ্ন করে না কেউ।
এই শহরে ওই মিছিল করা যাবে না। নাসিকে হবে, মুম্বইয়ে হবে, পাটনায় হয়েছে, পুণেতে এক স্কুলছাত্রী দুর্গাবাহিনীর প্রশিক্ষণে এয়ারগান চালাতে অস্বীকার করায় তাকে দিনের বেলায় ল্যাংটো করে শহরে ঘোরানো হয়েছে, বিহারেই আর-এক দলিত মহিলা নতুন শাড়ি পড়ায় তাকে উঁচু জাতের পুরুষদের মিছিলের সামনে পালা করে একাধিক পুরুষকে কাঁধে বয়ে উলঙ্গ অবস্থায় হাঁটতে হয়েছে… তালিকাটি দীর্ঘ। এখানে হবে না। এখানে অমন মিছিল করা যাবে না। প্রশ্ন হচ্ছে, কদ্দিন যাবে না? মিলিটারি দিয়ে যদি অমন মিছিল করায় রাষ্ট্র, তাহলে ঠেকানো যাবে? ইজ়রায়েলে তো গাজ়া থেকে তুলে আনা মেয়েদের ল্যাংটো করে রাস্তায় প্যারেড করিয়েছে নেতানিয়াহুর সেনারা। এখানে কীসের জোরে ঠেকাব, কদ্দিন ঠেকাব— সেটা এখনই ঝট করে ভেবে ফেলতে হবে। নয়তো যে জাতি একটানা যুদ্ধবিরোধী মিছিলে হেঁটেছে, তাদের পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চেয়ে মিছিলগুলো ‘পাকিস্তানিদের’ বিরুদ্ধে যুদ্ধ চাওয়ার মিছিলে বদলে যাবে। আর কে না জানে, ওই পাকিস্তানিরা সবসময়ই গগন, বিপিন, শশী পাথুরেঘাটার…