চোখ-কাল খোলা: পর্ব ৫

Representative Image

ভূত-ই ভবিষ্যৎ?

ভারতের সংসদে ছিলেন জওহরলাল নেহরু। না, ইতিহাসের কথা নয়, এই এক সপ্তাহ আগের সেন্ট্রাল ভিস্তায়, বর্ষাকালীন অধিবেশনের কথা বলা হচ্ছে।

শুনে অনেকেই ব্যোমকে যাবেন। অনেকেই ভাববেন, বাতুলতা অথবা নেশাগ্রস্ত প্রলাপ। কিন্তু এ হল গিয়ে, ‘সোনার কেল্লা’-য় উটের পিঠে ওঠা জটায়ুর সংলাপ-মাফিক, ‘ঘোর বাস্তব’।

সংসদের অধিবেশনে কথা হচ্ছিল পহেলগাঁও হামলার সন্ত্রাসীদের কীভাবে শায়েস্তা করেছে কেন্দ্রীয় সরকার, তাই নিয়ে। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিরোধী পক্ষ, মূলত কথা বললেন জওহরলাল নেহরুকে নিয়ে। অধিবেশন জুড়েই অবিশ্যি এই নেহরু-চর্চা চলেছে। বিজেপি সাংসদ তেজস্বী সূর্য এই নেহরুর গুষ্টির তুষ্টি করেন তো এই কংগ্রেস সাংসদ সুপ্রিয়া সুলে তাঁকে উচিত জবাব দেন। লোকসভা থেকে রাজ্যসভা, কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে নেহরুর নাম। প্রসঙ্গক্রমে তাঁর পরিবারের বাকিদের নামও চলে আসছে। শেষে তিতিবিরক্ত প্রিয়াঙ্কা গান্ধী বলতে বাধ্য হলেন, আপনারা ইতিহাস নিয়েকথা বলছেন বলুন, আমি বরং বর্তমান নিয়েই কথা বলে যাই।

পেপারব্যাক-ই কি বই ব্যবসার ভবিষ্যৎ? পড়ুন: চোখ-কান খোলা পর্ব ৪…

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ফিরে আসবেন, এমনটা অনেকেই দীর্ঘদিন বিশ্বাস করতেন। বালক ব্রহ্মচারী তো দেওয়াল ভরিয়ে রেখেইছে দশকের পর দশক। এখন এত বয়সে নেতাজি ফিরে আর দেশের ভার নেবেন কি না, তাই নিয়ে সংশয়ে হয়তো ওইসব দেওয়াললিখন অধুনায় একটু ফিকে হয়েছে। কিন্তু এ-কথা কি কেউ অস্বীকার করতে পারবেন যে, বিগত প্রায় আট দশক ধরে স্বাধীন ভারতের গণস্বপ্ন, গণআকাঙ্ক্ষার সুদীর্ঘ উপন্যাসের অন্যতম নায়ক ছিলেন নেতাজি? নেতাজির অন্তর্ধান, মৃত্যুরহস্য সবকিছুই তাঁকে এমন এক ধোঁয়াশা-ঘেরা মিথে পরিণত করে রেখেছে আজও, দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস কোথাও না কোথাও জনমানসে সমান্তরালভাবে লিখিত হয়ে চলেছে, যেখানে সুভাষ বসু ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন; অথবা আর কিছু না হোক, স্বাধীন দেশে তিনি থাকলে কেমন হত, সেই কল্পনার জাল যে কতভাবে বোনা হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই।

জওহরলাল নেহরু

জওহরলাল নেহরু তেমন রংচঙে গ্রাফিক চরিত্র নন, তিনি স্বাধীন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। স্কুলের সিলেবাস, বইপত্র সব বদলে দিলেও, সেই কিন্ডারগার্টেন থেকে ইউপিএসসি-র প্রশ্নপত্র পর্যন্ত কোথাও, এই তথ্যের তো অদলবদল করা যাবে না। কিন্তু ঘটনা হচ্ছে, পণ্ডিত নেহরু এমন সময়েই প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, যখন প্রধানমন্ত্রী সমালোচনা থেকে সাংবাদিক সম্মেলন, সবকিছুর ঊর্ধ্বে কোনও প্রচার-নির্মিত, ধরাছোঁয়ার বাইরের ইমেজ নিয়ে চলাফেরা করতেন না। শোনা যায়, একবার নাকি নেহরুকে কোনও এক সম্মেলনে এক কিশোর আঙুল তুলে প্রশ্ন করেন, এই দেশে নাকি গণতন্ত্র আছে! আপনি কি এমনই গণতন্ত্র আমাদের উপহার দিতে চেয়েছিলেন? নেহরু ছেলেটির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে উত্তর দেন, এমন গণতন্ত্র আমি অবশ্যই উপহার দিতে চেয়েছিলাম, যেখানে এক কিশোর প্রধানমন্ত্রীর দিকে সরাসরি আঙুল তুলে প্রশ্ন করতে পারে।

জওহরলাল নেহরুর এই সহিষ্ণুতা আলাদা করে পূজ্য নয়, বরং সত্যিকারের গণতন্ত্রে এটাই স্বাভাবিক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দিন গেছে, সময় গেছে, রাজনীতির খোলনলচে গেছে বদলে। এখন রাজনীতি মূলত চলে পোস্ট ট্রুথ, বা উত্তর-সত্যর ওপর। কাজেই দিনের শেষে কথা বলে আখ্যান, ন্যারেটিভ। এখানেই নেহরু ফাঁদে পড়ে গিয়েছেন। তাঁকে বারবার ফিরে আসতে হচ্ছে সংসদে। ভারতীয় অর্থনীতির কী হাল, জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে কোথায় কী সংকট দেখা দিল, দেশে গণতন্ত্র, সার্বভৌমত্ব আদৌ রক্ষিত হচ্ছে কি না, এইসব নিয়েই অন্তত দু’দশক আগে পর্যন্ত আলোচনা হত। কথায় কথায় লব্জ হয়ে উঠত ‘রাজ্যের প্রতি কেন্দ্রের বঞ্চনা’ নিয়ে, ‘যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো’ ইত্যাদি প্রভৃতি।

নতুন ভারতের নতুন সরকার কিন্তু বদলে দিল পরিস্থিতি। যা হত, তা হত। নয়া ভারত আর চলতি পরিস্থিতি নিয়ে আগের মতো করে কথা বলবে না। বরং তা গোড়ায় গলদ খুঁজবে। তা কথা বলবে ইতিহাসের ভুলভ্রান্তি নিয়ে। ইতিহাসই নিয়ন্ত্রণ করবে বর্তমানকে। নতুন রাজনীতি হয়তো এইভাবেই ঠিক করবে, জনমন কী ভাববে। কেবল তাই নয়, গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় ঘটনাও ইতিহাসের সঙ্গে জুড়ে থাকবে।

২০১৯ সালের ৫ অগাস্ট ভারতের ইতিহাসের নথিতে আরেকটি তারিখ যোগ হয়েছিল। সেইদিন রদ হয়েছিল ৩৭০ ধারা, যা জম্মু-কাশ্মীরকে ‘স্পেশাল স্টেটাস’ দিয়ে রেখেছিল স্বাধীনতা ইস্তক। সেই জওহরলাল নেহরু ও স্বাধীনতার ইতিহাসের গোড়ায় ফিরে গিয়ে তাকে সংশোধনের প্রচেষ্টা, ইতিহাসকে নতুনভাবে লেখার অক্লান্ত প্রয়াস। আবার, ঘটনাচক্রে আজকের দিনেই, ২০২৪ সালে বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থান শেষে পতন হয়েছিল শেখ হাসিনার সরকারের, দীর্ঘ রক্তপাত ও গণহত্যার ক্ষত পেরিয়ে। তার পরে পরেই কী ঘটেছিল? ভাঙা হয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তি। ইতিহাসকে নতুনভাবে পড়ানোর আরও একটি উদ্যোগ।

নেহরুকে কোনও এক সম্মেলনে এক কিশোর আঙুল তুলে প্রশ্ন করেন, এই দেশে নাকি গণতন্ত্র আছে! আপনি কি এমনই গণতন্ত্র আমাদের উপহার দিতে চেয়েছিলেন? নেহরু ছেলেটির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে উত্তর দেন, এমন গণতন্ত্র আমি অবশ্যই উপহার দিতে চেয়েছিলাম, যেখানে এক কিশোর প্রধানমন্ত্রীর দিকে সরাসরি আঙুল তুলে প্রশ্ন করতে পারে।

নকশাল আমলে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা যেমন ইতিহাসের সঙ্গে সংঘাত, তেমনই, আজও কথায় কথায় সেই মূর্তি ভাঙার প্রকল্প নিয়ে রাজনৈতিক কচকচিও, বর্তমানকে ফেলে ইতিহাসের সঙ্গে বোঝাপড়াই। মূর্তি ভাঙাই শ্রেয় হয়তো, কিন্তু কেবল মূর্তি নির্মাণ আর ভাঙা, এর মধ্যে ভবিষ্যতের কোনও বীজ কোথাও আছে কি? না কি, ইতিহাসের ভূতের বোঝা কাঁধে নিয়েই বাঁচতে হবে ভাবীকালকে? তাই জওহরলাল নেহরু বারবার ফিরে আসছেন সংসদের অধিবেশনে? এত সহজে ভারতের রাজনৈতিক পরিসরে তাঁর আত্মার বোধহয় মুক্তি নেই।