‘অর্ধেক জীবন’

Meena Kumari

বিগত শতাব্দীর তিনের দশকে বোম্বাইয়ের হিন্দি চলচিত্র জগতে প্রবেশ করেছিল চার বছরের মেয়েটি। বম্বে শহরেই তার জন্ম অতি সাধারণ এক পরিবারে। মেয়েটির বাবা মাস্টার আলি বকশ পেশায় হারমোনিয়াম বাদক এবং কবি—এসেছিলেন পাঞ্জাব থেকে। মা প্রভাবতী মিরাট শহরের মেয়ে। গান, অভিনয়ে পটু। চোখে স্বপ্ন নিয়ে তিনিও পা রেখেছিলেন স্বপ্নে মোড়া বোম্বাই শহরে। জনপ্রিয় পার্সি থিয়েটারের মঞ্চে পরিচয় এবং প্রেম আলি বকশের সঙ্গে। খ্রিস্টান ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে হলেন ইকবাল বেগম। আলি বকশ ও ইকবাল বেগমের তিন কন্যা— খুরশিদ, মধু এবং মাঝে মহাজাবিন বানু, সেই চার বছরের মেয়েটি,  যার জন্ম ১৯৩২ সালের পয়লা অগাস্ট। 

আসলে মহাজাবিন বানু হয়তো নিজেও কোনওদিন ভাবেনি, সে হয়ে উঠবে একদিন ঝলমলে রুপোলি পর্দার নায়িকা— মীনাকুমারী, যিনি স্বীকৃতি পাবেন স্বাধীনোত্তর ভারতীয় সিনেমার অন্যতম জনপ্রিয় নায়িকা হিসেবে। প্রায় নব্বইটির কাছাকাছি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন মীনাকুমারী, যার শুরু ১৯৩৯ সালের মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘Leatherface’ দিয়ে। পরিচালক বিজয় ভাট। সিনেমার প্রতি ভালবাসা বা শখ— কোনওটাই নয়,পরিবারের আর্থিক প্রতিকূলতার কারণেই তাঁকে আসতে হয়েছিল সিনেমার জগতে। নিজের মেয়েবেলাকে নিঃশব্দে, নিঃস্বার্থে বিসর্জন দিয়ে কাঁধে তুলে নিতে হয়েছিল সংসারের জোয়াল। চার বছর বয়সে মহাজাবিন নাম হারিয়ে হয়েছিলেন বেবি মিনা। এর পরের আট/নয় বছরে ‘নই রোশনি’,  ‘পূজা’ , ‘গরীব’, ‘প্রতিজ্ঞা’, ‘লাল হাভেলি’ এবং আরও কয়েকটি ছবিতে শিশু অভিনেত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন তিনি।

আট বছরের বেবি মীনা

আরও পড়ুন: আমজাদ খান আজীবন রয়ে গেলেন গব্বর সিংয়ের ছায়াতেই!
লিখছেন রাহুল অরুণোদয় বন্দ্যোপাধ্যায়…

এই সময়ে এক বড় সাফল্য আসে ‘দুনিয়া এক সরাই’ (১৯৪৬) ছবিতে। মিষ্টি গলা— তাই সংগীতের তালিম নেওয়া শুরু। নয় বছর বয়সে সংগীত পরিচালক অনিল বিশ্বাসের সুরে প্রথম গান রেকর্ড করলেন, ১৯৪১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা ‘বহেন’-এর জন্য। এই সিনেমায় তিনি বীণা কুমারীর সঙ্গে ‘তোরা কাজরা লাগুন মোরি রানি’ গানটি গেয়েছিলেন। গানের সিকোয়েন্সে, মীনা কুমারীর অভিনয়-অভিব্যক্তি ছিল অপূর্ব— সঙ্গে স্বকন্ঠে গান। 

‘বচ্চো কা খেল’ মুক্তি পেল ১৯৪৬-এর, দোসরা মে। এবার আর বেবি মীনা নয়— আত্মপ্রকাশ করলেন ‘মীনাকুমারী’— যে নাম এবার একটু একটু করে তৈরি করবে এক ইতিহাস, ভারত উপমহাদেশের চলচ্চিত্র-জগতে। ১৯৪৮ সালে ‘পিয়া ঘর আজা’ ছবিটি মীনাকুমারীর শিল্পী জীবনের আর-এক মাইলফলক— ছবির অধিকাংশ গান গাইলেন তিনি। 

বাড়ির আর্থিক অনটনের কারণে কোনও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেননি মীনা। কিন্তু একটা সময় এল, যখন খ্যাতি, যশ, অর্থ— এসবের সঙ্গে আসতে শুরু করেছে এক নতুন সামাজিক পরিচয়। বুঝলেন, নিজেকে শিক্ষিত করে তোলা প্রয়োজন। বাড়িতে মাস্টারমশাইয়ের কাছে শুরু হল হিন্দি, উর্দু আর ইংরেজির পাঠ। কলম ধরলেন তিনি। শের, গজল, নজম (nazm) লেখা হতে লাগল খাতার পাতায়। তাঁর মৃত্যুর পরে এইসব লেখা নিয়ে গ্রামোফোন রেকর্ডে একটি সংকলন প্রকাশ পায়— ‘I write, I recite’।   

মায়ের আকস্মিক মৃত্যুর পর মীনার জীবনে আসে খানিক শূন্যতা। তাকে ভরাট করার একটাই রাস্তা, সামনে তখন খোলা ছিল। নিজেকে সঁপে দিলেন সিনেমার কাছে। নানা ধরনের ছবিতে অভিনয় করলেন, যার মধ্যে ছিল হোমি ওয়াদিয়া পরিচালিত বেশ কিছু ধর্মীয় ছবি, যেমন ‘লক্ষ্মীনারায়ণ’, ‘হনুমান পাতাল বিজয়’ বা  ‘গণেশ মহিমা’। সেসব ছবিতেও আশাতীত সাফল্য। হোমির সঙ্গে মীনাকুমারীর শেষ ছবি ‘আলাদীন কা চিরাগ’, যার জন্য পারিশ্রমিক পেলেন দশ হাজার টাকা। ১৯৫০ সালে এই টাকা পেয়ে কিনলেন একটি সেকেন্ড হ্যান্ড Plymouth গাড়ি। 

এবার তিনি বসলেন চালকের আসনে,  নিজের যান ও জীবন— উভয়েরই !  

অশোককুমার–দেবিকারানি জুটি তখন দর্শকদের হৃদয় জয় করেছে। অশোককুমারের ‘তামাশা’ ছবিতে ব্যতিক্রমী একটি চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ এল। কিন্তু তার চেয়েও বড় ঘটনা— এই ছবির সেটে কামাল আমরোহির সঙ্গে মীনার পরিচয়, যাঁর সঙ্গে আমৃত্যু জড়িয়ে যাবে তাঁর জীবন। ছোটবেলায় দেখেছিলেন কামালকে। তাঁর ‘পুকার’ ছবিতে বেবি মীনাকে নিতে চেয়েছিলেন কামাল। কিন্তু সেই সুযোগ শেষ অবধি থেকে গিয়েছিল অধরা। দীর্ঘ দশ বছর পরে সেই সুযোগ এল। কামালের ছবি ‘আনারকলি’-তে তিনিই নায়িকা। এবারে তাঁর সান্নিধ্যে জীবনেরও মোড় ঘুরল। কিন্তু ছবির শুটিং শুরুর আগেই পথ দুর্ঘটনায় আহত হয়ে পুনের হাসপাতালে স্থান হল মীনার। সময়টা ১৯৫১ সালের মে মাস। কামাল নিয়মিত গাড়ি চালিয়ে পুনে যেতেন তাঁর ছবির নায়িকার খবর নিতে। কিন্তু একসময় বুঝলেন, শুধু ছবির নায়িকা নন মীনা— তিনি হয়ে উঠেছেন তাঁর হৃদয়ের ‘মঞ্জু’। অপরদিকে মীনার কাছে তিনি ‘চন্দন’! বৈবাহিক জীবনের শেষ দিন অবধি এই নামেই সম্বোধন করতেন একে-অন্যকে। 

সুস্থ হয়ে ফিরলেন শুটিং ফ্লোরে। ততদিনে বাবার অমতে লুকিয়ে নিকাহ করেছেন কামালকে। শেয়ার বাজারে প্রযোজকের টাকা ডুবে ততদিনে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে ‘আনারকলি’-র ভাগ্য। ৫/৬ রিল শুটিংয়ের পর অবশেষে একদিন বন্ধ হয়ে গেল ‘আনারকলি’।  এতদিন পরে আবার পাশে এসে দাঁড়ালেন পরিচালক বিজয় ভাট— মুক্তি পেল ‘বইজু বাওয়রা’। বম্বে জুড়ে প্রায় ১০০ সপ্তাহ অতিক্রম করল ছবি, তাঁর কাছে এল প্রথম ফিল্মফেয়ার পুরস্কার। এরপর আর পিছন ফিরে তাকাননি  মীনাকুমারী। ‘ফুটপাথ’, ‘পরিণীতা’, ‘এক হি রাস্তা’, ‘সারদা’, ‘কোহিনুর’,  ‘দিল আপনা প্রিত পারায়ি’ এবং অবশেষে গুরু দত্তর ‘সাহেব বিবি অউর গুলাম’ ১৯৬২ সালে। ১৯৬৩ সালের ফিল্মফেয়ার পুরষ্কারের শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিভাগে  যে তিনটি ছবি মনোনীত হয়েছিল, ‘আরতি’, ‘ম্যায় চুপ রহুঙ্গি’ এবং ‘সাহেব বিবি অউর গুলাম’— তাঁর তিনটেরই নায়িকা মীনা, কী অদ্ভুত সমাপতন! ১৯৫৪ সালে ‘পরিণীতা’-র হাত ধরে এসেছিল শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর দ্বিতীয় ফিল্মফেয়ার পুরস্কার। অবশেষে ‘সাহেব বিবি অউর গুলাম’ এনে দিল তাঁকে তৃতীয়বারের জন্য এই খ্যাতি। 

‘পরিণীতা’–র শুটিং চলাকালীন পরিচালক বিমল রায়ের অনুরোধে তাঁর ‘দো বিঘা জমিন’-এ অভিনয় করেন মীনা ‘ঠাকুরানী’-র চরিত্রে। অতিথি শিল্পী হিসেবে এই অভিনয় এবং তাঁর ঠোঁটে লতা মঙ্গেশকরের ‘আ রি আজা নিন্দিয়া তু আ’ গানটি দর্শকের কাছে কিন্তু তেমনভাবে ধরা দেয়নি, তার অন্যতম কারণ হয়তো ‘বইজু বাওরা’, ‘পরিণীতা’ এবং ‘সাহেব বিবি অউর গুলাম’— এই ত্রয়ীর বক্স অফিসের সাফল্য। 

১৯৫৬ সালে রামেশ্বরম বেড়াতে গিয়ে প্রথম পরিকল্পনা হয় ‘পাকিজা’ ছবির। ১৯৬০ সালে চিত্রনাট্য লেখা শেষ হলে শুটিং শুরু হয় এবং চলে পরের চার বছর। কিন্তু ততদিনে চন্দন-মঞ্জু— দুই গ্রহের মানুষ। শুটিং বন্ধ হয়ে যায়। মীনা বাড়ি পরিবর্তন করেন। একাকিত্ব এখন তাঁর নিত্যসঙ্গী। কবিতার পঙক্তি আর সুরার পাত্রে চলে খানিক শান্তির খোঁজ। আগে তৈরি হওয়া ছবি রিলিজ হতে থাকে একের পর এক।

কামালকে জড়িয়ে মীনার জীবন তখন বইছিল এক নতুন খাতে। কিন্তু আলি বকশ মেনে নিতে পারেননি তাঁকে;  কড়া নির্দেশ, কামালকে দিতে হবে তালাক— নইলে এ-বাড়ির দরজা চিরতরে বন্ধ হবে মীনার জন্য। ঘর ছাড়লেন মীনা— এসে উঠলেন কামালের বাড়িতে। পালি হিলের নতুন বাংলো জুড়ে তখন নতুন স্বপ্ন দেখা।

১৯৫৫ থেকে একনাগাড়ে প্রচুর ছবিতে অভিনয়ের ডাক আসে। সঙ্গে বাড়ে খ্যাতি, প্রতিপত্তি। তাঁর সঙ্গে কামালের সঙ্গ— সব মিলিয়ে মীনা তখন সপ্তম স্বর্গে। কিন্তু এত সুন্দর সম্পর্কের মধ্যে ফল্গুধারার মতো বয়ে চলেছিল খানিক অসন্তোষ, যা ক্রমশ ঘনীভূত হয়ে প্রকাশ পায় ‘সাহেব বিবি অউর গুলাম’ তৈরির সময়ে। সময় এগিয়ে চলে, বাড়ে দূরত্ব, বাড়ে অসহিষ্ণুতা। 

‘পাকিজা’ ছবির দৃশ্যে মীনাকুমারী

১৯৫৬ সালে রামেশ্বরম বেড়াতে গিয়ে প্রথম পরিকল্পনা হয় ‘পাকিজা’ ছবির। ১৯৬০ সালে চিত্রনাট্য লেখা শেষ হলে শুটিং শুরু হয় এবং চলে পরের চার বছর। কিন্তু ততদিনে চন্দন-মঞ্জু— দুই গ্রহের মানুষ। শুটিং বন্ধ হয়ে যায়। মীনা বাড়ি পরিবর্তন করেন। একাকিত্ব এখন তাঁর নিত্যসঙ্গী। কবিতার পঙক্তি আর সুরার পাত্রে চলে খানিক শান্তির খোঁজ। আগে তৈরি হওয়া ছবি রিলিজ হতে থাকে একের পর এক। রঙিন পর্দার পিছনে তখন এক ধূসর জীবন। শারীরিক অবস্থার অবনতির কারণে লন্ডনে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। ক্রমশ ভাল হয়ে উঠে দেশে ফিরে আসেন ১৯৬৮-র সেপ্টেম্বর মাসে। 

কামালের কাছ থেকে চিঠি আসে যদি শেষ করা যায় ‘পাকিজা’-র অসমাপ্ত কাজ। পারলেন না ফিরিয়ে দিতে অনুরোধ। ১৯৬৯ সালে হইহই করে শুরু হল শুটিং। না এবার আর সাদা-কালো নয়— রঙিন ছবি তৈরি হবে সিনেমাস্কোপের প্রশস্ত ফরম্যাটে। অশোক কুমারের জায়গায় আসেন রাজকুমার। ‘পাকিজা’ এক অর্থে তাঁদের নিজেদের ছবি। সমস্ত মনোমালিন্য পাশে সরিয়ে মীনাকুমারী আর কামাল আমরোহি শেষ করলেন ছবির কাজ। ৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২ মারাঠা মন্দিরে মুক্তি পেল ‘পাকিজা’। 

ভাগ্যের কী পরিহাস! সিনেমা-জগতের একটা অংশের বিচারে শুরু না হতেই ‘পাকিজা’-র গায়ে পড়ল ফ্লপের স্ট্যাম্প। গত চার বছরে আবার শরীর দুর্বল হতে শুরু করেছিল। সন্তানতুল্য ‘পাকিজা’-র এই আপাত-পরাজয় মেনে নিতে পারলেন না মীনা। বুঝতে পারছিলেন, আস্তে আস্তে ফুরিয়ে আসছে তাঁর প্রাণবায়ু। সেইন্ট এলিজাবেথ নার্সিং হোমে কাটল দুটো দিন সংজ্ঞাহীন অবস্থায়। ৩১ মার্চ, ১৯৭২ চলে গেলেন অভিনেত্রী মীনাকুমারী। 

দীর্ঘ ৫৩ বছর পেরিয়ে আজও রূপোলি পর্দার মীনাকুমারী আমাদের আচ্ছন্ন করে রাখেন। সমাজের নিচুতলা থেকে উঠে এসে জয় করেছিলেন খ্যাতির শিখর। তারপর নিজের মতো করেই একদিন আবার হারিয়ে গেছেন কালের অন্তরালে । 

জাভেদ আখতার বলেছিলেন, ‘People like Meena Kumari are paradoxes. We try to understand them, we appreciate them, we criticise them, we pity them, we laugh at them, we admire them. But they remain paradoxes.’ 

এর থেকে সহজভাবে বোধহয় এই মানুষটিকে আর বোঝা যায় না।