চোখ-কান খোলা : পর্ব ৩

Vidyasagar's Household

নথি ও নেতি

বাড়ি বদলে যায়, সঙ্গে ইতিহাস এবং আগামীও। রমাপদ চৌধুরীর বিখ্যাত উপন্যাস ‘বাড়ি বদলে যায়’-তে মানুষের স্থানান্তর, মননের পরিবর্তন— এমনই নানা মুহূর্তে আঁকা হয়েছিল। এই বদলের জন্য কত কিছু হারায়, কত কিছু নতুন করে পাওয়া যায়। হয়তো হারানোর তালিকাই বেশি।

সম্প্রতি বিভিন্ন সারবন্দি বস্তা থেকে মিলেছে, কলকাতা পুরসভার সচিবকে লেখা বিদ্যাসাগরের চিঠি! ভাবুন একবার, বিদ্যাসাগরের স্বহস্ত-লিখিত চিঠি বছরের-পর-বছর বস্তাবন্দি অবস্থায় ছিল, কেউ জানেনও না তার কথা। সম্প্রতি সংবাদপত্র থেকে জানা যাচ্ছে, পুরসভার হগ বিল্ডিংয়ের করিডোরে হাঁটতে গিয়ে জনৈক আধিকারিক জঞ্জালের জায়গা থেকে উদ্ধার করেন এই চিঠি।

১৮৮১ সালে পুরসভার তৎকালীন সচিব জর্জ টারবুনালকে লেখা এই চিঠিতে বিদ্যাসাগর তৎকালীন বাদুড়বাগান স্ট্রিটে একটি একতলা বাড়ি করতে চেয়ে আবেদন করেছিলেন। একই সঙ্গে মিলেছে পুরসভার তরফে বিদ্যাসাগরকে লেখা চিঠিও। সেখানে বিদ্যাসাগরকে জানানো হচ্ছে, তিনি যথাবিধি মেনে বাড়ি তৈরি করতে পারবেন, রাস্তার দিকের কোনও অংশে যেন বাড়ির জমি না বিস্তৃত হয়, একই সঙ্গে দরজা-জানলা খোলার সময়েও যেন অসুবিধে না হয় পথচারীদের এই শর্তে।

বিদ্যাসাগরের সেই চিঠি…

বাঙালিই কি বাঙালির শত্রু? নতুন চাপানউতোর তুলে দিচ্ছে প্রশ্ন! পড়ুন চোখ-কান খোলা পর্ব ২…

এ-চিঠির ঐতিহাসিক গুরুত্ব প্রশ্নাতীত। যেখানে একই সঙ্গে বিদ্যাসাগরের বয়ান ও সই আবার তৎকালীন পুরসভার কর্মকর্তাদের সই রয়েছে— তা তো একটা সময়েরই জীবন্ত দলিল।

মজার ব্যাপার হল, যেখানে এই বস্তা থেকেই মিলেছে বিদ্যাসাগরকে পুরসভা-প্রেরিত চিঠিও, সেটা তো পুরসভায় থাকার কথা নয়! তাহলে কি কখনও পুরসভাকে চিঠিগুলি দেওয়া হয়েছিল সংরক্ষণের জন্য? কিন্তু আমাদের সংরক্ষণ-বিমুখ সত্তা এই গুরুত্বপূর্ণ দলিলকে ঠাঁই দিয়েছে বস্তাবন্দি জঞ্জালের জায়গায়? উত্তর অজানা।

বিদ্যাসাগরের বাদুড়বাগান-স্থিত বাড়ি…

আশার কথা, দায়িত্বশীল সহনাগরিকের নজরে  আসায় এগুলি ‘ডিজিটাইজ’ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে প্রশ্ন উঠবে, এ তো গোচরে এল বলে সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নেওয়া হল। কিন্ত যা আমাদের গোচরে আসে না? এমনকী, গোচরে আসলেও যেসব নথি সম্পর্কে উদাসীন থাকি আমরা, সেগুলির কী হবে? এমনই একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, সাহিত্য পরিষৎ-এ সংরক্ষিত বিদ্যাসাগরের বইগুলি সম্পর্কে।  আমরা ধরে নিতে পারি, সেগুলির বয়স খুব স্বাভাবিকভাবেই ১৫০ থেকে ২০০ অতিক্রম করেছে। সেগুলি কি আদৌ ডিজিটাইজ করা হয়েছে? আর কয়েক বছর পর তো সেগুলি ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে ডিজিটাইজ না করা হলে।

১৮৮১ সালে পুরসভার তৎকালীন সচিব জর্জ টারবুনালকে লেখা এই চিঠিতে বিদ্যাসাগর তৎকালীন বাদুড়বাগান স্ট্রিটে একটি একতলা বাড়ি করতে চেয়ে আবেদন করেছিলেন। একই সঙ্গে মিলেছে পুরসভার তরফে বিদ্যাসাগরকে লেখা চিঠিও। সেখানে বিদ্যাসাগরকে জানানো হচ্ছে, তিনি যথাবিধি মেনে বাড়ি তৈরি করতে পারবেন, রাস্তার দিকের কোনও অংশে যেন বাড়ির জমি না বিস্তৃত হয়, একই সঙ্গে দরজা-জানলা খোলার সময়েও যেন অসুবিধে না হয় পথচারীদের
এই শর্তে।

বছর কয়েক আগে এক লিটল ম্যাগাজিন নজরে এনেছিল এই বইগুলির কথা। সেখানে দেখানো হয়, ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ গ্রন্থটিতে কীভাবে বইয়ের মধ্যেই পেনসিল দিয়ে নোট নিয়ে পড়েছিলেন বিদ্যাসাগর। রয়েছে তাঁর বিভিন্ন মন্তব্যও। এ তো গেল একটি বইয়ের কথা। আরও কত বইতে হয়তো এমন সম্পদ লুকিয়ে রয়েছে। সেগুলি কি আড়ালেই থেকে যাবে?

প্রসঙ্গত, বিদ্যাসাগরের বাড়ি বলতে বহুল-পরিচিত বাদুড়বাগানের বাড়িটিই; কিন্তু  ‘কলিকাতা দর্পণ’-খ্যাত রাধারমন মিত্র দেখাচ্ছেন, তৎকালীন দয়েহাটা স্ট্রিটের ১৩ নম্বর বাড়ি, যার বর্তমান ঠিকানা দিগম্বর জৈন টেম্পল রোডের ১৩ A, B, ও C-সংখ্যক বাড়ি, তার পরিচিতি অনেকেই জানেন না। কিন্তু এই বাড়িটির গুরুত্ব মারাত্মক! বিদ্যাসাগর কলকাতা এসে, সংস্কৃত কলেজে পড়ার সময়ে এই বাড়ির-ই একতলায় বাবা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে থাকতেন। কোথায় হারিয়ে গেল এসব বাড়ি, তার দলিল-নথিপত্র? হয়তো রয়েছে কোথাও কোনও জঞ্জালের মধ্যে বস্তাবন্দি হয়ে, কিংবা হারিয়ে গেছে চিরতরে কালের গর্ভে।

অবশ্য অদ্ভুত সমস্ত জায়গা থেকে ঐতিহাসিক নথিপত্র, দলিল, সাহিত্যিক নিদর্শন পাওয়ার ইতিহাস তো বহুদিনের। সেই যে বাঁকুড়া জেলার কাঁকিল্যা গ্রাম থেকে বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ জনৈক দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ির গোয়াল-ঘরের চাল থেকে খুঁজে পেয়েছিলেন চন্ডীদাস-কৃত ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের পুঁথি। তবে সে-সময়টা তো ১৯০৯ আর এখন ২০২৫! ১১৬ বছরের ব্যবধানে কত আধুনিক প্রযুক্তি এল, মানুষ নাকি উন্নত হল। কিন্তু তাঁর সংরক্ষণ প্রবণতায় কি কিছু বদল এল? প্রশ্ন থেকে যায়।

এই ক’দিন আগেও খিদিরপুর-স্থিত মাইকেল মধুসূদন দত্তর পৈতৃক ভিটে নিশ্চিহ্ন হওয়ার মুখে পড়ে। বাড়িটির ঠিকানা, ২০বি কার্ল মার্ক্স সরণী। খিদিরপুর ব্রিজ থেকে নেম, ফ্যান্সি মার্কেটের পাশে। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, মাইকেল তাঁর যৌবনের দীর্ঘ সময় এখানেই কাটিয়েছিলেন। বাড়িটি বানিয়েছিলেন মাইকেলের বাবা রাজনারায়ণ দত্ত। তবে তার কোনও পাথুরে নথি না থাকায় বাড়ির মালিকানা নিয়ে মামলা হয়। বর্তমানে কিছুই প্রায় অবশিষ্ট নেই বাড়িটির গঠনে। অতএব থাকা-না-থাকা সমান।  যা ধ্বংস হওয়ার হয়েই গেছে। অনেকবার বাড়িটির সামনে স্মারক, মূর্তি বসানোর পরিকল্পনা নেওয়া হলেও তা ভেস্তে যায়। ভবিষ্যতে হয়তো এমন কোনওদিন এর নথি পাওয়া যাবে, যখন বাড়িটিই আর থাকবে না। দাম্ভিক আস্ফালন নিয়ে ইতিহাসকে আড়াল করবে বহুতল!

দায় কার?