বইয়ের আত্মীয়তা
২৬ জানুয়ারি, ১ মে এবং ১৫ অগাস্ট— এই তিনদিন তো বটেই, অন্যান্য দিনেও যে পুরনো বইয়ের বাজার বসে কলেজ স্ট্রিটে, সেখানে গেলে দেখা যাবে আজকাল, ঘুরেফিরে সেই ফেলুদা-ঘনাদা-কাকাবাবুর বই। সঙ্গে বিশেষ কিছু রচনাবলি। নির্দিষ্ট কিছু বইয়ের বাইরে অন্যান্য বই প্রায় দুর্লভ। তবে এর কারণ সহজেই অনুমান করা সম্ভব। যেসব বই বিক্রি হতে দেখা যায় এখন সেখানে, বেশির ভাগেরই গায়ে সাঁটা ‘র.ঠ ০৫৬৭’ কিংবা ‘স ৩২৫’— এরকম কোনও নম্বর। বোঝাই যায়, এইসব বই লাইব্রেরির। অনাথ হয়ে উঠে এসেছে ফুটপাথে।
ছোট-বড় লাইব্রেরি শহর-মফস্সলে উঠে যাচ্ছে, এ-খবর পুরনো। লাইব্রেরি বলছে পাঠক নেই, পাঠক বলছে লাইব্রেরি নেই। কোনটা সত্য? দুটোই নয় কি? ধরা যাক, আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে কোনও অঞ্চলে তৈরি হয়েছিল এক পাঠাগার। নিয়মিত বইপড়ার চর্চা ছিল সে-অঞ্চলে। আজ এতদিন পর যদি সে-অঞ্চলে বই পড়ার চল নষ্ট হয়, স্বাভাবিকভাবেই সেই পাঠাগারে কারওর প্রবেশ ঘটবে না। এভাবে অচল হতে-হতে একদিন তা উঠে যাবে। অন্যদিকে উলটোভাবে দেখলে, যে-তরুণ পাঠক বই পড়তে আগ্রহী কিংবা গবেষণা নিয়ে হয়রান, সে লাইব্রেরি গিয়ে কী দেখে? হয় লাইব্রেরিয়ান নেই, নয়তো অভীষ্ট বই নষ্ট হয়ে গেছে বা খোয়া গেছে ইত্যাদি। সময়ের ব্যবধান কত যে পরিস্থিতি বদলে দেয়!
আরও পড়ুন: বাংলা বইবাজারে পেপারব্যাক কি হতে পারে মুক্তির আলো? চোখ-কান খোলা পর্ব ৪…
তারপরেও প্রশ্ন থাকে। আত্মীয়তার প্রশ্ন। পাঠকের সঙ্গে লাইব্রেরির আত্মীয়তা ঠিকমতো গড়ে উঠছে তো? লাইব্রেরির কর্তব্য কী হওয়া উচিত, এ-নিয়ে একশো বছর আগে কলম ধরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘লাইব্রেরির মুখ্য কর্ত্তব্য’ (১৩৩৫) নামক নিবন্ধে। তাঁর অভিযোগ ছিল, ‘অধিকাংশ লাইব্রেরিই সংগ্রহবাতিকগ্রস্ত। তার বারো আনা বই প্রায়ই ব্যবহারে লাগে না, ব্যবহারযোগ্য অন্য চার আনা বইকে এই অতিস্ফীত গ্রন্থপুঞ্জ কোণঠেসা করে’ রাখে।… লাইব্রেরিকে সম্পূর্ণ ব্যবহারযোগ্য করে’ তোল্বার চিন্তা ও পরিশ্রম লাইব্রেরিয়ান প্রায় স্বীকার কর্তে চায় না। তার কারণ সঞ্চয়বহুলতার দ্বারাই সাধারণের মনকে অভিভূত করা সহজ।’ বলেছিলেন এও, ‘সাধারণতঃ লাইব্রেরি বলে থাকে, আমার গ্রন্থতালিকা আছে, স্বয়ং দেখে নেও, বেছে নেও। কিন্তু তালিকার মধ্যে আহ্বান নেই, পরিচয় নেই, তার তরফে কোনো আগ্রহ নেই। যে লাইব্রেরির মধ্যে তার নিজের আগ্রহের পরিচয় পাই, যে নিজে এগিয়ে গিয়ে পাঠককে অভ্যর্থনা করে আনে, তাকেই বলি বদান্য— সেই হ’লো বড়ো লাইব্রেরি, আকৃতিতে নয় প্রকৃতিতে। শুধু পাঠক লাইব্রেরিকে তৈরি করে, তা নয়, লাইব্রেরি পাঠককে তৈরি ক’রে তোলে।’
জলপাইগুড়ি জেলার সদর বিডিও অফিস প্রাঙ্গণে রয়েছে সদর ব্লক পঞ্চায়েত সমিতির লাইব্রেরি। দীর্ঘকাল সেখানে ছিলেন না কোনও লাইব্রেরিয়ান। ১১ বছর পর যোগ দেন শবনম মুস্তফি, এবং তৈরি করেন এক আশ্চর্য নজির। পাঠকসংখ্যা বাড়াতে পরিচিতদের ফোন থেকে শুরু করে স্থানীয়দের বাড়িতে-বাড়িতেও ছোটা— সবই করছেন। গত ১০ মাসে এইভাবে শতাধিক পাঠক বাড়াতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, আগামীতে পাঠকদের চাহিদা অনুযায়ী বই জোগান দিয়ে যাতে আরও পাঠকসংখ্যা বাড়ানো যায়।
হ্যাঁ, দায় থাকে লাইব্রেরিরও। হয় পরিচালকমণ্ডলী, নয়তো লাইব্রেরিয়ান— এই দায়ভার বহন করতে হয় তাঁদেরই। এই কলকাতা শহরেই নিজ উদ্যোগে পাঠক তৈরি করার কাজ আমৃত্যু করে গেছেন সন্দীপ দত্ত। তরুণদের আহ্বান জানাতেন তাঁর লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরিতে। বইমেলা কিংবা অন্যান্য অনুষ্ঠানে প্রচার করতেন লাইব্রেরিতে যাওয়ার আমন্ত্রণলিপি। অশোক উপাধ্যায়ের মতন মানুষদের কাছ থেকে কতজন যে কতভাবে উপকৃত হয়েছেন, তার হিসেব মেলা ভার। কিন্তু এমন মানুষের সংখ্যা কত? খুব বেশি কি? অর্থাভাব, নানান প্রতিবন্ধকতার ভেতরেও নিজ উদ্যোগে পাঠক তৈরি করছেন, সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন, পাঠকের রুচি অনুযায়ী বই জোগান দিচ্ছেন কিংবা পরিশ্রম করে গ্রন্থাগারের বই কেনার তালিকা তৈরি করছেন— এরকম গ্রন্থাগারিক খুব-একটা চোখে পড়ে না বটে, তবু কখনও কোনও খবর এলে আশা জাগে। গরজ কি শুধুই পাঠকের? লাইব্রেরিয়ানের নয়? ‘গুদামরক্ষক’ না হয়ে, তাঁর কাজ তো হওয়া উচিত ‘আতিথ্যপালন’! নয় কি? নতুবা অন্তরঙ্গতা গড়ে উঠবে কোন রসায়নে?
জলপাইগুড়ি জেলার সদর বিডিও অফিস প্রাঙ্গণে রয়েছে সদর ব্লক পঞ্চায়েত সমিতির লাইব্রেরি। দীর্ঘকাল সেখানে ছিলেন না কোনও লাইব্রেরিয়ান। ১১ বছর পর যোগ দেন শবনম মুস্তফি, এবং তৈরি করেন এক আশ্চর্য নজির। পাঠকসংখ্যা বাড়াতে পরিচিতদের ফোন থেকে শুরু করে স্থানীয়দের বাড়িতে-বাড়িতেও ছোটা— সবই করছেন। গত ১০ মাসে এইভাবে শতাধিক পাঠক বাড়াতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, আগামীতে পাঠকদের চাহিদা অনুযায়ী বই জোগান দিয়ে যাতে আরও পাঠকসংখ্যা বাড়ানো যায়। সেই লক্ষ্যে আপাতত অবিচল শবনম। ইন্টারনেট-সর্বস্ব পৃথিবীতে, কোন জাদুতে তিনি শতাধিক পাঠক বাড়াতে সক্ষম হলেন?
মূল কথা হল এ-ই, একজন লাইব্রেরিয়ানের যদি যথার্থ গ্রন্থবোধ না থাকে, তা হলে লাইব্রেরি অচল। তিনি যদি শুধু ‘ভাণ্ডারী’ হয়ে থাকেন এবং চেনা ছকে চলেন, তাহলে পাঠকসংখ্যা দিনে-দিনে কমবে, এ আর আশ্চর্য কী! আজ শবনম যে-কাজটি করতে উদ্যোগী হয়েছেন, অর্থাৎ বই বিষয়ে স্থানীয়দের উৎসাহিত করা, লাইব্রেরির গ্রন্থসম্ভারের কথা পাঠকদের জানানো, পাঠকদের রুচি অনুযায়ী বই জোগান দেওয়া— সেরকম করে যদি অন্যান্য লাইব্রেরিয়ানরাও ভাবেন, ছোট-ছোট লাইব্রেরিগুলোকে কি আরও কিছুদিন বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবে না?