অনুকূল-প্রতিকূল
‘কী দাদা! গেটের সামনে ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকলে হবে?’ কিংবা ‘ঢুকে দাঁড়ান! মানুষকে উঠতে দিন! সব গেটে ঝুলে থাকবে!’— এ-ধরনের সংলাপ শোনা যাবে না সকাল ন’-টা সাত ও সন্ধে ছ’-টা পঞ্চাশের লোকাল ট্রেনে; উহুঁ, যে-সে ‘লোকাল’ নয়, এ হল বাতানুকূল লোকাল! তবে বাতানুকূল লোকাল যে আদপে কতকাল মানুষের কাছে ‘কুল’ থাকবে, সে-নিয়েই চর্চা তুঙ্গে। কেউ বলছেন, এ-সবই হুজুগ! কেউ বলেছেন, আরামই তো এতদিন চাইতুম!
উনিশ শতকে ভারতে প্রথম রেল চলাচল থেকে বিশ শতকের আটের দশকে প্রথম মেট্রো, সবই কলকাতার বুকে। শহরে যখন প্রথম মেট্রো শুরু হল ভবানীপুর-এসপ্ল্যানেড রুটে, মানুষের উত্তেজনা, বিস্ময় ছিল দেখার মতো! এত কম খরচে, কম সময়ে মাটির তলে-তলে এত দূর! নেই বাস-ট্রামের বাদুড়ঝোলা ভিড়, নেই ট্যাক্সির প্রত্যাখ্যান। দেখতে-দেখতে ২০১০ এল, মেট্রোরুটে পুজোর সময়ে চালু হবে বাতানুকূল রেক; মানুষের আনন্দ আর দেখে কে! চুলোয় যাক সময়ের পাল্লা, একই ভাড়ায় যখন এসি-তে চাপা যাচ্ছে, ছেড়েই না-হয় দেব একটা ট্রেন, কিছুক্ষণের জন্যও তো ঠান্ডা হাওয়ার স্বস্তি।
অভিনেতা কি কিছুই জানেন না? যে দায় শিল্পীকে নিতেই হবে! পড়ুন: চোখ-কান খোলা: পর্ব ৭…
তখন-ই কত মানুষ ভেবেছেন, যদি লোকাল ট্রেনেও এমন ব্যবস্থা থাকত! কিন্তু লোকাল ট্রেনে এসি? সে-আবার কেমন করে সম্ভব! অফিস টাইমের এত লোক! সবাই-ই তো তাহলে সেখানে ভিড় করবে, গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা হবে। দরজা খোলা-বন্ধই বা হবে কীভাবে? আর টিকিট! মেট্রোর সেই গোলচাকতি টিকিট-ই কত মানুষ নিজের মনে করে বাড়ি নিয়ে যেতেন, বছর-শেষে মেট্রো কর্তৃপক্ষ হিসেব মেলাতে বসলে দেখতেন, মস্ত গরমিল। এই ক’দিন আগে টিকিট-ব্যবস্থায় শুরু হল কিউ-আর কোড।

মানুষের এহেন ভাববঙ্গি যেখানে, সেখানে কলকাতার মতো জনবহুল শহরে লোকাল ট্রেনেকে বাতানুকূল করা কর্তৃপক্ষর কাছে চ্যালেঞ্জিং তো ছিলই। কিন্তু সামনে ছিল মুম্বই লোকাল-ট্রেনের নিদর্শন, যেখানে ২০১৭ সাল থেকে শুরু হয় বাতানুকূল লোকাল ট্রেন পরিষেবা এবং সে-প্রচেষ্টা সফলও হয়। অর্থাৎ, মুম্বইয়ের নিরিখে ধরলে, প্রায় আট বছরের মাথায় ভারতের আর-একটি মেট্রো সিটি-র মানুষ বাতানুকূল লোকাল ট্রেনের পরিষেবা পেল। কলকাতা এবং সংলগ্ন অঞ্চলের মানুষ আগে এসি ট্রেন শুনলেই, মেট্রো বুঝত কিংবা দূরপাল্লার এসি টায়ার। সে-সংজ্ঞায় বদল এল।



কেমন হল এই লোকাল ট্রেনের পরিষেবা? কিছু প্রশ্ন কি নতুন করে উঠল? প্রথমত ‘লোকাল’ যে-অর্থে ব্যবহার করা হয়, তা এখানে ‘গণপরিবহণ’ অর্থে প্রযোজ্য। আপাতভাবে প্রশ্ন উঠবে, যে-ভাড়া রাখা হয়েছে ট্রেনের জন্য (সাধারণ ভাড়ার প্রায় আটগুণ) তা কি সাধারণ মানুষ বহন করতে পারবেন? দশ টাকায় যেখানে প্রায় ৩৫ কিমি যাত্রা করা যায়, সেখানে ভাড়া প্রয়োজন ৮৫ টাকা। মানুষ কি যাবে আদৌ এত ভাড়া দিয়ে? দেখা গেল, ট্রেনটির বাণিজ্যিক যাত্রারম্ভের দিন থেকে এখনও অবধি ভালই ভিড় হচ্ছে। অবাক করার মতো বিষয় এই যে, বহু মানুষ-ই জানেন, এসি ট্রেনের টিকিট আলাদা, তা সত্ত্বেও তাঁরা সাধারণ টিকিট কেটেই ট্রেনে উঠছেন এবং টিটির ফাইনের ভাড়াও গুনছেন। যেন তাঁরা ফাইন দেবেন মনে করেই চেপে বসেছেন এসি ট্রেনে। এ-যেন এক নতুন উৎসব। অবশ্য ক’দিন চলবে এই প্রবণতা, তা বলা যায় না।
উল্টোদিকে, ট্রেনে টিটির-ও কমতি নেই! একটি ১২ বগির ট্রেনে ১৫ থেকে ২০ জন টিকিট চেকার টহল দিচ্ছেন। মাছি, থুড়ি বিনামূল্যে যাত্রী না-ঢোকার সবরকম ব্যবস্থাই বিদ্যমান। ট্রেনের মধ্যে গিজগিজ করছে আরপিএফ বাহিনী। তাঁদেরই একজনকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, রেলওয়ের নির্দেশ অনুযায়ী, কোনও হকার বা ভিক্ষুক ট্রেনে উঠতে পারবেন না, ফলত, পাঁচ কিংবা দশ টাকার বাদাম-ই হোক বা কিশোরকণ্ঠী গায়কের ভিক্ষা— কিছুই শোনা যাবে না এসি লোকাল ট্রেনে। কিন্তু বাইরের লোকের অনুপ্রবেশ আটকানো কি আদৌ সম্ভব? দেখা গেল, কণ্ঠিধারী এক ভিক্ষুক দিব্যি চেপে বসেছেন ট্রেনে, মানুষে তাঁকে ভিক্ষেও দিচ্ছেন। তাঁর উল্টোদিকেই দাঁড়িয়ে পুলিশ, তিনি কিছু বলার অবস্থাতেই নেই। কী করেই-বা বলবেন? একবার ট্রেনে উঠে যাওয়ার পর-পরই তো স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যায় দরজা, ঠিক মেট্রোর-ই মতো। কাউকে তো আর ধাক্কা মেরে নামানো যায় না। অগত্যা পরের স্টেশন অবধি অপেক্ষা। ততক্ষণে তিনিও যা ভিক্ষে করার করে নিয়েছেন। মানুষ-ও ভিক্ষে দিচ্ছেন মুক্ত হস্তে, কেউ দশ, কেউ-বা কুড়ি, এমনকী, কেউ-কেউ ৫০-ও! তবে দরজা আটকে গেলে বেরনো যেমন একটা সমস্যা, তেমনই ওঠার সময়েও দরজা আটকে গেলে আর-এক মুশকিল। প্রথম তিন-চারদিন তো যাত্রীদের সঙ্গে উঠেছেন অনেক ভ্লগার-ও । দেখা গেল, এক ভ্লগার স্টেশনে নেমে বকবক করার সময়েই বন্ধ হয়ে গেল ট্রেনের দরজা! তিনি আর উঠতেই পারলেন না। আর এ-ট্রেন একবার হাতছাড়া হলেই গেল! সে-দিনকার মতো মোটা অঙ্কের টাকা জলে!

চেন্নাইয়ের (ICF) ইন্ট্রিগ্রাল কোচ ফ্যাক্টরি বানিয়েছে এসি লোকাল ট্রেনের কোচগুলি। ১০ আগস্ট জয়রাইড হয়ে, গত ১১ আগস্ট থেকে শুরু হয়েছে এই ট্রেনের বাণিজ্যিক যাত্রা। প্রথমদিন থেকেই মানুষের ভিড় চোখের পড়ার মতো। টিটিদের থেকে প্রতিক্রিয়া নিয়ে জানা গেল, তাঁরা মনে করেন পূর্ব রেলের এই নয়া উদ্যোগ নিয়ে মানুষের আগ্রহ প্রাথমিকভাবে হুজুগ মনে হলেও, যতদিন যাচ্ছে ট্রেনে ভিড় বাড়ছে, বই কমেছে না। অর্থাৎ, যাঁরা যাওয়ার, তাঁরা যাবেন-ই, ভাড়াটা কোনও অজুহাত তাঁদের কাছে নয়। বাতানুকূল হওয়ার জন্য ট্রেনের বগিগুলি এমনভাবে যুক্ত, যাত্রীরা স্বচ্ছন্দে স্টেশনে না নেমেই একদম শেষ কামরা থেকে প্রথম কামরায় চলে আসতে পারবেন! তবে একটা মজার বিষয় দেখা গেল, ট্রেনে একদম শুরু এবং শেষের দু’টি কোচ মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত। কিন্তু সে-কোচদু’টির রং সম্পূর্ণ গোলাপি। মেয়েদের সঙ্গে গোলাপি রং-ই যাবে, এটা যে কী ভেবে কর্তৃপক্ষ ঠিক করলেন, তা বিস্ময় জাগায়! বিস্ময় ও বিতর্ক এই ট্রেন কেন গ্যালোপিং, তা নিয়েও! একদল মানুষের বক্তব্য সব স্টেশনে কেন দাঁড়াবে না এই ট্রেন? তাঁদেরও এসি ট্রেনে ওঠার ইচ্ছে ও ক্ষমতা দুটোই আছে! তবু কেন এ বঞ্ছনা? উত্তর দেবে সময়…