দু-চাকাকে ভালবেসে…

Rintu Adhikary and his Cycle

আজ বিশ্ব সাইকেল দিবস। বাইকে করে লাদাখ যাওয়ার প্রবণতাই এখন বেশি। তার মধ্যেও রিন্টু অধিকারী কেবল ভ্রমণ ও সাইকেলকে ভালবেসেই দু-চাকায় ভর করে কালকা থেকে পাড়ি জমিয়েছিলেন লাদাখ। তাঁর যাত্রাপথ, আশ্চর্য সব অভিজ্ঞতা নিয়ে কথোপকথনে থাকলেন তমাল মজুমদার। সঙ্গে ডাকবাংলা.কম…

শুরুতে আমাদের একটু বলুন, আপনার জার্নির জন্য সাইকেলই কেন বেছে নিলেন?

দেখুন, এই জার্নির জন্য সাইকেল বেছে নেওয়ায় আলাদা কোনও ভাবনা করেছে, তেমন নয়; আসলে, সাইকেলের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছোটবেলা থেকে। টুকটাক বাজার করা, এদিক-ওদিক যাওয়া— এসব সাইকেলেই করতাম আর পাঁচজনের মতো। ঘুরতে খুব ভাল লাগত সাইকেলে। সেখান থেকেই সাইকেলের প্রতি ভালবাসা। আমি ছোট থেকেই আশেপাশের বহু জায়গা সাইকেল নিয়ে ঘুরেছি। এখন যেমন হাতে দামি সাইকেল এসেছে (মাউন্টেন বাইক), তখন তো তা ছিল না, সাধারণ বাংলা সাইকেল নিয়েই ঘুরতাম।

এখনকার ছেলেমেয়েদের কথা যদি ধরি, দু’চাকার যান মানেই তাদের কাছে বাইক! বাইকই তাদের বেশি টানে…

অদ্ভুত কথা কী জানেন, বাইক কিন্তু আমাকে কোনওদিন টানেনি! আমার আকর্ষণের জায়গা বরাবরই সাইকেল। ছোটবেলা থেকে নিজেই চালানো শিখেছি, এখন ভাল লাগাটা আরও বেড়ে গেছে। এবং আরও যত দিন যাচ্ছে, টের পাচ্ছি, সাইকেলের সঙ্গে আত্মীয়তাটা আমায় আঁকড়ে ধরছে… 

আপনি যে বললেন, এখন মাউন্টেন বাইক চালান, সাধারণ সাইকেলের সঙ্গে সেটার পার্থক্য কী?

মাউন্টেন বাইক পাহাড়ের জন্য। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ওঠা-নামার ক্ষেত্রে কিংবা চড়াই-উতরাইতে চালাতে সুবিধে হয়। এই সুবিধেটা সাধারণ সাইকেলে পাওয়া যায় না। যিনি পাহাড়ে মাউন্টেন বাইক চালাবেন, তাঁর স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যাপার এটা। সমতলের রাস্তায়, আলাদা করে এর কোনও বিশেষ গুরুত্ব নেই!

আরও পড়ুন : ঠিক করি আমার পরবর্তী অভিযান কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীর আমি এই সাধারণ সাইকেলে ভ্রমণ করব! কথোপকথনে জ্যোতিষ্ক বিশ্বাস…

সাইকেলকে ভরসা করেই রওনা দিয়েছিলেন রিন্টু অধিকারী

আপনার যে-যাত্রাপথ বা সফরের চিন্তা, সেটা কি সাইকেলকে ভালবেসে না পাহাড় ভালবেসে? যদি এই দুটোই একসঙ্গে হয়, তাহলে দুটো আলাদা বিষয় মিলল কীভাবে? 

খুব যে নির্দিষ্ট কোনও কিছু ভালবেসে বেরিয়েছিলাম সেটা বলা যাবে না। আমার মূল উদ্দেশ্য ছিল ঘোরা। আমি ঘুরে বেড়াতে প্রচণ্ড ভালবাসি! আগে তো এমনিই ট্রেকিংয়ে যেতাম, তারপর বেছে নিলাম সাইকেল। সাইকেলের মজাটা হচ্ছে, যখন-তখন, যেখানে-সেখানে থেমে— আকাশটা দেখা যায়। আকাশের এক-একটা রং দেখে মুগ্ধ হই। বাইকেও যে দেখা যায় না, তা নয়, তবে সাইকেলের ক্ষেত্রে বিষয়টা আরও সহজ। এবং পাহাড়ের আনন্দই যেহেতু মেঘ দেখা, সাইকেলে ঘুরলে সেই মেঘদল আরও বেশি করে উপভোগ করা যায়। এটা বিশেষ করে লাদাখের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। লাদাখ ঠিক করে উপভোগ করতে যদি চাও, হয় সাইকেলে, নয়তো তোমাকে হেঁটেই দেখতে হবে।  

সাইকেলে করে এত দূরে যাওয়া— এজন্য কি আলাদা কোনও মিশন বা থিম সামনে ছিল?

না, আলাদা কোনও মিশন নয়। শুধু লাদাখ দেখার জন্যই যাওয়া। সাইকেলে ঘুরতে যাওয়ার পেছনে অনেকের সামনেই বিশ্ব পরিবেশ দিবস বা এরকম কোনও থিম বা একটা বিশেষ দিন উদযাপন সামনে থাকে; কিন্তু আমার সামনে ছিল শুধু ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছেটুকুই! বেশির ভাগ লোকই জানত না, আমার এই জার্নির কথা। আমার মা এবং কাছের কয়েকজন বন্ধুই জানত শুধু। শ্রীনগরে পৌঁছে সমাজমাধ্যমে যখন একটা পোস্ট করি, তখন অনেকে জানতে পারে। আমি বেশি আপডেট সমাজমাধ্যমে দিইনি, তার কারণ আমি তো শো অফ করার জন্য যাইনি! গেছিলাম নিজের জন্যই। নিজের জন্য বেড়াতে গিয়ে সারাক্ষণ যদি সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেকে জাহির করি, তাহলে নিজের আনন্দ বলে আর কিছু অবশিষ্ট থাকে কি? 

এই যে না জানিয়ে যাওয়া, এর জন্য কখনও আলাদা কোনও প্রতিক্রিয়া পেয়েছেন? মানে মিডিয়া যা খবর করেছে সে তো করেইছে, নিজের বন্ধুবান্ধব, কাছের লোকজনের থেকে অন্য রকমের কিছু?

হ্যাঁ, অনেকেই একটু অবাক হয়ে গেছিল, এই হুট করে কাউকে না বলে চলে যাওয়ায়! এটাই অবাক করেছিল সবাইকে। আসলে এর আগে সাইকেলে করে পুরুলিয়া, বকখালি, ঝাড়গ্রাম— এই ট্যুরগুলো করলেও লাদাখের মতো এত বড় ট্যুর এই প্রথম।

আমরা সাধারণত কাছেপিঠে কোথাও গেলেই, নানা পরিকল্পনা করে যাই। এখন তো গুগল ম্যাপের মতো এমন অনেক কিছুই বেরিয়ে গেছে, যা রাস্তা চেনা বা পরিকল্পনাগত দিক থেকে প্রযুক্তিনির্ভর হয়েছে— আপনি লাদাখ যাওয়ার ক্ষেত্রে এই জাতীয় পরিকল্পনা কীভাবে করেছিলেন? আলাদা করে কি কোনও ভাবনা ছিল?

হ্যাঁ, পরিকল্পনা অবশ্যই করেছিলাম। একজনের সঙ্গে কথা বলেছিলাম, তাঁর নাম অভিরূপ বসু, সেও সাইকেলিস্ট। তাঁকে আমি এ-বিষয়ে গুরু বলে মানি। সাইকেল বিষয়ক নানা খুঁটিনাটি তাঁর থেকে আমি জিজ্ঞেস করেছি নানা সময়ে। অভিরূপ আমার এই ট্যুরের যাত্রাপথ পরিকল্পনাতেও খুব সাহায্য করেছিলেন।

এমন নয় যে, কলকাতা থেকেই সম্পূর্ণ রাস্তাটা সাইকেলে করে গেছিলাম। সাইকেলটা হাওড়া থেকে নিয়ে গেছি কালকা অবধি; কালকা থেকে শুরু করে মানালি, লাদাখ হয়ে এদিকে শ্রীনগর পেরিয়ে জম্মুতে শেষ। এখান থেকে কালকাও সাইকেলে যাওয়া যেত, কিন্তু সেটাতে একটা মাস সময় লাগত। এই গরমে সেটা ঠিক চাইনি। এনার্জি তো নষ্ট হতই, সেই সঙ্গে তার প্রভাব পড়ত সামগ্রিক যাত্রাপথেই। 

ওখানকার মানুষের আতিথেয়তা এক কথায় অভূতপূর্ব! এত সহজে আপন করে নিতে পারেন ওঁরা… এমনকী রাস্তায় সাইকেলিংয়ের সময়ে ট্রাক-ড্রাইভারদের আতিথেয়তা দেখলেও অবাক হতে হয়। খুবই সম্মান করেন ওঁরা অভিযাত্রীদের। মনে আছে, যখন সাইকেল চালাচ্ছি, বেশ কিছুটা দূরত্ব রেখে সাবধানে চালাতেন ওঁরা, যেন অভিযাত্রীদের কোনও অসুবিধে না হয়। আমাদের এখানে তো উলটো!

আচ্ছা, সাইকেলে গেলে তো সাধারণত প্রাকৃতিক বিপর্যয়, ঝড়, বৃষ্টি, ধ্বস— এসব এড়ানো যায় না; জীবনের জন্যও যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ— সেক্ষেত্রে আপনার পরিকল্পনা ঠিক কী ছিল?

আমি যে-সময়ে গেছিলাম, চেয়েছিলাম কোনওভাবে অটল টানেলটা পার করতে; সাধারণত ওটা পেরোলেই ওই সময়ে আবহাওয়া ভাল পাওয়া যায়। এই পরিকল্পনাটা করার জন্য আমি বৃষ্টি, ধ্বস— এরকম বড় কোনও দুর্যোগের সম্মুখীন সেভাবে হইনি। তবে বেশ কিছু মুহূর্ত গায়ে কাঁটা দেওয়ার মতো; উমলিংলা পাস পেরিয়ে চিচুংলা পাস যাওয়ার সময়ে অসাধারণ কিছু মুহূর্তের সাক্ষী হয়েছিলাম। যখন চড়াই বেয়ে উঠি, তখনই অনেকে বলেছিল পৌঁছতে-পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে, ভেবেছিলাম, একা আছি, ঠিক উঠে যাব, অসুবিধে হবে না। কিন্তু হলও তাই… ফেরার সময়ে একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার— প্রায় ২৫ কিমি উতরাই বেয়ে নেমেছিলাম, সারা রাস্তা অন্ধকার, যখন নামছি, বুনো খরগোশ ছুটে যাচ্ছে, কখনও বন্য জন্তুর চোখ দেখতে পাচ্ছি… আমার সাধারণত একা সাইকেল চালাতে এমনিতে কোনও ভয় করে না, কিন্তু আমার একপাশে পাহাড়ি দেওয়াল, আরেক পাশে গভীর খাদ! ওই অন্ধকারে একবার কিছু এদিক-ওদিক হলেই একদম খাদে পড়ে মৃত কিংবা অর্ধমৃত অবস্থায় পড়ে থাকতাম। কিন্তু নামার সময়ে একটু দাঁড়িয়ে যখন ওপরের দিকে তাকাচ্ছি, দেখছি— আকাশ জুড়ে মিল্কিওয়ে— সে যে কী অনুভূতি, বলে বোঝাতে পারব না!     

পৌঁছতে-পৌঁছতে সন্ধ্যা সাড়ে-সাতটা বেজে গেছিল। যে-ধাবাতে আমি ছিলাম, যখন নেমে আসি, দেখি ওরা সবাই গাড়ি করে আমাকে খুঁজতে বেরোবে বলে প্রস্তুতি নিচ্ছে— আমি পৌঁছতেই আমাকে কী বকাঝকা! ওদের চিন্তিত হওয়াই স্বাভাবিক, কিন্তু আমার জীবনে ওই ২৫ কিমি সাইকেলে করে নামার মুহূর্ত আমি কখনও ভুলব না। 

পরের দিন, গেলাম ফোর্টিলা পাস; আমার দেখা অন্যতম কঠিন রাস্তা এটা। এখানেই যাওয়ার সময়ে পড়ে যাই। এর পর পরই কয়েকদিন বৃষ্টি, টায়ার পাংচার— এমন বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হই। টায়ার পাংচারের সময়ে বেশ অসুবিধেই হয়েছিল, কারণ আমার কাছে যে-দুটো পাম্পার ছিল, তার কোনওটাই কাজ করছিল না; অবশেষে দিল্লির দু’জনের সঙ্গে দেখা হয়, তাঁরা পাম্পার দিয়ে উপকার করেন। 

এটা সর্বমোট কতদিনের জার্নি ছিল? আর সাইকেলের জার্নিই-বা কতটা ছিল?

বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাড়ি ফেরা অবধি মোট ৩০ দিন আর মাঝে সাইকেল নিয়ে ২২/২৩ দিনমতো ঘোরাঘুরি করেছি। 

বাঙালির সাইকেলে করে ঘোরার একটা বড় ইতিহাস আছে— বিমল মুখার্জির ‘দু’চাকায় দুনিয়া’-র কথা আমরা অনেকেই জানি; আপনার ক্ষেত্রে এরকম কোনও অনুপ্রেরণা কাজ করেছিল কি?

না, আমি এগুলো ভাবিইনি! ট্রিপের আগে আমি এত কিছু ভাবিই না। ইচ্ছে হয়, বেরিয়ে পড়ি। পাশাপাশি লোকজনকেও জানাই না। গোটা ট্রিপে সাধারণত বেশ কিছু জায়গায় নেটওয়ার্ক থাকলেও ফোন বন্ধ রাখি, নইলে বড় ডাইভার্ট হতে হয়; ট্রিপ শেষ হয়, তারপর লোকজনের সঙ্গে কথা বলি।   

পাহাড়ে, ওখানকার মানুষের আপ্যায়ন- আতিথেয়তা নিয়ে কিছু যদি বলেন…

ওখানকার মানুষের আতিথেয়তা এক কথায় অভূতপূর্ব! এত সহজে আপন করে নিতে পারেন ওঁরা… এমনকী রাস্তায় সাইকেলিংয়ের সময়ে ট্রাক-ড্রাইভারদের আতিথেয়তা দেখলেও অবাক হতে হয়। খুবই সম্মান করেন ওঁরা অভিযাত্রীদের। মনে আছে, যখন সাইকেল চালাচ্ছি, বেশ কিছুটা দূরত্ব রেখে সাবধানে চালাতেন ওঁরা, যেন অভিযাত্রীদের কোনও অসুবিধে না হয়। আমাদের এখানে তো উলটো! পাশাপাশি ওখানে একজনের বাড়িতে সারারাত ছিলাম, জানতেই পারিনি যে একজন প্রাক্তন মিলিটারি কর্তার বাড়িতে রয়েছি! পরের দিন সকালে বাইরে রাখা গাড়ি দেখে বুঝতে পারি, তাঁর ছেলেও বর্তমানে মিলিটারিতে রয়েছেন। এছাড়া আর্মিদের ক্যান্টিনে চাউমিনও খেয়ছিলাম। পাশাপাশি মনে পড়ে একজন দাদির কথা, যাকে কোনওদিনও ভুলব না।

সাইকেল দিবসে যারা সাইকেলে করে নতুন অভিযানে যেতে চায়, তাদের উদ্দেশে কী বলবেন? পাশাপাশি কী-কী সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত? 

সবচেয়ে বড় হল সাহস, মনের জোর এবং ফিজিক্যাল ফিটনেস— পাশাপাশি যাওয়ার আগে ভাল করে প্ল্যান ও হোমওয়ার্ক করে যেতে হবে, অনেকেই সেভাবে পূর্বপরিকল্পনা না করে বেরিয়ে যায়— এখানেই মস্ত বড় ভুলটা হয়। ট্যুরে দু’জন-তিনজন গেলে তাও ঠিক আছে, একজন গেলে সে আগে থেকে রুট ঠিক না করলে বড় সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এটুকুই শুধু মাথায় রাখার…

ছবি সৌজন্য : রিন্টু অধিকারী