চেনা ছকের বাইরে

Banu Mushtaq

বানু মুশতাকের কন্নড় থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ হওয়া ছোট গল্প সংকলন ‘হার্ট ল্যাম্প’ আন্তর্জাতিক ম্যান বুকার পুরস্কার পেল। এই নামে আলাদা করে প্রকাশিত কোনও বই ছিল না। ২০১৯-২০২৪ অবধি বানুর লেখা থেকে বারোটি ছোটগল্প বেছে নিয়ে হার্ট ল্যাম্প’ শিরোনামে অনুবাদ করেছেন দীপা ভাসতি। এটি আমাদের দুর্দশাগ্রস্ত ও প্রতিঘাতময় জাতীয় জীবনে এক ধরনের মরিয়া আশার সঞ্চার ঘটায় বইকি।

বানু মুশতাক পেশায় আইনজীবী। তিনি সামাজিক-পারিবারিকভাবে কোনায় পড়ে থাকা, পিছিয়ে রাখা মেয়েদের অধিকার নিয়ে নিয়ত কাজ করে চলেছেন। একটি উপন্যাস, ছয়টি ছোট গল্পের সংগ্রহ, একটি প্রবন্ধ সংকলন ও একটি কাব্যগ্রন্থ আছে তাঁর। তাঁর লেখাতে মূলত কন্নড়-ভাষী মুসলমান সমাজের ঘরোয়া পারিবারিকতায় মেয়েদের বেঁচে থাকার ছবি আমরা দেখতে পাই। এবং সেই পারিবারিকতা দেশি সমাজের নানা ঘর বসত কোনাকানাচি ভেদে ভিন্ন। সেখানেই আধা আটপৌরে মধ্যবিত্ত মুসলমান জীবনে সালতামামির সঙ্গে নিম্নবিত্ত ও নিরন্নের অবয়ব অনবরত ভেসে ওঠে। শহর, শহরতলি, মফসসল ব্যেপে একটা ভূগোলে রক্ষণশীল জীবনের নানা ফেরে পড়ে থাকা মেয়েদের কাহন পাঠককে একেবারে স্বস্তি দেয় না। 

আরও পড়ুন : নজরুলের সৈনিক হিসেবে যোগদানের নেপথ্যে আদৌ কি কোনও উগ্রতা কাজ করেছিল? লিখছেন রাজ্যেশ্বর সিনহা…

বানু মুশতাকের গল্পে পর পর পাঁচটি সন্তানের জন্ম দিয়ে তিরিশে পা দিতে না দিতে অকালে বুড়িয়ে যাওয়া মেহ্রুন বাপের বাড়ি ফিরে আসে। তার স্বামী এর মধ্যেই উৎসাহ খুইয়ে অন্য মহিলায় আসক্ত। বানুর অন্যান্য গল্পের মতো এখানেও ধরে রাখা আছে লেখাপড়ার জন্য মেয়েদের অদম্য অভিলাষ। কিন্তু কিছুতেই পরিবারের বা সমাজের তা মেনে না নিয়ে, বিয়েতে বসিয়ে দেওয়ার পুনরাবৃত্তি চলে। যখন মেহ্রুন কান্নায় ভেঙে পড়ে বলে, আমি কলেজে গেলে বোরখা পরেই যাব, আমাকে পড়তে দাও, আমাদের অনেকের মনে পড়ে যেতে পারে কর্নাটকেই কর্তৃপক্ষ কলেজে হিজাব পরা নিষেধ করে দিলে ছাত্রীদের প্রতিবাদ। এখানে হিজাব শুধু মুসলমান পরিচয়ের চিহ্নই নয়, মেয়েদের ওপর ধর্মীয় গোঁড়ামির বন্ধন নয়, একটি রক্ষণশীল সমাজে হিজাব পরে অনেক সময় অনেক সুযোগ করে নিতে পারে মেয়েরা। হিজাব নিয়ে ঘটনাপ্রবাহ যে ভাবে চলেছে, তার পরিপ্রেক্ষিত অবশ্যই সংখ্যাগুরুর দমনমূলক রাজনীতি। তাই মুসলমান সমাজের লেখকরা যখন লেখেন, সাধারণ জীবনের গল্পে স্বভাবতই অনেকগুলি স্তর যুক্ত হয়ে যায়। কন্নড়ভাষী বানু মুশতাক বা সারা আবুবকর যেমন বোরখার সঙ্গে ধর্মীয় আব্রু হায়াকে যোগ করে মেয়েদের অধিকার খর্ব করার চেষ্টার বিরুদ্ধে সোচ্চার, তেমনই সঙ্গে সঙ্গে তাদের লেখায় আরও অনেকগুলি দিক থাকে। নারীবাদের প্রশ্নগুলি তখন আগে থেকে নিষ্পন্ন করা অধিকার বা প্রতিবাদের ধারণা থেকে সরে অনেক সমাজনুগ হয়ে ওঠে।  যাকে আমরা স্বতন্ত্র জীবন থেকে উঠে আসা স্বতন্ত্ররকম নারীবাদী প্রশ্ন বলতে পারি। লেখার শৈলী, সেও সেই স্বতন্ত্র জীবনের সঙ্গে মিলেই তৈরি হয়। যেমন বানু মুশতাক নিজেই বলেছেন আগে শুধু মুসলমান সমাজের নিহিত পিতৃতন্ত্র নিয়ে লিখে গেলেও ১৯৯২-এ বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরে তাঁর লেখা পারিবারিকতার ঘেরাটোপকে সাম্প্রদায়িক সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে নিয়ে যায়। এই দেশে সাধারণ মুসলমান সমাজ বলতে যে ছক তৈরি করে দেওয়া হয়েছে, হচ্ছে, সেটাকে মাথায় রেখে বানুর লেখায় বদল আসতে থাকে। 

আন্তর্জাতিক ম্যান বুকারের গুরুত্ব হল গ্রেট ব্রিটেন ও আয়ারল্যান্ডের বাইরে ইংরেজি ও ইংরেজি ছাড়া অন্য ভাষায় লেখা সাহিত্যের (ইংরেজিতে অনুবাদে) লেখকদের গুণমানের স্বীকৃতি। এর আগে ইংরেজি ভাষাতেই লেখেন এরকম ভারতীয় বেশ কয়েকজনই বুকার পেয়েছেন— সলমন রুশদি, অরুন্ধতী রায়, কিরণ দেশাই, এবং অরবিন্দ আদিগা পুরস্কার পাওয়া মাত্রে তাদের বই পাইরেটেড হয়ে  গোলপার্ক, গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজের সামনে বইয়ের দোকানে হইহই করে শামিল হয়ে গিয়ে ব্যাপ্ত বাঙালি পাঠকের গোচরে চলে এসেছে। কিন্তু ভারতীয় ভাষায় লেখা সাহিত্যের বুকার অর্জন একটা অন্যতর স্বীকৃতির দ্যোতক। তা দেখায় ইউরোপ, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, পশ্চিম ও পূর্ব এশিয়ার সাহিত্যের সঙ্গে সঙ্গে এবার ভারতীয় ভাষা-সাহিত্যের দিকে পশ্চিমা দুনিয়ার অভিনিবেশিত নজর এসে পড়েছে। এবং আশা হয়, ভারতীয় ভাষা-সাহিত্য তার বিপুল বৈভব নিয়ে একটেরে হয়ে পড়ে থাকা ছেড়ে এবার ইংরেজির মধ্যস্থতায় বিশ্বসাহিত্যের আলোচনায় স্পষ্ট দ্রষ্টব্য হয়ে উঠবে। আন্তর্জাতিক টেবিলে বসে ভারতীয় সাহিত্য বলতে আর শুধু টেগোর ও নোবেল বলে দীর্ঘশ্বাস চাপতে হবে না। শুধু কি তাই? এক কন্নদিগা লেখকের এহেন স্বীকৃতির ফলে এই যে আমরা ভারতবাসী হিসেবে হঠাৎ সগৌরবে চমকে উঠেছি, তার ফলে হয়তো আমরা এক দেশের এতরকম বহুত্ব ও আরও নানা ভাষাসাহিত্যের উপস্থিতি খেয়াল করে উঠতে পারব। বানু মুশতাক কি আমাদের হঠাৎ করে ধরিয়ে দেন না যে অন্যান্য ভারতীয় ভাষার সাহিত্য আছে, আছে অন্য অন্য জীবন, যা ভিন্ন, কিন্তু একত্রে ভারতীয়ত্বর আদত ধারণা? 

এর ঠিক আগেই আগেই দেশভাগ ও উদ্বাস্তু যন্ত্রণা নিয়ে হিন্দি ভাষায় লেখা গীতাঞ্জলী শ্রী-র রেত সমাধি ডেইজি রকওয়েলের অনুবাদে বুকার পাওয়াতে একথা টের পাওয়া গিয়েছিল যে, অবশেষে ইংরেজিতে অনূদিত ভারতীয় সাহিত্যের দিকে আন্তর্জাতিক রিভিউকারদের দৃষ্টি পড়েছে। তার মানে কিন্তু এ নয় যে, ভারতীয় ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ এই সদ্য কোনও ঘটনা। আধুনিক ভারতীয় সাহিত্য এক ভাষা থেকে অন্য ভারতীয় ভাষায় অনুবাদের চর্চা সেই উপনিবেশিত সময় থেকেই গভীর। স্বাধীনতা-উত্তর কালে বহু স্বরে বহুবিচিত্র এক দেশে বি-উপনিবেশিত ঐক্যবদ্ধ ভারতীয় নেশন গড়ার তোলার জন্য ভারতীয় ভাষাগুলির মধ্যে যোগাযোগ ও ভাষার লালন প্রয়োজন ছিল। ১৯৫৪-তে তৈরি হয় সাহিত্য অকাদেমি।   শাখাগুলির কর্মকাণ্ডে ভারতীয় ভাষায় সাহিত্য-লেখকদের লিখন-পরিধির নজির দেখা যায়। এছাড়াও কথা বুকস আটের দশক থেকে ভারতীয় ভাষা-সাহিত্যের ইংরেজি অনুবাদে বিশেষ ভূমিকা নেয়। 

অনুবাদক দীপা ভাসতির সঙ্গে

এখন কেন বানু মুশতাক গুরুত্বপূর্ণ! বানু মুশতাক এর আগেই ১৯৯৯-এ কর্নাটক সাহিত্য অকাদেমির পুরস্কার পেয়েছিলেন। ১৯৯০-২০১২ সালের মধ্যে বানুর লেখা পাঁচটি গল্প নিয়ে দীপা ভাসথির অনুবাদ ‘হাসিনা অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’ বুকারের আগে এই ২০২৪-এ পেন ইংলিশ ট্রানস্লেশন অ্যাওয়ার্ডও পায়। আর-এক কন্নদিগা লেখক সারা আবুবকর-এর মতো বানুও তাঁর লেখায় ও জীবনে মুসলমান মেয়েদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার। এঁরা একই প্রজন্মের লেখক, ক্রমাগত দেখে গিয়েছেন মেয়েদের ঘরের চৌহদ্দির মধ্যে আটকে বিনা বাক্যে বহু-প্রসবিনী হওয়াটাই তাদের একমাত্র ভবিতব্য। মেয়েদের জন্য লেখাপড়ার সুযোগ দূর অস্ত। পুরুষ লেখকদের লেখায় অনেক কঠোর সামাজিক প্রসঙ্গ এলেও মেয়েদের অধিকারের প্রসঙ্গ বা কোনও সুযোগের অভাবে কোণঠাসা দমবন্ধ জীবন সেভাবে ধরা পড়ার কথা নয়, ধরা পড়ছিলও না। সারা আবুবকর আবার কোনও নাম না করেই খেয়াল করিয়েছিলেন যে, মুসলমান লেখকদের অনেকেই শুরুর দিকে ছিলেন জামাত-ই-ইসলামের সঙ্গে যুক্ত। তাঁরা সারাকে রীতিমতো নিষেধ করতেন, ধর্মীয় রীতি বা সামাজিক অভ্যাসের কথা সোজাসাপটা আক্রমণে লিখতে। সারাকে একবার কাঠগড়ায় গিয়ে দাঁড়াতেও হয়। সারা তাঁর বাবাকে পাশে পান। বানুও একাধিকবার হুমকি পান। একবার তাঁকে ছোরা নিয়ে আক্রমণও করা হয়েছিল।

সারা আবুবকর

১৯৮০ থেকে বানু মৌলবাদ-বিরোধী সামাজিক আন্দোলনের রীতিমতো শরিক। ‘কোমু সৌহার্দ্য ভেদিকে’ নামে সেই আন্দোলনের অন্যতম হাতিয়ার ছিল সাহিত্য। গিরিশ কারনাড ও গৌরী লঙ্কেশ-সহ কর্নাটকের অনেক বুদ্ধিজীবীই এই আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। যে আদর্শ ও আন্দোলনের কথা এঁরা বলছিলেন, তা ছিল সবর্ণবাদী, হিন্দুত্ববিরোধী। এই দশকটা কন্নড় সাহিত্যের বাঁকবদলের সময়। অবশ্যই বি বাসবলিঙ্গাপ্পা, কন্নড়ে আধুনিক সাহিত্য বলতে যা লেখা হয়েছে তা গরু-মহিষের খাওয়ার ভুষি— ১৯৭৩ সালে এই বলে দিয়ে উলটো সংকীর্ণতা দেখিয়ে ফেলেছিলেন, কিন্তু সাহিত্যিক অভিব্যক্তি হিসেবে নবোদয় বা সেই সময় পর্যন্ত প্রগতিশীলতা স্বভাবতই ছিল উচ্চবর্ণীয় শ্রেণিনির্ভর। গত শতকের পাঁচ বা ছয়ের দশকে কর্নাটী আত্মতা নির্মাণে মস্তি ভেঙ্কটেশ আয়েঙ্গার বা টিআর সুব্বারাও কলম ধরেছেন, হায়দার আলি ও টিপু সুলতানের আক্রমণে দেশীয় হিন্দু রাজার পরাজয় ঐতিহাসিক সাহিত্যের মূল থিম হিসেবে দেখা দিয়েছে। তাই আটের দশকে বান্দায়া (বিদ্রোহী) ও দলিত সাহিত্য আন্দোলনের মধ্যদিয়ে দলিত ও মুসলিম লেখকরা যখন যখন জাহির হলেন, সমাজ ও সাহিত্যের মধ্যে অন্যতর সম্পর্ক নির্ণয়ের জন্য একটি বিশেষ  কালপর্ব সূচিত হল। প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবিতার ধারা বদলাতে লাগল। এই বুদ্ধিজীবিতায় সাহিত্য, নাট্য ও সমাজ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বানু।

বিশ শতকের শুরু থেকে কর্নাটক অঞ্চলের জটিল পালাবদল, ক্ষয়িষ্ণু ব্রাহ্মণ্য সমাজের অবশ্যম্ভাবী পতনের সঙ্গে প্রথাগত জীবনের অবলুপ্তির ইতিহাস, ব্যক্তির অস্তিত্ববাদী সংকটের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা-উত্তর কালের যে খতিয়ান রয়েছে ইউআর অনন্তমূর্তির গদ্যরচনায়, তা ১৯৮০ থেকে প্রগতিশীল, তার পরে বান্দায়া (বিদ্রোহী) ও দলিত সাহিত্য এবং মুসলমান লেখকদের রচনায় প্রান্তিক সমাজের যৌথ অভিজ্ঞতার প্রশ্নে সরে আসে। বেঙ্গালুরু থেকে প্রকাশিত পি লঙ্কেশ-এর ‘লঙ্কেশ পত্রিকে’ এই লেখকদের অনেকেরই প্রস্তুতি ও বিকাশে বিশেষ ভূমিকা নেয়।  সারা আবুবকর বারবার এ-কথা বলেছেন। বানু নিজে সরাসরি কিছুদিন ‘লঙ্কেশ পত্রিকে’-তে কাজও করেন।  

শুধু কন্নড় থেকে অনুবাদের দিকেই যদি তাকাই, তাহলে তো সেই ১৯৭৬-এই ইউআর অনন্তমূর্তির উপন্যাস ‘সংস্কার’ (১৯৬৫) ইংরিজিতে অনুবাদ করেছেন একে রামানুজন। একে রামানুজন তো নজর এড়িয়ে যাওয়ার মতো কোনও অস্পষ্ট আঞ্চলিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন না। নিজে কবি ও সাহিত্যতাত্ত্বিক, ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগো-তে ভাষাতত্ত্বর অধ্যাপক বহুভাষী রামানুজন তামিল, সংস্কৃত ও কন্নড় ধ্রুপদী, মধ্যযুগীয় ও আধুনিক সাহিত্যের সম্ভার ও লোকসাহিত্য প্রভূত অনুবাদ করছেন। কিন্তু যতক্ষণ না পর্যন্ত কোনও একটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার ভেতর থেকে নিজের দেখার পরিধি বাড়ায়, তাদের বিশ্বের ধারণা বদলায়, আদত বিশ্ব সেখানে অনুপস্থিত থেকে যায় । সেই দিক থেকে বলা যেতে পারে যে, বিশ্বসাহিত্যে নিহিত যে কেন্দ্র-পরিধির ধারণা, আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার তার একটা ভিন্ন ছবি তুলে আনতে সক্ষম হয়েছে। জ্ঞানপীঠ-প্রাপ্ত ইউআর অনন্তমূর্তি ২০১৩ সালে বুকারের জন্য শর্টলিস্টেড ছিলেন, নানা ভারতীয় ও ইউরোপীয় ভাষায় তাঁর লেখা অনুবাদও হয়েছে। 

কিন্তু প্রশ্ন, তাহলে এতদিনের অপেক্ষা কেন? আসলে ওই একটা মুহূর্ত লাগে। যখন আন্তর্জাতিক মহলে বিশ্বসাহিত্য রচনার ক্ষেত্র কাকে বলব, তার দিক বদলানোর প্রয়োজন দেখা দেয়। ও বদলায়। তখন ইংরিজিতে ভাষা-সাহিত্যের অনুবাদের সার্কিট ও বিশ্বসাহিত্যের পাঠকদের ও বুকার জুরির সাহিত্যের খোঁজ পরস্পর সুষ্ঠুভাবে আপতিত  হয়।

খেয়াল করলেই দেখা যাবে, সারা আবুবকর বা বানু মুশতাকের লেখা অনুবাদ হতে শুরু করেছে এই হালে। সারা আবুবকরের একটিই উপন্যাস অনুবাদ হয়েছে, সেটি তিন তালাক নিয়ে লেখা। ২০০১ সালে বনমালা বিশ্বনাথের অনুবাদ ছাপা হওয়ার দুই দশক পরেও তাঁর উপন্যাস ছোটগল্পের বিরাট সম্ভার থেকে আর কোনও অনুবাদ হয়েছে বলে মনে হয় না। বানু মুশতাকের লেখা তো দীপা অনুবাদ শুরু করেছেন ২০২২-এ মাত্র। অন্যান্য লেখকদের মধ্যে কেবলমাত্র কেএস নিসার আহমেদের কবিতাগুচ্ছর অনুবাদ ইংরেজিতে হচ্ছে, ২০২৬-এ প্রকাশিতব্য। বোলওয়ার মোহম্মদ কুনহি, ফকির মোহম্মদ কাটপাড়ি— এঁরা কেউ পদ্মশ্রী, কেউ একাধিকবার কর্নাটক সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পেয়েছেন, কেউ কর্নাটক সাহিত্য অকাদেমি ও কেন্দ্রীয় সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পেয়েছেন। এদের লেখা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত, তা থেকে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সিনেমা তৈরি হয়েছে। কিন্তু এত বছরে এখনও, এসব কোনও লেখাই ইংরেজিতে অনুবাদ হয়নি। সেদিক থেকে দীপা ভাসতিকে তুমুল অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা জানানোর থাকে আমাদের। 

বানু বলেছেন, মুসলমান সমাজের মধ্যে থেকে লিখতে শুরু করে তাঁর কাছে সাহিত্যের কোনও ধরতাই ছিল না। সমকালীন মুসলমান লেখকরা তখনও ঠিক সবর্ণ লেখকদের ছাঁচে লিখছেন। এই সময় প্রগতিশীল সাহিত্য-গোষ্ঠী তাঁকে তাঁর নিজের জীবন ও আশপাশ থেকে কাহিনি জোগাড় করে নিতে পরামর্শ দেয়। সেখানে দম বন্ধ হওয়া, প্রাণশক্তি ফুরিয়ে ফেলা মেয়েদের হেরে যাওয়া আছে।

কাদের লেখা অনুবাদ করা হবে? প্রাবন্ধিক, পোস্টকলোনিয়াল পোস্টস্ট্রাকচারালিস্ট অনুবাদ-তাত্ত্বিক তেজস্বিনী নিরঞ্জন অনুবাদ করেছিলেন বৈদেহীর ছোটগল্প সংকলন ‘গুলাবি টকিজ অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’ (২০০৮)। সেখানে এস বাগেশ্রী, মৃণালিনী সেবাস্টিয়ান ও নয়না কাশ্যপ অন্য গল্পগুলি অনুবাদ করেন। বৈদেহী (জানকী শ্রীনিবাস মূর্তি), সারা ও বানু একই প্রজন্মের লেখক। সাহিত্য অকাদেমি ও আরও অজস্র সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত বৈদেহী আধুনিক কন্নড় সাহিত্যে অন্যতম নাম। তাঁর প্রায় পাঁচ দশক ব্যেপে লেখা গদ্যে দক্ষিণ কর্নাটকের ব্রাহ্মণ্য সমাজে পরিবারে মেয়েদের বদ্ধ অবস্থান, লড়াই, জাতপাতের সামন্ত্রতন্ত্রের ভারতবর্ষের ভেঙে পড়ার আখ্যান। তেজস্বিনীর এম কে ইন্দিরার উপন্যাস অনুবাদ, ‘দ্য ইয়ং ব্রাইড’ (১৯৯১), সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত । কন্নড় কবি জয়ন্ত কৈকিনি-র বই তাঁর অনুবাদে ‘নো প্রেজেন্ট প্লিজ: মুম্ব,ই স্টোরিজ’ ডিএসসি সাউথ এশিয়ান লিটারেচার পুরস্কার (২০১৯) পেয়েছে। বৈদেহীর একাধিক গল্প ও উপন্যাস পরে অনুবাদ করেছেন নয়না কাশ্যপ, সুশীলা পুনিথা, সি বিমলা রাও। কিন্তু কন্নড়ভাষী মুসলমান লেখকদের লেখার মুসলমানত্ব কি অনুবাদের ক্ষেত্রে অপরিচয়ের একটা বাধা হয়ে দাঁড়ায়? যেমন অন্যান্য ভারতীয় ভাষার মুসলমান লেখকদের লেখার ক্ষেত্রেও? ভাষার মধ্যে নিহিত যে ভাব, যদি তার অর্থ মুসলমান সমাজের নিজস্ব প্রাত্যহিকী-নির্ভর হয়ে থাকে, যাঁরা সাধারণভাবে দেশীয় ভাষা থেকে ইংরিজিতে অনুবাদ করেন, তাঁদের কি সেই ভাষার সঙ্গে যোগাযোগ ঘটানো দুস্তর হয়ে পড়ে?

আমাদের দেশের বি-উপনিবেশিত-করণের হাতিয়ার হিসেবে দেশীয়/মাতৃভাষায় শিক্ষা ও মনন-চর্চার বিরাট প্রাতিষ্ঠানিকতা থাকলেও, ইংরেজির রাশ থেকে গিয়েছে একটা কুলজির-এর হাতে। যাকে সমালোচকরা নাগরিক সবর্ণ উচ্চ-মধ্যবিত্তর পরিসর বলে ডাকেন, ভাষা থেকে কোন টেক্সট ইংরিজিতে অনুবাদ হবে, সেই নির্বাচনের ক্ষেত্রটিও সেখান থেকে নির্ণীত হয়ে এসেছে এতকাল। এবার সেখানে দলিত সাহিত্য ও  অবশেষে মুসলমান-লিখিত সাহিত্য জায়গা করে নিচ্ছে। পুরস্কার তো পুরস্কারের মতো থাকে। তা দিয়ে তো আর একটা ভাষা-সাহিত্যের সম্পূর্ণ বৈভব মেপে ওঠা যায় না। বরং তা একটা আশা দেয় যে, এবার অন্যান্য ভাষায় যে অত্যুজ্জ্বল লেখকরা আছেন, যাঁদের কথা তাঁদের নিবিষ্ট পাঠকরা ছাড়া আর কেউ জেনে উঠতে পারেনি, এইবার তাঁদের লেখারও অনুবাদ শুরু হবে। যা সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ বা আবুল বাশারের ক্ষেত্রে এখনও হয়নি, নীহারুল ইসলাম, সাদিক হোসেন, হামিরউদ্দিন মিদ্যা বা আয়েশা খাতুনের ক্ষেত্রে তা হবে। অনুবাদের মধ্য দিয়ে কবে এঁদের আবিষ্কার করা হবে সেই অপেক্ষা এবার। 

না, ইংরেজিতে অনুবাদ বলে সেটা আবার বহুজাতিক চক্রের হাতে চলে যাচ্ছে বললে ভুল হবে। কারণ আমাদের দেশে অনেক পুরনো নতুন অনেক প্রকাশনাই খুবই যত্নে ভারতীয় ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ ছাপায়। আর বাংলায় চাইলে? দুটো জিনিস মনে করা যেতে পারে। এক, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় যখন নিজে ও অন্যান্য অনুবাদকদের দিয়ে অন্যান্য ভারতীয় ভাষা থেকে অজস্র ছোটগল্প অনুবাদ করে সম্পাদনা করেছিলেন, ইংরেজি অনুবাদই তাতে অনেক ক্ষেত্রে মধ্যস্থতা করেছিল। আর অন্য পথ তো আছেই। গুজরাতি-ভাষী, উর্দুভাষী সাহিত্যের স্কলারের সঙ্গে বসে সেই ভাষা থেকে এক সঙ্গে যৌথ অনুবাদ করলে তো প্রত্যক্ষ ভাষার সঙ্গে যোগও থেকে যায়। 

বানু বলেছেন, মুসলমান সমাজের মধ্যে থেকে লিখতে শুরু করে তাঁর কাছে সাহিত্যের কোনও ধরতাই ছিল না। সমকালীন মুসলমান লেখকরা তখনও ঠিক সবর্ণ লেখকদের ছাঁচে লিখছেন। এই সময় প্রগতিশীল সাহিত্য-গোষ্ঠী তাঁকে তাঁর নিজের জীবন ও আশপাশ থেকে কাহিনি জোগাড় করে নিতে পরামর্শ দেয়। সেখানে দম বন্ধ হওয়া, প্রাণশক্তি ফুরিয়ে ফেলা মেয়েদের হেরে যাওয়া আছে। এবং টিকে থাকা আছে। যেভাবে আমরা প্রতিবাদ বুঝি, তার জায়গা সেখানে নেই। যেমন নিজে পড়তে চেয়েও না পড়তে পারা শাইস্তা ভাবী সমানে ভেবে যায় বড় মেয়েকে সে পড়াতে চেয়েছিল। কিন্তু তার নিজেকে এত সন্তানের জন্ম দিতে হয় যে, বড় মেয়েকে পড়াশোনা ছেড়ে নিজের ছোট ভাইবোনদের কোলে-কাঁখে মানুষ করতে হয়। কারও কোনও পালানোর পথ নেই। অন্য মহিলা, গল্পের কথক যে, সে তা দেখাতেও পারে না। কিন্তু শাইস্তা ভাবী যে ভাবতে পারে যে, সে অপারেশন করিয়ে নেবে স্বামীর অজান্তে, এটাই এখানে লক্ষ করার। কিন্তু তার মৃত্যুতে, চালিসা পার হতে না হতে তার স্বামীর ফিরে বিয়েতে বসায় তৈরি হয় যে দম বন্ধ করা প্রতিবেশ, যেখানে বাড়ির বড় মেয়েটির গৃহদাস হয়ে থাকাটাই এক এমাত্র ভবিতব্য হয়ে ওঠে, তাতে এক একমাত্র আশা হয় কথক যে, সে নিজের জীবনে এটা ঘটতে দেবে না। তাই সক্রিয়  হওয়ার বদলে পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা বানুর রচনায় বিশেষ ট্রোপের মতো আসে। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম, তা পালন করার সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে রেখে দেওয়া হয় আল্লাহ্‌র প্রতি সমর্পণের  বিশুদ্ধ আবেগ। 

যেহেতু বানুর লেখাকে নারীবাদী বলে দেওয়া হচ্ছে, বলে দেওয়া হয়েছে তাঁর গল্পে মহিলাদের সচেতন মনোভঙ্গি (agency) ফুটে  উঠছে, আমরা যেন বানুর লেখায় একলপ্তে চেনা ধর্ম বনাম নারীবাদী চেতনার খোঁজ না করি। এখানে ধর্ম মানার যে ফরজ, তা কীভাবে পিতা-মাতা, স্বামী-ভাইদের হৃদয় নষ্ট করে দিয়েছে, সেটাই কখনও কাহিনি। কিন্তু যেই বানু একথা দেখাতে ভোলেন না যে, মেহ্রুন বাবা বা ভাইয়ের কত আদরের ছিল। তারই পাশে মেয়ে বলে তার কোনও নিজের স্বর না থাকার ও সেই বাবা ও ভাইয়ের পিতৃতন্ত্রের চাপে জীবন নষ্ট হয়ে যাওয়ার বৈপরীত্য এবার পাঠকের বিশ্লেষণের জন্য থাকে। কথক হিসেবে বানু কিছুই বলে দেন না। ফলে তাঁর লেখা ঝরঝরে, সহজ অনালংকৃত। কিন্তু লেখার বিষয় সোজাসাপটা চরিত্রের মেরুকরণ নয়, ধর্ম বনাম আধুনিক চেতনাও নয়। বরং অন্য কিছু। যেমন এই যে, গণ-খৎনায় ছাই দিয়ে রক্ত বন্ধ হয়ে সেরে উঠেছে বাড়ির কাজের মহিলার ছেলে আরিফ আর ডাক্তারের কাছে খৎনা নিয়ে সংক্রমণে ভুগছে বাড়ির ছেলে সামাদ— এর থেকে কি ভাবব, বানু হাতুড়ে পদ্ধতির গুণগান গাইছেন, না  দেখব, তিনি দেখাচ্ছেন খেটে খাওয়া মানুষের অদম্য প্রাণশক্তি? অন্যদিকে বাড়ির কর্তা লতিফ আহমদ গণখৎনার আয়োজন করে সওয়াব মিলে গেলেও খাবার ও টাকার জন্য খৎনা দেওয়া ছেলেকে বা সদ্যোজাত ছেলেকে খৎনায় নিয়ে আসা দরিদ্র মহিলাদের জন্য লতিফ আহমদের মন আর্দ্র হয়ে ওঠে, বানু এটাও দেখাতে চান। 

একলপ্তে আমাদের চেনাজানা নারীবাদেরর ছক না খুঁজে বরং বানু মুশতাকের লেখা থেকে নারীবাদের আর কী সংজ্ঞা তৈরি করা যেতে পারে তার একটা সুযোগ খুঁজে নেওয়া যেতে পারে। না হলে আবার মুসলমান পুরুষের ও ধর্মীয় সমাজের একটি স্টিরিওটাইপই আমরা দেখে উঠতে পারব খালি। যেখান থেকে আবার মুসলমান মেয়েদের উদ্ধার করার একটা জাতীয় উদ্দেশ্য তৈরি হতে পারে। বরং মনে রাখা যেতে পারে যে, একটা সমাজকে কীভাবে তার সামূহিক স্তরে বোঝা যেতে পারে, সেই চেষ্টা করাটাই তো সাহিত্য-পাঠের উদ্দেশ্য। সাহিত্য কথাটির মূলে আছে সহিতত্ব কথাটি— তাই না?