কলকাতা নাকি প্রাসাদনগরী। ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি। আমার ছোটবেলা কেটেছে টালাপার্ক অঞ্চলে। হিন্দু স্কুলে পড়তাম, তাই বেলগাছিয়া ট্রামডিপো ছিল, রোজকার যাতায়াতের পথ। ট্রামডিপোর উত্তরে পাঁচিল, আর গাছপালার আড়ালে, একটা বিরাট থামওয়ালা বাড়ি উঁকি দিত।
আমার দূর থেকে রোজ দেখা, প্রথম প্রাসাদ। তখন কীসের করিন্থিয়ান থাম, আর পেডিমেন্ট— কিছুই বুঝি না। অনেক পরে দেখেছি, সে বাড়ির বাইরে লেখা, ‘গোবিন্দবল্লভ পন্থ ছাত্রাবাস’। বোধহয় সরকারি বাড়ি বলেই, মাঝে-মাঝে রঙ হত; অন্তত বাইরে থেকে মোটামুটি পুরোনো চেহারাটা বজায় ছিল। কোনওদিন ভেতরে ঢোকার সাহস হয়নি।
আরও উত্তরে, আর-একটা একই ধরনের বাড়ি, সামনের রাস্তা (বেলগাছিয়া রোড) থেকে দেখা যেত, সবাই বলত ‘রাজবাড়ি’, আসলে নাম ‘ধূর্জটি ধাম’। চেহারাটা একটু মলিন, কিন্তু গাম্ভীর্যে বড় আকর্ষণীয়। এরই সামনের জায়গা অধিগ্রহণ করে, এখন বেলগাছিয়া মেট্রো স্টেশন হয়েছে, অটো স্ট্যান্ডের ভিড় কাটিয়ে, ভেতরের দিকে গেলে মূল বাড়িটা দেখা যায়। সাংবাদিকতা পেশার সূত্রে, পরে এই বাড়িতে ঢোকার সুযোগ হয়েছিল, তখন এর ইতিহাসও জেনেছি। এই দু’টি পাশাপাশি বাড়ি, প্রিয়লাল সেন ও নারায়ণকৃষ্ণ সেনের বাড়ি, যাঁরা বিখ্যাত ব্যাঙ্কার মথুর সেন পরিবারের শাখা।



এই সময়েই, অর্থাৎ ১৯৬০-এর শেষ এবং সাতের দশকের গোড়ার দিকে, কাছাকাছি এলাকায় আরও কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ বাড়ি দেখার সুযোগ হয়। একটা হল, দত্তবাগানের কাছে ঐতিহাসিক বেলগাছিয়া ভিলা বা দ্বারকানাথ ঠাকুরের বেলগাছিয়ার বাগানবাড়ি, যা কান্দি-পাইকপাড়ার সিংহরা পরে কিনে নেন, যেখানে মাইকেল মধুসূদনের ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটকের প্রথম অভিনয় হয়।
গল্পগুলো বাবার কাছে শোনা, আর বাবার হাত ধরেই প্রথম, বছর দশেক বয়সে, বাড়িটা দেখতে যাওয়া। বেলগাছিয়া রোড থেকে, এই বাড়ি যাওয়ার রাস্তাটা, দত্তবাগান থেকে মিল্ক কলোনি ঢোকার রাস্তার সামান্য দক্ষিণে। ঢোকার মুখে বাঁহাতে জীর্ণ গার্ড রুম, কিন্তু তার টোপরের মতো চুড়ো, আর সে চুড়োর গায়ে, মাছের আঁশের মতো নকশা, বইয়ে দেখা, ইউরোপীয় কাসলের চুড়োর কথা মনে পড়িয়ে দেয়।
বেশ খানিকটা গিয়ে বাড়িটা, পশ্চিমে মার্বেলের ফোয়ারার ভাঙা চেহারা একটু মনে আছে। কাঠের ঝিলমিল দেওয়া একতলার বারান্দায়, মার্বেলের মেঝে, তার কোণে পড়ে থাকা একটা ছোট্ট মার্বেলের টুকরো— আমার সে-দিনের মহার্ঘ সংগ্রহ ছিল। বাড়ির পুব আর পশ্চিমের মাঝে পোর্টিকো, তার দু’পাশে দুই মর্মর সিংহ। সবই তালাবন্ধ, তাই ভেতরে ঢোকার প্রশ্ন ছিল না। তবে পশ্চিমের হলঘরের দরজায়, নকশা করা কাচে নাক ঠেকিয়ে দেখেছিলাম, ভেতরে সারি-সারি বইয়ের আলমারি। আর বাড়ির পুবদিকটা দেখার মতো। অর্ধচন্দ্রাকৃতি ফাসাদ, সামনে নীচু সিমেন্টের রেলিং-ঘেরা অঙ্গন, কয়েক ধাপ সিঁড়ি পেরিয়ে উঠতে হয়। সেখানে খোলা আকাশের নীচে, সাজানো ছিল গাছের গুঁড়ির আকারে চেয়ার-টেবিল, কীসের তৈরি বুঝতে পারিনি। সামনে বিশাল খোলা মাঠ, তারপরে মিল্ক কলোনির সীমানা প্রাচীর।
ওই মাঠের জায়গায়, দ্বারকানাথের সময়ে, সাজানো পুকুর ছিল। মাঠের দক্ষিণে বেশ খানিকটা দূরে, পাঁচিলঘেরা আর-একটি বাড়ি, জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, ওখানেই রাজপরিবারের লোকেরা থাকেন। সে-বাড়িকে দূর থেকে মোটেও অভিজাত মনে হয়নি।



অনেক দিন পর্যন্ত, এই বাড়িটা পুরোনো চেহারায় টিকে ছিল। ১৯৮০-র গোড়ার দিকে যখন প্রথম আইসোলি-২ ক্যামেরায়, ছবি তোলার হাত পাকাচ্ছি, তখন পুব দিক থেকে, বাড়িটার একটা ছবি তুলেছিলাম। আস্তে-আস্তে বাড়িটা গোডাউন হয়ে উঠল, মার্বেলের ফোয়ারা আর সিংহরা, কিংবা উঠোনের ভারি-ভারি চেয়ার-টেবিলগুলো কোথায় কে জানে, উধাও হয়ে গেল; লাইব্রেরির চিহ্ন রইল না, আর চতুর্দিকে প্রায়, এ-বাড়ির গা-ঘেঁষে তৈরি হয়ে গেল, বাড়ির পর বাড়ি। পুবের মাঠেও বাড়ি হয়ে গেছে অনেকদিন। এখন আর তাকানো যায় না সে বাড়ির দিকে। ২০১৬-য় ‘ঠাকুরবাড়ির বাহিরমহল’ লেখার সময়ে, চিত্রা দেব দ্বারকানাথের বাড়ির পুরোনো ছবি খুঁজছিলেন, তখন তাঁকে সাড়ে তিন দশক আগের ছবিটা দিতে পেরেছিলাম। বইয়ে সেটা ছাপাও হয়।
বেলগাছিয়ার বাগানবাড়ি যেমন আমরা বাঁচাতে পারিনি, তেমনই রক্ষা পায়নি, বিটি রোডের উপর পাইকপাড়া রাজবাড়ি। এও ছোটবেলায় দেখা। কাকা রেলে চাকরি করতেন, কোয়ার্টার্স ছিল খগেন চ্যাটার্জি রোড (পুরনো গান ফাউন্ড্রি রোড) আর কাশীপুর রোডের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে একটা বহু পুরনো বাড়িতে।
আমাদের টালাপার্কের বাড়ি থেকে, রাজা মনীন্দ্র রোড দিয়ে, বিটি রোড হয়ে ‘লালাবাবুর গির্জা’ আর পাইকপাড়া রাজবাড়ি ডানহাতে রেখে, চিড়িয়া মোড় থেকে পশ্চিমে খগেন চ্যাটার্জি রোড ধরে হেঁটেই যেতাম কাকার বাড়ি। ‘লালাবাবুর গির্জা’ যে আসলে গ্রেট ট্রিগনোমেট্রিক্যাল সার্ভে বা জিটিএস টাওয়ার, সে-সব তখন জানতাম না, তবে গির্জা যে নয় এটুকু বুঝতাম।

এরই পুবে বিশাল জায়গা জুড়ে, পাইকপাড়া রাজবাড়ি, তখনই কেমন পোড়ো বাড়ির চেহারা। শুনেছিলাম, সরকার থেকে অনেকটা অংশই অধিগৃহীত, সেখানে পুলিশের কিছু অফিস, কোয়ার্টার্স আছে। বাইরে থেকে, এই বিরাট বাড়ির স্থাপত্য দাগ কাটার মতো ছিল না, শুধু একটা ঝুলবারান্দার কথা মনে আছে, যেটা রঙিন কাচে ঢাকা ছিল। ভেতরটা কেমন ছিল জানি না, এখন সেখানে বহুতল বিরাজ করছে। লালাবাবুর গির্জা অবশ্য এখনও আছে, সারিয়ে-টারিয়ে ভাল অবস্থায়, গায়ে তার বিবরণও লেখা দেখেছি। ‘লালাবাবু’র আসল নাম কৃষ্ণচন্দ্র সিংহ। পাইকপাড়া রাজবাড়ির এই সন্তান হঠাৎ, বিলাস-বৈভব ছেড়ে বৃন্দাবনে চলে যান, সে গল্প সুপরিচিত। তাঁর বাড়ির সামনেই অবস্থিত হওয়ার জন্য, জিটিএস টাওয়ারের নাম লোকমুখে হয়ে যায়, ‘লালাবাবুর গির্জা’।
কাকার কোয়ার্টার্সের কথা না বললে, একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বাড়ির কথাই বাদ থেকে যাবে। খগেন চ্যাটার্জি রোডের দিকটা ছিল, আদত বাড়ির পিছনদিক, ঢোকার দরজা সে-দিকেই, কারণ সামনেটা চিতপুর রেল ইয়ার্ডের দিকে। বস্তুত, ওটাই ছিল, রেল ইয়ার্ডের সীমা।
মামলা মোকদ্দমা, সরকারি হস্তক্ষেপ, কোনও কিছু করেই, এগুলি রক্ষা করা যায়নি। অনেকসময় কোনও আপত্তি ওঠার আগেই বাড়ি ভাঙা হয়ে গেছে, কাজেই প্রতিবাদ তখন, মান বাঁচানো ছাড়া আর কোনো কাজেই আসেনি।
বিশাল-বিশাল ঘর, খুব উঁচু সিলিং, জানালা-দরজা সবই আমাদের চোখে বেখাপ্পা রকমের বড়। গল্প শুনতাম, এই রেল ইয়ার্ডের সব জমিই নাকি আসলে ছিল কালীপ্রসন্ন সিংহের, এই এলাকার মধ্যে তাঁর বাড়িও ছিল, আর এই বাড়িটা ছিল কাছারিবাড়ি। কালীপ্রসন্ন সিংহের কাছারিবাড়িতে যাতায়াত করছি, এটা ছোটবেলার অন্যতম রোমাঞ্চকর ঘটনা ছিল, বলাই বাহুল্য। খুব সম্ভবত এই বাড়িতেই ছিল কালীপ্রসন্নের পুরাণ-প্রকাশ কার্যালয় (বইয়ে যার ঠিকানা কাশীপুর), যেখান থেকে প্রকাশ করেছিলেন অষ্টাদশপর্ব মহাভারতের অনুবাদ। এ-বাড়িও, অনেক দিন হল ভেঙে ফেলা হয়েছে।
এ তো গেল, অর্ধশতক আগের স্মৃতির কথা। বস্তুত, ১৯৯০-এর আগে-পরে কলকাতার তিনশো বছর নিয়ে হইচই শুরু হওয়ার পর, (যদিও মহামান্য আদালতের নির্দেশে এখন আর কলকাতার জন্মদিন বলে কিছু নেই) সরকারের টনক নড়ে এবং কমিটি তৈরি করে, হেরিটেজ চিহ্নিত করার কাজ আরম্ভ হয়।
কলকাতার হেরিটেজের দিকে সরকারি বা প্রাতিষ্ঠানিক নজর পড়তেই এত দেরি লেগেছে, যে সাধারণ মানুষজন বা স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি অর্থাৎ স্টেকহোল্ডারদের সচেতনতা বাড়ানোর কথা ১৯৮০-র দশকেও বিশেষ ভাবা হয়নি। এদিকে কিন্তু ‘দ্য স্টেটসম্যান’ পত্রিকার তৃতীয় পাতায়, ১৯৬৬-র জুন মাস থেকে, ডেসমন্ড ডয়েগের আঁকা কলকাতার ঐতিহ্যবাহী বাড়িঘরের ছবি ছাপা শুরু হয়, যা ৭৫ সপ্তাহ চলেছিল। পরে তার একাংশ বই আকারে প্রকাশিত হয়।


শিল্পী ব্রজগোপাল মান্নার আঁকা কলকাতার ছবিও, ১৯৬৯-এ ‘দ্য স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। ১৯৭০-এ ব্রজগোপাল আঁকেন তাঁর বিখ্যাত ‘কলকাতা স্কাইলাইন’। পরে রথীন মিত্র, সমীর বিশ্বাস ধারাবাহিকভাবে কলকাতার অজস্র ঐতিহ্যবাহী বাড়ির ছবি এঁকেছেন। এগুলো শহরের মানুষকে নিজের শহর চেনাতে, নিশ্চয়ই সাহায্য করেছিল। আর আজ, এ-সব ছবি তো ডকুমেন্টেশনের মর্যাদা পেয়েছে, কারণ ডয়েগ থেকে ধরলে গত ছয় দশকে, এর অনেকটাই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে! ডয়েগের ‘ক্যালকাটা অ্যান আর্টিস্টস ইমপ্রেশন’ বইয়ের পাতা উলটে দেখুন, চৌরঙ্গির পুরনো কন্টিনেন্টাল হোটেল কি লা মার্টিনিয়ারের রোটান্ডার মতো কটা ডোডোপাখি খুঁজে পান।


একদিকে যেমন হেরিটেজ চিহ্নিত করে, তার গুরুত্ব নির্ধারণ করে বিষয়টিকে আইনি বৈধতা দিতে প্রচুর সময় লেগেছে, এমনকী এখনও, তার বহু খুঁটিনাটি দিক নিয়ে বিতর্ক মেটেনি, তেমনই প্রথম থেকেই আঁচ পেয়ে, সক্রিয় হয়ে ওঠা প্রোমোটার ও অন্যান্য গোষ্ঠী, অসম্ভব দ্রুততায় তাদের স্বার্থ সিদ্ধি করতে ভুল করেনি। হেরিটেজ তকমা পেতে পারে, এমন সামান্য সম্ভাবনা থাকা বাড়িঘর রাতারাতি নিশ্চিহ্ন করে ফেলার বহু ঘটনা, চোখের সামনেই ঘটেছে। খুব বেশি করে মনে পড়ছে, আকাশবাণীর পুরনো ভবন (১ গার্স্টিন প্লেস), দ্বারভাঙা মহারাজার বাড়ি (৪২ জওহরলাল নেহরু রোড) যেখানে এখন বিখ্যাত হাইরাইজ ফর্টিটু, এবং চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউর উপর, মহম্মদ আলি পার্কের সামান্য দক্ষিণে, ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেনের জন্মভিটের কথা।
মামলা মোকদ্দমা, সরকারি হস্তক্ষেপ, কোনও কিছু করেই, এগুলি রক্ষা করা যায়নি। অনেকসময় কোনও আপত্তি ওঠার আগেই বাড়ি ভাঙা হয়ে গেছে, কাজেই প্রতিবাদ তখন, মান বাঁচানো ছাড়া আর কোনো কাজেই আসেনি।

মনে আছে, কেশবচন্দ্রের বাড়ি তখন ভাঙা হয়ে গেছে, কিন্তু সরকারের সঙ্গে মামলা চলার দরুণ পাঁচিলঘেরা জায়গাটা ফাঁকাই পড়ে আছে। এক সহপাঠী বন্ধুকে নিয়ে, দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম, উদ্দেশ্য কিছু ছবি তুলে রাখা। বাধা দেওয়ার মতো কেউ ছিল না। বিস্মিত হয়ে দেখলাম, অনেক মার্বেলের লিপিসহ কেশবচন্দ্রের আঁতুড়ঘর, লিপি দিয়ে চিহ্নিত পরিবারের বিভিন্ন জনের জন্মস্থান এবং চিতাভস্মের উপর নির্মিত বেশ কিছু স্মৃতিফলক, জমির বিভিন্ন অংশে ছড়ানো। যথাসম্ভব ছবি তোলা হল। সরকার মামলায় হেরে গেলে পরে, সেখানে একটি বহুতল তৈরি হয়েছে, তবে আদালতের নির্দেশে, কেশবচন্দ্রের জন্মস্থানটি বোধহয় সংরক্ষণ করা হয়েছে। অন্যান্য স্মৃতিচিহ্ন আদৌ রক্ষিত হয়েছে কিনা, আর দেখতে যেতে ইচ্ছে করেনি।