সাম্যের অধিকার

Represetative Image

এলিসা এসপোসিতো (স্যালি হকিন্স) ইশারার ভাষায় ভাব আদান-প্রদান করে। এক পূর্ণ নারী সে; কিন্তু তার জীবনে কোনও প্রেম নেই। তার বন্ধু কেবল দু’জন— সহকর্মী জ়েলডা (অক্টাভিয়া স্পেন্সার) আর প্রতিবেশী গিলস (রিচার্ড জেনকিন্স)। ১৯৬২ সালের ঠান্ডাযুদ্ধের সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোরের একটি গুপ্ত বিজ্ঞানল্যাবে, এলিসা ধোয়া-মোছার কাজ করত। সে মূক ও বধির। কেউ তার সঙ্গে মেশে না জ়েলডা ছাড়া। এই ল্যাবরেটরিতে একটি অর্ধ মানব-অর্ধ জলজ প্রাণীর মতো দেখতে জীব আনা হয়েছে কেটে পরীক্ষা করবার জন্য। অদ্ভুত ভাবে এলিসা আর এই জীবটির অজানা আদান-প্রদানে প্রেম তৈরি হয়। ২০১৭ সালে নির্মিত ‘দ্য শেপ অফ ওয়াটার’ ছবিতে পরিচালক গিয়েরমো ডেলতোরো আমাদের দেখান কীভাবে দু’জন ‘অপর’ মানুষ ভালবাসার বাঁধনে জড়িয়ে পড়তে পারে। সিনেমাটি কল্পকাহিনিমূলক। কিন্তু এর মধ্যে দিয়ে মূক ও বধির এলিসার বেদনা বাঙ্ময় হয়ে ওঠে। কোনও মানুষ না হোক, অজানা এক কিম্ভূত জীবই না হয় তার প্রেমাষ্পদ হল! অন্তত সেই জীব তো এলিসাকে তার প্রতিবন্ধকতার বাস্তব বোঝাবে না। এলিসা প্রতিবন্ধী বলে দূরেও ঠেলবে না। মানবিকতা ও অপরকে আপন করার এক অমূল্য দলিল ‘দ্য শেপ অফ ওয়াটার’ সিনেমা।


আরও পড়ুন: নির্মাণ শিল্পে কাজ করা অধিকাংশ মেয়েরা আজও কেন জোগাড়ে! সমাজের কোন রাজনীতিতে তাঁরা রাজমিস্ত্রি হলেন না? লিখছেন প্রহেলী ধর চৌধুরী…

এখন ‘প্রতিবন্ধী’ শব্দের পরিবর্তে সবাই চায় ‘বিশেষভাবে সক্ষম’, ‘বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন’ এসব লিখতে ও বলতে। এগুলো এখন আইনি পরিভাষা। বিশেষভাবে সক্ষম বলতে এটা চিহ্নিত হয় যে— কোনও ব্যক্তির আপাত অক্ষমতার মধ্যে কোথাও কিছু বিশেষ সক্ষমতা আছে। কিন্তু প্রশ্নটা তো কেবল সক্ষম-অক্ষমের নয়। একটি মানুষ প্রতিবন্ধী তখনই, যখন তার প্রতিবন্ধকতা রাষ্ট্র এবং সমাজ লালিত।

প্রতি বছর ৩ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস পালিত হয়। আমাদের শরীরের মধ্যে প্রতিবন্ধকতার সব বীজ উপ্ত থাকে। যে-কোনও সময়ে, যে-কোনও বয়সে একজন মানুষ প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে পারেন। আমরা প্রতিবন্ধী মানুষদের চিকিৎসাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে বরাবর দেখে এসেছি। প্রতিবন্ধকতা যার, সমস্যা যেন তার ব্যক্তিগত। আসলে তো তা নয়। প্রতিবন্ধকতা যদি সত্যিই সমস্যা হয়, তবে তা সমগ্র সমাজ ও রাষ্ট্রের। কথা উঠতে পারে— যে প্রতিবন্ধী নয়, তার সমস্যা কেন হবে? সে তো সক্ষম। যাকে ইংরেজিতে বলে ‘এবেলবডিড’। কিন্তু সমাজের সব প্রকরণ যে-মূহুর্তে শুধু ওই তথাকথিত সক্ষমদের জন্য নির্মিত হয়, তখন বুঝতে হবে গন্ডগোলটা আসলে সমাজেরই। আমাদের দেশে প্রতিবন্ধী বিষয়ে সচেতনতা এক সময়ে এই পর্যায়ে ছিল যে— মনে করা হত প্রতিবন্ধকতা আসলে ‘আগের জন্মের পাপের ফল’। কিংবা কেউ খারাপ কাজ করে থাকলে, ভগবান কুপিত হয়ে তাকে প্রতিবন্ধী বানিয়েছেন! তাকে দুর্ভোগের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। অসুবিধায় পড়তে হবে তার পরিবারকেও। রাষ্ট্র এবং সমাজের কোনও দায় নেই। কিন্তু যিনি দৃষ্টি-প্রতিবন্ধী, তিনি যদি পথঘাট চলতে, কাজকর্ম করতে আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য নিতে পারেন, চলাফেরায় যাঁর অসহায়তা বা অক্ষমতা আছে তাঁর ব্যবহৃত হুইলচেয়ারটি যদি কোথাও বাধাপ্রাপ্ত না হয়, কিংবা যিনি মূক ও বধির তাঁর সঙ্গে আশপাশের সকলে যদি ইশারার ভাষায় কথা বলে, তবে তথাকথিত প্রতিবন্ধকতা বলে কিছু আর থাকে না। কেবল গালভরা ‘বিশেষ ভাবে সক্ষম’ নাম না দিয়ে, প্রতিবন্ধকতার আসল জায়গাগুলির চিহ্নিতকরণ এবং সুরাহা যদি করা হয়, তাহলে প্রতিবন্ধী আর তথাকথিত ‘এবেলবডিড’ মানুষের মধ্যে সব রকম বৈষম্য ঘুচে গিয়ে সাম্য আসে। প্রতিবন্ধকতা একটা ধারণা মাত্র। পরিকাঠামোগত দিক থেকে দেশের উন্নয়ন হলে, প্রতিবন্ধকতা বলে কোনও জিনিসের অস্তিত্ব আর বজায় থাকে না।

ভারতে প্রতিবন্ধী অধিকার আইন আছে। ভারত সরকার প্রতিবন্ধী মানুষদের জন্য, বিশেষ ভাতার ব্যবস্থা রেখেছে। ভারতে শিক্ষা এবং সরকারি চাকরিতে প্রতিবন্ধী মানুষের সংরক্ষণও আছে। আপাতভাবে দেখলে মনে হয়, এ-দেশে যেন প্রতিবন্ধী মানুষদের জন্য সব রকম সুবিধা আছে। কিন্তু বাস্তবে তা ক্ষীণ। প্রথমত, কেন্দ্রীয় সরকার যে-অর্থের ভাতা দেয়, তা মারাত্মক নগন্য। সেই অর্থের সঙ্গে যুক্ত করে বিভিন্ন রাজ্যসরকার এক-এক রকম অর্থের ভাতা-ব্যবস্থা করে। এতে দেশের নানা প্রান্তের প্রতিবন্ধী নাগরিকদের জন্য ভাতার সাম্য তৈরি হয় না। কোনও-কোনও রাজ্যের প্রতিবন্ধীরা উপেক্ষিত হন। কেন্দ্রীয় ও রাজ্যসরকার সরকারি পরিবহনে, প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষিত আসন রেখেছেন। কিন্তু বাড়ি থেকে পরিবহণ অবধি— একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বা হুইলচেয়ার-ব্যবহারকারী মানুষ আসবেন কী করে তা ভেবে দেখা হয় না। শিক্ষা ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীরা ভীষণভাবে উপেক্ষিত। যদি একজন প্রতিবন্ধী মানুষ ন্যূনতম স্কুল কিংবা কলেজ-এর শিক্ষায় শিক্ষিত না হন, তবে কী করে তিনি সংরক্ষণ থাকলেও চাকরি পাবেন? আর চাকরিও যদি পান, তবে সেই আপিস কি প্রতিবন্ধী-বান্ধব হবে? যেখানে গোটা দেশটা স্থাপত্যের দিক থেকে তথাকথিত সক্ষমদের (‘এবেলবডিড’) জন্য তৈরি? এর সঙ্গে আরও কিছু বিষয় সংযোজিত হওয়া প্রয়োজন। প্রতিবন্ধী মানুষরা অনেকেই গৃহহিংসার বলি হয়ে থাকেন। বাইরে বেরিয়ে অর্থসংস্থান তো আছেই, সঙ্গে যদি বাড়ির মধ্যেও তাদের এত লড়াই লড়তে হয়, তবে তাঁরা যাবেন কোথায়? তথাকথিত সক্ষমদের যে-সামাজিক জীবন, তাতে কি একজন প্রতিবন্ধী মানুষ অংশগ্রহণ করতে পারেন? যদি পারেন, তাহলে একজন প্রতিবন্ধী মানুষের সঙ্গে আরেকজন প্রতিবন্ধী মানুষেরই কেন বিয়ে হয়? লিঙ্গযৌনতার দিক থেকে এ-দেশে একজন প্রতিবন্ধী মানুষ কতটুকু স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন? তাঁদের তো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মনে করা হয়— যৌনতাবিহীন মানুষ! বিসমকামী প্রতিবন্ধী মানুষ তা-ও যতটা পরিসর পান, একজন সমকামী-রূপান্তরকামী তথা সব রকমের প্রতিবন্ধী যৌনসংখ্যালঘু মানুষ কি কোনও স্বস্তিকর আশ্রয় পেতে পারেন?

ভারতে প্রতিবন্ধী অধিকার আইন আছে। ভারত সরকার প্রতিবন্ধী মানুষদের জন্য, বিশেষ ভাতার ব্যবস্থা রেখেছে। ভারতে শিক্ষা এবং সরকারি চাকরিতে প্রতিবন্ধী মানুষের সংরক্ষণও আছে। আপাতভাবে দেখলে মনে হয়, এ-দেশে যেন প্রতিবন্ধী মানুষদের জন্য সব রকম সুবিধা আছে। কিন্তু বাস্তবে তা ক্ষীণ।

এ-কথা ঠিক, এত সব অসুবিধার মধ্যেও এমন কোনও বিভাগ নেই, যাতে এ-দেশের প্রতিবন্ধী মানুষেরা সাফল্য পাননি। সবরকম চাকরি, ব্যবসা, শিল্পসাহিত্য, ক্রীড়া এমনকী রাজনীতিতেও তাঁরা নিজেদের উপস্থিতি জানান দিয়েছেন। যুগোপযোগী কোনও কাজে তাঁরা ব্যর্থ হননি। সাধারণ জীবনের পাশাপাশি আজ বহু প্রতিবন্ধী ইনফ্লুয়েন্সারদেরও আমরা দেখতে পাই। তাঁদের কেউই প্রতিবন্ধকতাকে বাধা মনে করেননি। রাষ্ট্র এবং সমাজ তাঁদের প্রতিবন্ধী, বিশেষভাবে সক্ষম কিংবা দিব্যাঙ্গ— যে-নামকরণই করুক, তাঁদের কিছু যায় আসে না। এগিয়ে যাবার পথ তৈরি করে নিতে তাঁরা যথেষ্ট ‘সক্ষম’। কিন্তু দেশ নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে কবে সচেতন হবে? রাষ্ট্রের সেই অক্ষমতা কাটবে কোনওদিন?