এ যুগের মুখ্য সাহিত্য ডিটেকটিভ সাহিত্য। অধিকাংশ পুস্তকই রকম-ফেরে ডিটেকটিভ পুস্তক— ডিটেকটিভ বা ভৌতিক বা রোমাঞ্চক অর্থাৎ থ্রিলার জাতীয় কিছু। স্বাভাবিক মানুষের কথায় মানুষের যেন আর আগ্রহ নাই। চোর, ডাকাত, খুনে, বাটপাড় বা ভৌতিক কিছু না হইলে মানুষের মুখে আর রোচে না। এমন হইবার কারণ কী? মাতালের রসনায় স্বাভাবিক মৃদু রস তেমন সাড়া জোগায় কি? কড়া ঝাল, কড়া টক, কড়া লবণাক্ত না হইলে মাতালের অসাড় জিহ্বা আর সাড়া দেয় না। অস্বাভাবিক অভ্যাসের ইহাই স্বাভাবিক পরিণাম।’
সত্যি করে বলুন তো, সাধু ক্রিয়াপদগুলো যদি একটু সরিয়ে নিই, এই লেখাটাকে আপনি একেবারে এই সময়ের উচ্চারণ বলে ভুল করবেন কি না? সেই এক রোগ, একই তার ডায়াগনসিস, এক প্রেসক্রিপশন। অথচ এসব লেখা হচ্ছে সেই দেশ স্বাধীন হওয়ার বছরে, লিখছেন প্রমথনাথ বিশী। বাঙালির লেখা আর পড়া, মৌন আর মুখরতা, মুঠোতোলা জিত কিংবা মলিন পরাজয়, সবই অব্যর্থ ভঙ্গিতে ধরা পড়ত তাঁর নিশানায়।
ছাত্রবয়স তাঁর কেটেছিল রবীন্দ্রসান্নিধ্যে, পুরাতনী শান্তিনিকেতনের গাছতলার পাঠচক্রে। সেখানেও তিনি নাকি ছিলেন ‘বিদ্রোহী’, সৈয়দ মুজতবা আলির জবানিতে। সে-বিদ্রোহ শুধুই যে নিকেতনী পোড়োদের দলের আবছা ব্যতিক্রম হয়ে থেকেছে, তা তো নয়, তাতে স্পষ্টতই মিশেছিল কিঞ্চিৎ ঔদ্ধত্য। সাহসের রকম ছিল এতই বেয়াড়া এবং তথাকথিত অশান্তিনিকেতনীয় যে, তাঁর অঙ্ক পরীক্ষার খাতা দেখতে গিয়ে তিতিবিরক্ত হয়ে সে-খাতা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের কাছে পেশ করতে বাধ্য হয়েছিলেন সেবারের পরীক্ষক নগেন্দ্রনাথ আইচ। কারণ, পরীক্ষায় খুব একটা সুবিধা করতে না পেরে ছাত্রটি সেখানে গোটা-গোটা অক্ষরে পদ্য ফেঁদে রেখেছেন— ‘হে হরি হে দয়াময়, কিছু মার্ক দিও আমায়/তোমার শরণাগত নহি সতত, শুধু এই পরীক্ষার সময়!’
নিজের ছেলেবেলার কথা রবীন্দ্রনাথের মনে পড়ে গিয়েছিল কি না জানি না, তবে তিনি নগেন আইচকে সে-যাত্রা বলেছিলেন, ‘ওকে অঙ্ক কষাতে চেষ্টা করো, কিন্তু কবিতা লিখতে বাধা দিও না। পরীক্ষার উদ্যত খাঁড়ার সামনে দাঁড়িয়ে কজনই বা এমন সরল স্বীকারোক্তি আর আত্মনিবেদন করতে পারে!’ অথচ এই রবীন্দ্রনাথই পরবর্তীকালে তীক্ষ্ণ সমালোচনার তলোয়ারে আগাপাশতলা আক্রমণ শানিয়েছেন তাঁর দিকে। অপরিণত মনের কল্পনাবিলাসে তাঁর যে-প্রশ্রয়ই থাক, যথাকালে সমানে-সমানে লড়াইয়ের সময়ে কনিষ্ঠকে মৃদু পিঠচাপড়ানি দিয়ে ভুলে যাওয়ার অবজ্ঞা তিনি দেখাননি। তাঁর ভালবাসায় আঘাত থাকতে পারে, অবহেলা তো ছিল না!

তবে প্রণয়ে কিংবা প্রত্যাখ্যানে বেহিসেবি গুরুভক্তির দক্ষিণা দেওয়ার প্রবণতা প্রমথনাথের ছিল না, এবং বলাই বাহুল্য, সে-যুগের শান্তিনিকেতনের নিরিখে এ একটা বেশ ব্যতিক্রমী ঘটনা। তখন তিনি শান্তিনিকেতনেরই ছাত্র। পড়শি গ্রাম সুপুরে বন্ধুরা অনেকে মিলে গেছেন রথযাত্রা দেখতে। কিন্তু রথ আর নড়ে না। প্রমথ বিশী তো আর নির্বাক দ্রষ্টা হয়ে বসে থাকার মানুষ নন। যে-মন নিয়ে শান্তিনিকেতনের আশ্রমে ছেলেবেলায় তিনি মেথরদের জন্য বরাদ্দ ডিমসেদ্ধ চুরি করে খেতেন নির্বিচারে, সেই একই দুর্নিবার অথচ সহজ সমাধানের পথ খেলে গেল তাঁর মাথায়। সেদিন ধানকল ফেরত সাঁওতালদের তিনি টেনে এনেছিলেন রথ টানার কাজে, তাঁদের হাতের দড়ির টানে গড়িয়েছিল পুণ্যরথের চাকা। কিন্তু গল্প এখানেই শেষ নয়। এই আশ্চর্য ঘটনার অভিঘাতে ‘রথযাত্রা’ নামে একটি নাটক লিখে ফেলেন প্রমথনাথ বিশী। উৎসাহী ছাত্রের লেখা পড়তে বসে, সে-লেখায় বেশ কিছু বদল করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ নিজে, সম্ভবত সংশোধনের স্বেচ্ছাপ্রত্যয়ী অধিকারেই। তারপর লেখা ফেরত দিয়ে ছাত্রকে বললেন, ‘প্রবাসীতে পাঠিয়ে দে।’ কিন্তু আত্মমর্যাদাজ্ঞান প্রখর ছিল প্রমথনাথের। প্রায় বদলে-যাওয়া নাটকের নবতর রূপটি ভাল করে পড়লেন প্রথমে, তারপর স্পষ্ট জানালেন, নিজের নামে এ-লেখা তিনি ছাপতে পাঠাতে পারবেন না। কারণ এতে আর তাঁর ‘নিজস্ব কিছু নেই’। রবীন্দ্র-সম্পাদনার সামান্যতম ছোঁয়া পেলে বর্তে-যাওয়া বাকি লিখনপ্রয়াসীদের ভিড়ে এই অদ্ভুত প্রত্যয়ী এবং অভিমানী ছাত্রটিকে কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সেদিন হাজার অনুরোধেও টলাতে পারেননি। শেষে প্রমথনাথের ঋণ স্বীকার করে রবীন্দ্রনাথের লেখকস্বাক্ষর-সহই ছাপা হয় এই ‘পরিবর্তিত’ নাটক, নাম হয় ‘রথের রশি’।

তাঁর নিত্যনতুন উৎকেন্দ্রিকতায় খানিক বিড়ম্বিত কি রবীন্দ্রনাথও হননি? নিজের স্মৃতিকথায় রোমন্থন করেছেন প্রমথনাথ নিজেই, একবার বাগানে হাঁটতে-হাঁটতে কুয়োতলার পাশে একটা গাব গাছ দেখিয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বলেন, ‘অশোক গাছ ভেবে লাগিয়েছিলাম, এখন দেখছি গাব গাছ। তোকেও তো অশোক গাছ ভেবে এনেছিলাম, হয়তো গাব গাছই।’ সত্যি বলতে কী, প্রমথনাথ বিশীর একেবারে আত্মজবানিতে এসব কথা ছাপার অক্ষরে লেখা না থাকলে, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের এমন কণ্টকাকীর্ণ রসিকতার অভ্যেস মেনে নেওয়াটা কঠিন হত। প্রমথনাথও অকারণ বশংবদ হওয়ার ধার ধারতেন না। তাই আশ্রমে ‘অচলায়তন’ নাটক অভিনয়ের সময়ে, চিত্রনাট্যের প্রয়োজনেই অভিনেতা রবীন্দ্রনাথকে যেখানে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলার কথা, সম্ভ্রমে আর সংশয়ে পিছিয়ে যায় সবাই। শেষপর্যন্ত ‘দূর ছাই, এ তো অভিনয় বৈ কিছু নয়’ ঘোষণা করে এগিয়ে যান সেই প্রমথনাথই, তাঁর অসংশয়ী হাতের শক্ত বাঁধনই পড়েছিল রবীন্দ্রনাথের হাতে।
এই সব বিদ্রোহ আর তার্কিক অবকাশের মধ্যেই কিন্তু ক্রমশ শুরু হয়ে গিয়েছিল তাঁর সাহিত্যজগতে প্রবেশপ্রচেষ্টার প্রথম লেখালিখি। একেবারে অল্পবয়সে ‘শিশু’ পত্রিকার দায়িত্ব যেমন তিনি পালন করেছেন, কিছুদিন পরে ‘শান্তিনিকেতন’ এবং ‘বুধবার’ পত্রিকার সম্পাদনার কাজও করেছিলেন। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘দেওয়ালী’ (১৯২৩) ছাপা হলে, তা প্রকাশও করেছিলেন তাঁর এই শান্তিনিকেতন আশ্রমেরই শিক্ষক জগদানন্দ রায়, যাঁর ক্লাসে একদা দুষ্টু ছাত্র প্রমথনাথের কপালে বেশ উত্তমমধ্যম জুটত। এমনই তার জের যে, স্বয়ং দ্বিজু ঠাকুর তাই দেখে ক্লাসের মধ্যেই জগদানন্দকে চিরকুট পাঠিয়েছিলেন, ‘গাধারে পিটিলে হয় না অশ্ব/অশ্ব পিটিলে হয় সে গাধা।’
অশ্ব বা অশ্বতর, কোনও শ্রেণিতেই উত্তীর্ণ-অনুত্তীর্ণ হওয়ার ধার অবশ্য ধারতেন না প্রমথনাথ নিজে। তাঁর প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর বেয়াড়া জীবন এসব তুচ্ছ শাসনে তাঁকে খুব একটা দমিয়ে রাখতে পারত না। পুজোর ছুটির আগে প্রতি বছর ছাত্ররা যে-‘আনন্দবাজার’ আয়োজন করে নানা পসরার মেলা বসাত, একবার সেখানেই প্রমথনাথের প্রত্যক্ষ মদতে খোলা হল ‘জাদুঘর’। সেখানে নাকি রামচন্দ্রের পাদুকা আর সীতাদেবীর চুলের প্রদর্শনী হচ্ছে! এমত ‘এক্সক্লুসিভ’ প্রদর্শনীতে টিকিটের ব্যবস্থা থাকবে না, তাও কি হয়! তা যুগপৎ উৎসাহী এবং সন্দেহপ্রবণরা টিকিটের মূল্যটুকু স্বীকার করে প্রদর্শনীতে উঁকি মেরে যে যার চক্ষু সার্থকও করেছিলেন; কারণ, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের জুতো আর তাঁর স্ত্রী সীতাদেবীর কয়েক গাছা চুল বেশ যত্ন সহকারেই সাজিয়ে রাখা ছিল ভেতরে! নির্বিবাদী একটা সহজ রসিকতার ছোঁয়া ছিল তাঁর চরিত্রের মজ্জাগত। সহপাঠীদের যথেচ্ছ জুটিয়ে এনে, আর তাদের ফুসলিয়ে নানারকম নিষিদ্ধ মজা করে শান্তিনিকেতনের স্থবির নিয়মের নিশুত হাওয়ায় চোরাগোপ্তা অন্তর্ঘাত ছড়িয়ে দিতেই যেন তাঁর আসা।

তাঁর এ-বিদ্রোহী স্বভাবটি পরেও বজায় ছিল বহুদিন। শান্তিনিকেতনের পাট শেষ করে তখন তিনি এমএ পড়ছেন, সবে প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়েছেন। দুর্দান্ত বিরোধীস্বভাব ছেলের সঙ্গে সাংঘাতিক তর্কাতর্কি হয় তাঁর বাবা নলিনীনাথের। জল গড়াল এতদূর যে, তিক্ত ক্ষোভে বাবা বাড়ি ছেড়ে চললেন স্টেশন অভিমুখে। যদিও পথেই তাঁকে মত বদলাতে হল। না, ছেলে এসে তাঁর মান ভাঙাননি মোটেই, অত নির্বিবাদীস্বভাব ছিলেন না প্রমথনাথ। কিন্তু তাঁর এমএ পরীক্ষায় বাংলায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়ার খবরটি সেই মুহূর্তেই বাবার কাছে আসে। ব্যাস, আর কাউকেই কিছু করতে হয়নি, নলিনীনাথ অচিরেই বাড়ি ফিরলেন, হাতে রাজশাহীর বিখ্যাত মিষ্টি রাঘবসাই। তবে পারিবারিক সম্পত্তির বিশাল উত্তরাধিকার বারবারই নানা অছিলায় অস্বীকার করেছেন প্রমথনাথ। বিপুল জমিদারির দিকে ফিরেও তাকাতেন না তিনি, ওই বিশাল প্রাসাদোপম বাড়ি ছেড়ে নির্মাণ করেছিলেন তাঁর মূর্তিমান বিরোধিতার স্থাবর স্থাপত্যপ্রতীক— বারো বিঘা জোড়া খড়ের বাংলো!
১৯৩৬ সাল থেকে প্রায় বছর দশেক রিপন কলেজে অধ্যাপনা করার পর বেশ কিছুদিন সাংবাদিকতা করেছেন, পরবর্তীকালে অধ্যাপনা করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েও। জর্জ বার্নার্ড শ-এর নাট্যাদর্শ মেনে তাঁরই প্রভাবে ‘জিবিএস’ নামের অনুকরণে নিজের নামটাকেও কেটেছেঁটে করে নিয়েছিলেন ‘প্র.না.বি.’। ব্যঙ্গাত্মক নাটক লিখতে গিয়ে সেই যে তিনি ‘প্রনাবি’ হলেন, আজও তাঁর বাঁকা ভ্রূকুটিভরা সমালোচনামূলক প্রবন্ধগুলির জন্য বাঙালি তাঁকে স্বীকৃতি দিয়েছে ‘প্রনাবি’ নামেই।
একটু বিদ্রুপঘেঁষা রসবোধের সঙ্গে অকৃপণ কল্পনার ওপরে চাবুক হাঁকড়ানো বাস্তববোধের মিশেল তাঁর গদ্যের অন্যতম চেনা স্বর। মহাকাব্যের বিরহ প্রসঙ্গ উত্থাপন করতে গিয়ে তিনি তাই নির্বিচারে লেখেন— ‘রামচন্দ্র সীতার স্বর্ণমূর্তি স্থাপন করিয়াছিলেন সত্য, কিন্তু তাঁহাকে ভোর ছয়টায় উঠিয়া রান্না করিতে হয় নাই, এবং গভীর রাত্রে বাড়ি ফিরিয়া ছিন্ন মশারি কৌশলে টানাইবার দুঃখ বহন করিতে হয় নাই। আমি যদি চিত্রকর হইতাম এবং বস্তুতান্ত্রিক চিত্রকর— তবে পত্নীবিয়োগবিধুর রামচন্দ্রের ছবি আঁকিতাম, তিনি গভীর রাত্রে মশারি টানাইবার ব্যর্থ চেষ্টা করিতেছেন।’


‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য় এক সময়ে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর ‘কমলাকান্তের আসর’। এমন নাম দেওয়ার জন্য সাহস দরকার নিশ্চিত, কিন্তু তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন চেনা কমলাকান্তের সঙ্গে লিখনসাযুজ্য বজায় রাখতে পারার ক্ষমতা। আপাতস্বাধীন দেশের বাস্তবতা আর বাঙালির হীনম্মন্যতার গ্লানি নিয়ে ঈষৎ হালকা চালে লেখা প্রবন্ধগুলো ‘সিরিয়াস রম্যরচনা’র অদ্বিতীয় নজির। এ ছাড়াও সাহিত্য সমালোচনা ও আলোচনামূলক প্রবন্ধগ্রন্থও প্রচুর লিখেছেন প্রমথনাথ বিশী, তার মধ্যে বেশ কয়েকটি রবীন্দ্রসাহিত্যবিষয়ক, সেগুলি আলাদা প্রণিধানের দাবিও রাখে। ‘রবীন্দ্র কাব্য প্রবাহ’, ‘রবীন্দ্র নাট্য প্রবাহ’, ‘রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্প’, ‘রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন’, ‘বাংলার কবি’, ‘বাঙালী ও বাংলা সাহিত্য’, ‘নানারকম’, ‘চিত্র চরিত্র’, ‘বিচিত্র উপল’— নানা স্বাদের ভাঁড়ার ভরপুর তাঁর লেখায়।
সমসাময়িক সাহিত্যিক বা সমালোচকদের মধ্যে তাঁর চরিত্রের একটি অবশ্য-উল্লেখ্য বিশেষত্ব, তাঁর রাজনৈতিক সক্রিয়তা। আজীবন কংগ্রেসি রাজনীতি করা গান্ধীবাদী নেতা প্রমথনাথ বিশী এককালে ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ বিধান পরিষদের সদস্য, ১৯৭২ সালে রাজ্যসভার সদস্য হিসেবেও নির্বাচিত হয়েছিলেন। নিজের এই দুই সত্তাকে নিজের বহু লেখাতেই পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দিতে ভালোবাসতেন তিনি— ‘প্রমথনাথ বিশী আবার লেখক নাকি? প্র-না-বি লেখে বটে তবে না লিখিলেই বোধ করি ছিল ভালো। আজকাল রাজসভায় বিদূষকের পদটা লোপ পাওয়াতে প্র-না-বি গণরাজের সভায় প্রবেশ করিয়াছে আর মাথার foolscap পাট করিয়া লইয়া তাহাতে সাহিত্য রচনা করিতেছে। লোককে কিছুতেই বুঝাইতে পারিলাম না যে প্রমথনাথ বিশীর সংক্ষিপ্ত রূপ প্র-না-বি। … মুখের চেয়ে মুখোস প্রবল হইয়া উঠিলে এমনি হয়— আর মুখ কদাচিৎ মুখোসের চেয়ে অধিকতর চিত্তাকর্ষক হইয়া থাকে। প্র-না-বি’র আড়ালে প্রমথনাথ বিশী অন্তর্হিত।’
নিজেকে নিয়ে এমন খরশান মশকরা করা সবার কর্ম নয়। শুধু লেখার পৃষ্ঠায় নয়, তাঁর রসবোধের নানা গল্প অ্যানেকডোটের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে আজও, চারপাশেই। কলেজ স্ট্রিট পাড়ার একটু নবীন সাহিত্যিকদের দলে ভিড়ে তিনি যখন জমাটি আসর বসাতেন মিত্র ও ঘোষের আড্ডাখানায়, অপেক্ষাকৃত বরিষ্ঠ সাহিত্যিকরা জনাকয়েক তখন নিয়মিত বসতেন এম সি সরকারের ঘরে। প্রমথনাথ বিশী এম সি সরকারের আসরের নাম দিয়েছিলেন ‘হাউজ অফ লর্ডস’ আর নিজেদেরটা, বলাই বাহুল্য, ‘হাউজ অফ কমন্স্’! সাধারণের এই মজলিশি দরবার ছেড়ে প্রমথনাথ বিশী চলে গেছেন বহুদিন, আজ তাঁর ১২৫ তম জন্মবর্ষ শুরু হল। তাঁর সুরসিক আত্মসমালোচনা আর ঋজু মর্যাদাবোধের ব্যতিক্রমী মিশেলে ভরপুর লেখার নজির বাংলা ভাষায় বেশ কম। তাই খুব বেশি চর্চাও তাঁকে নিয়ে হয় না। অবশ্য রবীন্দ্রসান্নিধ্য পাওয়া এতটা অরাবীন্দ্রিক বাঙালিকে জরিপ করার মতো বাঙালিই বা ক’জন আছে?