সংকেত ও সংলাপ

Representative Image

এনিওয়ান আপ ফর টক্স? যে লিখেছিল ফেসবুক ওয়ালে, সে হাতড়ে বেড়াচ্ছিল মানুষ। বোধ করি, সে আপাত-অস্থির। হাঁপ ধরেছে। অযুতনিযুত কথার বুদবুদে শ্বাস নিতে অপারগ। ‘একা একা কিছুদূর যাওয়া যায়। তারপর খুব ক্লান্তি লাগে। মনে হয়, কেউ পাশে থাকলে ভালো হতো।’ আসলে আমরা যত সভ্য হয়েছি, একা হয়েছি ততই। ঘোরঘন দুঃসময়ে চিৎকার করেছি। সাহায্য প্রার্থনা করেছি। অনির্দিষ্টের উদ্দেশে পাঠাতে চাইছি কোনও এসওএস কল।

ভাস্কর চক্রবর্তী ডায়েরিতে লিখছেন: Ugliest is; CRY FOR HELP। শেষ তিনটি শব্দের প্রতিটি অক্ষর বড় হাতের। অর্থাৎ যেন, একটি এসওএস সিগন্যালের প্রতিরূপ। সমগ্র মনুষ্যজাতির প্রতি অভিমান অথবা বিতৃষ্ণা থেকে এ-কথা লিখলেও, কেবলই চোখে লেগে থাকে ‘CRY FOR HELP’ এবং তার অন্তর্গত হাহাকার।

কিন্তু, এসওএস সিগন্যাল কী? সহজ কথায়, একটি মর্স কোড, যা একধরনের টেলিকমিউনিকেশন প্রক্রিয়া। ডট এবং ড্যাশ— দুইয়ে মিলে সৃষ্টি। ধরুন, কোনও জাহাজ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হলে, রেডিও মারফত যে সিগন্যাল পাঠিয়ে থাকে, তা-ই হল এসওএস। তিনটি ডট/তিনটি ড্যাশ/তিনটি ডট— এই ক্রম অনুযায়ী তৈরি। আন্তর্জাতিক মর্স কোড বলছে, তিনখানা ডটের অর্থ ‘S’ এবং তিনখানা ড্যাশ— ‘O’। ইংরেজি বর্ণমালার সঙ্গে কিন্তু কোনও যোগাসাজশ নেই। কিঞ্চিৎ ইম্যাজিনেশনের জন্য বলি, এসওএস সিগন্যালের চেহারাটি হল: . . . – – – . . .। শুনতে পেলেন নিশ্চয়ই? এইবার প্রশ্ন হল, টেলিকমিউনিকেশনের বর্ণমালায় এত এত সংকেত থাকতে শুধু ডট আর ড্যাশ কেন? যেহেতু এহেন কোডের অনুবাদ ও প্রেরণ— উভয়ই সম্ভব অতি দ্রুত।

আরও পড়ুন : ‘পঞ্চায়েত’ সিরিজ দেখায়, ক্ষমতার বৃত্তগুলো শুরু হয় নিজেদের পরিসর থেকেই!
লিখছেন আদিত্য ঘোষ…

১ এপ্রিল, ১৯০৫। আবিশ্বে, জার্মানিই প্রথম দেশ— বিপদ-সংকেত হিসেবে গ্রহণ করেছিল এসওএস সিগন্যাল। আরও তিন বছর পরে, অর্থাৎ, ১ জুলাই, ১৯০৮। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেল। প্রথম ব্যবহৃত হল কোথায়? ৩ জুন, ১৯০৯। কফি, তৈল-সামগ্রী এবং তামা বোঝাই করে, পর্তুগালের অ্যাজোস দ্বীপপুঞ্জের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিয়েছিল ব্রিটিশ জাহাজ স্লাভোনিয়া। যাত্রাপথের শেষপর্বে পৌঁছে, কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়ায় দিকভ্রষ্ট হল স্লাভোনিয়া। জাহাজের ক্যাপ্টেন, এ.জি. ডানিং সেই প্রথমবারের জন্য ব্যবহার করলেন— এসওএস সিগন্যাল! এ-ও এক ইতিহাস। পরদিন সকালে, উদ্ধারকাজে পৌঁছল দুটো সহকারি জাহাজ। বেঁচে ফিরল সকল যাত্রী ও কেবিন-ক্রু। স্লাভোনিয়া ডুবে গেল।

ওয়্যারলেস টেলিগ্রাফ নিয়ে ইতালিতে আয়োজিত ১৯০৩-এর একটি কনফারেন্সে এই এসওএস সিগন্যালকে জাহাজি সংকেত হিসেবেই মনে করা হয়েছিল। কিন্তু চলতি লব্জে যা ‘সেভ আওয়ার শিপ’, তা আদৌ এসওএস-এর পূর্ণাঙ্গ রূপ নয়, এমনকী, সেভ আওয়ার সোলস বলতেও এসওএস বোঝায় না, তা কালক্রমে স্পষ্ট হয়েছে। এই বার্তা আদতেই একটি ডিসট্রেস সিগন্যাল মাত্র।

যখনকার কথা বলা হচ্ছে, তখনও এসওএস কল কেবলই সংকেতমাত্র। শব্দ যুক্ত হয়নি। রেডিও ট্রান্সমিটার উন্নত হওয়া মাত্র, সেই সংকেত যেন ভাষা পেল। ১৯২৭ সালে, এসওএস সংকেতের সমতুল্য হিসেবে স্বীকৃতি পেল, ‘মেডে (Mayday)’ শব্দবন্ধটি। ব্যবহার, মূলত বিমান পরিবহণে। অনেক বছর আগেই এসওএস সংকেতের সঙ্গে মোলাকাত হয়েছে। ধরুন, ফিল্মমেকার জেমস ক্যামেরুনের ‘টাইটানিক’ কিংবা ক্রিস্টোফার নোলানের ছবি, ‘ডানকার্ক’— কমবেশি দেখেছি সকলেই। মনে পড়ে সেই সমস্ত ঐতিহাসিক এসওএস কল?

‘ডানকার্ক’ ছবির একটি দৃশ্য

তবে একবিংশ শতাব্দীতে এসে, আমাদের উদ্ধার করবে কে? চ্যাটজিপিটি? ডোনাল্ড ট্রাম্প? কোনও উত্তর-আধুনিক ঈশ্বর? ডায়াল করবে ১১২? মানুষ আপাতত হেবি কনফিউশনে।

মজার একটা গল্প বলি। একটি ছেলে ব্লাইন্ড ডেটে গেছে। যথারীতি মেয়েটিকে সে চেনে না। ছবিও দেখেনি কখনও। পৌঁছে দেখল, ছিপছিপে, সুন্দরী একটি মেয়ে অপেক্ষা করছে নির্দিষ্ট ক্যাফের টেবিলে। অথচ কথাবার্তা যত এগয়, ছেলেটি বুঝতে পারে, এ মেয়ে সেই মেয়ে নয়। যার সঙ্গে রাতভোর চ্যাট করেছে সে! এখন উপায়? ছড়িয়ে লাট করবে কি? সে স্মার্টফোনে টাইপ করে, এসওএস। এমার্জেন্সি কল! অমনি কোত্থেকে যেন গার্ডিয়ান এঞ্জেলের মতো হাজির হয় এক বন্ধু। কোনওক্রমে পালিয়ে বাঁচে।

বন্ধুর কথায় কথায় আব্বাস কিয়েরোসতামির একটি ছবির কথা বলি। ‘হোয়্যার ইজ দ্য ফ্রেন্ডস হাউজ’। আহমেদের বন্ধু, মহম্মদ রেজা ভীষণ বিপদে পড়েছে। রেজা প্রতিদিন স্কুলে আসে, অথচ সম্পূর্ণ করে না হোমটাস্ক। একদিন শ্রেণি-শিক্ষক বেজায় চটলেন। বললেন, আগামিকাল পুরো হোমটাস্ক চাই। নইলে স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেবেন। বাড়ি ফিরে আহমেদ দেখতে পেল, রেজা-র হোমওয়ার্কের খাতাটা ভুল করে সে নিজের সঙ্গে করেই এনেছে। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। কী বিষম বিপদ! মায়ের যাবতীয় বকুনি টপকে আহমেদ দৌড়তে শুরু করে। যেন একটা এসওএস কলের উত্তর দিতে, আহমেদ এলোপাথাড়ি খুঁজে বেড়ায় বন্ধুর বাড়ি। আমরা দেখব, বন্ধুর বাড়ির নাগাল আহমেদ পাবে না। সন্ধেবেলা ঘরে বসে বন্ধুর খাতায় অঙ্ক কষে দেবে সে নিজেই। দরজার ওপার থেকে আশ্চর্য একটা হাওয়া এসে লাগবে আহমেদের মুখে। তারপর সেই খাতায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যাবে হলুদ রঙের বুনোফুলের মায়া।

‘হোয়্যার ইজ দ্য ফ্রেন্ডস হাউজ’ ছবির দৃশ্য

বন্ধুর কথায় কথায় আব্বাস কিয়েরোসতামির একটি ছবির কথা বলি। ‘হোয়্যার ইজ দ্য ফ্রেন্ডস হাউজ’। আহমেদের বন্ধু, মহম্মদ রেজা ভীষণ বিপদে পড়েছে। রেজা প্রতিদিন স্কুলে আসে, অথচ সম্পূর্ণ করে না হোমটাস্ক। একদিন শ্রেণি-শিক্ষক বেজায় চটলেন। বললেন, আগামিকাল পুরো হোমটাস্ক চাই। নইলে স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেবেন। বাড়ি ফিরে আহমেদ দেখতে পেল, রেজা-র হোমওয়ার্কের খাতাটা ভুল করে সে নিজের সঙ্গে করেই এনেছে।

সেই হাওয়া অথবা রঙের ছোঁয়া দুর্লভ। যৌথতার পাঠ আমাদের চুকে-বুকে গেছে বহুদিন। দশ বছর আগে বিপদে পড়ামাত্র কত মানুষ জড়ো হয়েছিল আপনার পাশে— সেই জাতীয় নস্টালজিক কচকচানিতে যাচ্ছি না। কারণ, এই মুহূর্তে সম্মিলিত এমার্জেন্সির তুলনায় ইন্ডিভিজুয়াল এমার্জেন্সি বাজারে ট্রেন্ডিং। দেখলাম, গার্হস্থ্য হিংসার আর্তনাদ নিয়ে পালিয়ে এসেছিল যে মেয়েটি, পাড়ার মোড়ে দাঁড়িয়ে দারুণ চিৎকার করল। চেয়ে চেয়ে দেখল পাড়ার মাতব্বররা, খুব বেশি এগিয়ে গেল না কেউ। মশাই, এসওএস সিগন্যাল কি ভোঁতা হয়েছে? মনে হয়, দারুণ একা বাঁচতে শিখেছি আমরা। দারুণ হয়েছে আমাদের ফ্রেন্ডলিস্ট কিংবা ফলোয়ার সংখ্যা। কোনও মাঝরাত্তিরে, মানুষ হাতড়ে হাতড়ে ন’বছরের তামান্না খাতুন দুঃস্বপ্নে হানা দেয়। একটা প্যালেস্তিনীয় কিশোর, যে লেখক হতে চেয়েছিল, ওর মৃত আত্মার সঙ্গে দেখা হয় আমার। প্রতি শুক্রবার স্কুল ছুটি নিয়ে সুইডিশ পার্লামেন্টের সামনে বসে থাকেন গ্রেটা থুনবার্গ। হাতে প্ল্যাকার্ড। স্কুল স্ট্রাইক ফর ক্লাইমেট। আরজি কর হাসপাতালে যে মেয়েটিকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছিল, কোনও এসওএস সিগন্যাল পাঠাতে চেয়েছিল সে?

লেখাটা কেমন এক মুহূর্তে কেমন ঘেঁটে ঘ। মিনেসোটার রাস্তায় পুলিশ অফিসার ডেরেক শভিন হাঁটু দিয়ে চেপে ধরে আছেন জর্জ ফ্লয়েডের মাথা। মামা, আই কান্ট ব্রিদ! আই কান্ট ব্রিদ!

এইগুলো আসলে একটা রাজ্যের, একটা দেশের, একটা গ্রহের, একটা সময়গ্রন্থির এসওএস সিগন্যাল। সাড়া দাও? উদাসীন থেকো না, সাড়া দাও!