স্বাধীনতা হীনতায়…

Ibrahim Traore

গোটা জুলাই মাস জুড়ে পারি শহরে চলে উৎসব। সিনেমা, নাটক, নাচ থেকে শুরু করে পপ-রক-ইলেক্ট্রো সমস্ত ঘরানার গানের লাইভ অনুষ্ঠান, অপেরা, সার্কাস, সংগ্রহশালাগুলো জুড়ে ছবির প্রদর্শনী। সঙ্গে ‘ত্যুর দ্য ফ্রাঁস’-এর মতো পৃথিবীবিখ্যাত সাইক্লিং প্রতিযোগিতা। কীসের জন্য এত আয়োজন? ফ্রান্সে জুলাই-আগস্ট দু’মাস বন্ধ থাকে স্কুল-কলেজ। গরমের ছুটির এই মরশুমে গোটা ফ্রান্স তো বটেই, সারা পৃথিবীর মানুষ এসে জড়ো হয় দক্ষিণে ভূমধ্যসাগরের নীল জলের পাশে ছোট ছোট গ্রাম, জনপদ, শহরে। চলে গ্রীষ্মাবকাশের ফুর্তি। 

দ্বিতীয় কারণ, ১৪ জুলাই। বাস্তিল দিবস। ফরাসি বিপ্লবের বর্ষপূর্তি। ১৭৮৯ সালে এই দিন ফ্রান্সের জনতা বাস্তিল দুর্গ দখল করে রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্ত করে। রাজতন্ত্রর অবসান হয়। প্রথম প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা ঘটে। ইউজিন দেলাক্রোয়ার বিখ্যাত তেলরং ছবির লিবার্টি, হাতে লাল পতাকা নিয়ে মানুষকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে। যে বিপ্লবের ফসল ফ্রান্সের প্রজাতন্ত্রের মূল মন্ত্র— ‘লিবের্তে-এগালিতে-ফ্রাতেরনিতে’। স্বাধীনতা-সাম্য-সৌভ্রাতৃত্ব। 

কথাগুলো শুনতে বড় ভাল লাগে। 

আরও পড়ুন: জরুরি অবস্থার শেষের সেই অত্যাশ্চর্য মিছিল আজও ভোলা যায় না!
লিখছেন মৃদুল দাশগুপ্ত…

আজও পারির রাস্তাগুলো প্রতি বছরের মতোই জাতীয় পতাকায় সেজে উঠেছে। সামরিক বাহিনীর কুচকাওয়াজ শেষ। সারা দেশ জুড়ে ব্যাঙ্ক বন্ধ। রাষ্ট্রীয় ছুটি। রাস্তায় রাস্তায় মানুষের ঢল। টিভি-মিডিয়া সর্বত্র নীল-সাদা-লাল তেরং পতাকা আর প্রজাতন্ত্রের জয়গান, প্রেসিডেন্টের ভাষণের লাইভ সম্প্রচার, নেতাদের মুখে স্বাধীনতা আর ভ্রাতৃত্ববোধের উচ্চারণ… আর ঠিক এই সময়ে ফ্রান্স থেকে সামান্যই দূরে, আফ্রিকায়, ফ্রান্সের প্রাক্তন উপনিবেশগুলোতে এই শব্দগুলোই হয়ে দাঁড়িয়েছে বিশ্বাসঘাতী। 

ফ্রান্স তার বিপ্লবের ঐতিহ্য নিয়ে গর্ব করতেই পারে। কিন্তু ফ্রংকোফোন আফ্রিকা বা ফরাসিভাষী আফ্রিকার অধিকাংশ মানুষের চোখে এখন তার কোনও মূল্য নেই। প্রাক্তন এই উপনিবেশগুলো খাতায়-কলমেই স্বাধীন। আজও তারা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা পায়নি। সাম্য সেখানে কোনওদিনও ছিল না। ভ্রাতৃত্ব এসেছে শুধুই আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সুচতুর মুখোশ হয়ে। 

যে ফ্রান্স অভিজাততন্ত্রকে উপড়ে দিয়ে ক্ষমতাকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে শিখিয়েছিল, সেই ফ্রান্স-ই আফ্রিকায় উপনিবেশ গড়ে লুটপাট, একতরফা শাসন আর বর্ণবাদী আইন চালু করেছে। স্বাধীনতার পরেও উপনিবেশগুলো ছেড়ে চলে যায়নি। বরং কৌশল বদলেছে। ঘনিষ্ঠ সরকারদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে সামরিক ঘাঁটি বানিয়েছে। দীর্ঘ বছর যাবৎ এই ব্যবস্থা কার্যকর রাখতেও পেরেছে। আজ সেই কাঠামো ভেঙে পড়ছে। 

বুরকিনা ফাসো-র কথাই ধরা যাক। ২০২২ সালে, মাত্র ৩৪ বছর বয়সে ক্ষমতায় আসা ক্যাপ্টেন ইব্রাহিম ত্রাওরে এখন ‘ফ্রাঁসাফ্রিক’-এর সবচেয়ে কড়া সমালোচক। তাঁর ভাষণগুলো আগুন ধরিয়েছে জনতার বুকে। ত্রাওরে হয়ে উঠেছেন প্যান-আফ্রিকান জাতীয়তাবাদের প্রতীক। শুধু আফ্রিকা নয়, সারা পৃথিবীর মানুষ শুনতে চাইছেন তাঁর কথা। 

‘একজন দাস, যে লড়াই করে না, সে অনুগ্রহের যোগ্য নয়।’ 

ত্রাওরে দেশের মাটিতে ফ্রান্সের অনধিকার উপস্থিতির জবাব দিয়েছেন। ফরাসি সেনাদের বহিষ্কার করে ছেড়েছেন। ফ্রান্সের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা গ্রেপ্তার হয়েছেন। ফরাসি বিপ্লবের যা মূল প্রতিপাদ্য ছিল, সেই সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার বাণী বারবার প্রশ্নের মুখে বিদ্ধ করেছেন ত্রাওরে। পৃথিবী জেনেছে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নাম করে ফ্রান্স কীভাবে আফ্রিকার সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ করেছে শুধু নিজের স্বার্থরক্ষার কথা ভেবে। ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রঁ-কে ত্রাওরে সরাসরি অভিযুক্ত করেছেন আফ্রিকান মানুষদেরকে অবমাননার দায়ে। ‘আমরা তাঁর চোখে মানুষ নই।’ 

ফরাসি ভাষার ক্রমাগত প্রচারের মধ্য দিয়ে আফ্রিকায় ফ্রান্স যেভাবে ‘সফ্ট পাওয়ার’ বা সাদা চোখে ধরা পড়ে না, এমন পেলব অথচ শক্তিশালী ক্ষমতার চাতুরি দেখিয়েছে, ত্রাওরে তাকেও আক্রমণ করেছেন। ভাষা আর সংস্কৃতির কূটনৈতিক আগ্রাসন রুখতে ত্রাওরে বুরকিনা ফাসো-তে ‘রেডিও ফ্রান্স ইন্টারন্যাশনাল’ এবং ‘ফ্রাঁস-২৪’-কে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছেন। এই জয় যে কোনও সাম্রাজ্যবাদী দেশের বিরুদ্ধে যে কোনও উপনিবেশের জয়। 

রাষ্ট্রসংঘ (ইউনাইটেড নেশন্স)-র সাধারণ সমাবেশে সকলকে চমকে দিয়ে ত্রাওরে বলছেন— ‘আজ সকলের মুখোশ খুলে দেওয়ার দিন। আমি ইব্রাহিম ত্রাওরে, যাকে আপনারা  একজন অপরিণত জুন্টা নেতা, একজন বিপজ্জনক মৌলবাদী, একজন পাশ্চাত্য সভ্যতাবিরোধী স্বৈরতান্ত্রিক শাসক হিসেবে তকমা দিয়ে দিয়েছেন, আজ আমি সত্যি কথা বলতে এখানে এসেছি। আজ আপনারা আমার মাইক বন্ধ করে দিতে পারবেন না, ক্যামেরা ঘুরিয়ে দিতে পারবেন না অন্যদিকে, এডিট করে বাদ দিতে পারবেন না আমার কোনও কথা। কারণ আপনাদের মোনোপলির দিন শেষ… 

…আমার চৌত্রিশ বছর বয়স। জীবনের প্রতিটা দিন আমি আপনাদের মিথ্যে শুনে বড় হয়েছি। ছোটবেলায় টিভির পর্দায় আফ্রিকাকে দেখতাম। সবসময় সেই একই ছবি। শিশুদের ঘিরে ভনভন করছে মাছি, খরায় ফাটা জমি, অস্ত্র, মৃত্যু। এই হচ্ছে আফ্রিকা। ওরা বলেছিল আমাদের। আমরা বিশ্বাস করেছিলাম। আমরা নিজেদের দেখে লজ্জা পেতে শিখেছিলাম। নিজের দেশ, নিজের মানুষদের দেখে লজ্জা পেতে শিখেছিলাম। কিন্তু তারপর আমি বড় হলাম। পড়তে শুরু করলাম। খুঁজতে শুরু করলাম। প্রশ্ন করতে থাকলাম। এবং বুঝতে পারলাম, যে, আফ্রিকাকে আপনারা আমাদের দেখিয়ে চলেছেন, তা আসল আফ্রিকা নয়। যে আফ্রিকার গল্প আপনারা শোনাচ্ছেন তা মিথ্যে… একটা মনগড়া চিত্রনাট্য, যেটা আপনারা আপনাদের দর্শকদের কাছে বিক্রি করছেন। যেন আমরা এমন কতগুলো জীব, যারা মানুষের পর্যায়ে পড়ি না। যেন আমরা সভ্যতার বাইরের কতগুলো বুনো জংলি। যেন আমরা কতগুলো ভিখারি, যারা অপেক্ষা করে আছি কবে আপনারা এসে আমাদের বাঁচাবেন। 

…আপনাদের ডিকশনারিতে আফ্রিকাকে নিয়ে শুধু খিদে, সন্ত্রাস, যুদ্ধ, মৃত্যু, বিশৃঙ্খলা— এইসব শব্দই রয়েছে। আশা নেই, সাফল্য নেই, উন্নয়ন নেই, প্রতিরোধ নেই, সম্মান নেই, আত্মমর্যাদা নেই, জয় নেই। তাই আমি আপনাদের জিজ্ঞেস করছি আজ— ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’, ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’, ‘গার্ডিয়ান’, ‘ল্য মন্দ’— আপনাদের জিজ্ঞেস করছি— আপনারা কখনও আফ্রিকাকে নিয়ে কোনও ভাল প্রতিবেদন করেছেন? কতবার আপনাদের শিরোনামে রোয়ান্ডার প্রযুক্তির কথা উঠে এসেছে? কতবার আপনারা ইথিওপিয়ার অরণ্যায়ন প্রকল্পের কথা লিখেছেন? কতবার আপনারা বতসোয়ানার গণতন্ত্র সম্পর্কে প্রশংসা করেছেন? কতবার আপনারা কিনিয়ার বাস্তুতন্ত্র উদ্যোগ নিয়ে লিখেছেন? একবারও না। কারণ তাহলে আপনারা আফ্রিকাকে শুষে নেওয়াটা বৈধ করবেন কী করে!”

এই সেই ফ্রান্স? ভলতেয়ার, রুশো, মঁতেস্কিয়, দিদেরো-র ফ্রান্স? যে ভলতেয়ার চার্চ আর রাষ্ট্রের তীব্র সমালোচনা করতে শিখিয়েছিলেন, যে রুশো ব্যক্তি অধিকার নিয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন করেছিলেন, যে মঁতেস্কিয় আইন আদালত থেকে সরকারের ক্ষমতাকে আলাদা করার কথা বলেছিলেন? যাঁদের লেখা পড়ে ফ্রান্সের মানুষ দুর্নীতি আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে জনরোষ গড়ে তুলতে পেরেছিল, শিখেছিল বৈধ সরকার হবে শাসিতের সম্মতির ভিত্তিতে। মিরাবো, যাঁর বক্তৃতা মানুষকে তাতিয়ে দিত, মারা, যাঁর লেখা পড়ে বিপ্লবীরা উদবুদ্ধ হতেন, সেই মিরাবো, মারা-র ফ্রান্স? 

‘দস‍্যু-পায়ের কাঁটা-মারা জুতোর তলায়
বীভৎস কাদার পিন্ড
চিরচিহ্ন দিয়ে গেল তোমার অপমানিত ইতিহাসে’

ত্রাওরের এই ভাষণ থেকেই জানা যায় যে কোবাল্ট, প্লাটিনাম, সোনা, হিরে, ইউরেনিয়াম— আজকের সভ্যতার জন্য সবচেয়ে দামি প্রতিটি কাঁচামাল আসে আফ্রিকা থেকে। অথচ আফ্রিকার মানুষ খেতে পায় না, তাদের ঘরে আলো নেই। কেন আফ্রিকাকে গরিব করে রাখা হচ্ছে? 

‘উত্তর এটাই যে, উপনিবেশবাদ শেষ হয়নি। শুধু চেহারা পাল্টেছে। আগে আপনার এসে আমাদের জমি দখল করতেন। এখন আসেন বাণিজ্যিক কোম্পানির রূপ ধরে।  আগে আপনারা জোর খাটাতেন। এখন আপনারা চুক্তি করেন। আগে শাসন করতেন অস্ত্র দিয়ে। এখন করেন ঋণ দিয়ে…

…আপনারা রেললাইন রাস্তা বানিয়েছেন। শুধু খনি থেকে বন্দর অবধি। গ্রামের ভেতরের মানুষের জন্য নয়। আপনারা প্রত্যেকে এই সিস্টেমের অংশীদার। কিন্তু চুপ করে থাকার দিন শেষ।’

ফ্রান্সের সিএফএ ফ্রাঁ মুদ্রা চালু রয়েছে আফ্রিকার চোদ্দটা দেশে। ২১০ মিলিয়ন মানুষ এই মুদ্রা ব্যবহার করে। যাকে বলা চলে, ‘কলোনিয়াল কারেন্সি’। এই দেশগুলোর অর্ধেক রাষ্ট্রীয় রিজার্ভ জমা হয় ফ্রান্সের কোষাগারে। এই টাকার ওপর ফ্রান্স ঋণাত্মক সুদ লাগু করে। ফলে নিজেদের টাকা নিজেরা খরচ করতে চাইলে ফ্রান্সকে টাকা দিতে হয়। এই সিস্টেমের সুবিধে কাজে লাগিয়ে প্রতি বছর ফ্রান্স আফ্রিকা থেকে ৫০০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের সম্পদ পাচার করে। 

২০২৩ সালে বুরকিনা ফাসো হাত মেলায় মালি এবং নাইজের-এর সঙ্গে। তৈরি হয় সাহেল স্টেটস। এই তিনটি দেশই সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা হাতে নিয়েছে। নিজেদের সার্বভৌমত্ব বজায় রাখার জন্য এরা পরস্পরকে সাহায্য করতে প্রতিশ্রুত হয়েছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে সাহেল স্টেটসরা ইকোওয়াস (ECOWAS) থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছে। অর্থাৎ, পশ্চিম আফ্রিকান রাজ্যগুলোর অর্থনৈতিক জোট থেকে তারা এখন মুক্ত। এই তিনটি দেশই একদা ফ্রান্সের উপনিবেশ ছিল। এবং আজ তারা ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক ক্ষমতার হাত থেকে সম্পূর্ণ বেরিয়ে আসতে চাইছে। বুরকিনা ফাসোর স্থিতিশীলতা বারবার নষ্ট করতে চেয়েছে ফ্রান্স। ২০২৩ সালে বুরকিনা ফাসো ফ্রান্সের দ্বিগুণ করচুক্তি বাতিল করেছে। ফ্রান্স বিপুল অর্থের পণ্য রপ্তানি করেছে এতদিন বুরকিনা ফাসোতে। কিন্তু বদলে ফ্রান্সকে তার মাত্র এক দশমাংশ মূল্যের পণ্য রপ্তানি করতে পেরেছে বুরকিনা। এই বাণিজ্যও এখন বন্ধ। 

এই সেই ফ্রান্স? ভলতেয়ার, রুশো, মঁতেস্কিয়, দিদেরো-র ফ্রান্স? যে ভলতেয়ার চার্চ আর রাষ্ট্রের তীব্র সমালোচনা করতে শিখিয়েছিলেন, যে রুশো ব্যক্তি অধিকার নিয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন করেছিলেন, যে মঁতেস্কিয় আইন আদালত থেকে সরকারের ক্ষমতাকে আলাদা করার কথা বলেছিলেন? যাঁদের লেখা পড়ে ফ্রান্সের মানুষ দুর্নীতি আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে জনরোষ গড়ে তুলতে পেরেছিল, শিখেছিল বৈধ সরকার হবে শাসিতের সম্মতির ভিত্তিতে। মিরাবো, যাঁর বক্তৃতা মানুষকে তাতিয়ে দিত, মারা, যাঁর লেখা পড়ে বিপ্লবীরা উদবুদ্ধ হতেন, সেই মিরাবো, মারা-র ফ্রান্স? 

ফ্রান্সের সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়ানো বুরকিনা ফাসোকে দেখলে ব্রিটেনের ঔপনিবেশিকতার ক্ষতচিহ্নগুলো টাটিয়ে ওঠে। দুশো বছরের অত্যাচারের স্মৃতি চিৎকার করে ওঠে। যার মাশুল আজও দিয়ে চলেছি আমরা, ভারতের মানুষ। 

কিন্তু সমস্যার সহজ সমাধান নেই। সাহেল স্টেটের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক ক্রমশ শক্ত হচ্ছে। তিরিশ বছর পর বুরকিনা ফাসো-তে বন্ধ হয়ে যাওয়া রুশ দূতাবাস ফের খুলেছে। আপাতত কোনও রাজনৈতিক শর্ত ছাড়াই রাশিয়া সামরিক সহায়তার কথা বলেছে। শুধু রাশিয়াই নয়, চিন, তুরস্ক এবং উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গেও বিনিয়োগ, পরিকাঠামো এবং সামরিক সাহায্যের সম্পর্ক গড়ে উঠছে এই তিন দেশের। শিক্ষাগত মাধ্যম হিসেবে ফরাসি ভাষা এখনও রয়ে গেছে এখানে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে তার কর্তৃত্ব নিয়ে, নৈতিকতা নিয়ে। আফ্রিকার অভিজাত সম্প্রদায় চেষ্টা করছে স্থানীয় ভাষাকে ভবিষ্যতে ফরাসির বদলে কাজের ভাষা হিসেবে যাতে প্রতিষ্ঠা করা যায়। এই ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মধ্যেই আফ্রিকার নেতারা প্যারিস শীর্ষ সম্মেলন বয়কট করেছেন। 

ফ্রান্স নিজে এই পরিস্থিতিকে কীভাবে দেখছে? আফ্রিকায় ফরাসি সৈন্যের বদলে রুশ সৈন্যের উপস্থিতি নিয়ে ফ্রান্স যথেষ্ট অস্বস্তি ও উদ্বেগে রয়েছে। ফরাসি মিডিয়া ও শিক্ষাবিদদের বহিষ্কার সাংস্কৃতিক সংকট তৈরি করেছে। প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁ যেভাবে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছেন এই মুহূর্তে, তা বড় বেশি দেরি হয়ে গিয়েছে বলে মনে করছেন ফ্রান্সেরই অভ্যন্তরীণ রাজনীতিবিদেরা। রক্ষণশীল ডানপন্থীদের চোখে ত্রাওরে বিপজ্জনক। বামপন্থীরা মনে করছে, ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক ভূমিকার দোষ স্বীকার করে এই দেশগুলোর সার্বভৌমত্ব মেনে নেওয়া প্রয়োজন, কিন্তু একইসঙ্গে জুন্টা সরকারের সমালোচনা করাও দরকারি। আফ্রিকান অভিবাসী আর শিক্ষার্থীদের প্রতি সাধারণ ফরাসি নাগরিকদের উদাসীনতা এবং অসহযোগিতা বাড়ার আশংকা দেখা দিচ্ছে। 

ফ্রান্সের ইমেজ সারা বিশ্বের সামনে যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তাতে ফ্রান্স যদি নিজে এই সমস্ত দ্বিচারিতা আর ভন্ডামির দায় স্বীকার না করে, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও স্বচ্ছতার বিষয়ে উদ্যোগ না নেয়, তাহলে ১৪ জুলাই দিনটি ক্রমশ তার গৌরব আর মহিমা হারাবে। মানুষ এরপর বিদ্রুপ করবে এই দিনের প্রসঙ্গ এলে। বাস্তিল দিবস ছিল স্বৈরাচার থেকে মুক্তির প্রতীক। স্বাধীনতা, সাম্য, সৌভ্রাতৃত্বের মতো শব্দগুলোর ধারক বাহক হিসেবে নিজেকে আবার প্রতিষ্ঠা করতে হলে এই বৈপরীত্য থেকে মূল্যবোধ আর মানবতার দিকে যেতে হবে ফ্রান্সকে। বিশ্বরাজনীতির ক্রমপরিবর্তনশীল পটে ফ্রান্সের নিজের জায়গা অক্ষুণ্ণ রাখতে হলে আফ্রিকাকে পাশে পাওয়া প্রয়োজন হবে আবারও। কারণ, আফ্রিকার যতটা প্রয়োজন, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রয়োজন ফ্রান্সের, আফ্রিকাকে। একথা কে না জানে। 

তথ্যসূত্র:
রয়টার্স
আজেঞ্জিয়া নোভা
আফ্রিকান স্পেক্টেটর
আল জাজিরা 
ফিনান্সিয়াল টাইমস
ল্য মন্দ
রেডিট
এপি নিউজ
ইউরোনিউজ
ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল
টাইমস অফ ইন্ডিয়া
দ্য গার্ডিয়ান
রিপাবলিক ওয়ার্ল্ড