‘গড্‌ডলিকার শতবর্ষ’

Book Of Rajshekhar Basu

‘রাম রাম বাবুসাহেব!
আগন্তুক মধ্যবয়স্ক, শ্যামবর্ণ, পরিধানে সাদা ধুতি, লম্বা কালো বনাতের কোট, পায়ে বার্নিশ-করা জুতা, মাথায় পীতবর্ণ ভাঁজ-করা মল্‌মলের পাগড়ি, হাতে অনেকগুলি আংটি, কাণে পান্নার মাকড়ি, কপালে ফোঁটা।’

বাংলা সাহিত্যে এ-ভাবে যাঁর আগমন, সেই গণ্ডেরীরাম বাট্‌পারিয়া পরশুরামের নিছক কল্পনা নয়, দিনের পর দিন সশরীরে এ-রকম একটি ফেরেববাজকে দেখেছিলেন রাজশেখর বসু।

আরও পড়ুন: চলিত বাংলা আর মৌখিক বাংলা আসলে এক নয়; চলন্তিকার মাধ্যমে দেখিয়েছিলেন রাজশেখর বসু লিখছেন শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়

তখন তিনি পুরোপুরি মন দিয়েছেন, ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল’-এর উন্নয়নে। প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের পত্তন করা এই স্বদেশি প্রতিষ্ঠানের প্রায় সব দায়িত্বই তিনি সামলাতেন তখন। দেখতেন না কেবল শেয়ার বিক্রির বিষয়টা। প্রফুল্লচন্দ্রই বিষয়টি দেখাশোনা করতেন।

প্রফুল্লচন্দ্রের স্বপ্ন ছিল, এই ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল’-কে কেন্দ্র করেই জোয়ার আসবে স্বদেশি শিল্প-ব্যবসায়, দেশের টাকা দেশেই থাকবে, আর্থিক উন্নতি হবে বাঙালির। বিলিতি ওষুধ, রাসায়নিক, প্রসাধনীর বদলে দেশে চল হবে স্বদেশি জিনিসের। তার জন্য আরও আর্থিক সামর্থ্য চাই ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল’-এর, চাই আরও মূলধন। অতএব ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল’ হল পাবলিক লিমিটেড, বিক্রি হতে শুরু করল শেয়ার।

সে-পথেই ঢুকল মুনাফালোভীর দল। প্রফুল্লচন্দ্র খেয়ালও করলেন না যে, একটু-একটু করে শতকরা পঞ্চাশটির বেশি শেয়ার কিনে নিয়েছেন, অবাঙালি এক ব্যাবসায়ী। আর কোম্পানি-আইন বলে, পাবলিক লিমিটেড সংস্থার অর্ধেকের বেশি শেয়ার কুক্ষিগত করবেন যিনি তাঁরই হবে কোম্পানির কর্ণধার হওয়ার ক্ষমতা।

প্রফুল্লচন্দ্রের অসাবধানতার সুযোগে সে-ক্ষমতা প্রায় করায়ত্ত করে ফেলেছিলেন, নামে না-হলেও চরিত্রে সেই বাট্‌পারিয়া-ই। এ-বিষয়ে তাঁর তখন যথেষ্ট সুনাম ভারতীয় বণিকগোষ্ঠীতে। তবু পুরো সর্বনাশ হয়ে যাওয়ার আগে শেষরক্ষা হল। তলে-তলে চরম বিপদের দিকে এগোতে থাকা ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল’-র কর্তৃপক্ষ জানতে পারলেন পুরো বিষয়টা। মামলা করা হল। সে-কালের জাঁদরেল আইনজীবি উপেন্দ্রনাথ সরকার লড়লেন, ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল’-এর পক্ষে। তাঁকে দিনরাত জেগে সাহায্য করে গেলেন একদা আইনের ছাত্র রাজশেখর বসু। বেআইনি ভাবে, ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল’-কে না জানিয়ে, সেই বাট্‌পারিয়া তাঁর শেয়ারের কিছু অংশ বিক্রি করেন, একটি জাপানী জাহাজ-কোম্পানিকে, তার ফলেই তাঁকে আদালতে বাগে আনা গেল।

মামলা যখন আদালতে চলছে তখন প্রায়ই উপস্থিত থাকতেন রাজশেখর। মন দিয়ে আঁকতেন সেই ব্যাবসায়ীর স্কেচ। তার পরে মোকদ্দমা শেষ হলে লিখে ফেললেন গল্প, ‘শ্রীশ্রীসিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড’। তখন তাঁর কাজের দিনের ঠিকানা ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল’ কারখানার কোয়ার্টার, আর উইকএন্ডের ছুটির ঠিকানা ১৪ পার্সিবাগান লেন। ছোটবেলার বন্ধু যতীন্দ্রকুমার সেন সে-বাড়িতেই গল্পটা শুনে মুগ্ধ হয়ে বললেন, ‘আমি এর ছবি আঁকব।’ রাজশেখর বললেন, ‘বেশ, তা এঁকো। কিন্তু আমার এ-বিষয়ে কিছু করা আছে, তোমায় দেখাব।’

রাজশেখরের করা সে-সব স্কেচ ছিল যতীন্দ্রকুমার সেনের ‘গড্‌ডলিকা-অলংকরণের’ প্রেরণা। পরশুরামের নিজের করা স্কেচগুলো এতকাল চোখের আড়ালে থেকে হয়তো নষ্টই হয়ে যেত যদি না প্রয়াত বিশিষ্ট সংগ্রাহক পরিমল রায় আগলে রাখতেন সে-সব আর ভাস্কর কেএস রাধাকৃষ্ণণের বিন্যাসে সেগুলি প্রকাশিত হত ‘ভিশন অ্যান্ড ভিস্যুয়ালস’ নামে সুমুদ্রিত একটি বইয়ে (নিয়োগী বুকস)।

রাজশেখর বসুর করা স্কেচ

সে-পথেই ঢুকল মুনাফালোভীর দল। প্রফুল্লচন্দ্র খেয়ালও করলেন না যে, একটু-একটু করে শতকরা পঞ্চাশটির বেশি শেয়ার কিনে নিয়েছেন, অবাঙালি এক ব্যাবসায়ী। আর কোম্পানি-আইন বলে, পাবলিক লিমিটেড সংস্থার অর্ধেকের বেশি শেয়ার কুক্ষিগত করবেন যিনি তাঁরই হবে কোম্পানির কর্ণধার হওয়ার ক্ষমতা।

‘শ্রীশ্রীসিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড’ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৩-এ, ভারতবর্ষ পত্রিকায়। মাঘ ১৩২৯-এর সে-সংখ্যায় জানানো হয়, গল্পটি ‘শ্রীপরশুরাম-বিরচিত’ এবং ‘শ্রীনারদ-চিত্রাঙ্কিত’। পত্রিকায় গল্পটির চারটি পরিচ্ছেদ ছিল— আদিকাণ্ড, কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ড, সুন্দরাকাণ্ড আর লঙ্কাকাণ্ড। ১৩৩১-এ, ১৪ পার্সিবাগান লেন থেকেই যখন ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকাশক হয়ে প্রকাশ করলেন পরশুরামের প্রথম বই ‘গড্‌ডলিকা’ তখন সে-গল্প থেকে পরিচ্ছেদের নামগুলি বাদ গেল।

কিন্তু ব্রজেন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রকাশিত ১৯২৪-এর গড্‌ডলিকা তেমন প্রচার পায়নি। সে-বই রাতারাতি বিখ্যাত হল এমসিসরকার অ্যান্ড সন্স থেকে প্রকাশের পরে। সেই সংস্করণটির প্রথম প্রকাশ ১৩৩২ বঙ্গাব্দে।

প্রকাশক সুধীরচন্দ্র সরকারের স্মৃতিকথা ‘আমার কাল আমার দেশ’জানাচ্ছে, ‘১৩৩২ সালে রাজশেখরবাবু ও তাঁর ভাইদের গৃহে পার্শীবাগানের ‘উৎকেন্দ্র’ নামক আড্ডায় মধ্যে মধ্যে যাতায়াত আরম্ভ করেছিলেন। স্বর্গত ঐতিহাসিক বন্ধুবর ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় আমাকে রাজশেখরবাবুর কাছে প্রথম নিয়ে গিয়ে তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। ‘উৎকেন্দ্রে’র অন্যান্য সভ্যদের সঙ্গে পরিচয়ও তাঁর মাধ্যমেই হয়। বিখ্যাত চিত্রশিল্পী যতীন্দ্রকুমার সেন সে-সময়ে ‘উৎকেন্দ্রে’র একজন প্রধান কর্ণধার। তিনি আমাদের প্রতিষ্ঠানের বহু ছবি এঁকে দিয়েছিলেন। সকলেই জানেন যে, রাজশেখরবাবুর ছদ্মনাম ছিল পরশুরাম এবং তিনি এই নামেই সমস্ত গল্পের বইগুলি লিখেছিলেন। যে-সময়ে আমার সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়, সে-সময়ে তাঁর প্রথম বই বেরিয়েছে ‘গড্‌ডলিকা’— কতকগুলি মনোরম রসসমৃদ্ধ গল্পের সমষ্টি এই ‘গড্‌ডলিকা’। এ-হেন বইও একজন ভাল প্রকাশকের অভাবে আশাপ্রদ বিক্রি হয়নি। সে-কারণে, তিনি একজন ভাল প্রকাশক খুঁজছিলেন এবং সে-সূত্রেই বন্ধুবর ব্রজেন্দ্রনাথ আমাকে নিয়ে গিয়ে রাজশেখরবাবুর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেন। এবং ক্রমশঃ আমিই তাঁর সমস্ত বই-ই পরে প্রকাশ করি।

তার মানে, ‘গড্‌ডলিকা’-র যে-সংস্করণ প্রথম যথার্থ বিপণন পায় এবং প্রচারিত হয়, তারই শতবর্ষ এ-বছর। আর তার বীজ মুনাফালোভীর বিরুদ্ধে জাতীয় আদর্শের লড়াইয়ে। ব্যাবসাবিমুখ বলে দাগা-খাওয়া বাঙালির এও আরএক পরিচয় বই কী!