কালকূটের ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’ সিনেমা করতে চেয়েছিলেন তপন সিংহ। কিন্তু সে-ছবির স্বত্ব কিনে রেখেছিলেন বিমল রায়। এদিকে তাঁর পুরনো প্রতিষ্ঠান নিউ থিয়েটার্সের বিএন সরকারের ভাই এসএন সরকার তাড়া দিচ্ছেন তাঁর প্রযোজনায় একটা সিনেমা করার জন্য। শেষে অরুন্ধতী দেবী পরামর্শ দিলেন ‘নির্জন সৈকতে’ করার। সে-ও কালকূটেরই লেখা। সারা জীবনে ওই একটিই কালকূট বা সমরেশ-কাহিনি থেকে ছবি করেছিলেন তপন সিংহ। করতে চেয়েছিলেন আরও একটি, ‘কোথায় পাবো তারে’। তার শ্রেষ্ঠাংশে উত্তমকুমার। সে-ছবি মুক্তি পায়নি কোনওদিন। হয়েছিল কি না, তাও জানা নেই। কেবল একটি উত্তম-সিনেমার বুকলেটের পেছনে ছিল তার বিজ্ঞাপন। ১৯৭০-এ উত্তমকুমারের ‘রাজকুমারী’ সিনেমার বুকলেট জানাচ্ছে পরবর্তী আকর্ষণ সত্যসুধা প্রোডাকসন্সের নিবেদন তপন সিংহ পরিচালিত কালকূট-এর ‘কোথায় পাবো তারে’। সে-ছবি পরবর্তী আকর্ষণ হয়েই থেকে গেল। ১৯৭০-এর অক্টোবরে মুক্তি পেল ‘রাজকুমারী’। ১৯৭১-এর এপ্রিলে তপন সিংহের ‘এখনই’।

বাংলা সিনেমার ইতিহাসে না-হওয়া ছবি, ইন্ডাস্ট্রির মনের ছবি দেখায়। এক-একজন পরিচালকের ভাবনার ইতিহাসটা দেখিয়ে দেয়। উত্তমকুমারকে নানা কাহিনির নানা চরিত্রে অভিনয় করানোর এই ভাবনাগুলো মহানায়কের অভিনয়-ইতিহাসে নানা সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছিল। অবশ্য বাস্তবে তার আর কোনও পর ছিল না, ছিল না ঠিকানাও।
উত্তম তখন সবে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছেন। মুক্তি পেয়েছে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ আর ‘অগ্নিপরীক্ষা’। ১৯৫৪ সাল। ‘এই সত্যি’ ছবির প্রচারপুস্তিকায় ছাপা হল ‘চোখ’ ছবির বিজ্ঞাপন। সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনিতে সুরেশ হালদারের পরিচালনা। অভিনয়ে অসিতবরণ ও উত্তমকুমার একসঙ্গে। সেই অসিতবরণ, জীবনের প্রথম ছবি ‘দৃষ্টিদান’-এ যাঁর কিশোরবেলার চরিত্রে উত্তমের নামহীন অভিনয় এক গৌরী দেবী আর তাঁর ঠাকুমা ছাড়া তেমন কারও দৃষ্টিতেই পড়েনি।

‘চোখ’-এর চক্ষুদান হল না। সেও থেকে গেল অন্ধকারে। চার বছর পরে আর-একটি ছবির প্রচারপুস্তিকায় এল আর একটি না-হওয়া। ন্যাশনাল সিনে কর্পোরেশন বিজ্ঞাপন দিয়ে জানাল তাদের পরবর্তী ছবি ‘কান্তার কন্যা’। বিজ্ঞাপনের ছবিতে অশ্বারোহী এক রমণীর সিল্যুয়েট। জানা গেল নীরেন লাহিড়ীর পরিচালনায় সে-ছবির শ্রেষ্ঠাংশে থাকবেন উত্তম-কাবেরী। সে-বছরই মুক্তি পেয়েছে মঙ্গল চক্রবর্তীর পরিচালনায় ‘শিকার’। কলকাতার সেট, নিশ্চিন্ত ঘরোয়া গল্পের উত্তমকুমারকে পাওয়া গেছে একটু অন্য স্বাদে। ‘কান্তার কন্যা’-ও সেই রকম নতুনের আশা জাগিয়েছিল। আশা মেটেনি।

মুক্তি পায়নি মহাশ্বেতা দেবীর কাহিনি অবলম্বনে ‘যমুনা কী তীর’-ও । ১৯৬৯-এ বিএন রায় প্রোডাকসন্সের ‘মা ও মেয়ে’ ছবির প্রচারপুস্তিকায় বিজ্ঞাপন বেরিয়েছিল। সুনীল ব্যানার্জির পরিচালনা, অনিল বাগচীর সংগীত পরিচালনা। অভিনয়ে উত্তম-তনুজা। তার বছর দুয়েক আগে এসেছে সুনীল ব্যানার্জিরই পরিচালনায় ‘এন্টনী ফিরিঙ্গি’। অনিল বাগচীর সংগীত সেখানে হিট। সে-ও ছিল বিএন রায় প্রোডাকসন্সের। সেই সাফল্য থেকেই হয়তো একই পরিচালক-সংগীত পরিচালক, পরিচালক-নায়ক-নায়িকা নিয়ে আর-একটি সিনেমার পরিকল্পনা। সে-ছবিও হল না। বছর দুয়েক পরে ১৯৭১-এ পিয়ালী ফিল্মসের পরিবেশনায় যখন মুক্তি পেল সত্যজিৎ রায়ের ‘সীমাবদ্ধ’, তখন তার পুস্তিকা বলল পিয়ালীর পরের ছবি ‘যমুনা কে তীর’। ‘কী’ হল ‘কে’, পালটে গেল নায়িকাও, অপর্ণা সেন। পরিচালনায় সেই সুনীল ব্যানার্জিই। তার আগের বছরই মুক্তি পেয়েছে ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, সত্যজিতের যে-ছবিতে অপর্ণা স্মরণীয়তা পেলেন। ‘তিনকন্যা’-র সমাপ্তি, মৃণাল সেনের ‘আকাশকুসুম’-এ অভিনয় করে অপর্ণা তখন সবে জায়গা করে নিচ্ছেন। তার আগে ‘অপরিচিত’-তে অপর্ণা অভিনয় করেছেন উত্তমকুমারের সঙ্গে। তার পরে ১৯৭১-এই মুক্তি পেল উত্তম-অপর্ণার বেশ কয়েকটি ছবি— ‘এখানে পিঞ্জর’, ‘জয়জয়ন্তী’।


পরের বছর সেই উত্তাল সাতের দশকের কলকাতায় মৃণাল সেনের ‘কলকাতা ৭১’ যখন এল, তখন তারও প্রচারপুস্তিকা বিজ্ঞাপনে তৈরি করল উত্তমকুমারের অন্যরকম চরিত্রে অভিনয় করার সম্ভাবনা। যে ডিএস সুলতানিয়া প্রযোজনা করেছিল ‘কলকাতা ৭১’, তারাই জানাল বিমল করের ‘একদা কুয়াশায়’ অবলম্বনে ছবি করছেন অগ্রদূত, অভিনয় করবেন উত্তমকুমার। বিমল করের সে-উপন্যাস অস্থির সময়ের মানুষের নতুন সংকটের কথা বলে। সে-ছবি হলে হয়তো দেখা যেত ম্যাটিনি আইডলের বাইরের চরিত্রাভিনেতা উত্তমকুমারকে। মনে রাখতে হবে, বিমল করেরই কাহিনি থেকে পার্থপ্রতিম চৌধুরীর ‘যদুবংশ’ হবে আরও বছর তিনেক পরে, যেখানে পাওয়া যাবে একেবারেই অন্য উত্তমকে।

তবে ১৯৬৭-তে হৃষীকেশ মুখার্জী তাঁর পরিচালনায় যে-ছবিটির কথা জানিয়েছিলেন, সেটি হলে ঝলমলে এক ইতিহাস সৃষ্টি হত। কারণ সে-ছবিতে একইসঙ্গে অভিনয় করার কথা ছিল উত্তমকুমার ও রাজ কাপুরের। প্রিয়া ফিল্মসের প্রযোজনায় তপন সিংহের ‘হাটেবাজারে’ মুক্তি পেয়েছে সে বছর। তারই পুস্তিকা বলছে, প্রিয়া ফিল্মসের আগামী নিবেদন হৃষীকেশ মুখার্জীর ‘আনন্দসংবাদ’।
টলিউডে সে সংবাদ আসেনি কখনও। হয়তো মূলত কাব্যকল্পনা হয়ে উবে গিয়ে আনন্দ-ইতিহাস সৃষ্টি করেছে বলিউডে।
গ্রন্থঋণ
উত্তম নিশ্চিন্তে চলে
সম্পাদনা: সোমনাথ শর্মা
আচমন