রং, সৌন্দর্য, মাতিস

Article on legendary artist Henri Matisse on his Birth anniversary

কয়েক দশক আগে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ ক্লাসের একজন ভাল ছাত্র পরীক্ষার খাতায় ‘সুন্দর’ না লিখে লিখেছিলেন ‘সুন্দরতা’। মাস্টারমশাই নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ছাত্রটিকে বলেছিলেন, ‘সুন্দর এমনিতেই সুন্দর, তাতে তা দেবার কোনও দরকার নেই।’ সত্যিই তো! সুন্দর এমনিতেই সুন্দর। অঁরি মাতিসের ছবিও তাই। এমনিই সুন্দর। তিনি পিকাসোর মতন সাবভারসিভ নন। তিনি অত্যাচারীর বিরোধিতা করে ‘গ্যের্নিকা’ আঁকেননি। ‘কোরিয়ার যুদ্ধ’ও আঁকেননি। দালির মতন গভীর রহস্য ও জিজ্ঞাসায় পরিপূর্ণ সুররিয়াল শিল্পী তিনি নন। রেনে ম্যাগ্রিটের মতন স্মৃতিক্লিষ্ট-দুর্ভাবনাজর্জর ছবি করে যাননি। পল ক্লি-র মতন বিচিত্র সারফেসে দর্শককে ধাঁধার সম্মুখীনও করেননি। তাহলে কী তিনি এঁকেছেন? তিনি শুধুই এঁকে গেছেন সৌন্দর্যকে; যেখানে তাঁর পূর্বসূরি হলেন ফরাসি রকোকো ধারার শিল্পী ফ্রাঁসোয়া বুশার, ইমপ্রেশনিজমের অন্যতম স্মরণীয় চিত্রকর পিয়ের ওগুস্ত রেনোয়া। রেনোয়া কখনও দুঃখের ছবি আঁকতেন না। অঁরি মাতিসও আঁকেননি।

মাতিস মাঝবয়স থেকে জীবনের অন্তিম পর্যন্ত ফরাসি রিভিয়েরার নিস শহরে থাকতেন। দক্ষিণে নীলে নীল ভূমধ্যসাগর। আকাশে ঝকঝকে রোদ্দুর। নিস থেকে ১৬-১৭ কিলোমিটার দূরে, ক্যাগনেস-সুর-মেরে একটা অলিভ বাগানে ঘেরা সূর্যালোকিত বাড়িতে বৃদ্ধ ও আর্থারাইটিসে পঙ্গু রেনোয়া থাকতেন। তখন তাঁর কঙ্কালের মতন শীর্ণ দেহ, হাত পড়ে গেছে, শুধু জীবন্ত জ্বলজ্বলে দুই চক্ষু। মাতিস ট্রেনে করে প্রায়ই যেতেন রেনোয়ার কাছে। কালো রং ব্যবহার করার জন্য বৃদ্ধের বকুনিই খেয়েছেন। একদিন রেনোয়া বললেন, ‘এমন দারিদ্র ও দুঃখের দিনও গেছে, যখন হ্যরিকুট বিন খাবার জন্য ছেলেরা বায়না করায় এনে দিতে পারিনি। তারপর দিন যেতে-যেতে মালিন্য মুছে গেছে। মাতিস, জীবনের বেদনাগুলো ঝরে-ঝরে যায়। থেকে যায় শুধু সৌন্দর্য।’ ‘থেকে যায় শুধু সৌন্দর্য’— এই কথাটি মাতিসের মনে গাঁথা হয়ে গিয়েছিল।

Article on Henri Matisse on his Birth anniversary
শয্যাশায়ী অবস্থায় ছবি আঁকছেন অঁরি মাতিস

কিন্তু কথা হল, সুন্দরকে দেখবে কে? মানুষই তো দেখবে! কী করে দেখবে? কে তাকে দেখার ওই দৃষ্টি দেবে? সে কে? কে এই দেখতে শেখাবে? রবীন্দ্রনাথও বলতেন, চোখ সবারই থাকে কিন্তু দৃষ্টি থাকে কই! মাতিস বলতেন, সুন্দরকে দেখেতে যারা পায় না, তারা হল ‘পিকটোরিয়ালি ইললিটারেট’। শিল্প ও সৌন্দর্যকে বোঝার জন্য মন চাই। চোখ চাই।

কম বয়সে পিকাসো ছিলেন মাতিসের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী। কিছু পরে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা আর ছিল না। দুজনেই ফরাসি রিভিয়েরায় থাকতেন। দ্বিতীয় মহাসমরের সময়ে মাতিসের স্ত্রী ও কন্যা গেস্টাপোদের কবলে পড়েন। তাঁরা রেজিস্ট্যান্সের সমর্থক ছিলেন। সেই হতাশাভরা দিনে, পিকাসো ছিলেন মাতিসের প্রধান সহায়।

আজকাল যত দিন যাচ্ছে, হাড়ে-হাড়ে টের পাচ্ছি, সুন্দরকে সুন্দর বলে চেনার চোখ যাঁদের আছে তাঁদের সংখ্যা অতি নগণ্য হয়ে যাচ্ছে। খেলো ও হাবিজাবি বস্তুকে সুন্দর বলে প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। তাকে মদত দেয় গুচ্ছের অসুন্দর মনের লোকজন। স্বনামধন্য রাধাপ্রসাদ গুপ্ত সাধে কি আর লিখেছিলেন, ‘আজি কালি ছাই-পাঁশের বড় আদর।’ খুব সত্যি কথা!

‘দ্য নাইফ থ্রোয়ার’

দক্ষিণ ফ্রান্সের নিস-এর মাতিস মিউজিয়াম আমার দেখা হয়নি এখনও। তবে মাতিসের ছবি দেখেছি, পারি শহরে পঁপিদু সেন্টারে, অরসে মিউজিয়ামে, অরেঞ্জেরি মিউজিয়ামে এবং পিকাসো মিউজিয়ামে। পিকাসো মিউজিয়ামে রাখা মাতিসের ছবিগুলো পাবলো পিকাসোর ব্যক্তিগত সংগ্রহ ছিল। কম বয়সে পিকাসো ছিলেন মাতিসের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী। কিছু পরে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা আর ছিল না। দুজনেই ফরাসি রিভিয়েরায় থাকতেন। দ্বিতীয় মহাসমরের সময়ে মাতিসের স্ত্রী ও কন্যা গেস্টাপোদের কবলে পড়েন। তাঁরা রেজিস্ট্যান্সের সমর্থক ছিলেন। সেই হতাশাভরা দিনে, পিকাসো ছিলেন মাতিসের প্রধান সহায়।

ভাগ্যিস মাতিস তাঁর বাবার মতো শস্যদানা ও বাড়িঘরের রঙের ব্যবসায়ী হননি! ভাগ্যিস তিনি ল-অফিসের কর্মী হয়েই থাকেননি! পিকাসো মাতিসকে মনে করতেন, রঙের জাদুকর। ভাসিলি কান্দিনস্কি বলতেন, আধুনিক চিত্রকলার দুটি পথ। একটি মাতিসের রঙে-রঙে, অন্যটি পিকাসোর রেখায়-রেখায়। গন্তব্য এক, শিল্পের চরম রূপকে প্রতিষ্ঠা করা।

‘পলিনেসিয়া, দ্য স্কাই’, ১৯৪৬

কেউ-কেউ বলেন, মাতিস বড় হেডোনিস্ট, তিনি শুধু রূপ-রং, সৌন্দর্য-আনন্দকেই দেখেছেন। দীর্ণ-জীবনের দুঃখী মানুষকে তো তিনি আঁকেননি পিকাসোর মতো। তিনি ফ্রান্সিসকো গোইয়ার মতো যুদ্ধে নিপীড়িত মানুষকে কেন আঁকেননি? এই প্রশ্নের কোনও মানে হয় কি? রবিশংকর আর বিলায়েত খানে কেন তফাত? তারাশংকর আর বিভূতিভূষণ কেন একরকম নন? এমন বাজে প্রশ্ন হয় কি?

বছর যখন শেষ হয়ে আসে, মাতিসের কথা তখন খুব মনে হয়। কেননা, তাঁর জন্ম হয়েছিল বছরের শেষ দিনটিতে, ১৮৬৯-এ; মৃত্যু ১৯৫৪-তে। মানুষের সভ্যতা কতদিন থাকবে আমরা কেউই জানি না। কিন্তু সভ্যজীবনে সৌন্দর্য-সচেতন মানুষ যদ্দিন থাকবে, অঁরি মাতিসকে কেউ সরিয়ে রাখতে বা মুছে ফেলতে পারবে না।