অন্যরকম ‘মার্ক্সিস্ট’

Image of Himanish Goswami for an article about him

হিমানীশ গোস্বামীকে আমি প্রথম দেখি ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’-র নিউজরুমে। 

সাতের দশকের গোড়ার দিকের কথা, তখন আমি শিক্ষানবিশ সাংবাদিক। দুপুরবেলায় মাঝবয়সি এক ভদ্রলোক ঘরে ঢুকলেন। বিরলকেশ, ভারী চেহারা, খয়েরি রঙের প্যান্ট আর সাদামাটা বুশ শার্ট পরা, কাঁধে একটা শান্তিনিকেতনি ঝোলাব্যাগ, মুখে স্মিত হাসি। আমাকে নতুন দেখে নিজেই এগিয়ে এসে বললেন, ‘আমার নাম হিমানীশ গোস্বামী।’

তখন মাঝে মাঝেই নানা অপ্রচলিত বিষয়ে ওঁর লেখা বেরোত, রম্যরচনা ধাঁচের। একটার কথা মনে পড়ছে, ‘বানাম মানি না’। বাঙালিরা কীভাবে নির্দ্বিধায় ভুলভাল, যা খুশি বানান লেখে এবং তাতে বিন্দুমাত্র লজ্জা বোধ তো করেই না, বরং তর্ক করে— সেই নিয়ে। বানানের বদলে ইচ্ছে করেই উনি শিরোনামে লিখেছিলেন, ‘বানাম’। সেই হিমানীশ গোস্বামী! আমি লাফিয়ে উঠে বললাম, ‘আপনার লেখা পড়েছি, ভীষণ ভাল লাগে।’ 

আরও পড়ুন : বিতর্কিত উপন্যাস ছাপতে পিছপা হতেন না সাগরময় ঘোষ! লিখছেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়…

কেন জানি না, আমাদের আলাপের সেই প্রথম দিন থেকেই ওঁকে বেশ ভাল লেগে গেল। ওঁরও বোধহয় আমাকে মন্দ লাগেনি। এমনিতে কম কথা বললেও, পছন্দের লোকদের সঙ্গে বেশ জমিয়ে আড্ডা দিতেন। আমাদের কাজের টেবিল ছিল কাছাকাছি। উনি কাজের ফাঁকে নানারকম মজার কথা বলতেন, আমিও মজা করে উত্তর দিতাম। এই কথার খেলা দু’জনেই বেশ উপভোগ করতাম। হিমানীশদার কথা কিন্তু নিছকই মজার নয়, রেডি উইটের মধ্যে যে বুদ্ধিদীপ্ত ব্যাপার থাকে, সেটাই ফুটে বেরোত। 

সৌজন্য : হিমানীশ গোস্বামীর ফেসবুক পেজ

অবশ্য বুদ্ধি আর রসবোধ আমাদের অফিসে কারই বা কম ছিল! সেই সময়কার ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ ছিল চাঁদের হাট। অন্যান্য বিভাগের কথা বাদই দিচ্ছি, শুধু বার্তা বিভাগেই নামী সব কবি-সাহিত্যিক কাজ করতেন। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, অমিতাভ চৌধুরী, হিমানীশ গোস্বামী, সমরজিৎ মিত্র, পরে যিনি ‘জিৎ’ বাদ দিয়ে সমর মিত্র নামে গল্প লেখেন। এছাড়া সম্পাদকীয়, খেলা, বিনোদন, রিপোর্টিং ইত্যাদি ধরলে তো প্রায় সবটাই তারকাখচিত। এঁদের জন্য ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ হয়ে উঠেছিল সততই আনন্দের বাজার। 

ইতিমধ্যে আমি হিমানীশদার ভক্ত হয়ে উঠেছি। শুনেছিলাম, অল্প বয়সে বেশ কিছু বছর উনি বিলেতে কাটিয়েছেন। ওঁর কাছে সেখানকার গল্প শুনতে ভাল লাগত। জায়গাটা একেবারে আলাদা রকমের হলেও হিমানীশদার কথায় মনে হত, ওই দেশের বাসিন্দারা কেউ ভিনগ্রহের প্রাণী নয়! তারাও আমাদের মতোই, শুধু জামাকাপড় আর কথা বলার ধরনটাই যা অন্যরকম। ছোটবেলায় দেব সাহিত্য কুটিরের কোনওল পূজাবার্ষিকীতে মনোজ বসুর লেখা একটা ভ্রমণকাহিনি পড়েছিলাম, ‘বিলেত দেশটা, মাটির সেটা’। বিলেত-বাসের অভিজ্ঞতা নিয়ে হিমানীশদা বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন। সবক’টিই ওঁর ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা। তার একটি তখন সবে বেরিয়েছে, ‘লন্ডন শহরের সাধু ঘটক’। ঘটক ছিলেন লন্ডনে হিমানীশের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাঁর মাথায় নানা উদ্ভট আইডিয়া গিজগিজ করত। একবার সেই প্রবল পরোপকারী বন্ধুর মাথায় ঢুকল, বড়লোক হতে হবে, তা হলেই সব দুঃখ-কষ্ট লোপাট। বড়লোক হওয়ার জন্য যতরকমের চেষ্টা করা যায়, ঘটকের পরামর্শে ও নেতৃত্বে কয়েকজন বন্ধু মিলে সেইসব অভিযানে নামল। প্রতি বারে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকাই শুধু জলে গেল, আর প্রত্যেকে আগের থেকে আর-একটু গরিব হয়ে যেতে লাগল। তবু দমে না গিয়ে অন্য কোনও উপায়ে বাঁচার আনন্দের উপকরণ খুঁজে বের করেছে সবাই। ‘টম অ্যান্ড জেরি’-র কার্টুনের মতো, হিমানীশদার গল্পেও কারও দুঃখ স্থায়ী হয় না। 

ছবি সৌজন্য : লেখক

বইটা উনি আমাকে উপহার দিলেন, সঙ্গে ওঁর আঁকা অননুকরণীয় একটা লাইন ড্রইং। বললেন, ‘এটা কিন্তু উপহার নয়, ‘উপহার’ মানে তো যার হার হতে হতে হয়নি, মানে হারের চেয়ে কম। যেমন উপমহাদেশ, যা মহাদেশের থেকে ছোট।’ আমি ওঁর অনুকরণে ফোড়ন কাটলাম, ‘যেমন ‘উপদেশ’, দেশ হতে হতে হয়নি, দেশের থেকে ছোট!’ মনের মতো জবাব পেয়ে হিমানীশদা খুশিই হলেন, ‘বাঃ, মন্দ বলোনি তো! আচ্ছা, সোলার কুকারের বাংলা জানো?’ বললাম, ‘সে তো সবাই জানে, সৌর চুল্লি!’ উনি গম্ভীর মুখে বললেন, ‘রবি ঠাকুর।’ আমরা ঘরসুদ্ধ সবাই হো হো করে হেসে উঠলাম। 

পরে এরকম নানা পরিচিত শব্দের হিমানীশ-কৃত অদ্ভুত ব্যাখ্যা-সহ উনি একটা তথাকথিত ‘অভিধান’ লিখেছিলেন, ‘অভিধানাই পানাই’। 

সাধারণত আমাদের নাইট ডিউটি একসঙ্গে পড়ত। মাঝে মাঝে ভোরবেলায় উনি তাল তুলতেন, ‘হ্যামবাজারে যাবে নাকি?’ অফিস থেকে বেরিয়ে হিমানীশদার সঙ্গে আমরা দু’তিনজন যেতাম নিউ মার্কেটে পর্ক, হ্যাম, সসেজ কিনতে। ওই রাস্তাটুকু হেঁটে যেতে যেতে আমাদের কুইন্স ইংলিশের প্রাথমিক পাঠ হয়ে যেত। যেমন, স্যান্ডউইচের ডি-টা অনুচ্চারিত থাকে। বলতে হয়, স্যান‍্উইচ। উরসেস্টারশায়ার সস-এর মাঝের অনেকগুলো বর্ণই সাহেবরা গিলে ফেলে, শুধু বলে উওস্টারশার, বা শুধুই উওস্টার সস্। এরকম আরও কত কী! 

‘সহকর্মী’-র একটা মজার প্রতিশব্দ উনি বের করেছিলেন, ‘সহ-কুমীর’। বলতেন, ‘কী দরকার ঘাঁটিয়ে? কার গায়ে পা পড়বে, কামড়ে দেবে! তোমরা তো জানলে, তা হলেই হবে।’ খবরের কাগজে সংবাদ-সূত্র, যাকে বলা হয় ‘সোর্স’, তার থেকে ভুল খবর এলে হিমানীশদা বলতেন, ‘সোর্সের মধ্যে ভূত’!

উনি বুঝিয়েছিলেন, তখন খবরের কাগজে যে ‘রুশী’ বা ‘মার্কিনী’ লেখা হত, তা বাহুল্যদোষে দুষ্ট। রুশ মানেই রাশিয়ান, আর মার্কিন শব্দটা এসেছে আমেরিকান থেকে। তাই তাকে আবার ‘ই’ বা ‘ঈ’-কারান্ত করা অর্থহীন। শব্দের ব্যবহার সম্পর্কে এত কিছু জানলেও কিন্তু, হিমানীশদা আমাদের বিভাগীয় মিটিংয়ে মুখ খুলতেন না।

‘সহকর্মী’-র একটা মজার প্রতিশব্দ উনি বের করেছিলেন, ‘সহ-কুমীর’। বলতেন, ‘কী দরকার ঘাঁটিয়ে? কার গায়ে পা পড়বে, কামড়ে দেবে! তোমরা তো জানলে, তা হলেই হবে।’ খবরের কাগজে সংবাদ-সূত্র, যাকে বলা হয় ‘সোর্স’, তার থেকে ভুল খবর এলে হিমানীশদা বলতেন, ‘সোর্সের মধ্যে ভূত’!

হঠাৎ কিছু মজার নাম দেওয়া, অথবা একেবারে অন্যরকম ব্যাখ্যা দেওয়ায় হিমানীশদার জুড়ি ছিল না। রোজ একটা শান্তিনিকেতনি ঝোলা কাঁধে অফিসে আসতেন, একদিন চেপে ধরলাম, ‘খালি ঝোলা নিয়ে আসেন কেন?’ হিমানীশদার জবাব, ‘কে বলেছে খালি? এই দেখো…’, ঝোলায় হাত ঢুকিয়ে বের করে আনলেন একটা টুথব্রাশ। বললেন, ‘হঠাৎ কোথাও আটকে পড়লে, বাড়ি ফিরতে না পারলে, আর কিছু না থাকলেও চলবে। কিন্তু নিজের টুথব্রাশটা তো লাগবেই!’ একটা লিকলিকে টুথব্রাশের জন্য আস্ত একটা থলে! ‘আরে, কখন কী লেগে যায় কে জানে! এই তো সেদিন বাজারে দেখলাম, খুব সস্তায় সোনা পাওয়া যাচ্ছে। কিলোখানেক কিনে নেব ভাবলাম, কিন্তু রাখব কোথায়? তারপর থেকে সবসময় এই ব্যাগটা নিয়ে বেরই।’ ভাবা যায়? 

তখন দেশে সাফারি স্যুটের খুব চল। আনন্দবাজারের সম্পাদক অভীক সরকার সবসময় ধুতি পাঞ্জাবি পরে অফিসে এলেও যেদিন গলফ ক্লাবে খেলতে যেতেন, সেদিন সাফারি স্যুট পরে আসতেন। একদিন ওরকম সাফারি স্যুট পরে ঢুকেছেন, হিমানীশদা আমার কানের কাছে মুখ এনে বললেন, ‘অভীকবাবুর শার্টটা দেখেছ? উনিও নিশ্চয় সস্তায় সোনা পেয়ে গিয়ে বুকপকেটে রেখেছিলেন। সোনার ভারে পকেট পেটের কাছে নেমে এসেছে।’ সাফারি শার্টের পকেট দুটো নিচেই থাকত। কিন্তু তার এমন কারণ ব্যাখ্যা করা হিমানীশ গোস্বামীর পক্ষেই সম্ভব ছিল। 

পকেট বৃত্তান্ত আরও আছে। একবার কোনও সহকর্মী অনেকগুলো পকেটওয়ালা প্যান্ট পরে অফিসে এসেছিলেন, কী একটা জিনিস খুঁজতে এ-পকেট ও-পকেট হাতড়াচ্ছেন, হিমানীশদার চটজলদি মন্তব্য, ‘এত পকেটের মধ্যে কোনটাতে কী রেখেছেন, খুঁজতে তো আপনার পকেট ক্যালকুলেটর লাগবে দেখছি!’ 

কত রকমের কত বই যে হিমানীশ গোস্বামী লিখেছেন, সবগুলো আর বোধহয় পাওয়াও যায় না। দাবা খেলা নিয়ে কয়েকটি বই, অনেকগুলো গল্পের বই, রম্যরচনা তো বটেই, গোয়েন্দা-কাহিনিও লিখেছেন। ওঁর গোয়েন্দা যে অন্যদের থেকে আলাদা হবে, জানা কথা। 

আমাকে দুটো বিশ্ববিখ্যাত ম্যাগাজিনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন হিমানীশদা। বিলেতের ‘পাঞ্চ’, আর আমেরিকার ‘দ্য নিউ ইয়র্কার’। আনন্দবাজারের লাইব্রেরিতে ওই ম্যাগাজিন দুটো রাখা হত। মাঝে মাঝে লাইব্রেরিতে গিয়ে পড়তাম। 

হিমানীশ গোস্বামী ছিলেন স্বঘোষিত ‘মার্ক্সিস্ট’। তবে কার্ল মার্ক্স না, গ্রাউচো মার্ক্স। আমেরিকার ওই গুঁফো কমেডিয়ান তাঁর চার ভাই হার্পো, চিকো, জিপো আর গামোর সঙ্গে মিলে অসম্ভব মজার সব সিনেমা করেছেন। ওঁরা নিজেদের বলতেন, ‘মার্ক্স ব্রাদার্স’। হিমানীশদার কাছে শুনে আমিও মার্ক্সদের কয়েকটা কমেডি সিনেমা দেখেছি। 

বাবা পরিমল গোস্বামীর মতো উনিও ক্যামেরা দিয়ে ভাল-ভাল ছবি তুলতেন। তবে আমার সবচেয়ে ভাল লাগত ওঁর হালকা চালের কার্টুনগুলো। কলমের কয়েকটা মাত্র আঁচড়ে চমৎকার এক-একটা মজার ছবি এঁকে ফেলতেন। তার নিচে বেশিরভাগ সময় ইংরেজিতে সই করতেন— ‘হিম’। 

তখন স্কুল-কলেজের ফাইনাল পরীক্ষায় অনেক সময়ই নম্বরের কোনও মাথামুন্ডু থাকত না। একদিন ডেস্কে বসে হঠাৎ আমার মাথায় একটা ছড়া এল। লিখলাম: 

‘তুমি পাশ হবে, না ফেল? 

বলো হেড কিম্বা টেল। 

লেখাপড়ায় ফয়দা কী আর 

এই তো ভাল খেল!’

হিমানীশদাকে ছড়াটা দেখাতেই, উনি কাগজটা টেনে নিয়ে তার পাশে কলম দিয়ে চটপট একটা কার্টুন এঁকে ফেললেন। একজন পরীক্ষকের পাশে গাদা গাদা উত্তরপত্রের বান্ডিল বাঁধা। সামনে পা ছড়িয়ে বসে দুই অভাগা শিশু। তিনি একটা মুদ্রা টস্ করছেন, তাই দিয়ে পরীক্ষার্থীদের ভাগ্য নির্ধারণ হবে। আমার ওই ছড়া আর হিমানীশ গোস্বামীর কার্টুন মিলিয়ে ‘ছড়াচ্ছবি’ নামে আনন্দমেলা-য় বেরিয়েছিল।