একটা লোক— যে নিউ ইন্ডিয়া গড়ে তুলেছিল

আমি তখন বেশ ছোট। আমার এক আঙ্কল সৌরভ গাঙ্গুলিকে দেখাবেন বলে আমাকে নিয়ে লর্ডসের মাঠে গেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘এক জন বাঙালি তরুণ আজ এই মাঠে ডেবিউ করবে!’ তাঁর বলার ভঙ্গিতে এমন একটা ব্যাপার ছিল, যেন ওই কাজটুকু করতে পারাটাই বাঙালির পক্ষে বিশাল। আমার মনে আছে, ছোটবেলায় যখন কলকাতায় থাকতাম তখন রক থেকে সংবাদপত্র সব জায়গায় প্রচুর চর্চা হত একটা বিষয় নিয়ে— জাতীয় স্তরের নির্বাচনে বাঙালি ক্রিকেটারদের কীভাবে দুচ্ছাই করা হচ্ছে। আর, কলকাতার মতো একটা ক্রিকেট-উন্মত্ত জায়গায় থেকে মনে হত, আমাদের (বাঙালিদের) বাকি সবকিছুর মতো খেলারও আঁতেল দিকটায় ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। মানে, বাঙালি আলোচনা করুক, বিশ্লেষণ করুক, তর্ক-বিতর্ক করুক — কিন্তু আসল খেলাটা খেলবে না।

মাঠে ঢুকে মনে হল, এই সেই লর্ডস! ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের জাদু মাখানো ভারতের চোখে সে ছিল পবিত্র ভূমি! ভারত তখন সদ্য উদারনৈতিক হয়েছে, আটের দশকের সমাজতান্ত্রিক বেড়ি ভাঙার চেষ্টা করছে, দুনিয়ার বুকে নিজের ছাপ সম্বন্ধে তখনও সে নিশ্চিত নয়, যেকোনো ব্রিটিশ জিনিসপত্র সামনে এলেই তার হীনম্মন্যতা শুরু হয়ে যায়, তখনও সে গরিব, পাশ্চাত্যের চাকচিক্যের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। আর বিশ্বের কাছে ভারতীয়রা ছিলেন নম্র, লাজুক, পড়াশোনা জানা, বিনয়ী, মাথা নিচু করে থাকা জাতি। সেখানের একজন মানুষ লর্ডসে এসে কৃতজ্ঞই তো থাকবেন!

সেই সবকিছু দুম করে পালটে গেল ১৯৯৬ সালের জুন মাসের এক মেঘলা দিনে। সৌরভ গাঙ্গুলি ১৩১ রান করলেন। আবার পরের টেস্টে আরেকটা সেঞ্চুরি হাঁকালেন। নিজেদের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, এ আমরা কী দেখছি! আমরা কোনওদিন ভাবিইনি এরকমটা সম্ভব হতে পারে! কলকাতার এক বাঙালি নিজের কাঁধে দায়িত্ব নিয়ে ভারতীয় ইনিংসের মোড় ঘুরিয়ে দিচ্ছেন, আর সেটা লুকিয়ে চুরিয়ে নয়, এত প্রবল আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে করছেন, যা সেই সময় বাঙালিদের মধ্যে বা বিদেশে ভারতীয়দের মধ্যে দেখা যেত না। সেই মুহূর্ত থেকে আমাদের মনে হয়েছিল সবকিছু সম্ভব। সেইসময় আমরা অনেকেই সদ্য কলেজে ঢুকেছি, জীবনের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছি, তখন গাঙ্গুলি তাঁর খেলা আর ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে আমাদের দুনিয়া দেখার চোখ বদলে দিয়েছিলেন। যেন নতুন কিছু একটা জন্ম নিল। আর, তিনি একটা গোটা প্রজন্মকে স্বপ্ন সত্যি করার আত্মবিশ্বাস যোগালেন।

ছাব্বিশ বছর কেটে গেছে। এখন সৌরভ গাঙ্গুলি খুব পরিচিত নাম। ভারত দেশটাও অনেক পালটে গেছে। এখন সে সম্মানিত, ক্ষমতাসম্পন্ন, ধনী, গর্বিত। 

আমরা এখন বিদেশে গিয়ে লজ্জিত হই না বা হীনম্মন্যতায় ভুগি না। বরং ঠিক উলটো। আমার সবসময়ে মনে হয়, এই নতুন ভারতবর্ষ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যাঁরা অগ্রণী, তাঁদের মধ্যে সৌরভ গাঙ্গুলি অন্যতম। সমাজতন্ত্রের বেড়ি, ভয়, কৈফিয়ত, নতুন উদ্যোগ নেওয়ার মানসিকতার অভাব — সবকিছু গুঁড়িয়ে দিয়ে যেন গ্লোবাল পাওয়ারহাউজ হয়ে ওঠেন সৌরভ। তারপর থেকে যা যা হল— ধোনির হিসেবি দৈত্যসুলভ দক্ষতা, কোহলির এনার্জি — এইসব শুরু হয়েছিল গাঙ্গুলিকে দিয়ে। এখন আমরা ধরেই নিই যে, ভারতীয় ক্রিকেট টিম বিদেশে গিয়ে পিচের ওপর বীরের মতো চিতিয়ে দাঁড়াবে। হারুক বা জিতুক, তার হাবভাব হবে রাজার মতো। এখনকার তরুণ প্রজন্মের কাছে শপিং মল, স্কাইস্ক্র্যাপার, শয়ে শয়ে টিভি চ্যানেল, হাজার হাজার মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি, স্মার্টফোন, বিদেশের স্বাচ্ছন্দ্য, জি-সেভেন নেশনে জায়গা পাওয়া— সব কিছুই আত্মবিশ্বাস জোগায়। তাই মনে হয়, আগের মতো মাথা ঝুঁকিয়ে নয়, বরং আমেরিকা আর ইংল্যান্ডের সমান মর্যাদা পাওয়া কোনও ব্যাপার নয়। কিন্তু আগে এরকম ছিল না। সেই আগুনটা কাউকে জ্বালাতে হয়েছিল। এখন সেই শিখা পরিণত হয়েছে নতুন আত্মবিশ্বাসী ইভারতে, যেখানে আইপিএল-এ টাকা লেনদেন করতে গোটা পৃথিবীর লোক এসে পৌঁছয়। সেই আগুনটা ছড়িয়ে পড়েছিল গাঙ্গুলির কাছ থেকে, আর একটা গোটা প্রজন্ম উদ্ভাসিত হয়ে গেছিল।

সবকিছু দুম করে পালটে গেল ১৯৯৬ সালের জুন মাসের এক মেঘলা দিনে। সৌরভ গাঙ্গুলি ১৩১ রান করলেন। আবার পরের টেস্টে আরেকটা সেঞ্চুরি হাঁকালেন। নিজেদের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, এ আমরা কী দেখছি! আমরা কোনওদিন ভাবিইনি এরকমটা সম্ভব হতে পারে! কলকাতার এক বাঙালি নিজের কাঁধে দায়িত্ব নিয়ে ভারতীয় ইনিংসের মোড় ঘুরিয়ে দিচ্ছেন, আর সেটা লুকিয়ে চুরিয়ে নয়, এত প্রবল আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে করছেন, যা সেই সময় বাঙালিদের মধ্যে বা বিদেশে ভারতীয়দের মধ্যে দেখা যেত না। সেই মুহূর্ত থেকে আমাদের মনে হয়েছিল সবকিছু সম্ভব

কয়েক বছর পর ২০০২-এর ন্যাটওয়েস্ট ফাইনালে আমরা যখন লর্ডসে অভূতপূর্ব জয়লাভ করেছি, আর ক্যাপ্টেন গাঙ্গুলি শার্ট খুলে হাওয়ায় উড়িয়েছেন, বা যখন দক্ষিণ আফ্রিকায় দেশকে ফাইনালে নিয়ে গেছিলেন (বিশ্বকাপ ২০০৩), বা সবরকমের পেস আক্রমণের মুখোমুখি হয়ে সচিনের সঙ্গে সেইসব রেকর্ড ইনিংস — সেই সব কিছুই ছিল যুগান্তকারী মুহূর্ত। আমরা জানতাম না সেই মুহূর্তগুলো আমাদের হতে পারে, আমরা জানতাম না সেই মুহূর্তগুলো আমরাও পেতে পারি। গাঙ্গুলি চোখে আঙুল দিয়ে দেখালেন, স্বপ্ন সাকার করার জন্য অনুমতি নিতে হবে না। আমাদের কোনও কৈফিয়ত দিতে হবে না। আমাদের মাথা নিচু করতে হবে না। আমরা এখন আত্মবিশ্বাসী। গাভাস্কারের ইন্ডিয়াতে শান্তশিষ্ট মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক আর কোহলির ইন্ডিয়াতে অদম্য ধনী লড়াকু প্রজন্মের মাঝে যে সেতুটা আছে, গাঙ্গুলি সেই সেতুটা তৈরি করেছিলেন।

তাছাড়া, বাংলা এখন ক্রিকেটের সাইডলাইন নয়, বরং ইডেন গার্ডেনস এখন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু — গাঙ্গুলি এই বদল ঘটিয়েছেন।

এখন আমার বয়েস ৪০ পেরিয়েছে, কিছুদিন আগে ২০২২ সালে ইন্ডিয়া-ইংল্যান্ড ম্যাচ দেখতে লর্ডসে গেছিলাম। দুই দলই দারুণ, কিন্তু সবকিছু কেমন পালটে গেছে। ইংল্যান্ড মাথা ঝুঁকিয়ে লাজুক দাঁড়িয়েছিল, এখন ভারতের তুলনায় তাদের অর্থনীতি খাটো হয়ে গেছে। ভারতীয় খেলোয়াড়রা যখন মাঠে নামল, গোটা স্টেডিয়াম উল্লাসধ্বনিতে ভরে গেল (এখন ইউকে-র কুবের সম্প্রদায় প্রবাসী ভারতীয়রাই স্ট্যান্ড ভরিয়ে রেখেছিলেন), আর সবগুলো স্পনসর ছিল ভারতীয় কোম্পানি। ব্রিটিশ দর্শকেরা অবাক হয়ে দেখছিলেন। আমার প্রজন্ম এখন এমনিই ধারণা করে নেয় যে আমরাই জিতব, হয়তো সেটা একটু অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস, কিন্তু মোটেই কোনও হীনম্মন্যতা নেই। প্রায় ৩০ বছর কেটে গেছে, দুনিয়ার চাকা ঘুরে গেছে — আমরা এখন স্বাধীন। এখানে বলে রাখি, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম যেন ভুলে না যায় যে, সেই স্বাধীনতার লড়াইটা গাঙ্গুলি লড়েছিলেন। আর, ইন্ডিয়াকে আজকের জায়গায় নিয়ে এসেছিলেন।

Read in English