ঘরে ফেরার গান

‘ডমুরুধর বলিলেন,— এই যে দুর্গোৎসবটি, এটি তোমরা সামান্য জ্ঞান করিও না। কিন্তু এখনকার বাবুদের সে বোধ নাই। বাবুরা এখন হাওয়াখোর  হইয়াছেন। দেশে হাওয়া নাই, বিদেশে গমন করিয়া বাবুরা হাওয়া সেবন করেন, আর বাপ-পিতামহের পূজার দালানে ছুঁচো-ছামচিকাতে অপরিস্কার করে।’ (‘ডমুরুচরিত’) 

ডমুরুর খেদ স্বাভাবিক। কারণ সে বিলক্ষণ জানে ভগবতীর আরাধনা করিলে ধনসম্পদ হয়। কিন্তু যেই না এসেছে শরৎ হিমের পরশ, অমনি মন উড়ু উড়ু অবস্থা, পরশুরামের অতুলনীয় বিবরণে, ‘…ঘোলা আকাশ ছিঁড়িয়া ক্রমশঃ নীল রং বাহির হইতেছে। রৌদ্রে কাঁসার রং ধরিয়াছে, গৃহিণী নির্ভয়ে লেপ-কাঁথা শুকাইতেছেন। শেষ রাতে একটু ঘনীভূত হইয়া শুইতে হয়। টাকায় এক গণ্ডা রোগা-রোগা ফুলকপির বাচ্ছা বিকাইতেছে। পটোল চড়িতেছে, আলু নামিতেছে। স্থলে জলে মরুৎ-ব্যোমে শরৎ আত্মপ্রকাশ করিতেছে। সেকালে রাজারা এই সময়ে দিগ্বিজয়ে যাইতেন।’ 

ত্রৈলোক্যনাথের ডমুরুধর যদি হয় আধুনিক পুজো কমিটির উদ্যোক্তাদের পূর্বসূরি, পরশুরাম বলেছেন পুজোয় বেড়াতে যাওয়া বাঙালি টুরিস্টদের কথা। এছাড়া আরেক রকম আছে। তাদের কথা রবি ঠাকুর বলেছেন সহজ পাঠের দ্বিতীয় ভাগে।

                   ‘স্টিমার আসিছে ঘাটে, প’ড়ে আসে বেলা—

                   পূজার ছুটির দল, লোকজন মেলা

                   এল দূর দেশ হতে; বৎসরের পরে

                  ফিরে আসে যে যাহার আপনার ঘরে।’

আরও পড়ুন : পুজো মানে কেবল বাইরে যাওয়া নয়, অনেকের কাছে কলকাতা ফেরাও উৎসব! লিখছেন দেবত্রী ঘোষ…

হাফ-ইয়ারলি পরীক্ষা শেষ হলে আমরা ধরাকে সরা জ্ঞান করতাম। সাপের পাঁচ পা দেখতাম। ফলে জলঙ্গি নদীতে ছুটির দিনে সাঁতারের নামে জল ছেটানো আর ডুবসাঁতার মাত্রা ছাড়া হত। বাড়ি ফিরতাম টকটকে জবার মতো লাল চোখ নিয়ে। বর্ষায় টি-বলের ব্লাডার সাইকেল দোকান থেকে সলিউশন আর রাবারের তাপ্পি মেরে সারিয়ে ভেসলিন মাখিয়ে কাদা জলে দেদার পেটানো ছিল। কাঁটা ফুটে শেষ বিকেলে ব্লাডার আবার ফুটো হলে বাতাবি লেবু চুরি করতে হত ফুটবলের বিকল্প হিসেবে। আমাদের পায়ে কাঁটা বিঁধলে ভরসা ছিল সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে প্রদীপের পলতে জ্বালিয়ে ব্যথার জায়গায় আগুন ছুঁইয়ে ছুঁইয়ে শুশ্রূষা। অবশ্যই গুরুজনদের নজর এড়িয়ে। এত সব ‘পাখা’ গজানোর ফলও কিছুদিন পরেই মিলত। হঠাৎ এক সন্ধেবেলায় মা বলত, কই দেখি। চোখ ছলছল করছে কেন তোর? তারপর মাথা টেনে নিয়ে কপালে গাল ছুঁইয়ে টেনে বলতো, হুম। আমি বুঝতাম, হয়ে গেল। বাবা ফিরলে পাশের বাড়ি থেকে থার্মোমিটার আনা হত। হ্যারিকেনের আলোয় বাবা হাই পাওয়ার চশমা দিয়ে থার্মোমিটার দেখছে আর আমি ভাবছি, হল-হল, পুজোর ঠিক আগেই হতে হল! একে নিরানব্বই টেম্পারেচার, তার ওপর নাড়ি চঞ্চল। ভাত বন্ধ। বেরনো বন্ধ। বিছানায় বন্দি। পথ্যি বলতে লেবু টিপে বার্লি, দুধ সাবু। থিন এরারুট বিস্কুট। ভাল বলতে পড়াশোনার বালাই নেই। কত কী প্ল্যান ছিল! লোডশেডিং জামা বানিয়েছি। আদ্দেকটা ডিপ কালারের, বাকি আদ্দেকটা লাইট কালারের। দেখলে মনে হবে আলোছায়ার খেলা। সঙ্গে বেলবটম প্যান্ট। সব মাটি হয়ে গেল। মায়ের কাছে ঘ্যানঘ্যান করি গল্পের বই এনে দাও। মা আর কী করে! পাশের বাড়ি বাবুমামার বিয়ে হয়েছিল কিছুদিন আগে। সেই বিয়েতে উপহার পাওয়া ‘ভারতের সাধক’ এনে দিল মা। এখন বুঝি, কী ধরনের অন্তর্দৃষ্টি ও প্রজ্ঞা থাকলে নব-বিবাহিত দম্পতিকে ‘ভারতের সাধক’ উপহার দেওয়া যায়। কিন্তু আমার তখন বই পড়ার নেশা। এর মধ্যে এলএমএফ পাশ ডাক্তারবাবু এসে পরম স্নেহে  স্টেথোস্কোপ দিয়ে বুক-পিঠ দেখে গেছেন, জিভ দেখে নাড়ি টিপে অতি জঘন্য খেতে মিক্সচার কাগজের খাঁজকাটা লেবেল-লাগানো শিশিতে দিয়ে গেছেন। সাবু-বার্লি ছাড়া আর ‘ডাবের জল ঘোলের জল মিছরির শরবৎ’। মাঝে জ্বর খুব বেড়েছিল। বালিশের ওপর মানপাতা দিয়ে বাবা মাথায় জল ঢালছিল, মা উদ্বিগ্ন মুখে তাকিয়ে ছিল আর আমার কানে একঘেয়ে বেজে যাচ্ছিল, ‘ডাবের জল ঘোলের জল মিছরির শরবৎ’।

আহা, একটুকরো ঝাল আলুর দমের আলুর জন্য আমি আদ্দেক রাজত্ব, এমনকী, বারো দোলের মেলায় কেনা ‘শোলে’ সিনেমার পিস্তলের মতো পিস্তলটাও দিয়ে দিতে রাজি। যাই হোক, ‘ভারতের সাধক’ পড়তে গিয়ে দেখলাম বৈরাগ্যসাধনে মুক্তি আমার হওয়ার নয়। অত সব আধ্যাত্মিকতার মাঝে গিয়ে মোক্ষম জায়গায় আটকালাম। এক সাধকের পাহাড়ে তীর্থযাত্রার বিবরণ। সারাদিন দুর্গম চড়াই ভেঙে উঠে তিনি পৌঁছেছেন এক চটিতে। রাতে সেখানে খাবারের সামান্য আয়োজন। টানলে রবারের মতো বেড়ে যায় এমন মিলেটের রুটি আর কুমড়োর ঘ্যাঁট। ব্যস, আমার পাপীমন ওখানেই আটকে গেল। না জানি কেমন খেতে মিলেটের রুটি আর কুমড়োর ঘ্যাঁট। সাধন মার্গে আর বেশি এগতে পারলাম না। মাঝখান থেকে থিন-এরারুট বিস্কুটের খাঁজকাটা ধারগুলো  গোল করে ফেলার শিল্প রপ্ত হয়ে গেল।

কানাঘুষোয় বুঝতে পারি জ্বর কমেছে। কিন্তু ‘ফুল রেমিশন’ না হওয়া পর্যন্ত নিস্তার নেই। আমি আশায় আশায় দিন গুনতে থাকি। পাড়ার বন্ধু জানলা দিয়ে জানিয়ে যায়, তার বউদি কলকাতা থেকে পুজোসংখ্যা ‘নবকল্লোল’ নিয়ে এসেছে। প্রচুর বড়দের গল্প আছে। আর বড়দের গল্প। আমার তখন অন্ন চিন্তা  চমৎকারা!

অবশেষে একদিন দরজা-জানলা বন্ধ করে গরম জলে গা স্পাঞ্জ করানো হল। ঠান্ডা জলে মাথা ধোয়ানো হল। মা তড়িঘড়ি কাচা জামা পরিয়ে দিল, না হলে বাবা বলেছে ‘এক্সপোজার’ লেগে যাবে। আমি ঠিক করেছি, একহাঁড়ি ভাত একাই খাব। আসন পেতে বসতে দিয়েছে আবার। জন্মদিনে পায়েস দিলে যেমন দেয়। গলা ভাত, পেঁপে সেদ্ধ, গোলমরিচ দিয়ে মাগুর মাছের ঝোল। আহা, অমৃত! কিন্তু খেতে গিয়ে দেখি, একটু খেয়েই পেট ভরে গেল। বাবা বলল, জোর করে খাবে না। উঠে বালিশে হেলান দিয়ে গল্পের বই পড়বে। খবরদার ঘুমনো চলবে না। ঘুমলেই জ্বর আসবে নির্ঘাত। আমি মনে মনে বললাম, আমার ঘুমতে বয়েই গেছে। রেডিওতে ‘বিবিধ ভারতী’ শুনব। আজ সাত খুন মাফ।

ও মা! কোথায় কী? খেয়ে উঠতে উঠতেই রাজ্যের ঘুম দু-চোখে। সামনে বাবা স্টেটসম্যান নিয়ে বসে। কড়া পাহারা। মনে মনে কল্পনা করছি, আফ্রিকার গহিন জঙ্গলে অ্যাডভেঞ্চারে গিয়েছি। আমাকে স্লিপিং ফ্লাই Tsetse  কামড়েছে। ঘুমে দু-চোখ জুড়ে আসছে। পুজো আসতে আর দিনদশেক দেরি। 

ভটচায বাড়ির মণ্ডপে খড় বেঁধে কাঠামো হয়েছে, দেখা হয়নি। একমেটে হয়ে গেছে। দেখা হয়নি। এখন দো মেটে হওয়া ইস্তক ইস্কুলফেরত ওখানেই ডিউটি। ছাঁচের মুখ বসছে দেবীমূর্তির, এঁটেল মাটি দিয়ে মেরামত হচ্ছে ফাঁকফোকর। মহালয়ার ভোরে মা ডেকে উঠতে বলেছিল। আমি ‘তব অচিন্ত্য’ শুনতে শুনতে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে গেছি। ঠাকুর রং করা শুরু হতে চোখের সামনে ঘটে যাচ্ছে ম্যাজিক। নীল আর হলুদ মিলে হয়ে যাচ্ছে আশ্চর্য সবুজ। একটু একটু করে হিম পড়ে আর বয়ঃসন্ধি আসে। গা শিরশির করে। পুজোর সময় শাসন আলগা। বন্ধুরা মিলে প্ল্যান করি লুকিয়ে অনেক দুরের কোনও দোকান থেকে সিগারেট কিনে খাব। কিংসাইজ! গার্লস ইস্কুলের যেসব মেয়েদের দিকে তাকিয়ে দেখার সাহস করে উঠতে পারিনি এতদিন, এবার অষ্টমীর সন্ধেয় তাদের দেখা পেলে চোখে চোখে তাকাব, হাসতেও পারি। ইস্কুলের উঁচু ক্লাসের দাদাদের মতো হব। তারা কী সুন্দর সিটি দেয়, হিন্দি বইয়ের গান গায়। ওইরকম হব। অবশ্য বড়দের মতিগতি বোঝা ভার। 

গ্রামে একটা দুগ্ধ সমবায় ছিল। তার একটা দুধ ঠান্ডা করার ঘর ছিল, চলতি কথায় দুধ মিল। আর একটা লজঝড়ে গাড়ি ছিল সেই দুধ সদরে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সবাই সেই গাড়িকে বলত, ‘দুধ মিল্কের’ গাড়ি। বাবা আমার মুখে সে-কথা শুনে বলল, ও আবার কী কথা? মিল্ক কো-অপারেটিভ অ্যান্ড চিলিং প্ল্যান্ট-এর গাড়ি বলবে। গার্লস ইস্কুলের বড় পরীক্ষার সেন্টার বাইরে পড়লে বাস ভাড়া করা হত সেন্টারে যাওয়া-আসার জন্য। উঁচু ক্লাসের ছেলেরা দেখছি ওটাকেও বলছে ‘দুধ মিল্কের’ গাড়ি। আমি বললাম, মিল্ক কো অপারেটিভ অ্যান্ড চিলিং প্ল্যান্ট-এর গাড়ি। ডেঁপো বলে আমার মাথায় চাঁটি দিলো ওরা। এই তো বড়দের অবস্থা।  

গ্রামের পুজো মানেই আড়ম্বরহীন একচালার দেবীমূর্তি। সাদামাটা প্যান্ডেল। আলোর বাহুল্য নেই। গোটাচারেক টিউবলাইট জেনারেটরের ভরসায় লাগানো। অবোধ শিশুকোলে মা মণ্ডপে এসেছে আটপৌরে শাড়ি পরে। ক্যাপ ফাটাচ্ছে দু-তিনটে বালক। ঢাকি ঢাক বাজাচ্ছে আরতির তালে তালে। সঙ্গে কাঁসি বাজাচ্ছে আমাদের বয়সি একটা বাচ্চা, ঢাকির কেউ হবে। দেবীর কীসে আগমন আর কীসে গমন, তা মা পঞ্জিকা দেখে বলত। ফল শস্যপূর্ণবসুন্ধরা না ছত্রভঙ্গ। কিন্তু পুজো আসতে আসতেই ফিনিশ। এই কলাবউ স্নান-বোধন হল, সপ্তমীতে কুলকাঠের আগুন জ্বলল মণ্ডপের পাশে। তাই দিয়ে আমরা দেদার দোদমা আর চকলেট বোম ফাটিয়ে কোটা শেষ করে ফেললাম। অষ্টমীর সন্ধিপুজোর আগে দোনলা বন্দুক থেকে ফায়ার করে জানান দেওয়া হল সন্ধিপুজো শুরু হচ্ছে। পুরুতমশাইয়ের সন্ধি আরতি করতে গিয়ে ভর উঠল। আমরা সে ডামাডোলে সিগারেটে টান দিয়ে দেখলাম অতি বিস্বাদ। প্লাস কাশি হলও খুব। গার্লস স্কুলের কোনও মেয়ের সঙ্গে দেখা হল না। যার সঙ্গে দেখা হল, তার কড়া বাবা মা-কে দেখে আমরা পালিয়ে বাঁচলাম। বোঝার ওপর শাকের আঁটি, গুড বয় মাধব। সে অষ্টমীর রাত্রে নাকি টেস্ট পেপার সলভ করছে। একটু ভাল মনে আনন্দ করবো তার যো আছে? মাঝখান থেকে ভোম্বল দেখি মুখ শুকনো করে ঘুরছে। কী ব্যাপার? প্রতিবার ও মণ্ডপে তদারকি করে। ভোগ নেয়, প্রসাদী ভোগ ফেরত দেয়। গতবার ঠাকুরের প্রণামীর বাটা ঝেড়ে নাকি মুরগি দিয়ে ফিস্টি করেছিল। এবার সাসপেন্ড। 

নবমীর দিন বৃষ্টি হল, দেখতে দেখতে দশমী এসে গেল। সকালে মাটিতে গর্ত খুঁড়ে জল ঢেলে কাদা করে ‘কাদা খেড়’। না-ছাড়ানো নারকেল নিয়ে ছেলেপিলের মধ্যে কাদার মধ্যে কাড়াকাড়ি। দশমীর বিকেলে জলঙ্গী সমারোহে সেজে ওঠে। বিসর্জনের নৌকা বাইচ। ছোট-বড় নানান নৌকা ফুল-বেলুন দিয়ে সাজানো, পাক দিচ্ছে নদী জুড়ে। ভাড়া নৌকায় সবাই নেমেছে বিসর্জন দেখতে। দুই পারে কাতারে কাতারে লোক দাঁড়িয়ে। ঠাকুরের নৌকাগুলো জোড়া নৌকার ভারা। ঢাকি বিসর্জনের ঢাক বাজাচ্ছে, ধুনুচি নাচছে পাড়াতুতো কোনও হুনুরি। কলাবউয়ের লালপাড় সাদা শাড়ি জড়িয়ে মাতাল কেউ নাচছে ঘুরে ফিরে। থেকে জোকার উঠছে, দুগগা ঠাকুর মাইকি…।

প্রহর শেষের রাঙা আলোয় দু-একটা চোখাচখি হয়তো হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে বলছে, আসছে বছর আবার হবে। দিকচক্রবাল জুড়ে ঘন ঘন আকাশে উঠে ফেটে যাচ্ছে হাউই বাজি। দোদমার আওয়াজ নদীর ওপারে প্রতিধ্বনি হয়ে ডাবল হয়ে যাচ্ছে। সন্ধে নেমে আসছে ঝুপ করে। শেষ পাকের আগে অন্য নৌকা থেকে নেমে পড়ছে বিসর্জন দেখতে আসা মানুষজন। কলাবউয়ের শাড়ি পড়া মাতালটা লাট খাচ্ছে পাড়ের কাছে কাদায়। জলে ভেসে যাচ্ছে একলা বেলুন। ভাসান হয়ে গেলে দুম করে বদলে যাচ্ছে বিসর্জনের বাজনা। সেই বাজনায় মনখারাপের গন্ধ মিশে থাকে। নীলকণ্ঠ পাখি এতক্ষণে কৈলাস পৌঁছে গেছে বুঝি। বাড়ি ফিরে প্রণাম করার পালা। নাড়ু-মুড়কি। শৌখিন বাড়ি হলে ঘুগনিও দেয়। বাড়ি ফিরতে মা বলে, অনেক মাতন হয়েছে, কাল থেকে বই নিয়ে বসবে। যাঃ! শেষ।  

দেবীর কীসে আগমন আর কীসে গমন, তা মা পঞ্জিকা দেখে বলত। ফল শস্যপূর্ণবসুন্ধরা না ছত্রভঙ্গ। কিন্তু পুজো আসতে আসতেই ফিনিশ। এই কলাবউ স্নান-বোধন হল, সপ্তমীতে কুলকাঠের আগুন জ্বলল মণ্ডপের পাশে। তাই দিয়ে আমরা দেদার দোদমা আর চকলেট বোম ফাটিয়ে কোটা শেষ করে ফেললাম। অষ্টমীর সন্ধিপুজোর আগে দোনলা বন্দুক থেকে ফায়ার করে জানান দেওয়া হল সন্ধিপুজো শুরু হচ্ছে। পুরুতমশাইয়ের সন্ধি আরতি করতে গিয়ে ভর উঠল। আমরা সে ডামাডোলে সিগারেটে টান দিয়ে দেখলাম অতি বিস্বাদ। প্লাস কাশি হলও খুব।

তবে ওই যে বলে না, শেষ হয়েও না হইল শেষ। বহু বছর মহানগরবাসী হয়েও কোথাও একটা মায়া রয়ে যায়। এক অন্তহীন বয়ঃসন্ধির উদযাপন যেন। চুলে পাক ধরে, দেখায় পাক ধরে, কিন্তু পুজো এলেই মন চলে যায় ছোটবেলার গ্রামে। আমি যেমন বদলে গেছি, গ্রামও বদলে আধা শহর। প্যান্ডেলে থিম উঁকি দিচ্ছে। এলইডি আলোয় ঝলমল করছে পুজোপ্রাঙ্গণ। মোবাইলে ঘন ঘন সেলফি তুলছে সপ্রতিভ যুবসমাজ। মাইকে অরিজিত সিং বাজছে। শাঁখ বাজানো, প্রদীপ জ্বালানোর কম্পিটিশন চলছে প্যান্ডেলে-প্যান্ডেলে।বাইক নিয়ে পুজো পরিক্রমায় বেরিয়েছে স্থানীয় ভ্লগার। উদ্যোক্তারা প্রাচীনত্ব বোঝাতে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়িয়ে দিচ্ছে পুজোর বয়স। বিসর্জনের সময় চুটিয়ে সিঁদুর খেলছে আইবুড়ো মেয়েরা আর সোশ্যাল মিডিয়ায় আপডেট দিচ্ছে, ফিলিং ব্লেসড। আমার সঙ্গে সংস্কৃত ক্লাসে যে ছেলেটা কাটা-গোল্লা খেলত পিছনের বেঞ্চিতে, সে এখন গুরুগম্ভীর তন্ত্রধারক। দেখি মাইকে তারস্বরে মন্ত্র বলছে পুরহিতের জন্য। পুরো বীরেন ভদ্র রিডাক্স। একফাঁকে সুযোগ পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, হাঁ রে? আগে তো এরকমভাবে জোরে জোরে মন্ত্র বলার চল ছিল না? বলল, কী করি বল? পাব্লিক যা চায়! আমাদের তো সেরকম দিতে হবে। ছোটবেলার বন্ধু, তাই মুখ ফুটে বলেই ফেললাম, যদি ভুল সংস্কৃত কেউ ধরে ফেলে? বলল, তুই গানের সুর শুনিস না লিরিক্স? সুরটা ঠিক থাকলেই হল।

বুঝলাম, সুরটাই আসল। পুজোর সুর।