ডেটলাইন : পর্ব ২৭

Representative Image

থিম্পুর পথে…

‘সে কি জানিত না যত বড় রাজধানী
তত বিখ্যাত নয় এ হৃদয়পুর’

পারো থেকে থিম্পুতে পা দিয়েই মনে পড়ল শক্তি চট্টোপাধ্যায়। ছোট্ট-মিষ্টি পারোর সঙ্গে অনেক তফাৎ রাজধানী থিম্পুর। বেশ ব্যস্ততা মানুষের মধ্যে, বড়-বড় বাড়ি, অফিস, হোটেল, অনেক দোকানপাট। কোথায় যেন শুনেছিলাম, থিম্পু নাকি বিশ্বের একমাত্র রাজধানী শহর, যেখানে একটিও ট্রাফিক সিগন্যাল নেই। তাই হবে মনে হল, রাস্তা পারাপারের জন্য জেব্রা ক্রসিং আছে বটে, কিন্তু লাল-হলদে-সবুজ আলো চোখে পড়ল না। গাড়ির সংখ্যা অবশ্য তেমন বেশি নয়, লোক দেখলে নিজেরাই আস্তে করে দেয়, হাতের ইশারায় চালক বোঝায়, পেরিয়ে যান। ওয়েস্ট ইন্ডিজের কথা মনে পড়ল। সেখানকার ছোট্ট-ছোট্ট দেশগুলোর ছিমছাম রাজধানী শহরগুলোতেও এরকম রাস্তা পারাপারের সময় গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ে। অ্যান্টিগাতে তো আরও আশ্চর্য ব্যাপার। আমাকে একা রাস্তা পেরোতে দেখে গাড়ি তো দাঁড়িয়ে পড়লই, এমনকী একটা গাড়ির চালক নেমে এসে মাথা ঝুঁকিয়ে বাও করে হাত প্রসারিত করলেন, যেন আমি রাস্তা পেরিয়ে ওঁকে ধন্য করলাম! তত বাড়াবাড়ি না হলেও, থিম্পুতে বেশ লজ্জা লাগছিল এরকম রাজকীয় চালে রাস্তা পেরোতে। হোটেল থেকে বেরিয়ে উল্টোদিকের ফুটপাথে যাচ্ছিলাম চিরুনি কিনতে, কারণ আমারটা ফেলে এসেছি পারোর হোটেলে। সেই মনোহারি দোকানে অনেক কিছুর সঙ্গে সাজানো মধুর বোতল দেখে আমার কৌতূহল হল, ভুটানে কি মধু বিখ্যাত? শুনলাম, পুটকা নামের এই মধু নাকি এত স্বাস্থ্যকর যে অ্যান্টিবায়োটিকের কাজ করে। মেলিপোনা নামের একধরনের হুলবিহীন মৌমাছি, সম্ভবত ভুটানেই শুধু দেখা যায়, তাদের মধুর এমন আশ্চর্য গুণ। মধুর থেকেও আমার অবাক লাগল এমন মৌমাছির কথা শুনে যারা কামড়ায় না!

শুধুই কি এরকম দুর্গম জায়গায় বলে এত বিখ্যাত ভুটানের আইকনিক মনেস্ট্রি?
তপশ্রী গুপ্তর কলমে পড়ুন ‘ডেটলাইন’ পর্ব ২৫

থিম্পুতে এরকম আশ্চর্য জিনিস আরও আছে। জিপিও মানে জেনারেল পোস্ট অফিস, কলকাতার মতো জমকালো না হলেও, বেশ সম্ভ্রম জাগানো পুরনো আমলের বড় বাড়ি। তার একদিকে যেমন ডাকঘরের কাজকর্ম চলে, অন্যদিকে রয়েছে স্যুভেনির শপ। কলকাতার জিপিও-তেও নাকি খুলেছে এরকম একটা স্মারক সংগ্রহের দোকান। অনেক শহরেই আছে নিশ্চয়ই, দেখা হয়নি কখনও। আসলে এই হোয়াটস্‌অ্যাপ-ইমেল-ফেসটাইমের যুগে চিঠি, লেটার বক্স, ডাকঘররের কথা মনেই পড়ে না।

একজন মজার কথাটা বলেছিল বলেই খুঁজে বার করা থিম্পুর প্রধান ডাকঘর। এখানে এমন ব্যবস্থা আছে যে সামান্য খরচে আপনি চমকে দিতে পারেন বাড়িতে অপেক্ষায় থাকা প্রিয়জনকে, আপনার ছবি দেওয়া ডাকটিকিট লাগানো চিঠি বা পিকচার পোস্টকার্ড পাঠিয়ে। প্রথমে ভেবেছিলাম, এমনি স্ট্যাম্প, কাজের নয় নিশ্চয়ই। কিন্তু জানলাম, সাধারণ ডাকটিকিটের মতন খামে, কার্ডে সেঁটে পাঠিয়ে দেওয়া যায় পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে। আরও হতবাক হওয়া বাকি ছিল। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।

থিম্পু জিপিও

অপ্রাসঙ্গিক হলেও একটা কথা বলার ইচ্ছে হল আমার। বাঙালিদের মধ্যে অনেকের নেপাল বা ভুটান নাম শুনেছি। কই, অন্য প্রতিবেশী যেমন বর্মা, শ্রীলঙ্কা বা বাংলাদেশ নাম কেউ রেখেছেন ছেলের, এমন তো শুনিনি কখনও। পাকিস্তান নামে একটা গুন্ডা অবশ্য ছিল একসময় কলকাতার এক কুখ্যাত এলাকায়। পড়শিরা বলেছিল, বাবা-মা তার ওরকম নাম রাখেননি; ‘ডেঞ্জারাস’ বলে সমীহ করে, পাড়ার লোকই তাকে ঐ নাম দিয়েছিল।

সে যাই হোক, আপাতত এসেছি থিম্পুর এক ‘অথেন্টিক ভুটানি ফুড’-এর রেস্তরায়। এমা দাৎসি আর কেওয়া দাৎসি চেখে দেখতে। প্রথমটার রেসিপি শুনেই বুঝলাম, এই অমৃত আমার জন্য নয়। কেওয়া খেয়ে দেখা যেতে পারে। এমা দাৎসি হল ভুটানের জাতীয় খাদ্য, মারাত্মক লঙ্কাগুঁড়ো আর চিজ দেওয়া মশলাদার স্টু। কেওয়া দাৎসি বোধহয় আমার মতো গোবেচারাদের কথা ভেবে তৈরি, এতে লঙ্কাগুঁড়োর বদলে থাকে আলু। ভাত দিয়ে খাওয়া যায় দুটোই। লক্ষ্য করে দেখেছি, পাহাড়ি মানুষেরা খুব ঝাল খেতে পারে। ভূত জলোকিয়া বলে যে আগুনে ঝাল লাল লঙ্কা উত্তর-পূর্ব ভারতে পাওয়া যায়, সেগুলো ভুটান বা সিকিমের লোকেদেরও প্রিয়। রান্নায়, আচারে হরদম দেয়। আমি অবশ্য পথেঘাটে দুষ্টের দমনে মেয়েদের সহায় পিপার স্প্রের বিকল্প হিসেবে ছাড়া এর আর কোনও উপযোগিতা খুঁজে পাইনি! অগত্যা আমি নিরীহ কেওয়া দাৎসি দিয়ে কয়েক গ্রাস ভাত খেলাম এবং ট্রাভেল শোয়ের জন্য ক্যামেরার সামনে তার গুণগান গাইলাম।

থিম্পু

ভুটানে গেলে সব জায়গাতেই দেখবেন জং। মানে বিশাল দুর্গ, কিন্তু ফোর্ট বলতে আমরা যেমন বুঝি তার থেকে অনেকটাই আলাদা। সেনাবাহিনী, অস্ত্রশস্ত্র মজুদ, নজরদারি আর শত্রুর মোকাবিলা, এসব শুধু নয়। ভুটানে জং হল একদিকে প্রশাসনের সদর দপ্তর, অন্যদিকে ধর্মীয় মঠ। এই যৌথ ক্ষমতার কেন্দ্র থেকেই নিয়ন্ত্রিত হয় এলাকা বা গোটা দেশ, যেখানে যেমন দরকার। জং-এর বাইরে দুর্গের মতো উঁচু পাঁচিল, চারপাশে পরিখাও কাটা থাকতে পারে, ভেতরে বিরাট উঠোন, উপাসনা এবং থাকার জায়গা। সাধারণত নদীর ধারে বা পাহাড়চুড়োয় জৎ, অনেকটা হেঁটে উঠতে হয়। তরুণ তো বটেই, বৃদ্ধ শ্রমণরাও কী অনায়াসে ওঠানামা করেন— পাইনবনের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া সরু পাহাড়ি পাকদন্ডী বেয়ে। আমরাও হাঁপাতে-হাঁপাতে উঠেছি এরকম বেশ কয়েকটা জং-এ। থিম্পুর তাশিছো জং যা থিম্পু জং নামেই বেশি পরিচিত, শহরের কাছেই, অবশ্য দুর্গম নয়। পতপত করে উড়ছে বজ্র-ড্রাগন আঁকা জাতীয় পতাকা। যে ওয়াং ছু নদীর ধারে এই জৎ, সেটাই উত্তরবঙ্গের রায়ডাক নদী।

১২১৬ খ্রীষ্টাব্দে তৈরি হয়েছিল তাশিছো জং। তবে ভুটানের আরও অনেক জং-এর মতো এটিও বারবার আগুনে ভস্মীভূত হয়েছে, আবার তৈরি হয়েছে। শুধু নাকি বেঁচে রয়েছে মাঝখানের মিনার আর মূল দুটো মন্দির। ১৯৬২ সাল থেকে প্রশাসনের সদর দপ্তর। থ্রোন রুম, সচিবালয়, স্বরাষ্ট্র বা অর্থ দপ্তরের মতো গুরুত্বপূর্ণ অফিস রয়েছে। এবং এই চত্বরে রয়েছে ভুটানের প্রাচীনতম মূর্তিগুলোর একটা শাক্যমুনি বুদ্ধ, যাকে ঘিরে রয়েছে আট বোধিসত্বর মূর্তি। আর রয়েছে প্রচুর বৌদ্ধ মঠ, মন্দির, উপাসনার জায়গা, যাকে ভুটানের ভাষায় বলে চোরতেন।

তাশিছো জং

ট্যুরিস্টরা ঘুরে দেখতে পারেন বিকেল পাঁচটার পর, মানে অফিস টাইম শেষ হলে। সঙ্গে গাইড নিতেই হবে। একসময়ে এখানেই থাকত রাজপরিবার, পরে তাঁরা চলে যান একটু দূরের দেচেনচোলিং প্রাসাদে। এখনকার রাজা অবশ্য রাণী আর রাজপুত্র-কন্যাদের নিয়ে থাকেন লিংকানা প্রাসাদে। চমৎকার উইলো গাছ দিয়ে ঘেরা লন আর পুকুর পেরিয়ে জমকালো প্রাসাদ দেচেনচোলিং। দূর থেকে দেখা যায়, বিশাল-বিশাল সিল্কের থাঙ্কা দিয়ে সাজানো। থাঙ্কার উৎপত্তি তিব্বতে। লম্বা কাপড়ের ওপর বৌদ্ধ মূর্তি বা মন্ডলা আর্ট আঁকা বা অ্যাপ্লিক করা। নেপাল, ভুটানের বৌদ্ধ মঠ, মন্দির থেকে শুরু করে রাজপ্রাসাদ, এমনকী অনেক সাধারণ বাড়ি বা রেস্তরাও থাঙ্কা দিয়ে সাজানো।

বসন্তদিনের ডাক এসেছে। অপেক্ষায় আছে চেরি ব্লসম। কখন যাব পুনাখা, ভেবে মন উতলা। এই মে মাসে থিম্পু হাল্কা ঠান্ডার চাদরে মোড়া। মাত্র ঘণ্টা-তিনেকের দূরত্বে পুনাখা এর থেকে উষ্ণ। কিন্তু ‘একটু উষ্ণতার জন্য’-র কবিকেও প্রার্থনায় ব্যাকুল হতে হয়েছে, ‘নাথ হে, প্রেমপথে সব বাধা ভাঙিয়া দাও।’

অত সহজে কি পৌঁছনো যায় ভালবাসার ঘরবাড়িতে? সকালে উঠে তো চেপে বসলাম ভাড়ার গাড়িতে পুনাখা যাব বলে। থিম্পু ছাড়িয়ে পাইনের ছায়াঘেরা পাহাড়ি পথে, ঝুঁকে পড়া স্যাঁতসেতে ফার্নের গন্ধে, দলছুট স্কুল-বালিকার এগিয়ে যাওয়ার তাড়া দেখতে দেখতে মন ভাল করা যাত্রা। কিছুক্ষণ পর থামতে হল চেকপোস্টে। সেখানে খুব ভিড়। আমেরিকা থেকে একটা বড় বাইকার্সের দল এসেছে। দু’জন করে একটা বাইকে, মাউন্টেন বাইকিং করে যাবে উঁচুর দিকে। পুনাখা ছাড়িয়ে ফোবজিখা, বুমথাং উপত্যকা, দোচুলা পাস হয়ে পারো। তাদের সঙ্গে প্রচুর লটবহর। স্থানীয় গাইডের দল, অ্যাম্বুল্যান্স, এয়ার কন্ডিশনড ভ্যান ইত্যাদি। আমরা কোনওমতে কাউন্টারে পৌঁছলাম, ওপারে বসা সরকারি কর্মী পাস দেখতে চাইলেন। আমি পারো এয়ারপোর্টে পাওয়া এট্রি পারমিট দেখালাম। তিনি ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘এতে হবে না। এটা পারো আর থিম্পুর জন্য। তার বাইরে যেতে গেলে থিম্পুর অভিবাসন দপ্তর থেকে স্পেশ্যাল রুট পারমিট নিতে হবে।’ সর্বনাশ, অর্ধেক রাস্তা চলে এসেছি, আবার ফেরত গিয়ে পারমিট নিতে তো বেলা গড়িয়ে যাবে। হতাশ হয়ে একটা চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে পড়লাম। আমার সামনেই বসেছিল এক আমেরিকান তরুণ আর তার বান্ধবী। এসব ঝামেলার মাঝেও ক্যামেরাম্যান কিন্তু তার কাজ করে চলেছে, পাহাড় থেকে চেকপোস্ট, সাহেব মেমেদের ভিড় থেকে চায়ের দোকান, সব লেন্সবন্দী করছে। সেসব দেখেশুনে তারা জানতে চাইল, কীসের শ্যুটিং করছি। বললাম, ট্রাভেল শো। দেখলাম, মেয়েটি ফিসফিস করে কিছু বলল বন্ধুর কানে। ছেলেটি আমার দিকে তাকিয়ে হাসল, ‘ইউ আর লাকি। ইউ হ্যাভ অ্যাডিডাস অ্যাজ ইওর স্পনসর।’ আমি তো অবাক। এর মধ্যে অ্যাডিডাস এল কোথা থেকে? এবার মেয়েটি বেশ প্রশংসার গলায় বলল, ‘ইউনিক ওয়ে অফ মার্কেটিং। দ্য লোগো ইজ অন ইওর ইয়ার রিংস।’ ও হরি, ব্যাংককের ফুটপাথ থেকে কেনা কুড়ি ভাটের (ভারতীয় টাকায় ৫০ হবে) দুলে অ্যাডিডাসের লোগো! আমি একটু ভারিক্কি হাসি দিলাম। লাকিই বটে, আমি বলে গাড়িভাড়ার হিসেব করছি, এখন এতটা পথ উজিয়ে ফিরতে হবে থিম্পু, পারমিটের জন্য।

যাই হোক, দেড়গুণ ভাড়া গুণে থিম্পুর প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া সরকারি দপ্তর থেকে পারমিট যোগাড় করে সে-যাত্রা পুনাখা পৌঁছেছিলাম গভীর রাতে। মহা টেনশনে গোটা দিন কাটিয়ে টিপটিপ বৃষ্টিতে আবার সেই পাহাড়ের স্টেপল ফুড নুডলস খেতে-খেতে কিন্তু একটুও আফশোস হল না। দুপুরেই যে পেরিয়ে এসেছি ‘স্বর্গের আগের স্টেশন’ দোচুলা পাস। সেই অ্যাডভেঞ্চার পরের পর্বে।