মশগুল: পর্ব ১১

‘দোহার’-এর আড্ডা

বাঙালির জীবনে, চা আর আড্ডা একে অন্যের পরিপূরক; আড্ডার সঙ্গে গান-বাজনার প্রসঙ্গ— পৃথিবী জুড়ে একাকার হয়ে আছে। পৃথিবীর নানা প্রান্তে গান গাইতে যাওয়ার সুবাদে দেখেছি, গান-বাজনা সম্বল করে, যে-কোনও ভাষাভাষী মানুষের সঙ্গে অনায়াসে আড্ডা জুড়ে দেওয়া যায়। গান-বাজনার ভাষাতেই অনাবিল আড্ডা চলে।

‘দোহার’-এর ২৬ বছরের গান-জীবনে এমন অনেক মুহূর্ত তৈরি হয়েছে, আবার কখনও-কখনও, কোনও আড্ডা, গান-বাজনাকে কেন্দ্র করে শুরু হলেও, পরে নিখাদ আড্ডা হয়েই থেকে গেছে, গান-বাজনা তেমন কিছু হয়নি। আজ তেমনই কিছু মুহূর্ত ভাগ করে নেব সবার সঙ্গে।

শান্তিদেব ঘোষের ভাইয়ের সঙ্গে কি সুচিত্রা মিত্রের প্রেম ছিল? আড্ডায় উঠল সে-প্রসঙ্গ। কালোর দোকানের আড্ডা নিয়ে লিখছেন, ব্রতীন্দ্রমোহন সেন। পড়ুন: মশগুল পর্ব ১০

শীতকালে অনুষ্ঠানর মরশুম মানেই ট্রেন, ফ্লাইট কিংবা গাড়িতে ঘুরে বেড়ানো। গন্তব্যে যাওয়া, অনুষ্ঠান করার পাশাপাশি একটা বড় আকর্ষণ, রাস্তায় খাওয়া-দাওয়া এবং আড্ডা। দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে মানেই শক্তিগড়ে দাঁড়িয়ে চা, সিঙারা, লেংচা আর আড্ডা। কিংবা বম্বে রোডে কোলাঘাটে খাওয়া-দাওয়া সহযোগে আড্ডা। শুধু তো আড্ডা নয়, সঙ্গে এর-তার পেছনে খুনসুটি— এতেই আনন্দ বেশি।

কালিকাপ্রসাদ এবং আড্ডা…

সবচেয়ে উৎকৃষ্ট আড্ডার জায়গা অবশ্যই ট্রেন। আমাদের মধ্যমণি কালিকাপ্রসাদের সঙ্গে ‘আড্ডা’ শব্দটা যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। এমন অনেক সুর, লেখা, ভাবনা ‘দোহার’-এর গান জীবনে তৈরি হয়েছে, যে-সব কোনও না কোনও আড্ডারই ফসল।

২০১৬-র শেষের দিকে এক রিহার্সালের ফাঁকে, আড্ডার ছলেই কালিকামামা (কালিকাপ্রসাদ) হঠাৎ বলতে শুরু করলেন, ‘হাজার বছরের বাংলা গান’-নিয়ে যদি একটা সরণি তৈরি করা যায়! সেই আড্ডার ফসল­­­— ২০১৭-র ৩ ফেব্রুয়ারী কলকাতা বইমেলার মঞ্চে ‘হাজার বছরের বাংলা গান’ প্রোডাকশনের মঞ্চায়ন। ঠিক তেমনই আড্ডার ছলে, পুরুলিয়া থেকে কলকাতা ফেরার সময়, ট্রেনের কামরায় বিদ্যাপতির একটি পদে সুর জন্ম নেয়, পরে অনেক মঞ্চে আমরা সেই গানটি গাই।

লোকগান— লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ার গান, এমন অনেক ধারার গান আছে, যে-গানগুলোর জন্মই হয় এমন সব আড্ডায় বা বৈঠকি কোনও আসরে। সিলেট অঞ্চলের ধামাইল-গীত তার বড় উদাহরণ। মেয়েরা বাড়ির কোনও উৎসব-পরবে একত্রিত হন। সেখানে মূলত সময় কাটানোর জন্য একটি লাইন হয়তো কেউ আওড়ালেন, তারপর অন্যজন আরেক লাইন জুড়ে দিলেন আড্ডার ছলে, এভাবেই লাইন জুড়ে-জুড়ে অনেক গানের জন্ম হয়েছে। হয়তো সে-রকম অনেক গান আমরাও মঞ্চে গাই, যে-গানগুলো এ-রকমই কোনও আড্ডার ছলে তৈরি। তাই কে যে তার পদকর্তা, কেই-বা সুরকার কিছুই জানা যায় না। আদতে পুরোটাই ‘মুখে মুখে ফেরা মানুষের গান…’। 

আসলে লোকশিল্প তো একরকম যাপনের ফসল, লোকগানও সেই যাপন থেকে জন্ম নেয়। সেই যাপনের অংশ আড্ডাও। আমাদের পরম্পরা তাই-ই বলে। আমরাও এর ব্যতিক্রম নই। আমরা সেটাকে চর্চা করে আয়ত্তে আনি শহরে বসে। ছড়িয়ে দিই বিশ্বময়। তাই ‘আড্ডাবাজ বাঙলি’র তকমা আসলে অনেক ফসলের উৎস।

বাংলাগানের ইতিহাসে আড্ডায় গান-বাজনা একটা বড় অংশ জুড়ে আছে। ‘গান-বাজনার আড্ডা’ নাকি ‘আড্ডায় গান-বাজনা’ সে-নিয়েও এক বিতর্ক সভা আয়োজন করা যেতেই পারে। হয়তো কখনও হবে। 

২০০৯ সালে ‘দোহার’-এর প্রথম সম্পূর্ণ রবীন্দ্রসংগীতের অ্যালবামের প্রস্তুতির জন্য কালিকাপ্রসাদ, রাজীব, অমিত, মৃগনাভীরা গেছেন শান্তিনিকেতনে, শান্তিদেব ঘোষের অন্যতম ছাত্র, বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষক তমাল পালের কাছে গানের তালিম নিতে। গানের খুটিনাটি শিখছেন, স্বরলিপি দেখছেন— সবই হচ্ছে, কিন্তু সেই আসরের মূল আকর্ষণ আড্ডা ও রবীন্দ্রনাথ।

আড্ডার ছলেই তমালদা গেয়ে চলেছেন অসাধারণ সব গান। তমালদা গাইছেন, ‘বর্ষণগীত হল মুখরিত মেঘমন্দ্রিত ছন্দে’, বাইরে অঝোরে বৃষ্টি। কালিকাপ্রসাদের কাছেই পরে শুনেছি, আদতে গান শেখার অছিলায় ওই মানুষটার সঙ্গে সময় কাটানো, তাঁর সাহচর্য আর আড্ডা দেওয়াই ছিল মূল।

বাউল-ফকিরের ডেরার ঘুরে-ঘুরে আড্ডার ছলেই তৈরি হয়েছে দোহারের আরেকটি খুব গুরুত্বপূর্ণ অ্যালবাম ‘বাউল-ফকিরের রবীন্দ্রনাথ’।  রবীন্দ্রনাথ তো বাউলের সংস্পর্শে এসছেন, ‘বাউল-দর্শন’-কে ধরার চেষ্টা করছেন, তৈরি করছেন একের পর এক গান। কিন্তু আসলে বাংলার বাউল-ফকিররা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কী ভাবছেন, তাঁর গানকেই বা কীভাবে দেখছেন, সেখান থেকেই এ-ভাবনা। গোটা বাংলায় ঘুরে-ঘুরে আড্ডার আসরে জন্ম নিল আস্ত এক অ্যালবাম।

আমাদের ২০২৪-এর রাশিয়া সফরের কথা একটু বলি এবার। রাজীব মামা (রাজীব দাস)-এর নেতৃত্বে আমরা আটজন, এই জুন মাসেই পাড়ি দিয়েছিলাম ভারতীয় দূতাবাস, রাশিয়ার আয়োজনে রাশিয়ার দু’টি শহরে গান গাইতে। বাংলা বা ইংরেজি কোনওটাই সে-দেশে প্রায় চলেনা বললেই চলে, সে-কথা আমরা সবাই জানি। তাই দূতাবাসের তরফে অনুষ্ঠান চলাকালীন আমাদের সঙ্গে একজন দোভাষী বন্ধুকে সঙ্গী করে দেওয়া হয়েছিল। সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরে অনুষ্ঠান সেরে মস্কোতে আসার পর আমাদের দোভাষী বন্ধু হলেন এক সুন্দরী তরুণী ক্যাটরিনা।

আসলে লোকশিল্প তো একরকম যাপনের ফসল, লোকগানও সেই যাপন থেকে জন্ম নেয়। সেই যাপনের অংশ আড্ডাও। আমাদের পরম্পরা তাই-ই বলে। আমরাও এর ব্যতিক্রম নই। আমরা সেটাকে চর্চা করে আয়ত্তে আনি শহরে বসে। ছড়িয়ে দিই বিশ্বময়। তাই ‘আড্ডাবাজ বাঙলি’র তকমা আসলে অনেক ফসলের উৎস।

আমরা অনুষ্ঠানের আগে, চা সহযোগে দিব্যি আড্ডা দিচ্ছি মাতৃভাষায়, সে হাঁ করে তাকিয়ে শুনছে সবার কথা; কিন্তু, আড্ডায় সে-ভাবে যোগ দেওয়ার সুযোগ হচ্ছে না। প্রথম, দ্বিতীয় দিন এ-ভাবেই কেটে যাওয়ার পর, সত্যজিৎদা ওকে বাংলা শব্দ শেখাতে শুরু করল, এবং ধীরে-ধীরে সেই আড্ডার মূল আকর্ষণ কিন্তু , তরুণী ও তার মুখের বাংলা শব্দগুচ্ছ হয়ে উঠল। তবে, শুধু সেই তরুণীই নয়, আড্ডার ছলে সত্যজিৎদা গোটা রাশিয়া সফরে প্রায় সবার সঙ্গে দিব্যি বাংলায় কথা বলতে শুরু করেছিল, এবং তাঁরাও স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে যোগ দিচ্ছিলেন আমাদের সঙ্গে। এখনেই বাঙালির আড্ডাবাজির সার্থকতা।

২০১৪ হোক বা ২০১৮, নিউইয়র্কের টাইমস স্কোয়ারে আমরা যখনই গেছি, কফি এবং সঙ্গে নিয়ে যাওয়া চিড়েভাজা সহযোগে আড্ডাটা মাস্ট ছিল। ও-রকম হ্যাপেনিং একটা পরিবেশে অনাবিল আড্ডা যে আমাদের কী প্রাণসঞ্চার ঘটিয়েছে— সে বলে বোঝানোর নয়। 

আবার একইভাবে বীরভূমে কোনও বাউলের ডেরা হোক কিংবা পুরুলিয়ার চরিদা গ্রাম, আমরা বারবার অনায়াসে আড্ডায় মজেছি— বাংলার লোকশিল্পীদের সঙ্গে। আমাদের প্রাণ দিয়েছেন তাঁরা, সাহস যুগিয়েছেন সে-সব আসরে। ‘দোহার’, আজও নিজের গান-জীবনে— এ-ভাবেই হৈহৈ করে এগিয়ে চলেছে আড্ডাবাজিকে সঙ্গী করে।