গোপনে হিংসার কথা
আমার দু’ভাই ও বোন শম্ভুদার লং কোট পরা ছদ্মবেশ দেখে খুব হাসাহাসি করছিল। উঁকি দিয়ে আমার মা-ও হাসছিল। কাচুমাচুভাবে শম্ভুদা বলল, গুজরাতে লুকিয়ে থাকতে গিয়েছিলুম। ওখানকার কমরেডরা দিয়েছে। ‘কমরেড!’— আমি আশ্চর্য হওয়ায় শম্ভুদা বলল, ‘মোরারজির চ্যালারা, তারা জরুরি অবস্থার প্রতিবাদ করছে। আমাকে আশ্রয় দিয়েছিল, আমি তাদের কমরেড বলতুম।’ এরপরই শম্ভুদা বলল, ‘চল চল, ব্যারাকপুর যেতে হবে। জ্যোতিদা ঠ্যাং ভেঙে ব্যারাকপুরে পড়ে আছে। সেখানে একটা ভাঙা কুঠিবাড়িতে আছেন, তাঁর একটা নিরাপদ থাকার ব্যবস্থা তোকে করে দিতে হবে। তৎক্ষণাৎ আমার মাথায় দ্রুত খেলতে লাগল… রানাঘাট… কৃষ্ণনগর…।’ চন্দন আছে, নিজনদা আছেন, গৌতম তো খুব পরোপকারী ছেলে, ওদিকে দেবদাসদা আছেন… ব্যারাকপুর থেকে ট্রেনে নিয়ে যাওয়ার সুবিধা থাকলেও জনবহুল শহরাঞ্চল, যেখানে সেখানে জ্যোতিদা ধরা পড়ে যাবেন। তখনই আমার মাথায় এল, চাঁপাডাঙা… বিশ্বনাথ গরাই আছে, আমাদের সত্তর দশকীয় এই কবিবন্ধুটির ওই গ্রামগঞ্জে দলবল বিস্তর, টুলু পাল আছে, স্বপন ঘাটি আছে। টুলু পালের জিপগাড়িতে জ্যোতিদাকে চাঁপাডাঙার চেয়েও গহিন গ্রামে জ্যোতিদাকে নিরাপদে পাচার করে দেওয়া যাবে। বিশ্বনাথ চাঁপাডাঙা হাইস্কুলের শিক্ষক, গ্রামগ্রামান্তে তার ছাত্ররা আছে। ঠিক হল, জ্যোতিদাকে ব্যারাকপুর থেকে টুক করে লঞ্চে তুলে শ্রীরামপুরে এনে তারকেশ্বরের ট্রেনে তুলব। শেওড়াফুলি পার হলেই ওদিককার গ্রামীণ রেলস্টেশন (তখনকার), জ্যোতিদাকে কেউ বুঝতেই পারবে না, আমরা বলব, কাকাকে হাসপাতালে নে গেছলুম। তারকেশ্বর থেকে বাসে চাঁপাডাঙা পৌঁছোলেই নো চিন্তা।
আমি শম্ভুদার লং কোট খোলালাম। হাতের ডিকশনারিটি আমার ভাই তোতন নিল। গাঁট্টাগোঁট্টা শরীরের শম্ভু রক্ষিতের গায়ে আমার শার্ট হল না। আমার বাবার একটি পাঞ্জাবি শম্ভুদাকে পরালাম। লং কোটের নিচে শম্ভুদা পাজামা পরেছিল। সেটা থাকল।
শ্রীরামপুরের অলিগলি ধরে ফেরিঘাট যেতে যেতে শম্ভুদার কাছে শুনলাম, জ্যোতির্ময় দত্ত কলকাতায় দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে ছিলেন। পুলিশ তাঁকে ধরতে আসায় জ্যোতিদা দোতলা থেকে লাফ দিয়ে পা ভাঙেন। পাড়ার ছেলের ট্যাক্সিতে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিল, ওই ট্যাক্সিতেই ভুজুংভাজুং দিয়ে জ্যোতি দত্ত ব্যারাকপুর চলে আসেন। ব্যারাকপুর ক্যান্টনমেন্ট শহর। ব্যারাকপুরে ব্রিটিশ আমলের ভাঙাচোরা কয়েকটি কুঠি তখনও ছিল। সেইরকম একটি কুঠিতে জ্যোতিদা কী করে আশ্রয় পেয়েছেন, তা অবশ্য শম্ভুদা বলতে পারল না। তবে জ্যোতিদা সেখানে আশ্রয় নেওয়ায়, শম্ভুদা তাঁকে দেখে এসেছে। তখনই জ্যোতিদা অন্যত্র যাওয়ার ইচ্ছে জানিয়েছেন।
গঙ্গা পার হয়ে আমি আর শম্ভুদা ব্যারাকপুর পৌঁছলাম। জ্যোতিদা কোন কুঠিতে আছে, শম্ভুদা তার হদিশ জানত। ব্যারাকপুরে রিভারসাইড রোড ধরে আমরা ওই কুঠির উদ্দেশে হাঁটতে লাগলাম। হাঁটতে হাঁটতে শম্ভুদা পিছনে একবার তাকিয়ে আমাকে বলল, পিছনে তাকা। আমি তাকিয়ে দেখলাম, একটা ঢ্যাঙা মতো লোক নির্জন রিভারসাইড রোডে আমাদের পিছু পিছু হেঁটে আসছে। গম্ভীর মুখ করে শম্ভুদা বলল, পুলিশ হতে পারে। আমার আঁতকে ওঠা ভাব লক্ষ করে শম্ভুদা ফিসফিসিয়ে বলল, একা আছে, আমরা দু’জন। কিচ্ছুটি করতে পারবে না আমাদের। কী আশ্চর্য!— আমাদের কয়েক পা আগেই কয়েকটা বাঁশ, খুঁটি, চ্যালা কাঠ, দড়িদড়া রাস্তার ধারে পড়ে ছিল। ফের ফিসফিসিয়েই শম্ভুদা বলল, গুটি গুটি হাঁট, যদি আমাদের ক্রস করে চলে যায়, তাহলে কিছু না। আর যদি আমাদের কাছে এসে কিছু জিজ্ঞেস করে তাহলে, পুলিশ। শোন, জিজ্ঞেস করলেই আমি লাফিয়ে ওর গলা ধরে ওকে জাপটে ধরে ঝুলে পড়ব। তুই ওই বাঁশ দিয়ে ওর দু’পায় মারবি, যাতে উঠতে না পারে। তারপর দড়ি দিয়ে আমরা ওর হাত-পা বেঁধে আমরা চম্পট দেব।

আমি বললাম, শম্ভুদা, আমি কাউকে মারতে পারব না।
কথা ফুরতে না ফুরতে লোকটি আমাদের পাশে চলে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা জ্যোতির্ময় দত্তের কাছে যাচ্ছেন? উড়ন্ত বিদ্যুৎ যেন, শম্ভু রক্ষিত লাফ দিয়ে লোকটির গলা ধরে ঝুলতে লাগল। মুখে গর্জন, মার মৃদুল, মার! লোকটি বলতে থাকলেন, ছাড়ুন, ছাড়ুন, আমি আজিজুর রহমান, নিরঞ্জন হালদার আমাকে পাঠিয়েছেন…
তখন শম্ভু রক্ষিত আজিজুর রহমানকে ছেড়ে দিয়ে বলছে, ও তুমিই আজিজুর, তুমিই আজিজুর! আমিও আজিজুরকে ওই প্রথম দেখলাম। তখন শম্ভু জড়িয়ে ধরলেন আজিজুরকে। আমিও। আমাদের জড়াজড়ি হল। পথে একটা দোকানে আমরা চা খেলাম। তারপর আমরা তিনজনে পৌঁছলাম জ্যোতিদার আশ্রয়স্থল সেই কোঠিতে। ব্রিটিশ যুগের কোঠি, কোঠির লাগোয়া সে-সময়ের ঘোড়ার আস্তাবল। গোয়ালারা সেখানে খাটাল গড়েছে। হিন্দিভাষী একটি গোয়ালা পরিবারেরই আশ্রয়ে ছিলেন জ্যোতিদা। আমরা পৌঁছতেই জ্যোতিদা হাউহাউ করে কাঁদতে লাগলেন, তাঁর দেশমাতৃকার অবমাননা হয়েছে। ইন্দিরা গান্ধী গণতন্ত্র হত্যা করছেন। দেখলাম তাঁর একটি পায়ে হাঁটুর ওপর থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত প্লাস্টার রয়েছে। তবু ধরাধরি করে আমরা লঞ্চে গঙ্গা পেরিয়ে শ্রীরামপুর নিয়ে যেতে পারব, তারপর ট্রেনে তুলব, এই আশায় দু’টি রিকশা ডেকে আমরা ব্যারাকপুরের ধোবিঘাট রওনা হলাম। একটি রিকশায় জ্যোতিদা ও শম্ভুদা, আর-একটিতে আজিজুর ও আমি।
কথা ফুরতে না ফুরতে লোকটি আমাদের পাশে চলে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা জ্যোতির্ময় দত্তের কাছে যাচ্ছেন? উড়ন্ত বিদ্যুৎ যেন, শম্ভু রক্ষিত লাফ দিয়ে লোকটির গলা ধরে ঝুলতে লাগল। মুখে গর্জন, মার মৃদুল, মার! লোকটি বলতে থাকলেন, ছাড়ুন, ছাড়ুন, আমি আজিজুর রহমান, নিরঞ্জন হালদার আমাকে পাঠিয়েছেন…
তখন বিকেল হয়ে এসেছে। লোকজন পথে বের হয়েছে। হল কী, রিকশায় আসতে আসতে যেখানেই একটু লোকজন দেখছেন, রিকশ থামিয়ে দিচ্ছেন জ্যোতিদা। শম্ভুদার কাঁধে ভর দিয়ে আধ-দণ্ডায়মানভাবে ঈষৎ উঠে জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে বক্তৃতা দেওয়া শুরু করে দিচ্ছেন জ্যোতিদা। ভিড় জমে যাচ্ছে লোকজনের। কয়েকবার এমনটি দেখে বুঝলাম, ব্যারাকপুর ধোবিঘাটে, শ্রীরামপুর ফেরিঘাটে, শ্রীরামপুর স্টেশনে জ্যোতিদাকে নিয়ে গেলে, যে কোনও জায়গায় সবাই ধরা পড়ে যাব। শম্ভুদা, আজিজুরদার সঙ্গে তখনই আলোচনা করে ঠিক হল, না, জ্যোতিদাকে নিয়ে যাওয়া যাবে না। রিকশা ঘুরিয়ে আমরা আবার জ্যোতিদাকে ওই কোঠিবাড়িতে রেখে এলাম।
পরে কলকাতায় গিয়ে জ্যোতির্ময় দত্ত পুলিশের হাতে ধরা পরেন। শম্ভুদাও কলকাতা থেকে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। গৌরকিশোর ঘোষ, বরুণ সেনগুপ্ত আগেই গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। আজিজদা, আজিজুর রহমান ‘আজকাল’-এ আমার সহকর্মী ছিল। মুখোমুখি হলে মাঝে মাঝে তাকে ক্ষেপাতাম, ও আজিজদা, তোমাকে আমরা মেরেই ফেলতাম। এই আজিজুর শুধু জরুরি অবস্থায় নয়, গৌরকিশোর ঘোষ, জ্যোতির্ময় দত্তদের আরও নানা তৎপরতার সহযোগী ছিল।

ডিউক-পিনাকীর নৌযানে আন্দামান পাড়ি দেওয়া মাঝসমুদ্রে ভেস্তে যাওয়ার পর ‘মনিমেখলা’ নামে একটি ডিঙি ভাসিয়ে সিংহল (পরবর্তীকালের শ্রীলঙ্কা) যাত্রা করেছিলেন জ্যোতির্ময় দত্ত, আজিজুর রহমান ও মায়া সিদ্ধান্ত। জরুরি অবস্থার পরে ১৯৭৮ সালের মার্চে। মনিমেখলার ওই অভিযানও বিশাখাপত্তনম থেকে কিছুটা এগিয়ে দুর্যোগপূর্ণ সমুদ্রের জন্য পরিত্যক্ত হয়। গৌরকিশোর ঘোষ যখন তাঁর সম্পাদনায় ‘আজকাল’ সংবাদপত্রটি বের করেন, তখন আজিজুর রহমান ও শম্ভু রক্ষিত দু’জনকেই চাকরি দিয়েছিলেন। আজিজদা থেকে গেলেও, শম্ভুদা দিন তিন/চার হাজিরা দিয়ে সটান গৌরকিশোরকে গিয়ে বিনীতভাবে বলেন, গৌরদা এত নিয়মমাফিক চাকরি করা আমার কম্মো নয়, আমি চল্লুম। চাকরি থেকে আমার কিছুকাল আগেই অবসরপ্রাপ্ত আজিজদা এখন বারাসাতে থাকে। এ-লেখা লিখতে লিখতে আজিজদাকে ফোন করেছিলাম। জ্যোতিদা সাম্প্রতিক একটি সাক্ষাৎকারে জরুরি অবস্থার কথা বলতে গিয়ে শম্ভুদার নামোল্লেখ করেননি শুনে, আজিজদা বলল, জ্যোতিদার বয়স হয়েছে তো, ভুলে গেছেন।
নয়ের দশকে আমি তখন ‘আজকাল’-এ। আজিজুর রহমান ঢাকা যাবে, আমাকে এসে ধরল,মৃদুলভাই তোমার তো বাংলাদেশ অনেক চেনাজানা, আমি যাব, দু-চারজনকে চিঠি দিয়ে দাও না…। আমি তখন কয়েকবার বাংলাদেশে গিয়েছি।আমি দিয়ে দিলাম আজিজদা যাতে খাতিরযত্ন পায়, তেমন কয়েকজনকে চিঠি। তার ভেতর ঢাকার বাংলা আকাদেমির তৎকালীন মহাপরিচালক আসাদ চৌধুরীকে লেখা চিঠিও ছিল। আসাদভাই, কবি আসাদ চৌধুরী (প্রয়াত) বইরশাইল্যা, আমার সঙ্গে ছিল নিবিড় ভ্রাতৃসম্পর্ক। ঢাকা পৌঁছে আজিজদা বাংলা আকাদেমিতে পৌঁছল যখন, তখন সেখানে একটি সেমিনার চলছিল। আসাদভাই ছিলেন মঞ্চে। বাংলা আকাদেমির এক কর্মচারীর হাতে আজিজদা ওই চিঠি দেওয়ার পর, আসাদভাই ওই চিঠি পড়ে মঞ্চ থেকেই চেঁচালেন, ‘মৃদুলে পাঢাইসে, আসেন, আসেন’ বলে আজিজদাকে মঞ্চে তুলে নিলেন, তারপর মাইকে ঘোষণা করে দিলেন, কলকাতা থেকে বিশিষ্ট লেখক আজিজুর রহমান এসেছেন…. তিনি পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য নিয়া বলবেন।