বিভাজন-পূর্ব কালের অখণ্ড পঞ্জাব এবং সিন্ধ প্রদেশের অন্তর দিয়ে বহু নদী বয়ে গেছে দক্ষিণে সাগরের দিকে। সিন্ধু ছাড়াও রয়েছে ঝিলম, চেনাব, রাভি, বিয়াস, শতদ্রু। এইসব নদীর বিস্তীর্ণ অববাহিকায় একাদশ শতকের পরবর্তী সময় থেকে দীর্ঘ ছ’শো বছরে যে-সব সুফি ভাবধারার কবি ও সাধক কাজ করেছেন, তাঁদেরই মধ্যে থেকে নির্বাচিত কয়েকজনের রচনার সঙ্গে একটু কথাবার্তা বলাই আসলে লক্ষ্য।
ভক্তিবাদের এক তরঙ্গ অষ্টম থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত ভারতের অন্য নানা প্রান্তে যেমন প্রান্তজনের দিকে ছড়িয়ে দিয়েছিল পাখনা, কতক তেমনই, ভারতের এই অঞ্চলে সব ধর্মের মানুষের কাছে গিয়েছিল সুফিসন্তদের সুর। আজকের ভারতের ঘৃণালাঞ্ছিত রাজনীতির বয়ানে এসব অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। তবু মনে রাখা যাক, তৌহিদে আস্থাশীল সাধকের হাতে রাধা-কৃষ্ণ, সোহ্নি-মেহের, হির-রান্ঝা বড় সমাদরে এসেছিলেন। ইতিহাস খুঁড়ে সর্বদা মসজিদ বা মন্দির নয়, ‘রাশি রাশি দুঃখের খনি ভেদ করে’ প্রায়শই শোনা যায় ‘শত জল ঝর্ণার ধ্বনি।’ তার কিছু রেশ এখনও ঘুরে বেড়ায় হিন্দি-অবধি গানের সুরে। বাংলা ভাষাতেও তার কিছু ভাগ যদি পাওয়া যায়— এই আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এসেছে এই কলাম— ‘সিন্ধুপারের সুফি’।
বাবা ফরিদউদ্দিনের দর্শন ও কাব্য! পড়ুন ‘সিন্ধুপারের সুফি’ পর্ব ১ ও পর্ব ২…
শাহ্ মাধো লাল হুসেইন (১৫৩৯-১৫৯৪)

আমাদের কবি বিদ্যাপতির এই পঙ্ক্তি অনেকেরই জানা—
অনুখন মাধব মাধব সোঙরিতে
সুন্দরী ভেলি মাধাই—
বোঝাই যাচ্ছে, রাধার কথা বলা হচ্ছে এখানে। সারাক্ষণ কৃষ্ণের কথা ভাবতে ভাবতে রাধা একসময় নিজেই কৃষ্ণ হয়ে উঠলেন। তার ফলে কী কী কাণ্ড ঘটল, বিদ্যাপতির (১৩৫২-১৪৮৮) গানে তার বিবরণ আছে। গোলমাল হল খুব। কেননা, কৃষ্ণ হয়ে ওঠামাত্র রাধা রাধার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়লেন। বাইরে থেকে দেখে তখন মনে হল সকলের, রাধা স্বয়ং রাধার জন্য অস্থির হয়েছেন— বাইরের লোক তো আর জানে না, রাধা তখন আর রাধা নেই, তা বোঝা তাদের পক্ষে অসম্ভব। সে যাক, বিদ্যাপতির গান নিয়ে কথা নয়, আমরা আজ শাহ মাধো লাল হুসেইনকে নিয়ে কথা বলব— বিদ্যাপতির চেয়ে যিনি বয়সে বেশ কিছুটা ছোট— বিদ্যাপতির মৃত্যুর প্রায় একশো বছর পরে তাঁর জন্ম। পাঞ্জাবি ভাষার সুফি পরম্পরার কবি তিনি। কবিতা লিখেছেন প্রচলিত লোকায়ত সংরূপ ব্যবহার করে— পাঞ্জাবি সাহিত্যে সেগুলিকে ‘কাফি’ বলা হয়। হ্যাঁ, বর্তমান নিবন্ধকারের নামের সঙ্গে এর সাদৃশ্য আছে। অবশ্য বলে নেওয়া ভাল, কাফি ঠিক পাঠের জিনিস নয়, এটি গায়নের, উপস্থাপনের— একালে যাকে আমরা ‘পারফরম্যান্স’ বলি, সেই এলাকার বাসিন্দা। সেই শাহ হুসেইন কতকটা বিদ্যাপতির ঢঙে লিখেছিলেন পাঞ্জাবের লোককথার নায়ক-নায়িকা হির এবং রান্ঝার কথা। তাঁর নায়িকা হির সারাক্ষণ রান্ঝার নাম উচ্চারণ করতে করতে নিজেই একদিন রান্ঝা হয়ে যায়—
প্রেমিকের নাম মনে মনে আমি আউড়েছি এত এত বার,
নিজেই ক্রমশ হয়েছি স্বয়ং রান্ঝা…
আমাকে এখন রান্ঝা বলেই ডেকো ভাই,
হির বলে কেউ চেনে না আমায় এখানে…

এই একই অনুভূতির কথা পাঞ্জাবি সাহিত্যে অন্য কবিরাও লিখেছেন। পাঞ্জাবি সুফি সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি বাবা বুল্লে শাহ্-র কালামেও আমরা এই কথা পাব। কিন্তু তিনি আমাদের আলোচনায় আসবেন আরও অনেক পরে। আজকের পর্বে আছেন শাহ মাধো লাল হুসেইন। বাবা ফরিদকে নিয়ে আমাদের আগের আলোচনা অত্যধিক লম্বা হয়েছিল বলে দু’টি আলাদা পর্বে তাকে ভেঙে দিতে হয়েছে। এইবার তাই কিছুটা সংক্ষেপ করেছি কথা।
১
ভারতের সুফি সাধকদের পরিচয়জ্ঞাপক তিন খণ্ডের এক বৃহৎ সংকলনের নাম তাজকিরা-এ-অউলিয়া-এ-হিন্দ। সেখানে শাহ হুসেইনের পূর্ববৃত্তান্ত আছে কিছু পরিমাণ। কুলজস রাই, শাহ হসেইনের প্রপিতামহ ছিলেন কলসারি গোষ্ঠীর এক রাজপুত। এই জনগোষ্ঠীর বিচরণ ছিল শতদ্রু নদীর উপকূল ও অববাহিকা জুড়ে এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। জীবনের এক পর্বে ইসলাম ধর্ম নিয়েছিলেন তিনি। তাঁর পৌত্র, শেখ উসমান, হুসেইনের বাবা, তলোয়ার ছেড়ে সুতো বোনার কাজ বেছে নেন। হুসেইনের গানে মাঝে মাঝেই তাঁর জোলা পরিচয়ের কথা এসেছে—
নউন হুসাইনা তে জাত জুলাহা
গালিয়াঁ দেদিয়াঁ তানিয়াঁ বালিয়াঁ—
হুসাইন নাম, আমি জাতে এক জোলা—
আমার যতেক নিন্দুক তাই গালি দেয়।
পারিবারিক ও সামাজিক পরম্পরায় শাহ হুসেইন ইসলামি রীতি-রেওয়াজ মেনেই বড় হয়েছেন। নিজে কখনও জীবিকার জন্য তন্তুবায়ের কাজ করেছেন বলে মনে হয় না, কিন্তু বাবার পেশাটিকে অন্তত কবিতায় তিনি আঁকড়ে থেকেছেন। নিজের সঙ্গে সর্বদাই বেঁধে রেখেছেন তাঁর জোলা-পরিচিতিটি। সম্ভবত চারপাশ থেকে আসা তাচ্ছিল্য তাঁর সহায়ক হয়েছিল। সেটিকে বেশ আদরের সঙ্গে গায়ে জড়িয়ে নিয়েছিলেন হুসেইন। এর পাশাপাশি এও লক্ষণীয়, শাহ হুসেইন নিজের কাফিগুলির শেষে প্রায়শই নিজেকে চিহ্নিত করেছেন ‘নিমানা’ (নুমানা) ফকির হিসেবে। সোজাসাপটা দেখলে বলা যায়, এর অর্থ হল, মানহীন, অসম্মানিত, তাচ্ছিল্য-প্রাপ্ত ফকির।
এখানে দু’টি কথা মনে রাখা ভাল। বাংলায় আমরা ‘ফকির’ এবং ‘ভিখারি’ শব্দদু’টিকে এখন প্রায় সমার্থক মেনে নিয়েছি। বড়জোর মনে করা হয়, ফকির হল মুসলমান ভিখারি। অর্থাৎ, ভিখারি হিন্দুর এলাকায় থাকেন, ফকির মুসলমানপট্টিতে। এক হিসেবে হয়তো তাই। কিন্তু শব্দদু’টির গোড়ায় তাকালে বোঝা যাবে, ভিখারি শব্দে স্পষ্টতই আছে ভিক্ষা বা যাচনা। আর অন্যদিকে ফকির শব্দে কোনও চাওয়া নেই-ই। বরং না-চাওয়াই সেখানে আসল কথা। ফকির হলেন তিনিই, যিনি চাওয়া পেরিয়ে এসেছেন, যিনি বিলিয়ে দিয়েছেন সব। শব্দটি এসেছে আরবি ফক্র থেকে— যার অর্থ ‘দারিদ্র্য’ (গর্ব, আত্মসম্মান অর্থে ফারসি/ হিন্দি/ উর্দুতে প্রচলিত ফখ্র শব্দটির সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে চলবে না, তার মানে এবং বানান একেবারেই আলাদা)। শাহ হুসেইন নিজের গানে নিজেকে বারবার, বেশ মনে করিয়ে দেওয়ার ঢঙে বলেছেন মানহীন, তুচ্ছ ফকির।
বেশ ছোটবেলায় হুসেইন আরও অনেক সন্ত-ফকিরের মতোই বেশ মন দিয়ে পড়েছেন কোরআন। আদ্যোপান্ত মুখস্থ ছিল তাঁর, ফলে বলাই যেত ‘হাফিজ’। কিন্তু তাতে তো একটি মসজিদে বা মাদ্রাসায় শিক্ষক হয়ে থেকে যেতে পারতেন তিনি। তা হয়নি। বছর দশেক যখন বয়স তাঁর, লাহোরেই বাহ্লুল দারিয়াই নামক এক সুফি দরবেশের নজরে পড়ে যান শাহ হুসেইন। তাঁর যত্নে পড়তে থাকেন আরও নানা কিছু— বাহ্লুল নিজে ঘুরে বেড়িয়েছেন আরব-পারস্যের নানা শিক্ষা ও দর্শনচর্চার কেন্দ্র— ইরাক-ইরান-সিরিয়া, ছাত্রেরও কাছে সেইসব স্থানের জ্ঞান ও শিক্ষার আলো এসে পৌঁছল যেন শাহ হুসেইনের কাছে। এই জ্ঞান নিয়েই ক্রমশ তিনি এগলেন মত্ততার দিকে। ভালবাসার দিকে।

বাহ্লুল দরিয়াই তখন লাহোর থেকে ফিরে গেছেন নিজের এলাকায়— পাঞ্জাব প্রদেশেরই পশ্চিম প্রান্তের ঝং জেলার চিনিয়ত শহরে। হুসেইনের সুফি পন্থের শিক্ষা চলতে থাকে লাহোরেরই দাতা গঞ্জ বখ্শ্ কিংবা মখ্দুম হুজৌরির দরগায়— লাগাতার বারো বছর। বলা হয়, জীবনের এই পর্বে অনেক সময় রাভি নদীর তীরে সারা রাত দাঁড়িয়ে থেকে তিনি কোরআনের শ্লোক বা আয়াত আবৃত্তি করতেন। এসব ঘটনার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যায়, সন্তজীবনী প্রায়শই রচয়িতার ভক্তিভাবনার অনুসারী হয়ে থাকে, আমরা জানি। তবে এও লক্ষণীয়, এই বিবৃতির মধ্যে কিছু রহস্যময়তা আছে। কারণ প্রথাগত ইসলামের তরিকায় রাতে নদীর ধারে দাঁড়িয়ে কোরআন আবৃত্তি করার কোনও নির্দেশ নেই। এই পদ্ধতির মধ্য দিয়ে একাধারে ইসলামের প্রতি শ্রদ্ধা হুসেইনের এবং প্রথা অস্বীকারের প্রবণতা দুই-ই চোখে পড়ে। সারা রাত দাঁড়িয়ে থেকে কোরআন আবৃত্তির কাহিনি কি বলে দিচ্ছে এক ধরনের আত্মনিগ্রহের চেষ্টা এই সময় থেকেই শাহ হুসেইনের মধ্যে দেখা যাচ্ছিল? যোগ-দর্শনের প্রাথমিক পর্যায়ের কোনও রচনা কিংবা আলাপচারিতার সঙ্গে কি তাঁর পরিচয় হয়েছিল এই সময়েই? নিজেকে কষ্ট দিয়ে, নিজের ভেতরের দুর্মদ আমিটিকে অত্যাচার করে, তাচ্ছিল্য করে, ধ্বংস করে দেওয়ার যে জটিল কঠিন রাস্তা, সেই পথে কি শাহ হুসেইন শুরু করছেন তাঁর চলা? হেজিওগ্রাফি কিংবা ভক্তির চোখে ঝাপসা জীবনীতে এর উত্তর মিলবে না। তবে আমাদের অনুমান জোরদার হয় যখন দেখি, বারো বছর প্রথাগত ইসলামি শিক্ষার মাঝখানে থেকে আচমকা শাহ হুসেইন তাঁর গুরু বদলে নিচ্ছেন এই সময়েই। আগের শিক্ষক ছেড়ে তিনি এবার যাচ্ছেন সুফি পণ্ডিত সাদ-উল্লাহ্র কাছে। সুফি দর্শনে নিমজ্জিত হয়ে পড়ছেন এই সময়— তখন তাঁর ছাব্বিশ বছর বয়স।
কিন্তু তখনও চলছে ধর্মশাস্ত্র পাঠ। পাশাপাশি সুফি দর্শনের কোন কোন মার্গ তিনি অনুসরণ করছেন, তার স্পষ্ট হদিশ পাওয়া যাবে না। তিনি কি পড়ছেন বাগদাদের মত্ত ফকির জুনাইদের ভাবনা, কিংবা বায়াজিদ বাস্তামির লেখা ও জীবনবৃত্তান্তে আকৃষ্ট হচ্ছেন কিছু? জালালুদ্দিন রুমি এবং তাঁর গুরু ও বন্ধু তাব্রিজ শহর থেকে আগত শামস্উদ্দিনের সঙ্গে মোলাকাত হচ্ছে কিনা হুসেইনের, তা আমরা নির্দিষ্টভাবে জানি না। শাহ হুসেইনের মৃত্যুর বাষট্টি বছর পরে ফারসি ভাষায় তাঁর একটি কাব্যজীবনী লেখেন শেখ মাহ্মুদ ইবন্-এ মুহাম্মদ পির। সে কেতাবের নাম হকিকত্ আল ফুকারা— ‘হকিকত’ শব্দের মানে তো আমরা জানি— সত্য। আর এখানে ‘ফুকারা’ শব্দের অর্থ হবে সব-হারানো ফকিরত্ব— অর্থাৎ প্রেমে যে সর্বস্বান্ত হয়েছে তার বিষয়ে সত্যবচন— এই হল সেই গ্রন্থের শিরোনাম। আবারও বলে রাখা দরকার, আধুনিক সময়ের জীবনীতেও জীবনীকারের মন ও মেজাজ যেমন মিশে থাকে, তেমনই এখানেও ‘যথার্থ জীবনকথা’-র বদলে পাওয়া যাবে লেখক যা বিশ্বাস করতে চান, শাহ হুসেইনকে লেখক যেভাবে দেখতে চান, তারই একটি অবয়ব। ফলে এইসব জীবনীর অক্ষরে অক্ষরে যা বলা হয়েছে, তাকে অক্ষরের ভেতরেই না দেখে কিছু অনুমান ও যুক্তির সাহায্য নেওয়া চাই।
হুসেইনের জীবনীতে পাওয়া যাচ্ছে, শেখ সাদ্উল্লাহ্র কাছে অধ্যয়ন কালে হুসেইন আচমকা একদিন কোরআনের একটি শ্লোকে এসে থমকে যান। সেই শ্লোকটি এখানে উদ্ধৃত করি আগে— সুরা (অধ্যায়) ছয়, আল্ আনাম্, শ্লোক ৩২—
‘এই জাগতিক জীবন আসলে ক্রীড়া ও বিনোদন ছাড়া আর কিছুই নয়। আল্লাহ বিষয়ে সচেতন মানুষের কাছে এর চেয়ে অনেক ভাল হচ্ছে পরজগতের সেই চিরকালীন আবাস। একথা কি বুঝবে না তুমি?’
এই সেই শ্লোক বা আয়াত্, যা হুসেইনকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় নিষ্ঠাপরায়ণ শাস্ত্রপাঠ থেকে। তিনি সব ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন রাস্তায়। আর কখনওই তাঁর ফেরা হয়নি পূর্বাশ্রমে। এই সময়ে তাঁর জীবনধারা নিয়ে আরও একটি গল্প আছে— গল্পই বলছি তাকে, কেননা যুক্তিতে এর হিসেব মেলা ভার। এবং একই ধরনের গল্প অন্য অনেক সাধকের ক্ষেত্রেও ঘুরে ফিরে ব্যবহৃত হতে দেখি। গল্পটি এই—
তখনও হুসেইন শেখ সাদ্উল্লাহ্র শিষ্য। তাঁর সহপাঠীদের সামনে তিনি ঘোষণা করে, স্রষ্টা বিষয়ে গভীর সত্য তাঁর জানা হয়ে গেছে। ফলে এখন আর শাস্ত্র-কেতাব দরকার নেই তাঁর। একথা বলে তিনি সব ধর্মগ্রন্থ ছুড়ে ফেলে দেন কুয়োর মধ্যে। বাকিরা চিৎকার করে ওঠে। ভয়ে, ক্রোধে তারা জবাবদিহি চায় হুসেইনের কাছে। বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে হুসেইন পরমুহূর্তেই সেই সব ধর্মগ্রন্থ কূয়ো থেকে তুলে দেখিয়ে দেন কোথাও এক বিন্দু জলস্পর্শ নেই— সবই রয়েছে অবিকল।
ঘটনা হিসেবে এ যে অসম্ভব এবং অবাস্তব, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এই গল্প বলে দেয়, প্রথাগত তরিকা পেরিয়ে, নিয়মনিষ্ঠার এলাকা পার করে শাহ হুসেইন প্রবেশ করছেন রহস্যময় এক অনুভূতির জগতে, যেখানে ঈশ্বরের কাছে পৌঁছনোর জন্য আর পথ হাঁটতে হয় না, ঈশ্বর স্বয়ং হয়ে ওঠেন রাস্তা, তখন আর কোথাও যাওয়ার দরকার থাকে না, পথ আর গন্তব্য তখন মিলেমিশে গেছে। এই পর্বে শাহ হুসেইন তাঁর পূর্বাশ্রমের কঠিন আত্মনিগ্রহের ঠিক উল্টো পথে হাঁটেন। তাঁর সমস্ত শরীর ছেয়ে থাকে সুখ-আহ্লাদ। নাচ ও গান হয়ে ওঠে তাঁর আহ্লাদের ভাষা। উচ্চকিত লাল বর্ণের পোশাক হয়ে ওঠে তাঁর আনন্দের চিহ্ন। সুরা নিত্যসঙ্গী। শাহ হুসেইন নামের সঙ্গে জুড়ে যায় ‘লাল’। শাহ লাল হুসেইন।
তাঁর নামে যে ‘মাধো’ শব্দটি লেগে আছে, নিজেই তিনি সেটি তুলে নিয়েছিলেন গায়ে, সেই মাধব বা মাধো শব্দটির একটু খবর নিই এইবার। মাধো কিংবা মাধব যে শাহ হুসেইনের প্রেমিক কিংবা প্রেমাস্পদ, তা বোঝাই যায়। বেশ কিছু খুচরো গালগল্প রয়েছে তা নিয়ে। সমলৈঙ্গিক প্রেম বিষয়ে আমাদের সমাজে যে ধরনের কৌতূহল, বিরক্তি, বিক্ষোভ প্রচলিত আছে, তা থেকেই হুসেইন এবং মাধবের কাহিনি নানা দিকে পল্লবিত হয়ে ঘুরে বেড়ায়। একদল স্রেফ এই কারণেই তাঁকে পরিত্যাগ করার যুক্তি খুঁজে পান।
২
কিন্তু এই পর্বও খুব বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। লাল হুসেইন তখন উন্মত্তের মতো ঘোরাফেরা করেন রাস্তায়, নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা করেন না, সুরা ও নৃত্যেই তাঁর আরাম। সেই ছোটবেলার শিক্ষাগুরু বাহ্লুল দারিয়াই এসব খবরে উদ্বিগ্ন হয়ে চিনিয়াত থেকে ছুটে আসেন লাহোরে। প্রাক্তন ছাত্রের সঙ্গে নিভৃত কথা বলেন তিনি, তারপর সব দেখেশুনে শান্ত হয়ে ফিরে যান। পরোক্ষে শাহ লাল হুসেইন পেলেন প্রথম গুরুর স্বীকৃতি। এইবার মরমি পথের পথিক তিনি পুরোদস্তুর— আর কোনও বাধা নেই তাঁর সামনে। কোনও কোনও লোকপ্রচলিত কথায় পাওয়া যায় আকবর কিংবা জাহাঙ্গিরের সঙ্গে দেখা হয়েছিল হুসেইনের। আকবর তাঁর বিরুদ্ধে ‘অভব্যতার’ অভিযোগ পেয়ে তাঁকে নাকি বন্দি করতে চেয়েছিলেন, পরে মত পরিবর্তন করে ছেড়ে দেন। কিন্তু কোনও ঐতিহাসিক নথিতে, এমনকী, তুজুক-ই-জাহাঙ্গির-এও এর কোনও প্রমাণ মেলেনি। একমাত্র দারা শিকোহ্-র লেখা হাসানাত-উল-আরিফিন বইতে দু’বার তাঁর নামোল্লেখ আছে। দারার বিবরণ অনুযায়ী, আকবরের অন্দরমহলে লাল হুসেইনের ক্রিয়াকলাপ নিয়ে বেশ আগ্রহ ছিল— তাঁর অলৌকিক কার্যবিবরণ জানতে চাইতেন রানিরা অনেকে। সম্ভবত যুবরাজ সেলিম (পরে সম্রাট জাহাঙ্গির) হুসেইনের কাজকর্ম লিপিবদ্ধ করার জন্য একজন কর্মচারী নিয়োগ করেছিলেন। বাহার খান নামক সেই কর্মচারীর সমস্ত বিবরণী একত্রিত করে যে সংকলন প্রস্তুত করা হয় তার নাম ছিল ‘বাহারিয়া’। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সেটি আর পাওয়া যায়নি পরে। ফলে লাল হুসেইন শেষ পর্যন্ত রয়ে গেছেন কল্পনায়, কিছু অতিরঞ্জিত হয়ে, ভালবাসায় কিছু নিমজ্জিত তিনি, কিছুটা বিস্ময় তাঁর জীবন ঘিরে রয়েছে এতকাল।
তাঁর নামে যে ‘মাধো’ শব্দটি লেগে আছে, নিজেই তিনি সেটি তুলে নিয়েছিলেন গায়ে, সেই মাধব বা মাধো শব্দটির একটু খবর নিই এইবার। মাধো কিংবা মাধব যে শাহ হুসেইনের প্রেমিক কিংবা প্রেমাস্পদ, তা বোঝাই যায়। বেশ কিছু খুচরো গালগল্প রয়েছে তা নিয়ে। সমলৈঙ্গিক প্রেম বিষয়ে আমাদের সমাজে যে ধরনের কৌতূহল, বিরক্তি, বিক্ষোভ প্রচলিত আছে, তা থেকেই হুসেইন এবং মাধবের কাহিনি নানা দিকে পল্লবিত হয়ে ঘুরে বেড়ায়। একদল স্রেফ এই কারণেই তাঁকে পরিত্যাগ করার যুক্তি খুঁজে পান। কেউ মনে করেন, অতদিন আগে এমন ‘বেয়াদপি’, এমন ‘নির্লজ্জ’ কাণ্ড লোকটা ঘটাল কী করে? কারও কারও চোখে আবার এইসব অপকর্মের জন্যই সুফিদের সমাজ থেকে বহিষ্কার করা উচিত। যাই হোক, এ-বিষয়ে সবচেয়ে আগে যিনি মোটের ওপর স্পষ্ট খবর দিয়েছেন, তিনি শেখ মাহ্মুদ— তাঁর বই হকিকত আল ফুকারা-র কথা আগেই উল্লেখ করেছি। লেখকের বাবা শাহ হুসেইনের বন্ধুস্থানীয় ছিলেন, নিজেও তিনি হুসেইনকে দেখেছেন তো বটেই, দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন শাহ হুসেইনের প্রিয় মাধো বা মাধবের সঙ্গী হয়ে। ফলে প্রত্যক্ষদর্শীর কিছু দাবি তাঁর আছে। শাহ হুসেনের সব জীবনীকারই তাঁর এই বই ব্যবহার করেছেন। ফার্সিতে লেখা এই বইয়ের পূর্ণাঙ্গ ইংরেজি তর্জমা হয়নি। আমি নিজেও দেখেছি খণ্ডিত অংশই। কীভাবে হিন্দু কিশোর মাধোর সঙ্গে দেখা হল লাল হুসেইনের, কীভাবে বিদীর্ণ হল তাঁর হৃদয়, কীভাবে রচিত হল পরস্পর গভীর প্রণয়— তার এক চমকপ্রদ বিবরণ আছে হকিকত-আল-ফুকারা-তে।
বিস্তারিত বিবরণে যাওয়ার সুযোগ নেই এখানে। পাঠকের পক্ষে অত ধৈর্য রাখা কষ্টকর। আমি অতি সংক্ষেপে সেই সাক্ষাতের বিবরণ দিচ্ছি। রাভি নদীর তীরবর্তী এক গ্রাম, শাহ্দারার বাসিন্দা ছিলেন মাধো। একদিন লাহোরের রাস্তায় অপূর্ব রূপবান মাধোকে আচমকা দেখতে পান উন্মত্ত শাহ লাল হুসেইন। এবং সেই এক সাক্ষাতেই অত্যন্ত সুস্বাদু বেদনায় ভরে ওঠে তাঁর হৃদয়। সঙ্গের বন্ধুদের তিনি বলেন, ওই যুবক আমার সমস্ত কিছু কেড়ে নিয়েছে, একবার চোখ তুলে দেখা-মাত্র আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি— হৃদয় তো বটেই আমার আত্মা অবধি কেড়ে নিয়েছে ও। এবার কী করি আমি বন্ধুরা, ওর বিচ্ছেদে আমি অকথিত ব্যথায় ভরে উঠেছি এখন। মোটের ওপর একই বিবরণ পাওয়া যায় আঠারো শতকে লেখা নুর মুহম্মদ চিশতির লেখা তহ্কিকাত্-ই-চিশ্তি বইতেও। অন্য একটি সূত্র অবশ্য বলছে, দু’জনের দেখা হয় একটি পানশালায়। আর-একটি সূত্র মোতাবেক, মাধো প্রায়ই আসতেন লাল হুসেইনের আলোচনা শুনতে। সেখানেই তাঁদের দেখা। এবং শাহ্ লাল হুসেইনের হৃদয়-বিদারণ।
শাহ লাল হুসেইনের আচরণে স্বাভাবিকভাবেই অস্বস্তিতে পড়ে তাঁর পরিজন ও বন্ধুরা। বিরক্ত হয় মাধোর পরিবারও। সকলেই দু’জনকে পৃথক রাখার চেষ্টা করে প্রাণপণ। প্রাথমিকভাবে মাধো নিজেও বিস্মিত এবং বিরক্ত হয় ঠিকই, কিন্তু পরে সেও তীব্রভাবে আকৃষ্ট হয় হুসেইনের প্রতি। অনেকে মনে করেন, প্রায় পনেরো-ষোলো বছর শাহ লাল হুসেইন অপেক্ষা করেছিলেন মাধোর জন্য— সন্তকথায় অবশ্য এই সব সন-তারিখ সাধারণ অঙ্কের হিসেব মেনে চলে না। তাই বলা ভাল, বহুদিন অপেক্ষা করেছিলেন তিনি। প্রাথমিক আপত্তি থাকলেও মাধোর পরিবার শেষ পর্যন্ত মেনে নেয় দু’জনের সম্পর্ক।
ঠিক কীরকম ছিল মাধো এবং লাল হুসেইনের ভালবাসা? খুব নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। সমলৈঙ্গিক প্রেম— হোমো এরোটিক এক সম্পর্ক ছিল কি? এমন সম্পর্ক কি লাল হুসেইনের ক্ষেত্রেই প্রথম দেখা গেল? নানা ধরনের উত্তর আছে এসব প্রশ্নের। প্রাচীন গ্রিক সভ্যতায় সমলৈঙ্গিক প্রেমের বিষয়ে যে উচ্ছ্বাস দেখা যায় তারই কিছু রেশ পারস্যের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছিল, না কি আরব-পারস্যের সংস্কৃতিতে তার আগে থেকেই ছিল এমন প্রেমের আচরণ তা নিঃসংশয়ে বলা মুশকিল। প্রাচীন গ্রিকেরা অনেক সময় ভেবেছেন, রূপবান কিশোরের প্রতি ভালবাসাই একমাত্র ‘শুদ্ধ’ ভালবাসা। তাতে অন্য কোনও উদ্দেশ্য নেই। প্লেটো-অনুরাগী ইংরেজি ভাষার কবি শেলির লেখা প্রেম-বিষয়ক নিবন্ধেও এই সমপ্রেমের ইশারা বেশ স্পষ্ট। শেলির কাব্যভুবন এবং প্লেটোনিজম নিয়ে একাধিক ভারি গম্ভীর বই লেখা হয়েছে। এর একটি লিখেছেন এক গ্রিক সন্তান— জেম্স এ নটোপুলাস। গ্রিক সংস্কৃতির প্রেম-ভাবনা কীভাবে এক ইংরেজ কবিকে আকৃষ্ট করেছিল, তা নিয়ে ফের এক গ্রিক সমালোচকের আলোচনা বেশ চিত্তাকর্ষক বইকি। পারস্যের সুফি কবিদের কেউ কেউ তাঁদের গজলে ও কবিতায় সুরা-পরিবেশনকারী কিশোর সাকির প্রতিও যে-সব উচ্ছ্বসিত এবং প্রশস্তিময় কথা বলেছেন তাও যথেষ্ট প্রেমসিক্ত। শাহ্ হুসেইনের মাধো-প্রেমের পিছনে এই সমস্ত বিষয় কাজ করেছিল কি?

এই সূত্রে হুসেইনের পূর্বজ সুফি সাধক জালালুদ্দিন রুমির কথা স্বভাবতই উঠে আসতে পারে। তাঁর সঙ্গে লাল হুসেইনের মিল রয়েছে। প্রথম দিকে রুমিও ছিলেন মহা পণ্ডিত— ধর্মশাস্ত্রের ও দর্শনের অতুলনীয় শিক্ষক। তাব্রিজ শহর থেকে আগত শামস্উদ্দিনের সঙ্গে তাঁর গভীর রহস্যময় সম্পর্ক সব বদলে দিয়েছিল। শামস্কেই তার পর তিনি জীবনের ধ্রুবতারা করে তোলেন— এমনকী, নিজের কবিতাগুলিও শামসেরই রচিত— তিনি কেবল কলমধারী— এও বলেছিলেন তিনি। শামসের সঙ্গে রুমির সম্পর্কেও এক রহস্যময় প্রেমাসক্তি লক্ষ করেছেন কেউ কেউ। শাম্স তাব্রিজ আর রুমির শত্রু ছিল অনেক— তাঁদেরকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টাও কম হয়নি। অবশেষে একদিন নিখোঁজ হয়ে যান শাম্স— একটি সূত্র অনুযায়ী রুমির বন্ধুরাই তাঁকে হত্যা করেছিলেন। শাহ হুসেইনের ক্ষেত্রে অবশ্য তেমন হয়নি। হুসেইনের সঙ্গে গাঢ় গভীর ভালবাসার সম্পর্ক রেখেই মাধো সেনাবাহিনীর কাজে যোগ দেন। লাল হুসেইন যখন মারা যান, তাঁর শেষকৃত্যের সময় মাধো ছিলেন না তাঁর কাছে। পরে যখন এসে পৌঁছন তিনি, ততক্ষণে সমাধিস্থ করা হয়ে গেছে হুসেইনের দেহ। মাধোর আকুলতায় কবর থেকে তুলে তাঁকে পুনরায় সমাধিস্থ করা হয় লাহোরের কাছে। মাধোর নির্দেশ ছিল, তাঁকেও যেন মৃত্যুর পর হুসেইনের পাশেই সমাধি দেওয়া হয়। পাঞ্জাবের মানুষ সেই আবেদন পূরণ করেছিলেন। হুসেইনের পরে তিনি নিজেও সন্ত ফকির হিসেবে পরিচিত হন, আরও পঁয়ত্রিশ বছর বেঁচেছিলেন তিনি। তারপর বন্ধুকে শুইয়ে দেওয়া হয় বন্ধুর পাশেই। শাহ হুসেইনের নামের সঙ্গে ততদিনে পাকাপাকিভাবে জুড়ে গেছেন মাধো। তাঁদের আর আলাদা করবে কে?
৩
শাহ লাল হুসেইনের যেসব কবিতা (পাঞ্জাবি লোকায়ত কাব্য ধাঁচাটির নাম ‘কাফি’, বহুবচনে ‘কাফিয়া’) আমরা পেয়েছি, তাতে আশ্চর্যজনকভাবে মাধোর প্রসঙ্গ বেশ কম। যে দু-একটি কাফিতে মাধোর কথা আছে, সেখানেও যাকে বলে এরোটিক বা তীব্র সংরাগের প্রকাশ তেমন নেই। অনেকে মনে করেন, শাহ হুসেইনের ক্ষেত্রে এই সম্পর্ক শুদ্ধ সখ্যের। মাধোর জন্য যে মধুর আকুলতা তিনি প্রকাশ করেছিলেন, তাঁর সহচরদের কাছে, সেই আকুলতার ছিটেফোঁটাও তাঁর কবিতায় নেই। অবশ্য এমন হওয়া অসম্ভব নয়, আসলে ছিল তাঁর গানে সেই আর্তি, সেই বিহ্বলতা— যার কথা তাঁর বিবরণে লিখেছেন অন্যরা, যা ছড়িয়ে আছে লোকমুখে। কিন্তু তাঁর ভক্তরা সেসব বিহ্বল আর্তনাদগুলি তাঁর গান ও রচনা থেকে ছেঁটে দিয়েছেন— যাতে সামাজিকভাবে তাঁকে তেমন সমালোচনার মুখে না আর পড়তে হয়— যেন তাঁর প্রতি সম্মান বজায় থাকে সর্বদা। কিন্তু এটি একটি সম্ভাবনামাত্র। তাঁর জীবনীর ভগ্নাবশেষ এবং তাঁর রচনার মধ্যে যে অমিলটুকু চোখে পড়ে— সেদিকে তাকিয়ে এও একটি সম্ভাব্য উত্তর। অন্য সম্ভাবনাটি হচ্ছে, তীব্র ভগবদ্প্রেমের দিকে পৌঁছনোর একটি সোপান হিসেবে সৌন্দর্য এসেছে তাঁর কাছে— কোনও যৌন আকর্ষণের আশু উদ্দীপক হিসেবে নয়। শাহ হুসেইন হয়তো বলবেন, মাধোর অপরূপ সৌন্দর্য তাঁকে পরমের দিকে ঠেলে দেয়— পরমের সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ-যাতনা মনে পড়িয়ে দেয়— সেখানে কোনও দৈহিক কামনা নেই, কেবল পরম সৌন্দর্যের একটি ছাপ তিনি দেখেন মাধোর চাহনিতে। সৌন্দর্যের কোনও লিঙ্গ-পরিচয় নেই— তা ঐশ্বরিক। তা লৌকিক যাতনালোক থেকে মুক্ত করে। তা মিস্কিন বা দীন-দরিদ্রকে করে তোলে সুলতান।
শাহ হুসেইনের কিছু পূর্ববর্তী মানুষ এই বাংলার শ্রীচৈতন্যদেবের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে পুরুষ সহচরের প্রতি গভীর ভালবাসার প্রকাশ। নিজেকে নারী রূপে ও ভাবে দেখেছেন চৈতন্যদেব স্বয়ং। অবশ্য সেক্ষেত্রে বলে নেওয়া হয়েছিল, ভাব আর দ্যুতিটুকুই শুধু নারীর, আসলে তিনি কৃষ্ণই। ভাবোন্মত্ত অবস্থায় নিজের পরিকরদের জন্য চৈতন্যদেবের আকুল অস্থিরতার কথা তুলে কোনও কোনও সমালোচকও এই ধরনের ইঙ্গিত করে থাকেন। ভক্ত বৈষ্ণব স্বাভাবিকভাবেই সেকথা মানেন না। আরও কিছু পরে, সুফি সাধক সরমাদ কাশানির (১৫৯০-১৬৬১) জীবনেও অনুরূপ ঘটনা ছিল। অভয়চাঁদ নামক এক যুবকের প্রেমে মাতোয়ারা ছিলেন সরমাদ। সেক্ষেত্রেও তাঁকে সমকালীন ধর্মবেত্তারা যথেষ্ট নাকাল করে তুলেছিলেন। যেসব কারণে দারা শিকোহ্র বন্ধু এবং গুরু সরমাদের মৃত্যুদণ্ড হয়, তার মধ্যে এই অভিযোগও ছিল যে, তিনি সমলৈঙ্গিক প্রেমের প্রচারক। এই নিয়ে শেষ কথা বলা বোধহয় অসম্ভব। তবে সুন্দর আর সত্যের মধ্যে একটি সোজা সড়ক-যোগ যে প্রাচ্যের প্রাচীন কবি ও সাধকেরা আবিষ্কার করেছিলেন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তার সঙ্গে এসে মিশেছিল প্রেম। রবীন্দ্রনাথের সুন্দর ও আনন্দের তত্ত্বে প্রেম-সৌন্দর্য-আনন্দ-সত্য-মঙ্গলের যে একত্রবাস লক্ষ করি, তার একটি পূর্বসূত্র প্রাচ্যের কবিকুলে বেশ টের পাওয়া যায়।
সুফি ভাবধারার মরমি সূত্র নিয়ে যাঁরা কাজ করেছেন সেই মহাপণ্ডিত নিকলসন-আর্বেরি থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক কালের অ্যানমেরি শিমেল পর্যন্ত সকলেই একটি বিষয়ে একমত। সেটি হল সুফি পন্থায় একা ইসলাম নয়, তার সঙ্গে মিশেছে আরও নানা ধরনের জ্ঞানতত্ত্ব। পারস্য এবং আরব দুনিয়ার সুফি কবিরা পাঞ্জাবের নদীতীরে যে ইসলামের যে মরমি সংকেত ও চিন্তাধারা নিয়ে হাজির হয়েছিলেন, তার সঙ্গে হিন্দু দর্শনের মোলাকাতের ফলে এক অপূর্ব সংমিশ্রণ তৈরি হয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই। সেই মিশ্রণে যেমন ছিল প্রাচীন গ্রিক চিন্তাধারার অবশেষ, ইরানি ভাবসূত্র, আরবি কোরআনের কিছু সূত্রের ব্যাখ্যা, তেমনই ছিল যোগ দর্শনের আত্মশুদ্ধির চিন্তা— এ সেই পাতঞ্জল যোগসূত্র— দশম শতকে যা আলবেরুণী অনুবাদের মাধ্যমে পৌঁছে যায় ইরান থেকে মিশর অবধি চিন্তাবিশ্বে। ছিল উপনিষদের অদ্বৈতচিন্তা, আর ছিল ভক্তির চোরাস্রোত। এত সব পরস্পরবিরোধী দার্শনিক মত ও পথ মিলেমিশে কী যে এক আশ্চর্য দ্বৈতাদ্বৈতবাদী সমন্বয়ী বয়ান গড়ে উঠেছিল, তা ভাবলেই আজ আপ্লুত লাগে। ওইদিকে বাবা ফরিদ, এই পারে বু আলি শাহ কলন্দর, ওই পারে কাজি কাদান, এই দিকে আমির খুস্রৌ— এই বিরাট মেলামেশার ছবিটি যখন ভেসে উঠছে আজ আমার সামনে— এই বাক্যটি লিখতে লিখতে— তখন আক্ষরিক অর্থেই কাঁটা দিচ্ছে গায়ে। একেই কি বলে অলৌকিক? কিন্তু এর চেয়ে বেশি লৌকিকই বা আর কী হতে পারে? পাঞ্জাবের সুফি কবিদের কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।

শাহ হুসেইনের প্রায় দুশো বছর পরে পাঞ্জাবেই এসেছিলেন আর এক আশ্চর্য কবি— তাঁকে নিয়ে এই সিরিজেই আমরা লিখব শেষ দিকে— তিনি সচল সর্মস্ত। তাঁর একটি গানে একসঙ্গে উঠে এসেছিল তিন নিহত কবির নাম— মনসুর হাল্লাজ, সরমাদ আর শামস্উদ্দিন তব্রিজ। এসেছিল গভীর এবং সর্বত্যাগী প্রেমের অনুষঙ্গে। সত্য আর প্রেমের স্বার্থে মনসুর হাল্লাজ মেনে নিয়েছিলেন মৃত্যু, ভারতের কবি সরমাদও সেই পথের পথিক। মাধো লাল হুসেইনকে ঘাতকের হাতে মৃত্যু বরণ করতে হয়নি ঠিকই, তিনি আগেই মরে ছিলেন, মৃত্যু তাঁর জীবনের অংশ হয়ে ছিল। আবিদা পারভিনের অলৌকিক গায়নে সেই পঙ্ক্তিগুলি আলোকিত হয়ে ওঠে, শুনে দেখবেন আপনারা— যাঁরা এখনও শোনেননি— এই গান শাহ হুসেইনের জন্য প্রযোজ্য হতে পারে—
মন্সুর্ হো ইয়া সর্মাদ হো সনম্
ইয়া শাম্সুল হক্ তাব্রেজি হো
ইস্ তেরি গলি মে অ্যায় দিল্বর্
হর্ এক কা সর্ কুর্বান হুয়া
হোক মন্সুর,/ না-হয় সে হোক/ সরমাদ
কিংবা শাম্স/ তাব্রেজিই সে/ হোক না
হে প্রাণেশ যদি/ তোমার পথে সে/ আসে কোনও দিন/ একবার
প্রত্যেকে দেখি/ নিজের মাথাটি/ নামিয়ে রেখেছে/ যত্নে…
৪
পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী সুফি ও ভক্তি কবিদের অনেকেরই মতো মাধো লাল হুসেইনের গানের যে ‘আমি’, সে প্রায় সর্বদাই একটি মেয়ে। তার কাঙ্ক্ষিত পাত্রটি— যার জন্য তার আকুলতা, বেদনার নদী প্রবাহিত, সে এক পুরুষ। সিন্ধ অঞ্চলে, পাঞ্জাব প্রদেশের কবিদের রচনায় যেসব লোককথার পুনঃকথন লক্ষ করা যায়, তাদের প্রায় সব ক্ষেত্রেই পুরুষ সঙ্গীর জন্য নারীর বয়ানে কাতরতা দেখতে পাই। পুরুষ কবির হাতে নারীর এই এজেন্সি বা কর্তাসত্তা অর্জন খুব সহজ কাজ না। যাকে এখন আমরা জেন্ডার-ফ্লুইডিটি বলি, তার পুরাতন ইশারা এসব ক্ষেত্রে পাওয়া যায় বইকি। কোনও একটি কবিতায় একজন নারীর হয়ে কথা বলা এক জিনিস, আর সমস্ত কাব্যজীবনেই সেই বয়ান জারি রাখা অন্য ব্যাপার। শাহ হুসেইনের কবিতা ও গান পড়তে গিয়ে এই কথাটি আবার মনে পড়বে। রচনায় এমন পিছলতা, এমন তারল্য বা ফ্লুইডিটি থাকলে পাঠক তাকে গ্রহণ করেন ঠিকই, অনেক সময় উচ্ছ্বসিত হয়ে প্রশংসায় ভরিয়েও দেন, কিন্তু যেই সেটি জীবনাচরণে নেমে আসে, তখন এক ধরনের প্রতিরোধ তৈরি করেন সেই একই পাঠক। তখন সে-ই বয়ান তাঁর বিপজ্জনক মনে হয়। কাব্যে যা আস্বাদনে তাঁর আনন্দ হয়, সেই একই জিনিস বাস্তবে দেখতে এবং গ্রহণ করতে তাঁর ঘোর আপত্তি। কেন এমন হয় বারবার, সে অন্য আলোচনার জিনিস। এইটি তার যথার্থ স্থান নয়। আমরা বরং হুসেইনের কবিতা নিয়ে আর একটি কথা বলেই শেষ করব আজকের পর্ব।
মাধো লাল হুসেইনের গানে আমরা একই সঙ্গে বৈরাগ্য এবং সংরাগ দুই রকম অনুভূতিই পাই। একই সঙ্গে গভীর বৈরাগ্য— পার্থিব বস্তুজগৎ থেকে সব আকর্ষণ, সব পিছুটান তুচ্ছ করে ফেলা, আর অন্যদিকে গভীর ও সন্তপ্ত প্রেমের অনুভূতি— এই দু’টিকেই একসঙ্গে ধারণ করা কি সম্ভব? মনে হওয়াই স্বাভাবিক, এরা পরস্পরের বিপরীত। কিন্তু বিরাগ আর টান যদি একই উদ্দেশ্যে ধাবিত হয়, একদিকের বিরাগ অন্যদিকের সংরাগে নিয়ে যায় যদি? যদি এই বিরাগ আসলে ওই সংরাগের প্রাক্শর্ত হয়? তখন তীব্র সংরাগের স্বার্থে বিরাগও উৎকট হয়ে উঠতে পারে। সাদা চোখে, বাইরে থেকে দেখলে মনে হতে পারে, এই বিরাগ বিধ্বংসী, অতীব নেতিবাচক, এ কেবলই আত্মপ্রত্যাহার। কিন্তু আর একটু মনোযোগে টের পাওয়া যায়, এই প্রত্যাহার, এই সংযম আসলে ধনুকের টেনে-ধরা ছিলার মতো— বহু দূর যেতে হবে বলে অনেকখানি পিছনে তাকে টান দিতে হয়। শাহ হুসেনের অনেকগুলি কাফিতে তাই সংযম আর আত্মপ্রত্যাহার মুখ্য, আর অনেক ক্ষেত্রে তীব্র সুখ আর আহ্লাদ। বিরাগ তাঁর কাছে প্রস্তুতিপর্ব। আত্মধ্বংসী মিলনের প্রস্তুতি।
মাত্র পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে সুফি কবি ও সাধক মাধো লাল হুসেইন মারা যান। তাঁর কাফি কিংবা কবিতার কিছু নমুনা এইখানে রাখছি। আল্লাহ্ বা ঈশ্বর তাঁর রচনায় কখনও রব্, কখনও সাঁই কখনও আবার সাজন হিসেবে সম্বোধিত। ঈশ্বরকে সখা কিংবা প্রেমাষ্পদ হিসেবে দেখার রেওয়াজ প্রথাগত ইসলামে নেই। তবে সুফি কবিদের রচনায় যে এ জিনিস বারবার দেখা গেছে, তা আজ আর না বললেও চলে। আমাদের তর্জমায় সমস্ত ক্ষেত্রেই অন্ত্যমিল বর্জন করা করা হয়েছে। মিশ্রবৃত্ত এবং মাত্রাবৃত্ত (সরলবৃত্ত)— ব্যবহৃত হয়েছে এই দুইরকম ছন্দ। নতুন পাঠকের সুবিধার জন্য কোনও কোনও ক্ষেত্রে প্রথম পঙ্ক্তিতে ছন্দবিন্যাসের একটি আভাস দেওয়া আছে। কয়েকটি ক্ষেত্রে মূল পাঞ্জাবি কবিতার কিছু পঙ্ক্তিও রেখেছি যদি পাঠকের তাতে কিছু সুরাহা হয়। আর শাহ্ হুসেইনের আত্মপরিচয়জ্ঞাপক প্রিয় শব্দ ‘নুমানা’ (নিমানা) তর্জমা করিনি। ওর মধ্যে একই সঙ্গে মানহীন, তুচ্ছ, নিচ, বাতিল, পরিত্যক্ত, সামান্য, দীনহীন— ইত্যাদি নানা অনুষঙ্গ জড়িয়ে আছে। একটি বাংলা শব্দে এর সবগুলিকে ধরা অসম্ভব।
১
ছোড় তক্কাবুর পকড় হালিমি কো কহিঁ দা নহিঁ
কহে হুসাইন ফকির নুমানা হর দম সাঁই সাঁই
গর্ব ছেড়ে/ দাও আর/ নম্রতাকে/ টেনে নাও/ কাছে,
নুমানা ফকির এই তুচ্ছ হুসাইন
সারাক্ষণ, প্রতিটি নিঃশ্বাসে
বলে চলে তার প্রিয় সাঁইজির নাম…
২
বন্ধুর হাতে রয়েছে লাটাই, সুতো
আমি তার হাতে তুচ্ছ ঘুড়ির মতো।
সব ছেড়ে দিই আজ আমি তাঁর কাছে
নইলে কোথায় পড়ব যে কোন খাদে।
৩
এই পৃথিবীতে ফিরে আসা
হবে না কখনও আর, জানি।
যা কিছু এখন করি
কিছুটা বিচার কিছু বিবেচনা প্রয়োজন তাই,
অন্তে যাতে অনুশোচনায়
পুড়ে যেতে না হয় আমায়।
বলছে শাহ্ হুসাইন, শোনো,
ধুলোয় ধুলোয় মিশে যেতে হবে শেষে।
৪
সমস্ত সন্দেহ দ্বিধা চলে গেছে দূরে,
দ্বিধামুক্ত এখন জীবন,
এখন নির্গুণ হয়ে নেচে উঠি তাই।
আমি ও আমার সেই প্রেমের মানুষ মিলেমিশে
এই ভাবে কাটাই দিবস রাত যদি
সদাই সোহাগে থাকি, খুব তৃপ্ত বধূটির মতো।
কালো হয়ে ওঠে দেখি মিথ্যুকের মুখ,
সত্য হয়ে ফুটে থাকে প্রেমিকের বাণী।
দ্বিধা ও সংশয় চলে গেছে,
নির্গুণ হয়েছি আজ, মেতে উঠি নাচে।
৫
রব্ জানে কী হাল আমার,
ভিতরে রয়েছ তুমি, বাইরেও তুমিই কেবল।
দেহের সমস্ত রোমে তুমিই হাজির,
তুমিই পড়েন, তুমি টানা—
সুতো বুনে তোলো সদা তুমি,
যা কিছু আমার তুমি-তুমি।
সাইঁ-এর ফকির এই হুসাইন বলে,
আমি নই কিছু, সব তুমি।
৬
প্রিয় সখা, লাল,
শ্বাসের ভরসা নেই কোনও,
ভ্রমরের মতো উড়ে যাবে আত্মা অন্য কোন্ দিকে,
পরদেশী পথিকের মতো যাবে কে জানে কোথায়।
মায়ার জগৎ, এই সব মায়াময়,
ফুটে আছে শিশিরের মুক্তোবিন্দু যেন।
৭
দর্দ বিচ্ছোড়ে দা হাল নি ম্যাঁ কেহুঁ আক্খান
মর্ দিবানি কীতি বির্হোঁ পিয়া খয়াল নি ম্যাঁ কেহুঁ আক্খান
কার কাছে বলি এই বিরহমলিন কথাখানি,
যে দীর্ঘ বিরহ বসে আছে আজ আমার ভিতরে,
আমাকে করেছে মত্ত, কার কাছে বলি তার কথা?
অরণ্যে অরণ্যে খুঁজে ফিরি
তবুও তো আসে না প্রেমিক, হায়,
সেই কথা বলি কার কাছে ?
ব্যথার আগুন জ্বলে চুপিচুপি, ধোঁয়া ওঠে কালো,
যখনই সে আঁচ আমি দেখি নেড়েচেড়ে
ভিতরে লুকোনো আছে লাল, হায় প্রেমিক আমার।
রবের ফকির আমি, অতি তুচ্ছ, হুসেইন নাম,
কী হাল আমার দেখো, এ বেদনা-কথা কাকে বলি?
৮
সজ্জন বিন রাতন হোইয়াঁ বড্ডিয়াঁ
মাস ঝড়ে ঝড় পিন্জর হোয়া কন্ কন্ গ্যইয়া হাড্ডিয়াঁ
ইশ্ক্ ছুপায়া ছপ্দা নহিঁ বির্হো তন্বন্ গড্ডিয়াঁ
রন্ঝা যোগী ম্যাঁ যোগিয়ানি ম্যাঁ কে কর্ ছড্ডিয়াঁ
কহে শাহ্ হুসাইন ফকির সাঁই দা তেরে দামন লাগ্গিয়াঁ
কাছে নেই প্রেমিক আমার—
তাই রাত দীর্ঘতর মনে হয় যেন,
ঝরে গেছে মাংস, দেহ হয়েছে কঙ্কাল,
হাড়ে হাড়ে গভীর সংঘাত।
যত চেষ্টা কর, প্রেম থাকে না গোপন,
বিরহ যখন তার তাঁবু ফেলে যায়।
রান্ঝা যোগী, আমি হীর্ যোগিনী যে তার,
কী করি এখন আমি কী করি কী করি?
রবের ফকির আমি শাহ্ হুসাইন
তোমার ওই কাপড়ের পাড়ে আমি বেঁধেছি জীবন।
৯
বন্ধুরা, আমি / পালন করেছি / চোখের সকল/ নির্দেশ,
পবিত্র চোখ রয়েছে যাদের, তাদের ঠকানো শক্ত।
সফেদ হবে না কখনওই কালো রঙ,
কৃষ্ণ রঙিন কাক কি কখনও হয়েছে সফেদ বর্ণ?
বন্ধুর কথা ভেবে যে ব্যক্তি বরণ করেছে মৃত্যু
বলো শা-হুসেইন সে কি শাহাদত পায়নি?
১০
চুরমার করে/ দিয়েছি নিজের/ দেহটি এবং/ আত্মা,
তবুও হে সখা তোমার দয়ালু নজর পাইনি এখনও,
ওটি ছাড়া আর কিছুতেই নেই তৃপ্তি, পাই না শান্তি,
আমার মতন অভাগা আর কী করবে বলো হে বন্ধু…
আমি তো ফকির হুসাইন, আমি অসহায়, মেনে নিই না
তুমি ছাড়া আর কাউকেই; তুমি জ্ঞান, তুমি নিজে চক্ষু।
তুমিই স্বয়ং জ্ঞান, তুমি নিজে দৃষ্টি,
অগতির গতি, অসহায় যত মানুষের তুমি সম্বল।
১১
হে ঈশ্বর, বন্ধু একা তুমিই কেবল,
বিশ্বাসের পাত্র, তুমি সখা।
দেহের ভিতরে আর বাইরে তুমি রয়েছ একাকী,
আমার সকল নিয়ে বসে আছ সব রোমকূপে,
টানা ও পড়েন দুই-ই তুমি।
এই আমি, অচলন ফকির হুসেইন—
বলে যাই, আমি কিছু নই, সব তুমি।
১২
দুঃখই কেবল এনে দেয়, শোনো, পূর্ণতার বোধ।
ব্যথা আর ক্ষতচিহ্ন গড়ে তোলে সত্তা আমাদের।
লক্ষ থেকে কোটি পরিমাণ
অর্থে যারা ব্যতিব্যস্ত রয়েছে সতত—
রয়ে যায় তারা শুধু লোভাতুর সারাটা জীবন।
শ্বেত-শুভ্র পোশাকে আগুন দাও তুমি,
বেছে নাও দরবেশের বিষণ্ণ মলিন পরিধান।
সরল লোকের মাঝে যে চলিতে পারে,
বিপদের আওতা-মুক্ত সে-ই,
জ্ঞানে তার জন্মে অধিকার।
সাঁই-এর ফকির এই হুসেইনের কথা—
এমন জীবন হায় মানুষের, তাকে
কিছুটা অতৃপ্তি নিয়ে চলে যেতে হয়…
১৩
কেঁদেছি সমস্ত রাত।
অশ্রুবিন্দুগুলি
পারেনি কমাতে ব্যথা, পারেনি সারাতে।
কীভাবে ভরসা করি প্রাণবায়ুটিকে,
কোনও এক সরাইখানায়
কাটানো রাতের মতো মনে হয় জীবন আমার।
খোলসের মতো দেহ খুলে ফেলে রেখে
আত্মা চলে যায়,
উৎসব ঝরে যায় হেমন্তের পাতার মতন।
সাঁইয়ের ফকির এই হুসেইন-এর কথা—
বোঝার আগেই দেখো, ভোর হয়ে গেছে।
১৪
ক্ষণিকের তুমি/ অতিথি, পথিক/
যা কিছু তোমার/ সম্পদ সব /ফেলে যেতে হবে/ একদিন,
প্রাসাদের খ্যাত অধিবাসী যত, তারাও বাতাসে উবে যায়,
পড়ে থাকে শুধু মুদ্রার গায়ে অঙ্কিত রেখাচিহ্ন।
অহং ছাড়ো হে, নম্রতা পরে নাও আজ,
কোত্থাও কারো পাকা অধিকার লেখা নেই।
নুমানা ফকির হুসেইন বলে,
প্রাণবায়ুটিকে ভাসাও এবার সাঁইজির নামে, ছন্দে…
১৫
যে পথ দিয়ে এল/ আমার প্রিয়তম
ধন্য সেই পথ,/ ধন্য…
রেখো না হাতে আর/ সেলাই-ঝাঁপিটিকে/
আছড়ে ফেলে দাও/ ভূমিতে,
সূচের কারসাজি আমাকে আর এখন
টানে না, মন নেই ও কাজে…
হির্-এর মন থেকে আকুল বেদনায়
অগ্নিফুল ছোটে ফিন্কি,
ওই যে তার টানে হাজারা থেকে দেখো
জলদি ছুটে আসে রান্ঝা…
তুচ্ছ এ ফকির হুসেইন বলে তাই
মিলিয়ে দিয়েছেন আল্লাহ,
আহা অলৌকিক… বঁধুর সাথে বঁধু
কেমন মিলে গেছে আজকে…
১৬
তোমার কাগজ/ খুলে বসো ওগো/ জ্যোতিষী,
ভালো করে দেখে/ বলো আজ
প্রিয়তম কবে আসবে আমার নিকটে…
হরিৎ বর্ণ হল নদীতীর,
আমার কাতর কামনার ভারি
বৃক্ষশাখারা ঝুঁকে এল নিচে কিছুটা,
চারিদিকে দেখি না-থাকাই প্রস্ফুটিত।
দেখে যাও এসে কীভাবে
দূরত্ব পার হয়ে যাই আমি, পার হয়ে যাই নদীও…
পথে ঘুমোচ্ছে সিংহ, আহা-হা তাকে ঠিক পাশ কাটিয়ে
হেঁটে চলে যাই অনায়াস…
অভীষ্ট কিছু নেই আর, কিছু চাই না,
তোমার জন্য অপেক্ষা দিয়ে দিবস ফুরিয়ে ফেলব—
এছাড়া আমার নেই যে বাসনা অন্য…
শাহ্ হুসাইন চিৎকার করে বলছে,
একবার শুধু তোমাকে দেখতে চাইছি;
হে আমার প্রিয় সাঁইজি,
একবার তুমি তাকাবে কি ফিরে?
একটি চাওয়া কি জুটবে?
১৭
বলো সাঁইজিকে,/ কী আমার ব্যথা/ বলো মা…
প্রেমের সুতোয়/ বাঁধা আছে এই/ দেহের যতেক/ তন্ত্রী।
কাঁটা দিয়ে ত্বক রয়েছে সেলাই করা যে…
কেন তুমি মাগো জন্ম দিয়েছ আমাকে,
কেন পাপে ভরে দিয়েছ জীবন, বলো মা…
দুঃখী ফকির হুসেইন বলে, আল্লাই জানে সে-কথা…
১৮
বাহবা জানাও/ তোমরা আমায়/ আজকে,
প্রিয় মনোরম/ এসেছে আমার/ ঘরে যে…
আঁতিপাঁতি করে প্রেমিকের খোঁজ করেছি–
এতকাল বাদে সে দেখা দিয়েছে অদ্য।
আঙিনা আমার ঝলমল করে উঠল,
মুখে উদ্ভাস, আহা বারান্দা আলোময়।
নুমানা ফকির হুসাইন তাই বলছে
বন্ধুকে সাঁই এনেছেন পথ চিনিয়ে।
১৯
রান্ঝাকে চাই,/ শুধু চাই তাকে/ প্রাণপণ…
সব ঠাঁই তাকে/ খুজেছি তন্ন/ তন্ন,
অথচ সে আছে আমার সাথেই, নিকটে।
‘ধেনু এল গোঠে ফিরে’ অবশেষে সন্ধ্যায়,
কিন্তু এল না ঘরে ফিরে হায়
প্রিয় রাখালিয়া ছেলেটি…
ক্রন্দনরত কুঞ্জের মাঝে বলে হির:
ঘন অরণ্যে দিবস-রাত্রি রান্ঝাকে আমি খুঁজছি,
ছিঁড়ে গেছে দু-পা পাথরে পাথরে পা রেখে।
দুঃস্থ ফকির হুসাইন বলে,
রান্ঝাকে কাছে এনে দাও পার যেভাবে…
২০
প্রেমিকের নাম/ মনে মনে আমি/ আউড়েছি এত/ এত বার,
নিজেই ক্রমশ/ হয়েছি স্বয়ং/ রান্ঝা…
আমাকে এখন রান্ঝা বলেই ডেকো ভাই,
হির বলে কেউ চেনে না আমায় এখানে…
যে প্রিয়তমকে বারবার চেয়ে এসেছি,
এখন আমি তাকে পেয়ে গেছি খুব ভিতরে…
ঘটবে এমনই—
যদি তুমি পাও দরবেশদের সঙ্গ,
দূর হয়ে যাবে সব লৌকিক ধন্দ…
২১
আমি যদি ভুল/ করেও কখনও/ ভুল করে ফেলি/ তাহলে,
তোমার কৃপাটি সরিয়ে নিও না সাঁইজি…
প্রকৃত গুরুর পানপাত্রটি প্রণয়-সুধায় পূর্ণ—
সেই সুধাপানে হারিয়েছি সব ইন্দ্রিয়গুলি তখনই।
দূরে যাও প্রথা, দূরে যাও নিজ পরিবার…
চলেছি এখন প্রেমিকের কাছে একাকী।
সাঁইজির দাস, হুসেইন ফকির বলে যায় এই কথাটি—
করেছি তোমার নামটি আমার মাথার ভূষণ, শির্তাজ।




