স্মৃতির বইঘর
গড়িয়ায় যে-বাড়িতে আমরা ভাড়া থাকতাম, তার ঠিক পাশের গলিতে পরপর বেশ কয়েকখানা ফাঁকা জমি। বিক্রি হচ্ছে একে-একে। দেড় কাঠা বা দু’কাঠা মতো তাদের মাপ। পাড়ারই এক বয়স্ক ভদ্রলোকের জমি সেসব, আস্তে-আস্তে বিক্রি করে দিচ্ছেন তিনি। আমার মা-বাবা অনেক ভেবেচিন্তে এক টুকরো জমি কিনলেন, পরে কখনও সময় বা সামর্থ্য হলে বাড়ি করা যাবে, এই ভেবে। তার পাশের একচিলতে জমিও বিক্রি হয়ে গেল, বেপাড়ার একজন এসে দেখেশুনে কিনলেন, দেখতে-দেখতে তাঁদের বাড়ির ভিতও গাঁথা হয়ে গেল। আমার মনে-মনে বেশ ভাল লাগত ভাবতে যে, আমাদের নামেও এই পাড়াতেই একখানা জমি আছে, আর তাতে আমাদেরও বাড়ি উঠবে একদিন। নিজেদের বাড়ি।
কিন্তু যতদিন বাড়ি না-উঠছে, ততদিন কি ও-জমি এমনিই পড়ে থাকবে? মোটেই না। আমরা সাত-আটজন বন্ধু, যারা পাড়ায় বিকেল থেকে দেরিসন্ধে অব্দি এ-গলি সে-গলি খেলে বেড়াতাম, তারাই সাময়িক ভাবে জমিটার দখল নিলাম। বিকেল চারটে থেকে সাতটা ওই ফাঁকা এক টুকরো জমি আমাদের ঝলমলে রাজপাট হয়ে উঠল ক’দিনের মধ্যেই। উদ্যোগেরও কোনও কমতি নেই। এর তার বাড়ি থেকে কোদাল-কাটারি চেয়ে এনে আগাছা সাফ করে নিলাম আমরাই, যাতে নিশ্চিন্তে দেদার খেলাধুলো করা যায়। তারপর আর কী! জমিয়ে খেলা শুরু। ক্রিকেট থেকে কানামাছি, বাদ নেই কিছুই।
আরও পড়ুন: একটি অটোসফর আমাকে উপন্যাস লিখতে প্রেরণা দিয়েছিল! ‘হিয়া টুপটাপ জিয়া নস্টাল’ পর্ব ৪২…
তবে কেবল খেলায় আমাদের মন উঠছিল না। বারেবারে মনে হচ্ছিল, আরেকটু আলাদারকম কি কিছু করা যায়? আরেকটু নিজেদের, আরেকটু কেতাবি কিছু? বলে রাখি, ততদিনে পাশের জমিতে ইটের গাঁথনি উঠে বাড়ির কাঠামো তৈরি। একখানা বারান্দা, বেশ কয়েকটা ঘর, ইত্যাদি। পাঁচিল একটা আছে বটে, তবে আমাদের মতো দস্যিদের কাছে সে-পাঁচিল টপকানো নস্যি। জনাকয়েক রাজমিস্ত্রি সারাদিন ঠুকঠাক চালিয়ে বিকেল হলেই বিদায় নেন। তারপর সে-বাড়িতে ইটকাঠ আর বালিসিমেন্ট ছাড়া কেউ থাকে না। একদিন মনে হল, ক’জন মিলে সেখানে একখানা লাইব্রেরি চালু করলে কেমন হয়? পাড়ায় বেশ বড়সড় লাইব্রেরি আছে, আজাদ হিন্দ পাঠাগার, কিন্তু সে তো সকলের জন্যে। এই লাইব্রেরি হবে কেবলই আমাদের। বইয়ের ওপর বেশ একরকম মৌরসিপাট্টা থাকবে, তবে না ব্যাপার?
যেমন ভাবা, তেমনি কাজ। আমরা সকলে যে-যার বাড়ি থেকে গাদাগুচ্ছের গল্পের বই এনে হাজির করলাম ওই ইটকাঠের জনহীন বাড়িতে। বারান্দার পাঁচিল আর জানলার তাকগুলো হল আমাদের বুক র্যাক। এডগার রাইস বারোজ থেকে লীলা মজুমদার, রুডইয়ার্ড কিপলিং থেকে অবন ঠাকুরে সেজে উঠল সেই প্রায়ান্ধকার অর্ধসমাপ্ত বাড়ি। যেন মরে যাওয়া ফুলগাছে জোনাকি ফুটে আছে। লাইব্রেরির নামও দেওয়া হল, ‘কিশলয়’। এখানেই শেষ নয়, পাড়ার দোকান থেকে আর্ট পেপার আর স্কেচ পেন কিনে প্রত্যেকের জন্যে নাম লেখা ‘কিশলয়’ লাইব্রেরির কার্ডও বানানো হল। তাতে নানারকম খোপ কাটা। কোন বই কবে নেওয়া হচ্ছে আর কবে ফেরত দেওয়া হচ্ছে, সেসব হিসেব যাতে নিখুঁত ভাবে লিখে রাখা যায়।
দেখতে-দেখতে জমজমাট হয়ে উঠল আমাদের সেই ‘কিশলয়’। টাকাপয়সা বা চাঁদার বালাই নেই, বই নিয়ে গিয়ে ফেরত দিলেই হল। পাড়ার বড়রাও দেখেশুনে বেশ প্রশংসা করলেন, এই বয়সি বাচ্চারা কেমন নিজেদের বুদ্ধি খাটিয়ে ভাল একখানা কাজ করেছে! আমাদের তাতে দিব্যি গর্বও হল। বিকেল-বিকেল এসে, খেলাধুলোর পাট মিটিয়ে আমরা লাইব্রেরিতে ঢুকতাম। মিস্ত্রিকাকুদের বলেই নিয়েছিলাম যে, আমাদের বইগুলো দিনরাত এখানে থাকবে, তাদের যেন কোনও অসুবিধে না হয়। ওঁরাও সে-কথা মেনেই নিজেদের ঠুকঠাক চালাতেন। আর সন্ধের মুখে আমরা সেই বাড়িতে ঢুকে বই দেওয়া-নেওয়া করতাম ভরপুর উত্তেজনায়। মাঝেমধ্যে যদিও মনে হত, একদিন তো এ-বাড়ির কাজ শেষ হবে, যাঁরা মালিক, তাঁরা এসে সংসার সাজিয়ে থাকতে শুরু করবেন, তখন তো আমাদের সাধের লাইব্রেরি সরিয়ে নিতে হবে অন্যত্র। কিন্তু পরের কথা পরে। যতদিন তেমনটা হচ্ছে না, ততদিন নিজেদের এই মালিকানা চালিয়ে যেতে ক্ষতি কী? আমাদের সেই ‘কিশলয়’ লাইব্রেরি শেষমেশ চলেছিল বছর দেড়। তারপর ও-বাড়িতে রঙ চড়ল, দরজা-জানলা বসল, বইয়ের জায়গায় নানা বয়সি মানুষ এসে জুটল।
মানুষ তো এল, কিন্তু তারা ঠিক পাড়ার আর পাঁচজন মানুষের মতো নয়। কয়েকদিন যেতেই বোঝা গেল, বাড়ির মেজো মেয়েটির মনের সমস্যা আছে। সে সারাদিন আপনমনে চেঁচিয়ে কথা বলে, আলুথালু হয়ে রাতবিরেতে ছাদে হেঁটে বেড়ায়, যখন তখন পাড়ার রাস্তায় বেরিয়ে দিশেহারা হয়ে হাঁটতে থাকে। তার বাবা, বড়দা বা দিদি তখন ধরেবেঁধে বাড়িতে ফিরিয়ে আনে। সারাদিনই ও-বাড়ির ভেতর থেকে কলহ আর বচসার শব্দ উড়ে আসে, মাঝেমধ্যে কান পাতা দায় হয়। ক’দিনের মধ্যেই নতুন মানুষদের সেই সংসার ‘পাগলদের বাড়ি’ আখ্যা পেল। যাঁরা সে-বাড়ির বাসিন্দা, তাঁদেরও কানে গেল এই নতুন নাম। তাঁরা ক্রুদ্ধ বা আহত হবার বদলে কেমন যেন বিষণ্ণ হয়ে গেলেন। বুঝলাম, যেখানেই যান, এই নাম তাঁদের পিছু ছাড়ে না। বিষাদ তাঁদের অভ্যেস হয়ে গেছে।
ডগার রাইস বারোজ থেকে লীলা মজুমদার, রুডইয়ার্ড কিপলিং থেকে অবন ঠাকুরে সেজে উঠল সেই প্রায়ান্ধকার অর্ধসমাপ্ত বাড়ি। যেন মরে যাওয়া ফুলগাছে জোনাকি ফুটে আছে। লাইব্রেরির নামও দেওয়া হল, ‘কিশলয়’। এখানেই শেষ নয়, পাড়ার দোকান থেকে আর্ট পেপার আর স্কেচ পেন কিনে প্রত্যেকের জন্যে নাম লেখা ‘কিশলয়’ লাইব্রেরির কার্ডও বানানো হল।
তার বেশ কিছু পরে সেই বাড়ির পাশেই আমাদের বাড়িও উঠেছিল, আমরাও অনেক বছর সেখানে সংসার সাজিয়ে ছিলাম। তারপর বাড়ি বিক্রি করে অন্যত্র এসেছি। এখন যে-বাড়িতে থাকি সেও বিক্রি করে আরেক জায়গায় উঠে যাব কয়েকদিনে। বাড়ি কেনা এক, আর জমি কিনে বাড়ি তৈরি করা এক। জীবন এরকমই। সময়ের দাবি মেনে তাকে ভালবেসে বদলে যেতে হয়। আমাদের সেই পুরনো পাড়াও বদলে গেছে যেমন। জানি না আমাদের সেই পাশের বাড়িটিতে এখন কে বা কারা থাকে, বা আদৌ কেউ আর থাকে কি না। কেবল মাঝেমধ্যে মনে হয়, অন্ধকার হয়ে আসা সন্ধেবেলা, ঝিঁঝিঁডাকা সন্ধেবেলা, মশার কামড় খাওয়া সন্ধেবেলা, ঐ পরিত্যক্ত পাগলদের বাড়িতে জেগে আছে কিছু বই, তাদের গা-ভর্তি আগাছা, কেউ সেসব সাফ করে দেবার নেই। কেবল একজন উন্মাদ, আলুথালু মেয়ে আপনমনে গান গেয়ে তাদের পাতা উলটে বেড়াচ্ছে। আমাদের লাইব্রেরি এখনও বন্ধ হয়ে যায়নি…