লিবার্টি কেলেঙ্কারি
৪ জুলাই। রোদ ঝলমলে সকালবেলা আমরা চললাম স্ট্যাচু অফ লিবার্টি দেখতে। আমেরিকার আইকন, ন্যাশনাল মনুমেন্ট। যে লিবার্টি আইল্যান্ডের ওপর দাঁড়িয়ে আছে স্বাধীনতার এই প্রতিমূর্তি, সেটা কি সমুদ্রে, না কি নদীর বুকে? আসলে দুটোই বলা যায়। নিউ ইয়র্ক হারবার আটলান্টিক মহাসাগরের অংশ, আবার হাডসন নদী এখানে এসে পড়ছে। দল বেঁধে তো গেলাম, কিন্তু আমরা খেয়ালই করিনি আজ আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস, আর ছুটির মেজাজে ফেরির সব টিকিট আগে থেকেই বুকড হয়ে যাবে।
লিবার্টি পার্কে তো যে কেউ ঢুকে ঘুরতে পারে, বসতে পারে, পিকনিক করতে পারে। এমনকী দূর থেকে স্ট্যাচু অফ লিবার্টি দেখতেও পারে। কিন্তু ফেরিতে চেপে জল পেরিয়ে স্ট্যাচুর কাছে পৌঁছে তার চারপাশে ঘোরা, দ্বীপে নেমে তার কাছে যাওয়া, সেটাকেই তো বলে স্ট্যাচু অফ লিবার্টি দেখা। আজ অগ্রিম টিকিট কেটে, কাল আবার আসা যেতেই পারে। কিন্তু দলের বেশ কয়েকজন কালই নিউ ইয়র্ক ছেড়ে অন্য শহরে চলে যাবে। হতাশ হয়ে বেঞ্চে বসে চিনিমাখা বাদামভাজা খাচ্ছি (ঠেলাগাড়িতে বিক্রি হয় গরমাগরম), হঠাৎ এক কৃষ্ণাঙ্গের উদয়। পরে বুঝেছিলাম, ও অনেকক্ষণ ধরেই আমাদের নজর করছিল।
সংস্কারের বশে রকেট পরীক্ষার সময়ে, গরু পাশে রাখেন নাসার বিজ্ঞানীরাও! পড়ুন: ডেটলাইন পর্ব ৩৬
প্রথমেই সেই মাঝবয়সি লোকটি আমাদের দলের এক সুদর্শন অভিনেতাকে পাকড়াও করল, ‘হে হ্যান্ডসাম। ইউ মাস্ট বি অ্যান অ্যাক্টর।’ সে তো বটেই, আমরাও দারুণ অবাক। সুদূর নিউ ইয়র্কে দাঁড়িয়ে, কলকাতার বড়-ছোট পর্দার এই জনপ্রিয় মুখকে ও চিনল কীভাবে? আমরা উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলাম। সে রীতিমতো বিগলিত হয়ে সেলফি তুলল হিরোর সঙ্গে, হিরোর ফোনেই। আর বলল, আমার নম্বর দেব,পাঠিয়ে দিও প্লিজ। এবার সে আমাদের দলের দাদাস্থানীয় একজন, যিনি তিরিশ বছর ধরে আমেরিকা প্রবাসী এবং পয়লা সারির বিশ্ববিদ্যালয়ের নামজাদা অধ্যাপক, তাঁকে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমাদের দেখলাম টিকিট কাউন্টারে গিয়ে কথা বললে, তারপর আবার ফিরে চলে এলে। অ্যান্ড ইউ লুক ডিপ্রেসড। ব্যাপারটা কী?’ বিশ্বাস করুন, এরপর যা হল, সেটা বলতে লজ্জাই লাগছে, কারণ আমরা এতগুলো লোক, যার মধ্যে নামী শিল্পোদ্যোগী থেকে শিল্পী, সাংবাদিক থেকে সাহিত্যিক, কে না ছিল, অথচ আমরা সবাই যেন বশীভূত হয়ে পড়লাম। পরে জামতাড়া সিরিজে যখন দেখেছিলাম, হাইকোর্টের বিচারপতি বা রাজনৈতিক নেত্রী ফোনে পাতা ফাঁদে, মুহূর্তে লক্ষ-লক্ষ টাকা খোয়ালেন, একটুও অবাক হইনি। লোকটি প্রস্তাব দিল, তার কাছে আগে থেকে কিনে রাখা কিছু টিকিট আছে, আমরা বিদেশি, আমাদের উপকারের জন্য সে দামের দামেই দিয়ে দেবে। আমরা প্রবাসী দাদার মুখের দিকে তাকালাম। উনি বাংলায় বললেন, ‘এরকম হয় এখানে। এরা দালাল হলেও ঠকাবে না, কারণ দেশটা তো আমেরিকা। পুলিশের ভয় আছে। আর বেশি নিচ্ছে না যখন অসুবিধে কী?’ আমরা তো হাতে চাঁদ পেলাম। এখানে বলে রাখি, টিকিটের দাম কিন্তু কম না, সেই ২০১৬ সালে আঠেরোশো কী দু’হাজার টাকার মতো ছিল। টিকিট নিয়ে বীরবিক্রমে আমরা পা বাড়ালাম জেটির দিকে। আজ আমাদের কপালে লেখা, স্ট্যাচু অফ লিবার্টি দর্শন ঠেকায় কে!

অন্তত শখানেক লোকের লাইন। পরের ফেরিতে ওঠার জন্য। আমরাও দাঁড়িয়ে পড়লাম। টিকিট চেকারের কাছে পৌঁছে দাদা একগোছা টিকিট এগিয়ে দিলেন। বৌদি-সহ আমরা সবাই তাঁর পেছনে পরপর। চেকার টিকিট হাতে নিয়েই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন, ‘এই টিকিট কোথায় পেয়েছেন?’ দাদা যথাসম্ভব স্মার্ট ভাবে জবাব দিলেন, ‘বাইরে থেকে।’ উনি টিকিটগুলো ফেরত দিয়ে পত্রপাঠ বললেন, ‘দিজ আর নট ভ্যালিড বিকজ দ্য স্ট্যাম্প ইজ মিসিং। ইউ শুড পারচেজ ফ্রম দ্য অথরাইজড কাউন্টার ওনলি।’ বলে, আঙুল তুলে দেখালেন সামনের বুকিং কাউন্টার, যেখানে সকালে এসে শুনেছিলাম সব বিক্রি হয়ে গেছে। তখন আমাদের সবার মুখের যা অবস্থা হয়েছিল, যত না দুঃখে, তার থেকে অনেক বেশি লজ্জা আর অপমানে, বলে বোঝানোর নয়। আশেপাশের লোক তাকাচ্ছে, একঝাঁক বিদেশি ট্যুরিস্ট মুর্গি হয়েছে, জাল টিকিট নিয়ে ফেরিতে উঠতে এসেছে।
গুটিগুটি পায়ে লাইন থেকে বেরিয়ে এসে, হাঁটা লাগালাম। একটু তফাতে গিয়ে রাগে ফেটে পড়লেন দাদা, ‘এত বড় সাহস, আমি এদেশে বুড়ো হয়ে গেলাম। আমাকে ঠকাল! এক্ষুনি পুলিশে নালিশ করতে হবে।’ নায়কের মাথায় বুদ্ধি খেলল, ‘আমার সঙ্গে ছবি তুলল লোকটা। পুলিশকে ছবি দেখালে ঠিক খুঁজে বার করবে।’ সবাই ছুটলাম পুলিশ পোস্টের দিকে। সবটা বলা হল, ছবিও দেখানো হল। খুব একটা যে পাত্তা দিল পুলিশ, তা বলা যায় না। উলটে বলল, ‘এই ভিড়ের মধ্যে কোথায় খুঁজব দালালটাকে? অনেক ঘোরে ওরকম। তোমাদের ভুল হয়েছে বাইরে থেকে টিকিট নেওয়া। এখনও কাউন্টার খোলা আছে। কাল যেতে চাইলে, অ্যাডভান্স টিকিট কেটে নাও।’ জোরজার করায় দাদার ফোন নম্বর নিয়ে দায়সারা ভাবে বলল, ‘সন্ধান পেলে টাকা ফেরত চাইব, আর তোমাকে ফোন করে দেব।’ এবার আমরা কাউন্টারে গেলাম। ওঁদের দেশে এসে, বিদেশিদের হেনস্থা হওয়ার বিষয়টা বেশ সিরিয়াসলি নিলেন ম্যানেজার। এবং এখানেও একটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার ঘটল। নতুন করে টিকিট কাটার বদলে, পরেরদিনের ফেরির ছাপ মেরে দিলেন আমাদের টিকিটগুলোর ওপরেই। বাড়তি ডলার লাগল না। এবার বুঝলাম, তফাৎ শুধু শিরদাঁড়ায়, থুড়ি, স্ট্যাম্পে।
দাদা বললেন, ‘আমরা বিদেশি হওয়ায় বেঁচে গেলাম। দালালের কাছ থেকে টিকিট কিনে যদি কোনও আমেরিকান ধরা পড়ত, নির্ঘাত পুলিশে দিত।’ সকাল থেকে ঠা ঠা রোদে এই ঝকমারির দুঃখ ভুলে হাঁফ ছাড়লাম, যাক বাবা, বিদেশে জেল তো খাটতে হল না! আর ভাগ্যিস ওরা জানে না, দাদা-বৌদির আমেরিকান পাসপোর্ট! আমরা খুশিমনে ব্যাটারিপার্কে বসে, ফিশ অ্যান্ড চিপস খেয়ে হোটেলে ফিরে গেলাম।
৪ জুলাই রাতের কথা একটু বলা দরকার। নয়তো কমেডি শোটা ঠিক শেষ হবে না। সকালের ঐ হেনস্থার পরও, আমরা এতটুকু দমে না গিয়ে ঠিক করেছিলাম, স্বাধীনতার রাতে বাজির খেলা দেখতে যাব দল বেঁধে। এই ২০১৬ সালে নাকি মেগা সেলিব্রেশন, লেজার প্রযুক্তিতে বাজি পুড়বে, ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটবে ইস্ট নদীর বুকে। এবার জব্বর স্পনসর পাওয়া গেছে। মেসি, মার্কিন মুলুকের বিশাল শপিং চেন। ম্যানহাটানে আমাদের হোটেলের কাছেই একটা মল আছে মেসির, ভেতরে ঢুকলে মালুম হয় আচার্য রজনীশের মোক্ষম বাণী— ‘জীবন এক উৎসব’। পরের সংযোজন হতেই পারে, ‘যদি করো প্রাণ খুলে শপিং’। যাই হোক, কোটি-কোটি ডলার পোড়ানোর উৎসবে সামিল হতে উবের ধরে ছুটলাম সন্ধে হতেই। শুনেছি, সাংঘাতিক ভিড় হয়, জায়গা পাওয়া মুশকিল। সকালে যে দাদার সৌজন্যে দালালের খপ্পরে পড়ে মান যেতে বসেছিল, তিনিই গম্ভীর মুখে বললেন, ‘হোটেলের তোয়ালেগুলো সঙ্গে নে। বসতে হবে তো রাস্তায়। পেতে বসবি।’ পরামর্শ শিরোধার্য করে তোয়ালে ঘাড়ে চললাম, শুধু যাওয়ার আগে রিসেপশনে ছোট্ট করে পারমিশন চাইলাম। হোটেলের তোয়ালে বাইরে নিয়ে যাওয়া এমনিতে নিয়মবিরুদ্ধ বলেই তো জানি। হাসিমুখে মাথা নাড়ল যুবকটি। আমেরিকানদের এই বিন্দাস ব্যাপারটা আমার দারুণ লাগে, ছোটখাটো ব্যাপার একদম সিরিয়াসলি নেয় না ওরা, সে দুর্ঘটনা হোক কী ঝগড়া, নিয়ম ভাঙা কী ফ্লার্টিং!
উবের গেল একটা চারমাথার মোড় পর্যন্ত। বেশ কিছুটা আগের থেকেই রাস্তা বন্ধ। সেখানেই পিৎজার দোকানে বসে পড়লেন দলের কয়েকজন। হাঁটাহাঁটির মধ্যে নেই তাঁরা। নায়ক বললেন, ‘কটা পনেরোই আগস্ট উদ্যাপন দেখতে আমরা ছুটি বল তো?’ সঠিক কথা। তাই বলে এতটা এসে যাব না নদীর ধারে? দাদার ভরসায় আমরা কজন রওনা দিলাম জনস্রোতে গা ভাসিয়ে। পুরীর রথযাত্রার ভিড়ের সঙ্গে শুধু তুলনা চলে এর। অনেকটাই হাঁটা, তার ওপর ভিড়ের কারণে ধীরগতি। মাঝপথে নামল তুমুল বৃষ্টি। তখন ফেরার উপায় নেই। কাঁধের তোয়ালে উঠল মাথায়। এবং হোটেলের পেল্লায় সাইজের সাদা তোয়ালে পাথর হয়ে চেপে বসল। ভিজেই পৌঁছলাম যতটা যাওয়া সম্ভব। কয়েক ঘণ্টা আগে থেকে হাজার-হাজার লোক এসে সামনের দিকের পুরোটা জায়গা দখল করে নিয়েছে। বিজ্ঞাপনের মাহাত্ম্য একেই বলে! মেসি এমন ক্যাম্পেন করেছে যে, নিউ ইয়র্ক আর আশেপাশের জায়গাগুলো থেকে লোক একেবারে ভেঙে পড়েছে। দাদার ভবিষ্যতবাণী মিলে গেল। আমরা পথেই বসলাম ভিজে তোয়ালে পেতে। এখন শুধু অপেক্ষা, বৃষ্টি শেষ হয়ে শুরু হোক বাজির খেলা। এই বিপুল জনসমুদ্রের কোথাও থেকে ভেসে আসছে কোরাসে জাতীয় সংগীত। কোথাও গিটার বাজিয়ে হার্ড রক গাইছে যুবকের দল, কোথাও শুধুই কথার শব্দ। সব মিলিয়ে অদ্ভুত এক ঐকতান।
আমেরিকানদের এই বিন্দাস ব্যাপারটা আমার দারুণ লাগে, ছোটখাটো ব্যাপার একদম সিরিয়াসলি নেয় না ওরা, সে দুর্ঘটনা হোক কী ঝগড়া, নিয়ম ভাঙা কী ফ্লার্টিং!
মিনিট চল্লিশেক পর বৃষ্টি থামল এবং শুরু হল কৃষ্ণকালো আকাশে এক অতিলৌকিক আলোর খেলা। নদীর বুকে দ্বীপের মতো একটা জায়গা থেকে ছাড়া হচ্ছিল বাজি, অত্যাধুনিক প্রযুক্তির নিখুঁত অঙ্কে মাপা সময়, নক্সা, রোশনাই। আর প্রতিবার উঠছিল লক্ষ কণ্ঠে তুমুল হর্ষধ্বনি।

এত পরিশ্রমের পর, বেশ আনন্দ মনে নিয়ে ফেরার পথ ধরলাম। বাচ্চা, বুড়ো সবার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হাঁটা তো লাগালাম, এদিকে ভেজা তোয়ালের ওজন কয়েক কেজি। মনে আশা, বড় রাস্তায় পৌঁছলেই উবের পাব। কোথায় কী! অধঘণ্টা হেঁটে, মোড়ে পৌঁছে শুনলাম— আজ উবের, হলুদ ট্যাক্সি কিছুই পাওয়া যাবে না। স্বাধীনতার রাত, তায় জমিয়ে বৃষ্টি হয়েছে, ট্যাক্সিওয়ালা বলে কি মানুষ নয়! অগত্যা ফের হাঁটা। হোটেল বহুৎ দূর। ভেজা গায়ে ভেজা তোয়ালে, কাঁপুনি উঠছে। এক দাদা সাধু প্রস্তাব দিলেন, ‘চলো, কফি খেয়ে গা গরম করে নিই।’ সামনের এই বিশাল আলো ঝলমলে ক্যাফেটাতে ঢুকব এই কিম্ভুত অবস্থায়? সম্পূর্ণ ভেজা, তার ওপর বিশাল সাদা তোয়ালে জড়ানো গায়ে! দাদা অভয় দিলেন। ঢুকলাম, বসলাম, ব্রাজিলিয়ান কফি খেলাম। এবং হাসিমুখের সেলসম্যান ছেলেটি আমাদের একটা করে বড় ক্যারিব্যাগ দিল ভেজা তোয়ালে নেওয়ার জন্য। বলেছিলাম না, আমেরিকানরা বিন্দাস, ছোটখাটো ব্যাপারে। বড়-বড় ব্যাপার হলে কিন্তু আলাদা কথা। বার্গার, কোক, যুদ্ধ এসব ব্যাপারে আমেরিকা খুব সেন্সিটিভ। পাঙ্গা নেওয়া একদম পছন্দ করে না!


