আস্তিক গল্প
একটা আধুনিক ছবির মূল বিষয় ঈশ্বর, বা ত্যাগ, ভাবতে ঈষৎ বিস্ময় জাগে। ‘সামথিং, এনিথিং’ (চিত্রনাট্য ও পরিচালনা: পল হারিল, ২০১৪) ছবিতে প্রথমেই দেখানো হয়, একটি ছেলে একটি মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দিল। তার পরেই তাদের বিয়ে, তার পরেই মেয়েটির সন্তান-সম্ভাবনা। এর মাঝে শুধু দেখানো হয়েছে, মেয়েটি বাড়ি-কিনতে-ইচ্ছুক লোকেদের বাড়ি খুঁজে দেওয়ার কাজ করে। তারপর এক সন্ধ্যার দৃশ্য, যেখানে স্বামী বার-এ গিয়ে সহকর্মীদের সঙ্গে আনন্দ করতে চায়, স্ত্রী শরীর খারাপ বলে যেতে চায় না। স্বামী বলে, আরে ন’মাস তো আর কেউ বাড়িতে বসে থাকে না, এবং কথা দেয় যে পৌনে এগারোটার মধ্যে বাড়ি ফিরবেই। যদিও সেই সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও তার গল্প থামাবার কোনও লক্ষণ দেখা যায় না। স্ত্রী উঠে বাথরুমে যায়, তার জরায়ু থেকে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। আকুল হয়ে স্বামীকে ফোন করে, কিন্তু স্বামী তার নাম দেখেও ফোন ধরে না (হয়তো ভাবে, ধুর, বাড়ি যাওয়ার জন্য তাড়া দেবে)। তার পরের দৃশ্যেই বোঝা যায়, বাচ্চা নষ্ট হয়ে গেছে। ছবি শুরুর ১০ মিনিটের মধ্যে তড়িঘড়ি এতগুলো ঘটনা দেখিয়ে দেওয়ায়, আমরা একটু অবাক হয়ে ভাবতে থাকি, তাহলে ছবিটা কী নিয়ে? স্বামীর ঔদাসীন্য? সন্তান হারানোর বেদনা? আমরা দেখি এই গর্ভ-নষ্টের পর, মেয়েটি প্রথমে মা-বাবার কাছে গেলেও, পরে একা থাকতে শুরু করে। এবং যে-সংস্থার হয়ে সে বাড়ি বিক্রির কাজ করছিল, সেখানে অফিসের বস বেশি টাকা পাওয়ার জন্য একটা নিতান্ত প্রচলিত কিন্তু নীতিহীন কাজ করলে, সে চাকরি ছেড়ে একটা অনেক কম মাইনের চাকরি নেয় লাইব্রেরিতে। অথচ বস তাকে এই কাজে প্রচ্ছন্ন সমর্থনের জন্য বোনাস দিয়েছিল। যখন চাকরি ছাড়ছে, বস তাকে জিজ্ঞেস করে, কেন? ওখানে তো অনেক কম টাকা। সে বলে, টাকার জন্য নয়। বস হেসে ফ্যালে, বলে, টাকার জন্যই তো আমরা কাজ করি।
আরও পড়ুন: শিশুকন্যার নিগ্রহকে আমরা কী চোখে দেখি? প্রশ্ন তোলে ‘দ্য টেল’! লিখছেন চন্দ্রিল ভট্টাচার্য…
এর মধ্যে তাকে পূর্বপরিচিত একটি ছেলে (বন্ধুর দাদা, কৈশোরে পরিচয় ছিল, কিন্তু খুব বেশি নয়) চিঠি লিখে সমবেদনা জানিয়েছিল (বাচ্চা নষ্ট হয়ে যাওয়ার জন্য), তার সম্পর্কে মেয়েটি শোনে, সে সন্ন্যাসী হয়ে গেছে। একটু অবাক হয়, উইকিপিডিয়ায় ওই মঠ বিষয়ে খোঁজ করে। সন্ন্যাস বিষয়ে বই আনে (সেখানে পড়ে, সন্ন্যাসীর জীবন বৈপরীত্যের জীবন। সে সম্পত্তি ত্যাগ করে, আর তার সব বস্তুগত প্রয়োজন অন্যরা মেটায়। সে একা থাকতে চায়, তাই সম্প্রদায়ে যোগ দেয়। সে ঈশ্বরকে খুঁজতে চায়, কিন্তু তা সম্ভব হয় যদি ঈশ্বর তাকে খুঁজে নেন)। ডাইরিতে মেয়েটি লেখে, সন্ন্যাসীর জীবন খারাপ নয়। ডাক্তার দেখাতে গিয়ে অপেক্ষা-কক্ষে বাইবেলের গল্পের বই ওলটায়। লাইব্রেরি থেকে বাইবেলের পাতা ফোটোকপি করে। ডাইরিতে যখন বাইবেলের উদ্ধৃতি টুকে রাখছে, বার বার মোবাইলে বন্ধুদের মেসেজ আসতে থাকে, তাই সে মোবাইল ত্যাগ করে। দোকানদার অবাক হয়ে বলে, আর মোবাইল ব্যবহার করবেন না? মেয়েটি তার বদলে একটা ল্যান্ডলাইন নেয়। স্বামী তার সঙ্গে যোগাযোগ করে, বড় প্রোমোশন হয়েছে, বিশাল মাইনে, অন্য শহরে যাবে, বলে তুমি আমার কাছে ফিরে এসো (আগেও ক্রিসমাসে গয়না পাঠিয়েছিল এবং এই অনুরোধ জানিয়েছিল)। বান্ধবীরাও মেয়েটিকে বেশ বিচ্ছিরিভাবেই বলে, স্বামীর সঙ্গে সে মোটে যথাযথ ব্যবহার করেনি (অত্যন্ত সামান্য কারণে বিচ্ছিন্ন হয়েছে)। এক বান্ধবীর বাচ্চা হয়েছে, সে সূক্ষ্মভাবে বলার চেষ্টা করছিল মাতৃত্বেই নারীর সার্থকতা। জবাবে আমাদের নায়িকা বলে, জীবনের উদ্দেশ্য যদি হয় শুধু সন্তানের জন্ম দেওয়া এবং সেইসব বন্দোবস্ত করা যাতে তারা আবার সন্তানের জন্ম দিতে পারে, তাহলে তা খুব অদ্ভুত। জিজ্ঞেস করে, তোদের অন্য কিছুর জন্য বাঁচতে ইচ্ছে করে না? নিজের বা সন্তানের জন্য নয়, অন্য কিছুর জন্য? এরপর ফিরে এসেই সে নিজের সাধের পোশাক, গয়না, প্রসাধনী, জুতো— সমস্ত বেচে দেয় এবং সেই টাকা লাইব্রেরির দানের বাক্সে (প্রাপ্তবয়স্কদের পড়াশোনা শেখানোর জন্য ব্যয় হবে) দিয়ে দেয়। নিজেকে সচেতনভাবে লোভ থেকে বিযুক্ত করতে শুরু করে।
এই হচ্ছে ছবিটার মূল বিস্ময়। গল্প আরও এগোয়, কিন্তু যা নায়িকাকে বিশিষ্ট করে তোলে, ছবি জুড়ে সে কোনও প্রাপ্তির দিকে ঝাঁপাচ্ছে না, তার সাধনাটা ত্যাগের সাধনা। একজন সন্ন্যাসী হয়ে গেছে, কথাটা তার কৌতূহল জাগায় এবং সে ওই সন্ন্যাসীর সঙ্গে দেখা করার আগেই, সন্ন্যাস ও ধর্ম বিষয়ে আকৃষ্ট হয়ে, নিজেকে প্রশ্ন করে, যে ব্যাপারগুলোকে আমরা ধ্রুব ধরে নিয়েছি, সেগুলোর ব্যত্যয়ে ক্ষতি কী। যেমন, আমরা জানি, মানুষ একা থাকতে চায় না, তার সঙ্গ দরকার। নায়িকা একজনকে বলে, তার মাঝেমধ্যে খারাপ লাগলেও, একা থাকতে মোটের উপর ভাল লাগে, আর কখনও নিঃসঙ্গতা খুবই উপভোগ্য। তার একটাও ফোন আর আসে না, কিন্তু তাতেও সে বিষণ্ণ নয়। সে যে স্বামীকে ছেড়ে এসেছে, তারপর তার সংসারের জন্য কোনও হানটান দেখা যায় না। অথচ সে তো প্রথমে দাম্পত্য সংসারগঠন ও সন্তানধারণকেই জীবনের মাইল-ফলক ধরে চলছিল। এবং যখন সে লাইব্রেরিতে চাকরি নেয়, সেখানেও বলে, আগের চেয়ে অনেক কম মাইনেতেই দিব্যি চলে যাবে, তখন সে আমাদের সর্বাধিক লালিত একটা বিশ্বাসকে আঘাত করে: বেশি টাকা সব সময়ে কম টাকার চেয়ে ভাল। সে তার জীবনের মধ্যে দিয়ে কোনও ঘোষণা করে না, কিন্তু খুব মৃদুভাবে এই সরু পথটা ধরে চলতে চায়, যেখানে উৎকীর্ণ আছে: তোমার যতটুকু প্রয়োজন তার বেশি চেয়ো না। তাতে শান্তির সম্ভাবনা বেশি। রবীন্দ্রনাথের ভাষা ধার করে বলা যায়, সে চিত্তকে কাঙালবৃত্তিতে দীক্ষিত করতে চায় না। কিন্তু সিনেমার প্লট সাধারণত গড়েই ওঠে নায়ক বা নায়িকার অভাব ও তা ঘোচাবার প্রাণপণ চেষ্টার ওপর নির্ভর করে। সে প্রেম চাইছে কিন্তু পাচ্ছে না, বা সাফল্য চাইছে অথচ পাচ্ছে না, বা একটা সমস্যায় পড়েছে সমাধান পাচ্ছে না। এই মেয়েটি উলটে, চাওয়া ছাড়তে-ছাড়তে, সংযত হতে-হতে, নিজেকে খুঁজে পাচ্ছে। এবং তার মনে হচ্ছে, সন্ন্যাসীর জীবন ভাল, কারণ সে একা থাকতে পারে ও এমন কিছুর জন্য নিজেকে নিবেদন করতে পারে, যা স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। বৈভবের যে-দীপ্তি ও অহংকার, তা থেকে নিজেকে ছিঁড়ে সে নিজের একটা ভেতরঘর তৈরি করে নেয়, তা তাকে চলতি সমাজ থেকে পুরোপুরি দলছুট ও বেমানান (এবং সুতরাং নিন্দা ও বিদ্রুপের পাত্রী) করে দেবে জেনেও মোটে পিছপা হয় না।
যা নায়িকাকে বিশিষ্ট করে তোলে, ছবি জুড়ে সে কোনও প্রাপ্তির দিকে ঝাঁপাচ্ছে না, তার সাধনাটা ত্যাগের সাধনা। একজন সন্ন্যাসী হয়ে গেছে, কথাটা তার কৌতূহল জাগায় এবং সে ওই সন্ন্যাসীর সঙ্গে দেখা করার আগেই, সন্ন্যাস ও ধর্ম বিষয়ে আকৃষ্ট হয়ে, নিজেকে প্রশ্ন করে, যে ব্যাপারগুলোকে আমরা ধ্রুব ধরে নিয়েছি, সেগুলোর ব্যত্যয়ে ক্ষতি কী। যেমন, আমরা জানি, মানুষ একা থাকতে চায় না, তার সঙ্গ দরকার। নায়িকা একজনকে বলে, তার মাঝেমধ্যে খারাপ লাগলেও, একা থাকতে মোটের উপর ভাল লাগে, আর কখনও নিঃসঙ্গতা খুবই উপভোগ্য।
ওই বন্ধু-সন্ন্যাসীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে মেয়েটি শোনে, ছেলেটি সন্ন্যাস ছেড়ে চলে গেছে। মেয়েটি অবাক হয়ে বলে, সন্ন্যাস ত্যাগ করা যায়, সে জানত না। মঠের প্রধান বলেন, প্রতিটি দিনই তো একটা নতুন বাছাইয়ের দিন। পরে অবশ্য মেয়েটি ছেলেটির খোঁজ পায়, সে এখন গানের ব্যান্ডের সঙ্গে আছে, তাদের অনেক গল্প হয়। ছেলেটি বলার চেষ্টা করে, কেন সে সন্ন্যাস নিয়েছিল। মেয়েটি বলে, ছেলেটিকে আগাগোড়াই তার অন্যরকম মনে হত, কারণ রাজপথ ছেলেটিকে কোনওদিনই টানত না। রাতে মেয়েটি ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করে, স্বামীর বিষয়ে তার কী কর্তব্য। ছেলেটি বলে, ‘যদি তুমি ওর কাছে ক্ষমা চাইতে না-ও পারো, ওকে ক্ষমা করে দেওয়ার চেষ্টা করো।’ মেয়েটি স্বামীর কাছে যায়, বলে, ‘আমি তোমায় ছেড়ে গেছিলাম বটে, কিন্তু আমার পরিত্যক্ত লাগত’, তারা আবার একসঙ্গে থাকতে শুরু করে। এদিকে একদিন প্রাক্তন সন্ন্যাসী ছেলেটি মেয়েটির কাছে আসে এবং মেয়েটির প্রতি তার আকর্ষণের কথা জানায়। মেয়েটি উঠে চলে যায়। পরে, গাড়িতে একটা সামান্য ধাক্কা লাগার কারণে স্বামী এমন কর্কশভাবে অন্য গাড়ির চালকের সঙ্গে কথা বলে এবং সে-কথায় এত আর্থিক দম্ভ প্রকাশ পায়, মেয়েটি স্বামীকে পুনরায় ত্যাগ করে। সে প্রাক্তন সন্ন্যাসী ছেলেটির কাছে যায় এবং বলে, সে যদি এক বছর অপেক্ষা করতে পারে, একবারও দেখা না করে এবং ফোন না করে (চিঠি লেখার অনুমতি আছে), তবে মেয়েটি বুঝবে ছেলেটির প্রেম খাঁটি এবং তখন তারা সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে। ছবি শেষ হয়। ঈশ্বর চেয়ে মেয়েটি প্রেম পায়। এবং সেই প্রেম তার ঈশ্বরচিন্তারই দোসর। আমরা আশা করি, ছেলেটি তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারবে, আত্মনিয়ন্ত্রণের পরীক্ষা দিয়ে তবে প্রেমের তোরণে প্রবেশ করবে। তারা দু’জনেই তারপর সংযত ও শমিত এক জীবন যাপন করবে, যা ফ্রিজ ও এসইউভি-র লালসা দিয়ে নির্ধারিত হয় না। এক সময়ে ছেলেটি মেয়েটিকে বলেছিল, তার সন্ন্যাস ছাড়ার প্রকৃত কারণ নিঃসঙ্গতা সহ্য করতে না পারা (আমি ভেবেছিলাম আমি এসবের ঊর্ধ্বে, কিন্তু দেখলাম আমি সকলেরই মতো)। এই কথা বলেই সে হাত বাড়িয়ে মেয়েটির হাত ধরেছিল। মেয়েটি তখন হাত ছাড়িয়ে নিয়েছিল, এখন প্রণয়-প্রতিশ্রুতি দেয়, তবে তার কথায় ইঙ্গিত থাকে, ছেলেটিকে অন্য সকলের মতো হলে চলবে না, আত্মপ্রশ্রয়ের বিপরীতে চলার ক্ষমতাসম্পন্ন হতে হবে। ছবিতে মেয়েটি প্রথমে প্রথাসিদ্ধ, পরে একটা আঘাত পেয়ে অকস্মাৎ একলা, তারপরে একটা সাধনার প্রতি অনুরক্ত এবং শেষে নিজশর্তে একটি প্রেম গ্রহণের বিন্দুতে স্থিত। তার এই বিবর্তনের মূলে আছে জীবনের কেন্দ্রে বস্তুগত অনাকাঙ্ক্ষাকে প্রতিষ্ঠা করা, বা ঈশ্বরের আসন পেতে দেওয়া। কোনও অতিরেক বা আবেগ-বিস্ফোরণ ছাড়া, মৃদু ও নম্র এক আধুনিক ছবিতে এই বিষয় প্রদক্ষিণ বেশ ধাক্কা দেয়।
এক দৃশ্যে মেয়েটি রাত্রে জোনাকি দেখতে গিয়েছিল এক জায়গায়, পরে বলে, কিছু জোনাকির আলো একসঙ্গে জ্বলছিল-নিভছিল। এই যে দুটি মানুষ চালু-জীবনকে প্রত্যাখ্যান করেছে, সেই প্রথম সমবেদনা-পত্র থেকেই যেন একটা পূর্বনির্ধারিত সেতু বেয়ে পরস্পরের কাছে এসেছে, এদের সম-স্পন্দন ও (সম্ভাব্য) মিলনেই ঈশ্বরের মহিমা কীর্তিত হয়। আমরা দেখেছি, ছেলেটি পড়ছে তলস্তয়ের ধর্মীয় লেখালিখির সংকলন আর মেয়েটি বাইবেল পড়তে-পড়তে বহু নোট নিয়েছে। আপাতভাবে যে-জীবন দরিদ্র নিঃসঙ্গ বর্ণহীন, এবং আধুনিকতার বিপরীতগামী, সে-জীবনকে শ্রেয় বলে দুজনেই বেছে নিয়েছে। আমাদের ভেবে অবাক লাগতে পারে, কিন্তু কে না জানে, প্রতিটি দিনই নতুন ও আশ্চর্য বাছাইয়ের সম্ভাবনা নিয়ে আসে!


